ধরা যাক, কৃতজ্ঞতার মতো একটি শব্দ—বিতিকিচ্ছিরি বানান; যেন শব্দ নয়, আদিম তেলাপোকা। ক-এর নিচে ঝুলে থাকা তেলাপোকার ঠ্যাং দেখে হয়তো গা রি রি করেছিল। আঙুলের ডগায় ফোলানো বেলুনের ফেটে যাওয়া কী,—তেলাপোকা আমলে আনেনি। সে জানত না—অতীত থেকে দ্রুতবেগে পালিয়ে যাওয়া স্যান্ডেলের তলা থেকেও এ রকম শব্দ হতে পারে। সাদা থুতুর সঙ্গে লেপ্টে থাকে বীভৎস বর্ণের কৃতজ্ঞতা—হাঁটুভাঙা, থ্যাঁতলানো আকার-প্রকার। গর্ভধারিণী অভিধানও প্রচলিত অভ্যাসবশত শিউরে ওঠে,—কিন্তু ঘেন্নায়।
অথচ, এ সেই জনপদ, যেখানে আগুন জন্ম নিয়ে নরম তাকিয়ে দেখেছিল—তার পিতামাতা স্থির তাকিয়ে রয়েছে তার দিকে; পিতামাতা—পাথর-পাথরী। সেই থেকে, সর্বভুক আগুনেরা পাথর পোড়ে না।
শব্দ কিংবা তেলাপোকা এসবের কিছুই জানে না। যারা সভ্যতার এই অংশটুকু জানে, ঋ-কারের ঠ্যাংটা খসিয়ে তারা হাঁটতে চেয়েছিল। হয়তো হাঁটছে তারা—বানানের মতোই—বিকলাঙ্গ এবং কিছুটা ভারমুক্ত।
কত অজ্ঞতা নিয়ে শব্দ কিংবা তেলাপোকা পায়ে পায়ে নেমে এসেছিল, সভ্য এই জনপদে; আর ভেবেছিল—তাকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য দাঁড়িয়ে রয়েছে কর্তৃকারক এবং ক্রিয়াপদাদি।
কিন্তু সকালবেলায়, শিশু রোদের চিৎকার শুনে দেখি—নিহত শব্দের লাশ পড়ে আছে বনের ভেতর। জানাজার ভঙ্গিমায় দাঁড়িয়ে প্রতিটি বৃক্ষ, ঝরে পড়ছে বাদামি অশ্রু। আমি প্রেতাত্মার মতো উপুড় হয়ে বুঝতে চাইছি—এ শব্দের ক্রিয়াশীলতা কবে থেকে লুপ্ত হয়েছিল। এরপর লাশটাকে আলতোভাবে তুলে নিলাম, ঘাসের ওপর থেকে রক্তাক্ত শিউলিকে যেভাবে এখনো তোলা হয়।
কিন্তু কোথায় রাখব আমি তাকে? একবার ভাবি—যেই পাতার আড়াল থেকে সে বিপজ্জনকভাবে নেমে এসেছিল, সেখানে শুইয়ে রাখি। এও ভাবলাম—অভিধানের ওই অংশটুকু তেলাপোকার আইকা-আঠা দিয়ে সেঁটে দেব, যাতে টুপ করে আবার খসে না পড়ে দৌড়-প্রতিযোগিতার রাস্তার ধুলোয়।
হঠাৎ প্রাচীন এক জাদুকর এসে নিহত শব্দের লাশ কেড়ে নিয়ে গেছে। শব্দটা এখন মৃত তেলাপোকার মতো স্তব্ধ হয়ে আছে,—জাদুঘরে। অবিরাম সিঁড়ি বেয়ে উঠতে উঠতে একদিন ক্লান্ত মানুষের মনে হবে— আহা, তেলাপোকার ঠ্যাংগুলো থাকলে আজ মন্দ হতো না।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, জুলাই ০১, ২০১১
Leave a Reply