কয়েক বছর ধরে একালের শ্রেষ্ঠ মার্কিন ঔপন্যাসিক ফিলিপ রথের নাম সম্ভাব্য নোবেল বিজয়ীদের তালিকায় আসছে, আবার বাদ পড়ে যাচ্ছে। সম্প্রতি তিনি পেলেন মান বুকার ইন্টারন্যাশনাল প্রাইজ এবং নতুন করে আলোচনায় ফিরে এলেন। নাথান জুকারম্যান তাঁর নয়টি উপন্যাসেই অন্যতম চরিত্র হিসেবে উপস্থিত থেকে এক্সিট গোস্ট-এ বিদায় নিয়েছেন। সাক্ষাৎকারের শুরু নাথানকে নিয়েই। এটি ফিলিপ রথের একটি সমান্তরাল চরিত্র; কিন্তু কর্মকাণ্ড ভিন্ন। নাথান শেষদিকে প্রোস্টেট ক্যানসারে আক্রান্ত এবং নিবীর্য।
প্রশ্ন: আপনার আর পাওয়ার কী আছে? আপনার প্রত্যাশা?
ফিলিপ রথ: সুস্বাস্থ্য, হয়তো সুখ।
প্রশ্ন: নোবেল প্রাইজ?
ফিলিপ রথ: আহ্! নোবেল প্রাইজ, এটার কথা ভাবছি না।
ফিলিপ রথের সমান্তরাল নায়ক
প্রশ্ন: আপনার অনেক উপন্যাসের নায়ক কিংবা সূত্রধর নাথান জুকারম্যান একজন লেখক, যিনি গ্রামের দিকে একা একা বসবাস করতেন। অনেকটা ফিলিপ রথের মতো—কিন্তু দেখা যাচ্ছে তিনি আবার নিউইয়র্কে ফিরে এসেছেন। তিনি কি বার্ধক্য থেকে পালিয়ে যেতে চাচ্ছেন? আবার বলবান হয়ে ওঠার চেষ্টা করছেন?
প্রশ্ন: তা হতে পারে। তবে আমি মনে করি এই শেষ বইটিতে এসে জীবন আসলে তার কাছ থেকে বেরিয়ে গেছে। তার ভেতরের লড়াই আর তার সঙ্গে নেই। তবে তাৎক্ষণিকভাবে তার মধ্যে পৌরুষ ও লড়াইয়ের বিস্ফোরণ ঘটে, কিন্তু তার পরই মিলিয়ে যায়।
প্রশ্ন: এখানেই কি নাথান জুকারম্যানের সমাপ্তি?
ফিলিপ রথ: হ্যাঁ।
প্রশ্ন: আপনি কেন আপনার সবচেয়ে বিখ্যাত চরিত্রটিকে শেষ করে দিতে চাচ্ছেন?
ফিলিপ রথ: শেষ করে দেওয়ার ইচ্ছে যে আমার আছে, তা জানতামও না। এটা ঘটে গেছে। বইটা যখন শুরু করি একবারও ভাবিনি এখানেই শেষ হয়ে যাবে নাথান জুকারম্যান।
প্রশ্ন: আপনি যখন বইটা শুরু করেন, তার আগে কোনো পরিকল্পনা করেননি?
ফিলিপ রথ: পরিকল্পনা করেছি বলে মনে হয় না। গল্পটাই ওর শেষ নিয়ে এসেছে। আর যেভাবে গল্পটা উন্মোচিত হয়েছে, এর একটি সমাপ্তি এবং উপসংহারও এসে গেছে একইসঙ্গে। রিপ ভ্যান উইঙ্কলের গল্পটা জানেন তো? রিপ ভ্যান উইঙ্কল ২০ বছর ধরে ঘুমিয়েছে। তারপর জেগে ওঠে। জুকারম্যানের শহরে আসার ব্যাপারটাও সে রকমই। তিনি এসে কী আবিষ্কার করবেন, তা আমাকে আবিষ্কার করতে হয়েছে; কী দেখবেন, মানুষ কেমন হবে, বিশেষ করে তরুণ জনগোষ্ঠী, আমাকেই বের করতে হয়েছে। আমার মধ্যে তার জন্য একটা আবিষ্কারের প্রক্রিয়া চলেছে।
প্রশ্ন: তিনি যা আবিষ্কার করেছেন, তা হচ্ছে সেলফোন।
ফিলিপ রথ: তিনি এখনো টাইপ রাইটারের যুগে বসবাস করছেন। তারপর তিনি দেখেন মানুষ নিজেদের মধ্যে কথা বলছে।
প্রশ্ন: এই বইটির প্রেক্ষাপট তো ২০০৪ সালের নির্বাচন। এটা আপনার কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠল কেন?
ফিলিপ রথ: বিশেষ করে তরুণদের মধ্যে হতাশা খুব তীব্রভাবে অনুভূত হচ্ছিল। আমার মনে হয়েছে এটা একটা শক্তিশালী ঐতিহাসিক মুহূর্ত। আমার মনে হয়েছে নির্বাচনটা আমার রচনার একটি বর্ণিল প্রেক্ষাপট হিসেবে কাজ করবে।
প্রশ্ন: অন্যভাবে বলতে গেলে প্রায়োগিক কৌশল হিসেবে আপনি নির্বাচনকে প্রেক্ষাপট হিসেবে নিয়েছেন?
ফিলিপ রথ: আমি সব সময়ই চেয়েছি বইয়ে যা ঘটছে, তার বাইরেও কিছু একটা সেখানে ঘটুক। আর আমি অনুভব করছি, এই নির্বাচন সবার আচরণ, কর্মকাণ্ড ও আবেগ তুলে ধরতে আমাকে একটা সুযোগ করে দিয়েছে। এটাই আমাকে দিয়ে তরুণ একটি জোড়কে জীবিত ফিরিয়ে এনেছে এবং তাদের সঙ্গে জুকারম্যানের পার্থক্যটা সুনির্দিষ্ট করে দিতে পেরেছে।
প্রশ্ন: কিন্তু তিনি তো নৈরাশ্যবাদী আর ওরা উন্মত্ত।
ফিলিপ রথ: ঠিকই বলেছেন, তবে আমি বলব না যেভাবে তাঁর সমাপ্তি ঘটেছে, তিনি ততটা নৈরাশ্যবাদী। তিনি তাঁর নৈরাশ্য নিয়েই বিদায় নিয়েছেন।
ওবামার ভোটার ফিলিপ রথ
প্রশ্ন: কোন কারণে ওবামার প্রতি আগ্রহী হলেন?
ফিলিপ রথ: আমার আগ্রহের কারণ তিনি কালো। আমি মনে করি, এ দেশে ফেমিনিস্ট ইস্যুর চেয়ে বর্ণের ইস্যুটি বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এতে কালোদের গুরুত্ব দারুণভাবে বেড়ে যাবে। ওবামা একজন আকর্ষণীয় পুরুষ, চটপটে ও চমৎকার কথা বলেন। ডেমোক্রেটিক পার্টিতে তাঁর অবস্থান আমার বিবেচনায় সঠিক স্থানেই রয়েছে। তাঁর প্রেসিডেন্ট হওয়াটা কালো আমেরিকানদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
বুশ এতই বীভৎস যে ভোলা কঠিন
প্রশ্ন: প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশের ব্যাপারে…?
ফিলিপ রথ: বুশ এতই বীভৎস যে তাঁকে ভোলা কঠিন। এসব নিয়ে অনেক লেখালেখি হবে। ইরাক যুদ্ধ নিয়ে অনেক লেখা হবে। রেগানিজম নিয়ে বুশ কী করেছেন তা লেখা হবে। তিনি রেগানকে অনেক ছাড়িয়ে গেছেন। কাজেই তাঁকে ভোলা যাবে না। কেউ কেউ বলছেন, বুশ আমেরিকার ইতিহাসে সবচেয়ে বাজে প্রেসিডেন্ট। আমি মনে করি, তা সত্যি।
প্রশ্ন: কেন?
ফিলিপ রথ: সবচেয়ে বড় ব্যাপার হচ্ছে, যুদ্ধ আর যুদ্ধে জড়াতে প্রতারণা। এই প্রতারণাকে ঘিরে চরম হতাশাবাদ। যুদ্ধের ব্যয়, রাজকোষের অবস্থা, আমেরিকান জনগণের জীবন—সবই বীভৎস। এর মতো ভয়ংকর কিছু আর নেই। এরপর বৈশ্বিক উষ্ণতার বিষয়টি দেখুন, এটা তো বৈশ্বিক সমস্যা—এ ব্যাপারে বৈরী না হলেও বুশ সম্পূর্ণ উদাসীন। এ রকম বহু কিছু আছে। বুশ অনেক ক্ষতি করে গেছেন।
জীবনীর প্রতি ভয়
প্রশ্ন: আপনার এক্সিট গোস্ট-এর একটি বিষয় হচ্ছে তরুণ লেখক রিচার্ড ক্লিম্যান প্রয়াত নাট্যকার ইএল লোনোফের জীবনী লেখার উদ্যোগ নেন। আপনার নায়ক জুকারম্যানের আদর্শ লোনোফ। কিন্তু ক্লিম্যানের এই উদ্যোগকে তিনি রীতিমতো ঘৃণা করেন। আপনিও কি জীবনী নিয়ে ভীত?
ফিলিপ রথ: আমার একজন জীবনীকার আছেন। এ পর্যন্ত তিনি আমার ১০টি সাক্ষাৎকার নিয়েছেন। তিনি কী লিখেছেন এখনো দেখাননি। আমি দেখতেও চাই না। আমি সত্যিই এই জীবনীর সঙ্গে নিজেকে জড়াতে চাই না।
প্রশ্ন: আপনি কি ভয় পান?
ফিলিপ রথ: হ্যাঁ, দুই ধরনের ভয়; কোনটা তিনি ভুল লিখে ফেলেন আর কোনটা তিনি সঠিক লেখেন, দুটোই।
প্রশ্ন: বিব্রত হবার ভয়? একজন কমবয়সীর প্রেমে পড়ে টমাস মান ভেবেছেন তার সুনাম বিনষ্ট হবে; আপনার নায়ক নাথান জুকারম্যান একই সঙ্গে পুরুষত্বহীন এবং রাগ নিয়ন্ত্রণে অসমর্থ—তিনি বিব্রত হবেন বলে আতঙ্কিত?
ফিলিপ রথ: টমাস মানের সময় যে পরিস্থিতি ও বিধিবিধান ছিল, তা এখন আর বিরাজ করে বলে আমি মনে করি না। কার্যত সুখ্যাতি নষ্ট করার তেমন সুযোগ আপনার নেই। খ্যাতিতে কিছুটা আঁচড় ফেলতে ব্লুমিংডেইলের জানালায় আপনাকে পাশবিক কিছু করতে হবে। তবুও তরুণী জেমি নাথান জুকারম্যানের কাছে প্রবেশাধিকার পাচ্ছে না কেবল বয়সের ব্যবধানের কারণে নয়, তার শারীরিক ভোগান্তির কারণেও।
প্রশ্ন: মেয়েটি কি তা জানে?
ফিলিপ রথ: জুকারম্যান জানেন। তিনি আরও জানেন তাঁর বাসনা অসম্ভবের ওপর ভিত্তি করে দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু জুকারম্যানের দিক থেকে করুণ রসাত্মক বিষয়টি হচ্ছে যে যদি তিনি থেমেও যান, তিনি তাঁর বাসনাকে দমিয়ে রাখতে পারেন না। কাজেই তাঁর প্রত্যাশার কামনাটি বড় হূদয়বিদারক।
পুরোনো গুরুদের লেখাই ভালো লাগে
প্রশ্ন: কাদের বই পড়েন।
ফিলিপ রথ: পুরোনো গুরুদের লেখা। কনরাড, তুর্গেনিভ, হেমিংওয়ে—ফকনার আবার পড়ছি—এখনো আমার কাছে অনেক আনন্দের। সমকালীন কথাসাহিত্য কদাচিৎ পড়া হয়। তবে নন-ফিকশন পড়ি।
প্রশ্ন: আর নাথান জুকারম্যানের মতো সেখানে আপনার কোনো ইন্টারনেট নেই।
ফিলিপ রথ: না, ইন্টারনেট নেই।
প্রশ্ন: নিউইয়র্কেও আপনার বাড়িতে ইন্টারনেট নেই?
ফিলিপ রথ: এখন আছে। কতগুলো পুরোনো বইয়ের সাইট আছে, আমার পছন্দের। আমি প্রচুর বই কিনি। কিন্তু এ খবরটা কাউকে জানাবেন না।
প্রশ্ন: আপনার ই-মেইল আছে? ব্যবহার করেন না?
ফিলিপ রথ: কেবল একজনের সঙ্গে ব্যবহার করি, অন্য কারও সঙ্গে নয়। আমি বিরক্ত হতে চাই না।
প্রশ্ন: জানতে পারি, সেই একজনটি কে?
ফিলিপ রথ: না।
প্রতিদিন অন্তত একটি পৃষ্ঠা
প্রশ্ন: আপনি কি সত্যি সত্যিই লেখালেখি উপভোগ করেন?
ফিলিপ রথ: হ্যাঁ, বিশেষ করে লেখাটা যখন প্রায় শেষ হয়ে আসে, যখন আমি নিশ্চিত হতে পারি, আমি কী করেছি। প্রথম ড্রাফট, তারপর দ্বিতীয় ড্রাফট এবং তারপর সত্যিকারের আনন্দ। তখন আপনার পায়ের তলায় শক্ত মেঝে, তখন আপনি জানেন আপনি কী লিখেছেন।…
প্রশ্ন: প্রতিদিন কয়পাতা লিখবেন, তার কি কোনো একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্য স্থির করে নেন?
ফিলিপ রথ: দিনে অন্তত একটি পৃষ্ঠা আমি লিখতেই চাই। এটা করতে না পারলে খুবই খারাপ বোধ করি। কোনো কোনো দিন আট-১০ পৃষ্ঠা লেখা যায়। কোনো দিন টেনেটুনে একটা প্যারাগ্রাফ। কিন্তু প্রতিদিন অন্তত একটি পৃষ্ঠা হচ্ছে—এটা অনুভব করতে পারলে চমৎকার—তাহলে বছরে তো ৩৬৫ পৃষ্ঠা হচ্ছে।
প্রশ্ন: আপনি কি এখনো টাইপরাইটার ব্যবহার করেন?
ফিলিপ রথ: আমি এখন কম্পিউটার ব্যবহার করি। আমি এখন অন্য ফিলিপ রথ। আমি সবচেয়ে বড় ‘হাই-টেক’ মানুষদের একজন!
(ফিলিপ রথের একটি সেলফোন আছে, নম্বর কেউ জানে না। কিংবা যার জানার কেবল সেই একজনই জানে!)
অনুবাদ: আন্দালিব রাশদী
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, মে ২৭, ২০১১
opu
emon ekti sakkhatkar porar sujog kore deyar jonyo dhonyobad
পদ্ম মনি
ফিলিপ রথ সাহেব,সত্যিই এক অপূর্ লেখক,দোয়করিদীর্ জীবি হূক /