[মোহাম্মদ কিবরিয়া – জন্ম: ১ জানুয়ারি ১৯২৯, মৃত্যু: ৭ জুন ২০১১]
দেখা হলেই কিছু কুশল জিজ্ঞাসা, কিছু শিক্ষকসুলভ পরামর্শ। তারপর ধীরে ধীরে শিল্পকলা থেকে শুরু করে হরেক গল্পের ঝাঁপি খুলে এগিয়ে যাওয়া আসরি ঢঙে। কিছুদিন আগে তেমন করেই বললেন, ‘কেমন আছো? উড-কাট করছ না? যত দিন ভালো লাগবে করে যাও। ছেড়ে দিয়ো না।’
তারপর আমার জিজ্ঞেস করার পালা। বলেছিলাম, ‘স্যার, কেমন আছেন।’ জানতাম ইদানীং প্রায়ই অসুস্থ থাকেন। সেদিন বেশ সুস্থ ঝরঝরে মনে হয়েছিল। তিনি বলেছিলেন, ‘আছি। এখন কয়েক দিন তো ভালোই। তোমার শ্যালক ডাক্তার জাকিউরকে বলো আমার কথা। ওর অক্সিজেন সিলিন্ডার আর নেবুলাইজার ব্যবস্থার জন্য ধন্যবাদ জানিয়ে দিয়ো, আসতে বোলো।’
তাঁর টেলিফোন পেলেই বুঝতাম, তিনি গল্প করতে ডাকবেন। বলতেন, সময় পেলে যেন যাই। যাব যাব করেও হয়ে উঠত না। আজ যাব কাল যাব করে কেনই যেন যাওয়া হয়ে ওঠেনি বেশ কিছুকাল। কিন্তু তিনি যে চলে যাবেন এত তাড়াতাড়ি, সে কথা মনে আসেনি। অসুস্থ থাকেন জানতাম। কিন্তু সেই অসুস্থতা যে তাঁকে বাধ্য করবে অচিরেই চলে যেতে, এমনটা ভাবনায় আসেনি। তো সেই তিনি চলেই গেলেন।
চলে গেলেন শিল্পকলা জগতের এক যুগস্রষ্টা মহান শিল্পী, আমাদের ছবি আঁকিয়ে শিল্পীদের পথিকৃৎ, পথনির্দেশক পরম শ্রদ্ধেয় শিক্ষাগুরু মোহাম্মদ কিবরিয়া। শূন্য করে রেখে গেলেন তাঁর একান্ত নিজস্ব অপূর্ব সুষমামণ্ডিত চিত্রধারার অঙ্গনটি। বহুকাল রোগ-ভোগে পরিশ্রান্ত চিরকালের নিভৃতচারী, বিনম্র-স্বল্পভাষী, বিনয়ী এই বিশাল মাপের মানুষটি বিদায় নিলেন—বলতে গেলে প্রায় নিভৃতেই।
‘নিভৃত’ কথাটি বলার একটি কারণ রয়েছে। সেটি উল্লেখ করার প্রয়োজনীয়তা বোধ করছি কিছুটা অবান্তর বা প্রসঙ্গান্তর মনে হলেও। প্রচারবিমুখ অথচ চিত্রকলার ক্ষেত্রে অত্যন্ত নামীদামি এবং জনপ্রিয় শিল্পী কিবরিয়াকে নিয়ে আমরা গর্বিত হই। বিশ্বজুড়ে যাঁর খ্যাতি, যিনি দেশের জন্য শিল্পকলার ক্ষেত্রে অঢেল সুনাম বয়ে এনেছেন। দেশকে পরিচিত করেছেন বিশ্বের বিশাল শিল্পকলা জগতে, চিকিৎসাধীন তাঁকে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে শীর্ষস্থানীয় কেউ হাসপাতালে শ্রদ্ধা নিবেদনে যাওয়ার কথা স্মরণে রাখেননি। অথচ তিনি রাষ্ট্রীয় পুরস্কারে ভূষিত দেশের সেরা ব্যক্তিদের একজন। স্বাধীনতা পদক, একুশে পদকপ্রাপ্ত শিল্পী। শিক্ষক হিসেবেও তাঁর প্রাপ্তি অনেক। দেশব্যাপী অসংখ্য শিল্পী তাঁর ছাত্র। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি ‘প্রফেসর ইমেরিটাস’। দেশ-বিদেশে তাঁর পরিচিতি অপরিসীম।
এত সবকিছুর পরও তাঁকে জীবনের শেষ সময়টিতে উঁচু জায়গার কারও দেখতে না যাওয়ার আমাদের অতৃপ্তি রয়ে গেল।
যা-ই হোক, এই মহান শিল্পী কিবরিয়া স্যারের সঙ্গে আমার পরিচয় ১৯৬১ সালে। তখন ঢাকার আর্ট কলেজে আমি দ্বিতীয় বর্ষে পাঠ শেষ করছি প্রায়। তিনি জাপান থেকে চিত্রকলায় উচ্চতর লেখাপড়া শেষ করে সদ্য ফিরেছেন। ১৯৫৯-এ ভর্তির পর তাঁকে শিক্ষক হিসেবে না পেলেও তিনি যে দেশের খ্যাতিমান এবং শ্রেষ্ঠতম শিল্পীদের একজন, কলেজের সব ছাত্রছাত্রী, শিক্ষক এবং শিল্পীদের অত্যন্ত প্রিয় মানুষ, তা জানা হয়ে গিয়েছিল। সবার মুখে-মুখে ব্যক্তি কিবরিয়া, শিক্ষক কিবরিয়া, শিল্পী কিবরিয়া—এই তিন মর্যাদায় সমান প্রশংসা উচ্চারিত হতে দেখতাম। সব দিকেই সমান সুনাম, সমান খ্যাতি, ঈর্ষণীয় সমান জনপ্রিয়তা উপলব্ধি করে অপেক্ষায় ছিলাম তাঁকে দেখতে পাওয়ার জন্য।
একদিন সেই শুভক্ষণ এল। সেই ইচ্ছাপূর্তি ঘটল, অপেক্ষার পালা শেষ হলো—তিনি ফিরে আসায়। সেই থেকে আমার আজীবনের শিক্ষক হয়ে গেলেন তিনি। কলা-কৈবল্যের খুঁটিনাটি। ভাবায় ঠেকে গেলেই তাঁর শরণাপন্ন হয়েছি যখন-তখন। তিনি শিক্ষকসুলভ বিশ্লেষণ দিয়ে জট খুলে দিয়েছেন।
তাঁর ফিরে আসাটা মনে পড়ছে—একদিন হঠাৎ অধ্যক্ষ শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের একটি নোটিশ এসে হাজির হলো ক্লাস টিচারের হাতে। তিনি ঘোষণা দিলেন, ‘ক্লাস ছুটি। সবাইকে তেজগাঁ বিমানবন্দরে যেতে হবে। শিল্পী কিবরিয়া আসছেন।’ তাঁকে অভ্যর্থনা জানাতে অতএব আর্ট কলেজের ছাত্রছাত্রী, শিক্ষক মিছিল করে গিয়ে উপস্থিত হলাম। রানওয়েতে প্রায় উড়োজাহাজের কাছাকাছিতে দাঁড়িয়ে অপেক্ষারত সবাই। দেশি-বিদেশি নানান যাত্রী একে একে নেমে আসতে শুরু করল। অবশেষে বেশ কয়েকজনের পর সাদা শার্ট-প্যান্ট পরিহিত হালকা-পাতলা গড়নের খুবই সাদামাটা চলনের একজনের গলায় ফুলের মালা পরিয়ে, হাতে ফুলের তোড়া দিয়ে কোলাকুলি করলেন আবেদিন স্যার। আমরা সবাই তালি দিলাম।
আমি অবাক হলাম। এই বুঝি অত নাম-ডাকের শিল্পী! আমার ধারণায় ছিল—বেশ ডাকসাইটে স্যুটেডবুটেড কাউকে দেখব, যেহেতু বিদেশ থেকে দীর্ঘ সময় কাটিয়ে ফিরছেন। তা সে ভাবনার সঙ্গে মিলল কই? পরবর্তী কালে আবিষ্কার করলাম—পোশাক-আশাকে নয়, শিল্পীর মনোজগৎটিই তাঁর দারুণ স্মার্ট। অত্যন্ত আধুনিক ভাবনার এক অপূর্ব ব্যক্তিত্ব। শিক্ষা, দেখার—গ্রহণের চোখ এবং স্বভাবজ্ঞান মিশিয়ে অভূতপূর্ব এক পরিশীলিত শিল্পী, যাঁর বোধ তাঁর সমকালিনতা, সমসাময়িকতা থেকে আরও অনেক অনেক অগ্রসরমাণ।
কিবরিয়া স্যারকে যাঁরা কাছে থেকে দেখেছেন বা তাঁর সান্নিধ্য লাভ করেছেন, তাঁরা প্রত্যেকেই তাঁকে কাছের ঘনিষ্ঠজন ভাবতে বাধ্য হয়েছেন। কারণ, তাঁর একধরনের আকর্ষণীয় মিষ্টি স্বভাব। স্বল্পভাষী ছিলেন বটে, কিন্তু চমৎকার আলাপি ছিলেন, ছিলেন রসিকতাপ্রবণও। তাঁর স্বভাবের রোমান্টিকতা তাঁর চিত্রকলায়ও সঞ্চারিত। সেই জন্যই হয়তো তিনি তাঁর চিত্র ভাষাকে কখনোই কোমলতাকে ছাপিয়ে যেতে দেননি বা বলা যায়, বিষয়ের ভিড়কে প্রশ্রয় দেননি। জাপান থেকে ফিরে আসার পর ষাটের দশক থেকে শুরু করে শেষ অবধি রং এবং টেক্সচারকেই বিষয় হিসেবে সাজিয়ে চিত্র-রচনা করেছেন অভূতপূর্ব শৈল্পিক দক্ষতা এবং শৈলীকে একত্র করে। এ সবকিছু থেকে সৃষ্ট স্টাইলটি তাঁর একান্তই নিজস্ব হওয়ায়, তা একটি ‘স্কুল’ হিসেবেই প্রতিষ্ঠিত হয়।
তো, কিবরিয়া স্যার চলে গেলেন। চিরতরের জন্য তাঁর সৃষ্টি থেকে প্রতিনিয়ত, নিত্যনতুন চিত্র-রচনা থেকে সরে গেলেন। আমরা সেসব থেকে বঞ্চিত হব। কিন্তু যে সম্ভার দেশের শিল্পকলার জগৎকে দিয়ে গেছেন, তা আমাদের সবার পাথেয় হয়ে থাকল। তিনি বেঁচে থাকবেন তাঁর সৃষ্ট এসব শিল্পকর্মে এবং অগণিত ছাত্র আর ভক্তকুলের বোধে, চেতনার চিত্রকলা-চর্চায়। তাঁর বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করছি।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, জুন ১০, ২০১১
Leave a Reply