আমি যখন আমার ভেতরে চোখ রাখি, সমুদ্র দেখি—গর্জনশীল, ঢেউবহুল। তীরলগ্ন জল-কাদা মেশানো, দূরের জল নীল। জলের ওপরে ছোট-বড় ঢেউ, ঢেউয়ের মাথা ভাঙা। ঝড়ের তোড়ে মাথাভাঙা ঢেউগুলো দক্ষিণ থেকে উত্তরে ধাবমান। অজগরের মতো ওলট-পালট খাওয়া ঢেউ। হাঁ হাঁ করা ঢেউগুলো জেলেনৌকাগুলোর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ছে। নৌকার আগাকে ঢেউয়ের দিকে সোজা করে রেখে শক্ত মুঠিতে হাল ধরে পাছায় বসা পূর্ণচন্দ্র, রামনারায়ণ, উপেন্দ্ররা। মুখে তাদের ‘আঃ বদরসাহেব, আঃ বারো আউলিয়া, আঃ মা কালী, আমাদের রক্ষা করো। এই ঝড় থেকে বাঁচলে, মা গঙ্গা, তোমারে পূজা দেব।’ এই সব দৃশ্য আমার চোখের সামনে দিয়ে চলচ্চিত্রের মতো একের পর এক ভেসে যায়। জীবনের ত্রিশটি বছর আমিও পূর্ণচন্দ্র, রামনারায়ণদের সহযোদ্ধা ছিলাম। আমার সমুদ্র মানে বঙ্গোপসাগর। আমি আরব সাগর দেখিনি, প্রশান্ত বা আটলান্টিক মহাসাগর আমার ধরাছোঁয়ার বাইরে। ভারত মহাসাগর বা লোহিত সাগরের গল্প শুনেছি শুধু। যার জলে আমি অবগাহন করেছি বা যার জলশস্যে আমার চৌদ্দ পুরুষ পালিত হয়েছে, সে বঙ্গোপসাগর। মানুষের শরীরের নাকি এক-তৃতীয়াংশ জল। তা যদি সত্যি হয়, তাহলে আমার শরীরের সমস্ত জলই বঙ্গোপসাগরের। আমার বেড়ে ওঠা, আমার জীবনযাপন জুড়ে আছে বঙ্গোপসাগর। আমার আনন্দ আর বেদনার সঙ্গে জড়িয়ে আছে এই বঙ্গোপসাগর। আজ থেকে আশি বছর আগে এই বঙ্গোপসাগরই আমার দাদুকে কেড়ে নিয়েছিল। সমুদ্রের অতল নীল জলকে বড় ভালোবাসতেন চন্দ্রমণি। নীলজলের ঢেউ তাঁর ভেতরে মাথা কুরে মরত। ওই জলের টানে চন্দ্রমণি, মানে আমার দাদু, স্থায়ী সুইপারের চাকরি ছেড়ে ঠুনকো কাঠের নৌকা বঙ্গোপসাগরে ভাসিয়েছিলেন। আশ্বিনের ঝড়ো বঙ্গোপসাগর ওই নৌকা খেয়েছে, চন্দ্রমণিকে খেয়েছে, চন্দ্রমণির আটজন সঙ্গীকে খেয়েছে। বাপের অপমৃত্যুতে ভড়কে যাননি চন্দ্রমণির ছেলে যুধিষ্ঠির। তরুণ যুধিষ্ঠিরও একগাছি নৌকার পাছায় শক্ত মুঠিতে হাল ধরে বসেছেন। লইট্যা মাছ, ঘোঁওড়া মাছ, রিশ্শা মাছ, করকইজ্যা ইচা, অলুয়া মাছ আর ইলিশ মাছে ভর্তি করে নৌকা কূলে ভিড়িয়েছেন। আমি, চন্দ্রমণির তৃতীয় পুরুষ, বঙ্গোপসাগরে নৌকা না ভাসিয়ে পারিনি। পরিবার-পরিজন এবং নিজেকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য আমিও কালবৈশাখীকে মাথায় নিয়ে, আষাঢ়-শ্রাবণের ঝড়-জলকে উপেক্ষা করে কখনো বাবার সঙ্গে, কখনো বা গাউর-কামলাদের সঙ্গে মাছ মারতে গেছি বঙ্গোপসাগরে। ঢেউয়ের বাড়ি আর জলের তোড় আমাদের প্রতিপক্ষ হয়েছে বারবার। ঝড়-জলের আঘাতে নৌকার গুঁড়ি ভেঙেছে, পাল ছিঁড়েছে, দাঁড় ভেসে গেছে। কিন্তু আমরা হার মানিনি। জানি, হার মানলে মৃত্যু অবধারিত, হার মানলে উনুনে আগুন জ্বলবে না। মা-বাবা-পরিজন না খেয়ে মরবে। এ জন্য আমরা আঘাতের বদলে প্রত্যাঘাত দিতে শিখেছি। তাই নৌকাকে ঢেউ-ঝড়ের প্রতিকূলে ঠেলে সমুদ্রে পাতানো জালের কাছে নিয়ে গেছি। জলশস্য নৌকায় তুলে বিজয়ীর বেশে বাড়ি ফিরেছি।
আমার দেখা সমুদ্র শরৎচন্দ্রের দেখা সমুদ্রের মতো নয়। তিনি শ্রীকান্ত-এ ঝড়ো সমুদ্রের যে বর্ণনা দিয়েছেন, তা দূর থেকে দেখা। মানে জাহাজের ডেক থেকে দেখা। জলতল থেকে জাহাজের পাটাতনের উচ্চতা কম হলেও ত্রিশ ফুট। নিরাপদ দূরত্বই বলা চলে। কিন্তু আমি যে নৌকায় সমুদ্রে যেতাম, জলের উপরতল থেকে সে নৌকার পাটাতনের উচ্চতা তিন ফুট। ওই তিন ফুট উচ্চতার নৌকা নিয়েই আমরা তুফানের সময় ঝঞ্ঝামগ্ন বঙ্গোপসাগরের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হতাম। প্রথম প্রথম ঝড়ে পড়ে ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে উঠলেও পরে অনেকটা গা-সওয়া হয়ে গিয়েছিল ওই ঝড়ো সমুদ্র। শুনেছি, জীবন ঘষে ঘষে নাকি আগুন জ্বালানো যায়। এই ত্রিশ বছরের সমুদ্রজীবনে আমার জীবন বাজি রেখে যে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছিলাম, তার একেবারেই জলাঞ্জলি হয়নি। যখন আমি লিখতে বসলাম, ওই ঝড়-জলের অভিজ্ঞতা, ওই মাছ মারার অভিজ্ঞতা, ওই রুক্ষ-রুদ্র-ভয়ংকর সমুদ্র দর্শনের অভিজ্ঞতা কাজে লাগল। দহনকাল-এ সমুদ্রের ভয়াল রূপের বর্ণনা দিতে গিয়ে ওই জীবনঘষা অভিজ্ঞতার কথা কাহিনির মোড়কে উপস্থাপন করেছি। দহনকাল থেকে সামান্য উদ্ধৃতি দেওয়া যেতে পারে, ‘তখন নৌকার চারদিকে বড় বড় ঢেউয়ের তাণ্ডব। পর্বতসমান ঢেউ নৌকার সামনে এসে দাঁড়াচ্ছে আর শক্ত কুশলী হাতে আগাটি সেই ঢেউয়ের মাথায় চড়িয়ে দিচ্ছে ঈশান। আক্রোশে ফুঁসতে ফুঁসতে সেই ঢেউ নৌকাকে ঝাপটা দিয়ে পেছনে গলে যাচ্ছে। করাল হাঁ ব্যাদান করে বাতাস এগিয়ে আসছে হু হু করে। ঘন কালো মেঘ নেমে এসেছে অনেক নিচে। মেঘে মেঘে ঘর্ষণে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। কাছে-দূরে বজ্রপাত হচ্ছে। যেন মহাদেব মহাপ্রলয়ে নেমে রুদ্ররোষে হুংকার দিচ্ছেন।…ঢেউয়ের সঙ্গে ঢেউয়ের বাড়ি লেগে জলতল ফেনাময়। জলকণাগুলো ঘন আস্তরণ সৃষ্টি করেছে গোটা সমুদ্রজুড়ে। বাতাস, ঢেউ, জলকণা, মেঘের গর্জন, বৃষ্টির ছাঁট মিলেমিশে এক ভয়জাগানিয়া পরিবেশ তৈরি হল সমুদ্রবুকে।’
সমুদ্র শুধু আমাকে রুদ্র-ভয়ংকরের অভিজ্ঞতা দেয়নি, ধবল জ্যোৎস্না আর অতল নীল জল দেখার সুযোগও করে দিয়েছে। শীতকালে বঙ্গোপসাগর হয়ে যায় সৌম্য ঋষির মতো। ঢেউ নেই, কল্লোল নেই। তীর ছুঁইছুঁই তখন তার নীল জল। তীর ধরে ধরে নীল জলের ছলাৎছলাৎ পায়ে মৃদু অগ্রগমন। দিগন্তজুড়ে বালিয়াড়ি। জলের ধার ঘেঁষে অগণন লাল কাঁকড়ার এধার-ওধার দৌড়াদৌড়ি। কাঁকড়ার দুটো শুঁড়ে যেন মৃদু আলোর দুটো বাল্ব। কাছে গেলেই ফুরুৎ ফুরুৎ গর্তে ঢুকে পড়া। ইচ্ছে হলো তো দল বেঁধে নীল জলে অবগাহন। শীতের সময় মাছ মারতে যাওয়ার আলাদা একটা আনন্দ আছে। আষাঢ় থেকে কার্তিক পর্যন্ত বঙ্গোপসাগর যেন মাছমারাদের প্রবল প্রতিপক্ষ। কোনোক্রমেই এই সময়ে সমুদ্রকে বাগে আনা যায় না। শুধু ভাঙে পালের মাস্তুল, নৌকার আগা, হালের দাঁড়। শুধু কেড়ে নেয় জাল, নৌকা, জীবন। হরবাঁশির বাপ, জয়ন্তের মেয়ের জামাই, মধুরাম, মঙ্গলচরণ—এঁদের জীবন কেড়ে নিয়েও সন্তুষ্ট হয় না সমুদ্র, আরও গ্রাস করার জন্য ফুঁসতে থাকে। অগ্রহায়ণ এলেই তার সব ফাঁসফোঁসানির অবসান ঘটে। বুকভরা নীল জল নিয়ে উত্তর থেকে দক্ষিণে আর দক্ষিণ থেকে উত্তরে চলতে থাকা শুধু। ওই নীল জলের তলায় তখন প্রচুর মাছ—চিক্কা ইচা, লইট্যা মাছ, ছুরি মাছ, রূপচাঁদা, আর চেঁউয়া মাছ। কূল আঁধার করা দূরত্বে তখন জেলেরা তাদের বিহিন্দি জাল পাতে। সারি সারি। নানা বহদ্দার আর পাউন্যা নাইয়া ওই সারি সারি জালে ঘাইয়ে থাকে। গভীর রাতে মাছ তোলার সময় হয়। ওই সময় কূল থেকে দাঁড় বেয়ে এসে নিজের জালের হদিস পাওয়া সম্ভব নয়। তাই জেলেরা জালে লম্বা রশি বেঁধে পুরো জোয়ারের সময়টা জাললগ্ন হয়ে থাকে। একে বলে ঘাইয়ে থাকা। ওই ঘাইয়ে থাকাকালে অগ্রহায়ণের ধবল জ্যোৎস্নার সঙ্গে আমার দেখা। ফকফকা জ্যোৎস্নাও যে মানুষকে ঘোরে ফেলে দেয়, তা আমি বুঝেছি ওই সময়। শনশন করে নৌকার দুই পাশ দিয়ে জল ধাবমান। জলতল নখের পিঠের মতো সমতল। দু-চারটা অচেনা মাছ জলের ওপর একটু করে লাফিয়ে উঠে জলে ডুবে যাচ্ছে। নৌকার কাঁইকের ওপর সঙ্গের চারজন বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। আমি জেগে আছি। নৌকার পাছার দিকের ছোট্ট খোপে শরীরটা আটকে দিয়ে বিপুল জ্যোৎস্নার দিকে তাকিয়ে আছি। দক্ষিণ দিকের আকাশ ঘেঁষে পূর্ণ চাঁদ। পূর্ণিমাই হবে সে রাতে। না হলে এত জ্যোৎস্নায় আকাশ-সমুদ্র ভেসে যাবে কেন? রুপালি চাঁদের পাগল করা আলো নীল জলের রংটাই পাল্টে দিয়েছে। আমি একবার জল দেখি, আরেকবার চাঁদ। আমি হাত বাড়িয়ে জ্যোৎস্নামাখা জল ছুঁই, আর জ্যোৎস্না ছুঁয়ে থাকে আমাকে। আমার মুখ দিয়ে আমারই অজান্তে সেই সময় কোনো একটা আওয়াজ বেরিয়ে এসেছিল। না হলে কেন যুধিষ্ঠির আথালিপাথালি বিছানা ছেড়ে উঠে বসে আমাকে বলেছিলেন, ‘কী অইয়ে, অ বাছা কী অইয়ে?’ আমি একটু লজ্জা পেয়ে বলেছিলাম, ‘কিছু না বাবা।’ ‘নিচ্চয় কিছু বাছা, ভয় পাইও না? এই সময় সাগরে কত কিছু হাঁডি বেড়ায়।’ বাবা বলেছিলেন। আমি জবাব দিইনি। বাবা আবার ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। তখন আমি এমএ পাস দিয়ে ফেলেছি। অধ্যাপনাও করছি সরকারি সিটি কলেজে। সাত শ পঞ্চাশ টাকা বেতন। ওই টাকা দিয়ে এগারো জনের হাঁ বন্ধ করা যায় না। ভাইয়েরা ছোট ছোট। দু-চারজন স্কুলে পড়ছে। পরিজনের দুমুঠো অন্ন জোগাড় করার জন্য তাই আমার জ্যোৎস্নারাতে বা বজ্রনিনাদিত ঝড়ো রজনীতে মাছ মারার অভিযান।
খুব ছোটবেলা থেকে বঙ্গোপসাগরকে ভালোবাসতে শিখেছি আমি। বঙ্গোপসাগর আমাদের পরিবারের স্বস্তি কেড়ে নিয়েছে, শান্তি কেড়ে নিয়েছে, বারবার। বেঁচে থাকার প্রধান উপকরণ নৌকা আর বিহিন্দি জালও গ্রাস করতে কখনো দ্বিধা করেনি। তার পরও কেন জানি সমুদ্রকেই ভালোবেসেছি। সমুদ্র আমাকে অস্তিত্ব, আমার বিকাশ-বিস্তারের উর্বর ক্ষেত্র। কবি কামাল চৌধুরীর কবিতায় আমার, জেলে সমাজের প্রকৃত নৃতত্ত্ব উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছে যেন—
‘আমাদের গায়ে লেগে আছে অনার্য রোদ্দুর
পুরোনো পাথরের স্তূপ দেখে আমরা শনাক্ত করতে পারি প্রার্থনার গৃহ
অথচ অসংখ্য নদী, সমুদ্র সমতল, আমাদের মাছ-ভাতের ঐতিহ্য
সবটাই ধীবরকালের নৃতত্ত্ব।’
এই ভালোবাসাবাসি থেকেই সমুদ্রতত্ত্ব নিয়ে পড়াশোনা করার প্রবল আগ্রহ জন্মে আমার ভেতরে। আইএ পাস করার পর জানলাম, চট্টগ্রাম কলেজে বা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে সমুদ্রতত্ত্ব নিয়ে পড়াশোনা করার কোনো সুযোগ নেই; আছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। কিন্তু যুধিষ্ঠির জলদাসের বড় ছেলেকে ঢাকায় পড়তে পাঠানোর মতো সামর্থ্য নেই। সমুদ্রের ওপর পড়তে না পারার বেদনাকে মনে লুকিয়ে রেখে এখনো সুযোগ পেলে আমি পতেঙ্গার সমুদ্রচরে গিয়ে বসি। জেলেপাড়ার মানুষেরা আমাকে ঘিরে বেড়ে বসে। থাকে তরুণেরা, থাকে সমুদ্রে স্বামী হারানো বিধবারা, আর থাকেন বয়োবৃদ্ধরা। আমি যে অধ্যাপনা করি, অধিকাংশই তা জানে না। কোনো একটা স্কুলে-টিস্কুলে পড়াই—ওইটুকুই তারা জানে এবং মানে। আমাকে তারা সম্বোধন করে ‘মাস্টার’ বলে। ওই ডাকেই আমি সাড়া দিই। তাদের আবাল্য দেখা হরিশংকর কত বড় অধ্যাপক হয়েছে বা অন্য কিছু, তাতে তাদের কোনো আগ্রহ নেই। তাদের আনন্দ হরিশংকর এখনো তাদের ভোলেনি। ওদের নিয়ে সমুদ্রপাড়ে গিয়ে বসি। বয়োবৃদ্ধরা তাঁদের সমুদ্রাভিযানের গল্প শোনান, বিধবারা তাদের স্বামী হারানোর বেদনার কথা আমার সামনে খুলেমেলে ধরে। বলে, ‘ওই হারামি দইন্যা, ওই নিষ্ঠুর মা গঙ্গা আমার সোয়ামিরে কাইড়া লইছে। যৌবন থাকতে আমারে বিধবা বানাইছে। আমাদের নৌকা ছিল, জাল ছিল। ওই লক্ষ্মীছাড়া সমুদ্র আমার স্বামী, নৌকা, হাল-জাল সব গেরাস করছে। আজ আমি মাইডারে লইয়া পাড়ায় পাড়ায় মাছ বেইচ্যা বেড়াই। হা ভগমান, আমার কপালে এ-ও লিখি রাখছিলা!’ বাতাস ভারী হয়ে ওঠে। বিধবাটির হাহাকার সমুদ্রকল্লোলকে বিষণ্নতায় ভরিয়ে তোলে। পরিবেশকে হালকা করার জন্য আমি প্রসঙ্গান্তরে যাই। আমি তাদের তাকাষি শিবশঙ্কর পিল্লাইয়ের চেম্মীন উপন্যাসের কাহিনি শোনাই। বলি, কী অসাধারণ দক্ষতায় তামিলনাড়ুর সমুদ্র-নির্ভর এক জেলেপল্লির জীবনচিত্র শিবশঙ্কর তাঁর উপন্যাসে এঁকেছেন। তারা অবাক হয়ে তামিলনাড়ুর মাছমারাদের সমুদ্রযুদ্ধের কথা শোনে, পালা-পার্বণের কথা শোনে। বলে, ‘কী আচার্য, ওদের সঙ্গে আমাদের এত মিল কী করে হলো?’ ওরা বিস্ময়ে আবিষ্ট হয়, যখন শোনে, শ্রীলঙ্কার কিংবদন্তি ক্রিকেটার জয়সুরিয়া সমুদ্রসন্তান, শ্রীলঙ্কারই এক ধীবরপল্লিতে তাঁর জন্ম।
আমি ধীরে ধীরে কাহিনি ঘোরাই তামিলনাড়ু থেকে কিউবার হাভানার দিকে। জয়সুরিয়াকে ছাড়িয়ে আমি হেমিংওয়ের ‘ওল্ডম্যান অ্যান্ড দি সি’ উপন্যাসের সান্তিয়াগোর গল্প পাড়ি তাদের সামনে। হাভানার উপসাগরে সান্তিয়াগো চুরাশি দিন বড়শি ফেলে একটি মাছও পায় না শুনে তারা হাসাহাসি করে। বলে, ‘সমুদ্রে মাছ ছিল না? বড়শিতে আধার ছিল না? সত্যি জলে ফেলেছিল তো বড়শিটি?’
বঙ্গোপসাগর আমাদের অনেক ব্যথার সাক্ষী। বঙ্গোপসাগরের একেবারে কোল ঘেঁষেই উত্তর পতেঙ্গার জেলেপল্লিটি। পূর্ণিমা-অমাবস্যার জোয়ারে জেলেপাড়াটি সাগরজলে গোসল করে। সমুদ্রের শোঁ শোঁ বাতাস জেলেপাড়ার শিমুলগাছ আর নারকেলগাছের মাথা এলোমেলো করতে থাকে। বঙ্গোপসাগরের গর্জন শুনতে শুনতেই আমার বেড়ে ওঠা। আমাদের রাতে ঘুমোতে যাওয়া। সমুদ্র আর জেলেপাড়ার মাঝখানে কোনো আড়াল নেই। আমরা মাছ মারতে সমুদ্রে যাই, আনন্দে সমুদ্রপাড়ে যাই, বেদনা বোঝাতে যাই সমুদ্রের কাছে। কিন্তু ১৯৭১ সালে সমুদ্র আর আমাদের সখ্যের মাঝখানে এসে দাঁড়াল পাকিস্তানি হানাদাররা। সমুদ্র আর জেলেপাড়ার মাঝখানের ভূমিটি দখল করে আস্তানা গাড়ল তারা। তারা মাছ ধরা নিষিদ্ধ করল। সমুদ্রপাড়ে যাওয়া বন্ধ করে দিল। সমুদ্র-বিচ্ছিন্ন হয়ে জেলেরা হাহাকার করে উঠল। মাছ মারতে না পেরে জলবিযুক্ত মাছের মতন খাবি খেতে লাগল। জেলেদের জলবিচ্ছিন্ন করে ক্ষান্ত হলো না হায়েনারা। তাদের দেহসুখ মেটানোর জন্য বেছে নিল আমাদের জেলেপল্লিটিকে। এরা সন্ধ্যায় আসে, রাতে আসে, পূর্বাহ্নে আসে, অপরাহ্নে আসে। ঘিরে ফেলে এক-একদিন এক-একটি বাড়ি। শরীরের চাহিদা মিটিয়ে এরা ফিরে যায়। চাপা আর্তনাদে ধর্ষিতা নারীরা চূর্ণ-বিচূর্ণ হতে থাকে। জেলে পুরুষেরা সমুদ্রের দিকে ফিরে চিৎকার করে ওঠে, ‘হা মা গঙ্গা, অ বঙ্গসাগর, তুমি তোমার জল দিয়ে এই জেলেপাড়াটি ভাসিয়ে নিয়ে যাও। তোমার পবিত্র জলে আমাদের ধর্ষিতা নারীদের অপবিত্রতাকে শুচিময় করে তুলো।’ যে বিকেলে কৃষ্ণবন্ধুর চৌদ্দ বছরের বোনটিকে হানাদাররা ধর্ষণ করে, সে বিকেলেই কৃষ্ণবন্ধু আত্মাহুতি দিতে বঙ্গোপসাগরে যায়। কিন্তু বেড়িবাঁধের পাঞ্জাবি সেনারা তাকে আটক করে, সমুদ্রজল পর্যন্ত পৌঁছাতে দেয় না। দুই দিন পর প্রচণ্ড অত্যাচার শেষে মৃতপ্রায় কৃষ্ণবন্ধুকে বেড়িবাঁধ থেকে নিচে ছুড়ে ফেলে দেয়। কৃষ্ণবন্ধু এখনো হানাদারদের নির্যাতনের চিহ্ন গায়ে বহন করে বেঁচে আছে। কোমরভাঙা কৃষ্ণবন্ধু এখনো হুরিজাল কাঁধে নিয়ে সাগরে নামে। উত্তর পতেঙ্গার জেলেপাড়া থেকে বিচ্ছিন্ন কেউ নই আমি। ওদের জীবনকথা আমার জীবনকাহিনির সঙ্গে একাকার হয়ে আছে এখনো। এখনো সময় করে আমি সাগরপাড়ে গিয়ে বসি। তাদের জীবনগাথা শুনি।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, জুলাই ০১, ২০১১
Leave a Reply