কম্পোজিশন উইথ ব্লু অবচেতনের নীল
কম্পোজিশন উইথ ব্লু আমি এঁকেছি অসুখের পর। বছর দুয়েক আগে আমি হঠাৎ হূদরোগে আক্রান্ত হই। অচেতন হয়ে পড়ে থাকি শয্যায়। চিকিৎসার পর আমার চেতনা ফিরে আসে। অচেতন অবস্থা থেকে চেতন অবস্থায় ফেরার মুহূর্তে আমি যেন নীল আলো দেখতে পেয়েছিলাম। এর আগে নীলকে কখনো আমার এত শক্তিশালী মনে হয়নি। যেন নীল আলো দেখতে দেখতে বেঁচে উঠেছি, জীবনে ফিরে এসেছি। নীল আমাকে শান্তি দিয়েছে।
এ ছবিতে নীল রঙের ব্যবহারটাই বিশেষভাবে দেখার বিষয়। আমার মনে হয়, নীলের কারণেই এতে একটা প্রশান্তির ভাব ফুটে উঠেছে। প্রশান্তির সঙ্গে কোমলতার সম্পর্ক আছে, স্বচ্ছতারও। নীল জল অনেক দেখেছি। ওই তরল নীল আমাকে ভীষণভাবে ভাবিয়েছে। ওই নীলটা কেমন যেন নরম ও মধুর স্পর্শ দেয়। এ রঙের প্রতি আমার বিশেষ আকর্ষণটা যে জল থেকেই এসেছে, আমি ধীরে ধীরে সেটা বুঝতে পারি। তাই নীলকে আমি সুরেলা করি, যেন জলের শব্দ শুনছি, শুনছি রঙিন ধ্বনি। পরে আরো উপলব্ধি করেছি, প্রকৃতি ও মানুষ উভয়ের জীবনের সঙ্গেই পানির সম্পর্ক অনন্য। পানিই যেন আলোড়িত করে রেখেছে জীবন।
নীল তো শুধু চোখের দেখার মধ্যে সীমিত নয়। সীমা ছেড়ে অসীমের দিকে তা টেনে নিয়ে যায়। নীল আমাকে দেখার বাইরের জগৎটা দেখাতে সাহায্য করে। হয়তো আমি বিস্তারকে বোঝাতে চেষ্টা করেছি। বিস্তার আমার ভালো লাগে। মানুষের মন ধরা পড়ে ছবির আয়তনগত ব্যাপারটার মধ্যে। এ ছবিটা আনুভূমিক। আনুভূমিক ছবি আমি খুব বেশি আঁকিনি। কিন্তু আনুভূমিক বলেই যে বিস্তারটা ধরা পড়েছে, তা নয়। এর আসল রহস্য রঙের মধ্যে। মাধ্যমের সীমাবদ্ধতা কিন্তু মাধ্যমের শক্তিও। রঙ দিয়েই আমি স্তব্ধতা বা নীরবতা বোঝাতে চেয়েছি, একই সঙ্গে বোঝাতে চেয়েছি ধ্বনিময়তাও। এই স্তব্ধতা বা নীরবতা যে আনুভূমিক হিসেবে বোঝা যায় তা আমি পিকটোরিয়াল এলিমেন্টের মাধ্যমে বোঝাতে চেয়েছি। একটা ইশারা রেখেছি ছবিটার বাঁয়ে। একটুখানি রেখা, তা আনুভূমিকতার ইশারা দিচ্ছে। আর ওই যে টেক্সচার, নানা জায়গায় কুচিকুচি কাটাকুটি, তা শব্দময় অবস্থা বোঝানোর জন্য।
দৃষ্টির মধ্যের এবং দৃষ্টির বাইরের জগতের সম্পর্কটাই তো ছবি। আর এই যাতায়াতে যে আনন্দ তাই তো শিল্পীরা আঁকে। এ ছবিতে সেই আনন্দটা আছে। শব্দ, রঙ, রেখার বিভিন্ন ইঙ্গিতে সেই দৃশ্যের অতীত জগতের কথা বলতে চেয়েছি।
২০০২
মাটির মমতা
অনেক শিল্পীর কাজই আমার বেশ ভালো লাগে। অনেকেই আমার প্রিয় শিল্পী। তবে আমাকে বিশেষভাবে আকর্ষণ করে আন্তোনি তাপিয়েসের কাজ। তাপিয়েসের কাজ আমি প্রথম দেখি জাপানে। সেটা ১৯৬১ সাল। একটা গ্রুপ প্রদর্শনীতে তাঁর বেশ কিছু কাজ ছিল। কাজটি খুব সম্ভবত পঞ্চাশের দশকের। আমাকে আলোড়িত করে তাঁর উপাদান ব্যবহারের দিকটা, তাঁর মাটির রূপটা ফুটিয়ে তোলার শৈল্পিক দিকটা। তিনি বিশেষ কায়দায় রঙ ব্যবহার করেন। এতে মাটির রঙ ও স্বভাব ফুটে ওঠে। কতগুলো অপ্রথাগত রেখা টানেন, তাতে পরিসর তৈরি হয়। ওই পরিসর ও বর্ণের সতেজ গুণটা এ ছবিটাতেও আছে। দেখলেই বোঝা যায়, একটা ডিম্বাকার গোল গড়নের আশপাশে আরো অনেক আঁকিবুঁকি মাটিকে বোঝাতে চাইছে। এ মাটি তাঁর জন্মভূমি কাতালানের।
স্পেনের কাতালান প্রদেশের মানুষের জীবনযাপন তাঁকে প্রেরণা দিয়েছে। ওখানে পাহাড়ি চাষীরা আছেন। তাঁদের জীবন মাটির সঙ্গে ওতপ্রোত। চাষীদের জীবনে একটা কঠিন শ্রমের ব্যাপার আছে। ওই কষ্টকর জীবনের রূপ মাটিতে ফোটাতে গিয়ে তাপিয়েজ কখনো চাষীদের প্রাত্যহিক প্রয়োজনের জিনিস দিয়ে তার ভারী বর্ণতলে ছাপ দিয়েছেন। মাটিতে শ্রমের প্রতিক্রিয়া, মাটির মমতা—দুই-ই শিল্পী তুলে ধরতে চেয়েছেন। আর কালচে বাদামি মাটির ভেতর থেকে উঁকি দিচ্ছে হলুদ সতেজ মাটি। এও এক শৈল্পিক পরিচর্যার চিহ্ন। তাপিয়েসকে প্রাচ্যের ক্যালিগ্রাফি ও দর্শন বেশ টানে বলে জ্যামিতি-উত্তীর্ণ একটা মায়া আছে তাঁর কাজে। এ জন্য ট্রিটমেন্টেও তিনি অনেক বেশি স্বতঃস্ফূর্ত। সারল্য পছন্দ করেন। টেক্সচার আর মুক্ত রেখা দিয়েই মনের অনেক স্পর্শকাতর অবস্থা তুলে ধরেন।
তবে মাটির রূপ ফুটে উঠলেও এই কাজটিতে একটা আভিজাত্য আছে। বৃহৎকে দেখার ব্যাপার আছে। নিবিড় ও গহন পরিস্থিতি শিল্পী তৈরি করতে পেরেছেন। একটা স্পর্শকাতরতাও আছে ছবিটাতে। নরম অথচ সহিষ্ণু মাটিকে তিনি দেখাতে পেরেছেন। কোথাও দাগ কেটে, কোথাও কোনো কিছুর ছাপ দিয়ে, কোথাও বা জ্যামিতিক গড়ন অনুসরণ করে, কোথাও আবার জ্যামিতি ছেড়ে খেয়ালি ভাবনায় রেখা টেনে এক নিজস্ব বর্ণমালায় এই ছবি ও ছবির পরিসরটা শিল্পী তৈরি করেছেন।
২০০৩
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, জুন ১০, ২০১১
Leave a Reply