রানু সোম
ঢাকা শহর। নজরুলের বয়স ত্রিশ-বত্রিশ। যৌবন তাঁর চোখ-মুখে, সমস্ত শরীরে নদীর স্রোতের মতো বহমান ও বেগবান, দুই কুল প্লাবী আনন্দধারা দিয়ে গড়া তাঁর চরিত্র। মস্ত বড় টানা টানা কালো চোখ, এলোমেলো ঘন চুলের বাবরি, তীক্ষ নাসিকা, ঘষা তামার মতো রং, লাবণ্য সহজ-সরল, অদাম্ভিক ব্যবহার, উদ্দাম হাসি, উচ্ছ্বাস প্রবণতা—সব মিলিয়ে একটা ব্যক্তিত্ব বটে। ধুলায় লুটিয়ে পড়ছে গেরুয়া চাদর।
ফুলবাড়িয়ায় নেমে ঘোড়ার গাড়িতে চেপে হাজির রানুর বাসায়। রানু দেখল, নজরুল নেমে আসছেন তারই বাসার দিকে। বনগ্রামে রানুদের একতলা বাড়ি।
‘এই তো, তুমি রানু? ঠিক তো। মন্টুর ছাত্রী।’
রানুর বুক কেঁপে উঠল। ভাবল, তার গুরু দিলীপকুমার রায়ের নাম যে মন্টু, তা এ ভদ্রলোক জানলেন কেমন করে।
বিস্ময়াবিষ্ট রানু।
‘আপনি—আপনি কি…?’
‘আমি নজরুল ইসলাম।’ বড়গলায় হেসে উঠলেন কবি।
রানু জানে সামনে দাঁড়িয়ে এই ভদ্রলোকের অস্তিত্বে বহমান শুধু সংগীত। তার মতো নগণ্য এক কিশোরীর সামনে উপস্থিত বিরাট এক মহীরুহ।
এর আগেরবার মোতাহার হোসেন পরিচয় করিয়ে দেন নোটনের সঙ্গে কবির। নোটনের চেয়ে রানুর কণ্ঠ মিষ্টি।
‘তোমার গান সুন্দর বটে। এত মিষ্টিগলা আমি কখনো শুনিনি। জানো, মিষ্টিগলা মেয়েদের আমি কী বলি?’
কিশোরী রানু কী বলবে ভেবে পায় না। বলল, ‘আমি জানি, আমি শুনেছি, কথাটা অভোলন।’
‘তুমি জানলে কী করে?’
‘নোটনের কাছে। শুনেছি আপনি যা কিছু ভুলতে পারেন না, তার একটি নতুন শব্দ তৈরি করেছেন। শব্দটি অভোলন, যা ভোলা যায় না।’
‘কেন ভোলা যায় না জানো তো?’
‘তা তো আপনি জানবেন ভালো।’
‘সুন্দর গলার জন্য—।’
কিশোরী রানু তাকিয়ে থাকে বাবরি চুলের কবির দিকে। মনে মনে ভাবে, শুধু কি সুর? আর কিছু নয়?
কয়েক দিন পর এলে রানু সোম গাইছিল কবির লেখা গানটি: ‘আমার কোন কূলে আজ ভিড়ল তরী, এ কোন সোনারগাঁয়’।
নজরুল ঘরে ঢুকেই পরের লাইনটি গাইলেন: ‘আমার ভাটির তরী আবার কেন উজান যেতে চায়’।
রানু দুষ্টুমি করে গানটি থামাল না, গাইল: ‘আমার দুঃখের কান্ডারি করি, আমি ভাসিয়েছিলেম তরী’।
নজরুল কম যান না। গাইলেন: ‘তুমি ডাক দিলে কে স্বপনপরী নয়ন ইশারায়, ওগো সোনার দেশের সোনার মেয়ে…’।
রানু অকারণে এবার গান থামিয়ে দিল।
নজরুল দাঁড়িয়ে। বললেন, ‘গান শেষ না করলে আমি উঠব না’।
রানু গাইল: ‘তুমি হবে কি মোর তরীর নেয়ে, এবার ভাঙা তরী চল বেয়ে, রাঙা অলকায়’।
তিন দিন আর নজরুলের দেখা নেই। ঢাকার বন্ধুদের নিয়ে ব্যস্ত, বিশেষ করে কাজী মোতাহার হোসেনকে নিয়ে। ওদের বাড়ি সেগুনবাগিচা। শুধু গাছ আর গাছ, আর ছোট নদীনালা।
এরপর দেখা হতেই প্রশ্ন: ‘রানু, তুমি কোথায়, আগের গানটি কি আরেকবার গাইবে, না আরেকটি দেব? দেখো, গানটি তোমার পছন্দ হয় কি না।’ হারমোনিয়ামটি টেনে গাইলেন: ‘এত জল ও কাজল চোখে পাষাণী আনলে বল কে’। রানুর ভালো নাম প্রতিভা। গানটি এত সুন্দরভাবে তুলল, যাতে তার প্রতিভার স্বাক্ষর।
রানু বলল, ‘প্রতিদিন আপনার জন্য বাবা নিয়ে আসেন ঢাকার কালাচান্দ গন্ধবণিকের মিষ্টি। আপনার বোধ হয় মিষ্টির চেয়ে বাখরখানি আর পনির পছন্দ, তাই না?’
‘আমার পছন্দ বর্ধমানের মিহিদানা আর শক্তিগড়ের ল্যাংচা। একবার খেলে তা কেউ ভোলে না। তবে আমি সবচেয়ে ভালোবাসি আতাফল, যা ঢাকায় প্রায় প্রতি ঘরে ঘরে।’
‘তা তো জানতাম না, আমাদের বাসায়ই আছে আতার গাছ। বাবার পছন্দ সীতাফল। আতার বড় রূপ।’
কত সন্ধ্যা, কত সকাল, যেন চোখের পলকে কেটে গেল। গান লেখা হলো, শেখা হলো, সেগুলো তো আছে সবার গানের খাতায়। আর যা নেই, তা এখানে।
‘কবিদা, তুমি চলে গেলে আমার মোটেও ভালো লাগবে না। আমার মনে হবে এত সুন্দর গান আর আমি কারও কাছে শেখার সুযোগ পাব না।’
‘তোমার বনগ্রামের এই বাসাটি চিরদিন মনে থাকবে। এখন তোমার অটোগ্রাফের খাতাটি নিয়ে এসো। আর চা কোথায়? এতক্ষণ চা না খেয়ে তোমার কবিদা তেষ্টায় ছটফট করছে। বনমালিকে দিয়ে পান আনাতে ভুলো না।’
রানু বুঝতে পারছে, তার চিরচঞ্চল কবিদার যাওয়ার সময় হয়ে এসেছে। তার চোখের কোণে কি পানি এসে জমা হয়েছে? না, তা কেন হবে? তার কিশোরী মনে এই নবীন কবির ভালোবাসার গানগুলো চিরদিন জমা হয়ে থাকবে। কিন্তু কবিকে সে পাবে না। তাই তার চোখে আজ অশ্রুকণা।
‘অটোগ্রাফ খাতাটি ভারি সুন্দর!’ নজরুল বলে উঠলেন বালকের মতো। ‘দেখি কে কে লিখেছেন।’ তাতে আছে সবার ওপরে রবীন্দ্রনাথের হস্তাক্ষর। নজরুল লিখলেন: ‘শ্রীমতী রানু সোম কল্যাণীয়াসু:
মাটির ঊর্ধ্বে গান গেয়ে ফেরে, স্মরণের যত পাখি
তোমার কণ্ঠ রাখি…
তুমি আনিয়াছ শুধু সুরে সুরে, ভাষাহীন আবেদন,
সে সুরমায়ায় শশীতারা অগণন। ….কবিদা।’
গানগুলো এক দিনে তোলা হয়নি। অনেক সুন্দর প্রহর কেটেছে বনগ্রামের এই বাসায়। মাঝে মাঝে নোটন এসে বসে থাকত গান গাওয়ার সময়। কী সুন্দর নজরুলের গাওয়ার ভঙ্গি! দুই কিশোরীর মুগ্ধাবস্থা। শুধু প্রেমে পড়তে বাকি। আর গানগুলো?
নজরুল বললেন, ‘আমি তোমাকে যে গানগুলো শিখিয়েছি, সেগুলো কাউকে শিখিয়ো না। পরে তোমাকে দিয়ে রেকর্ড করাব। আর যদি তোমাকে না পাই, তাহলে হয়তো অন্য কেউ রেকর্ড করবে। কিন্তু সেগুলো কোনো দিনই তোমার মতো হবে না।’
রানু তাঁর পা ছুঁয়ে বলল, ‘তথাস্তু, মহারাজ।’
গানের খাতায় নজরুলের হস্তাক্ষরে গানগুলো লেখা: ‘যাও যাও তুমি ফিরে, এই মুছিনু আঁখি, ছাড়িতে পরাণ নাহি চায়, আমি কি মুছিল গৃহে, নাইয়া কর পার, আঁধার রাতে কে গো একলা, না মিটিতে সাধ মোর নিশি পোহায়’।
ঢাকার পাট শেষ।
এবার কলকাতায় রানু সোম আবার এসে হাজির হুগলিতে পিসেমশাইয়ের বাসায়। পিসেমশাই সুরেন্দ্রনাথ বসু হুগলি কলেজিয়েট স্কুলের শিক্ষক। রানু চিঠি দিয়েছে, নজরুলও। বিষয়বস্তু: শুধু গান রেকর্ড, আর কিছু নয়।
দিনের নানা কাজ শেষ করে নজরুল যেতে চান রানুর কাছে। কেনই বা যাবেন না। ওই কিশোরী তাঁর মন অধিকার করেছে, তার কণ্ঠ দিয়ে। তাই সব গান ওকে না শেখালেই নয়।
এদিকে দিলীপকুমার রায় নজরুলের গানগুলো প্রথম দিকে গাইলেও পরে তা আর হলো না।
নজরুল: আমার গানগুলো তাহলে তোর বিহনে ভুলে যাবে মানুষ?
দিলীপ: কেন, রানু রইল। ও তোর গান গাইবে। তা ছাড়া আছে উমা মৈত্র মানে নোটন। ওর গলাও মিষ্টি। আমি জানি, তুই রানুকে প্রেফার করিস। তা তো করবিই, আমিও করি।
‘কিন্তু তুই দিনে দিনে সন্ন্যাসী হয়ে উঠছিস, তা কি আমি জানি না। আমি সবই জানি, শুধু চুপ করে থাকি।’
‘কী করে জানলি?’
‘ধ্যানে। তুই ভাবিস তুই একাই ধ্যানী, আর কেউ নয়। সংসারে আরও লোক আছে, যারা তোকে মন থেকে ভালোবাসে। চিরদিন জানিস, আমি তাদের একজন।’
দিলীপ জড়িয়ে ধরলেন নজরুলকে।
‘তুই দোয়া কর, সত্যি মন থেকে, যেন আমি ঈশ্বরকে খুঁজে পাই। গানে যাঁকে পেলাম না, তাঁকে আমার পেতেই হবে।’
‘কীভাবে তুই জানলি শ্রীঅরবিন্দকে? আমাকে জানাবি না, আমাকে বলবি না? আমি কি তোর পর?’
‘তোর আর আমার গানের পথ এক। সাধনার পথ আলাদা। তুই নুরু মিঞা, এ কথা ভুলে যাস না। তোর তালাশ আর আমার তালাশ আলাদা হতেই হবে। তবে যার তালাশ সে এক, অদ্বিতীয়। শ্রীঅরবিন্দ আমাকে তার সন্ধান দিয়েছেন।’
‘আমি গান-বাজনা ছেড়ে দেব রে। তুই আমাকে সেখানে নিয়ে চল। আমি আর পারছি না। আমাকে সেই প্রভুর দ্বারে যেতেই হবে, যে আমাকে প্রতিক্ষণেই ডাকছে।’
এর মধ্যে রানু বেতারশিল্পী হিসেবে নাম লেখাল। দিলীপকুমার রায় পণ্ডিচেরি থেকে লিখলেন নজরুলকে:
এত দূর থেকে তোর গানের বই চোখের চাতক পেয়ে খানিকক্ষণ কাঁদলাম। তুই গানে গানে যাকে খুঁজে ফিরেছিস সে কোনো কিশোরীর চাতক দৃষ্টি নয়, নয় তা কোনো বনবঁধুর উচ্ছ্বসিত রসমাধুরী। এত লোক ছেড়ে আমাকেই কেন উৎসর্গ তোর ওই গানের ডালি?
ইন্দুবালা, আঙ্গুরবালা ছাড়াও আরও ছিল যারা তোর গানের বইতে নাম দেখতে পেলে খুশিতে হতো বাগে বাগ। আমি জানি, তুই কেন আমাকে উৎসর্গ করেছিস এই গান।
দুই বন্ধুতে এর পরে দেখা সেই রানুর বাসায়ই।
দিলীপ জড়িয়ে ধরলেন নজরুলকে।
নজরুলের প্রথম প্রশ্ন: তার দেখা পেয়েছিস?
‘সে দেখা দেয়, আবার পালিয়ে যায়। এভাবেই সাধনা চলছে।’
‘আমাকে কবে নিয়ে যাবি?’
নলিনী পাশেই দাঁড়িয়ে, বললেন: নজরুল এখন হিজ মাস্টার্স ভয়েসের ট্রেইনার, তার একমুহূর্তও সময় নেই। সারা দিন শিল্পীরা তার চারপাশে ঘুরছে মৌমাছির মতো।
দিলীপ চায়ে চুমুক দিলেন। চায়ে নেই চিনি, নেই দুধ।
নজরুল বললেন: তুই তো প্রায় অর্ধেক বিসর্জন দিলি।
দিলীপ বললেন: তোকে তো দেখে বেশ নাদুসনুদুস মনে হচ্ছে। তবে কি সাধনার পথে কিছু কারণবারির সাহায্য নিচ্ছিস?
উত্তর দিলেন নলিনী: না, দিলীপদা। কাজীকে বোঝা আমাদের সাধ্য নেই। সারা দিন ডুবে আছে পঙ্কে, অথচ কাদা স্পর্শ করে না।
নজরুল কানে হাত দিলেন। বললেন: বন্ধুরা চেষ্টা করছে আমাকে জ্ঞান দিতে, পারেনি। পারবে না। কোনো দিনই। আল্লার কসম।
দিলীপ বললেন: তুই যে মুসলমান সেটা মাঝেমধ্যেই বেরিয়ে পড়ে, এই যেমন বললি, আল্লার কসম।
জাহানারা, পৃথিবীর আলো
রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে দেখা করে এসেছেন মুসলমানদের মধ্যে অপূর্ব সুন্দরী মহিলা জাহানারা। নবাব পরিবারের মেয়ে। রবীন্দ্রনাথ ভালো ব্যবহার করেছেন তাঁর সঙ্গে। নাশতা খাইয়েছেন, বই উপহার দিয়েছেন এবং সেই সঙ্গে একটি লেখাও সংগ্রহ করেছেন জাহানারা। নজরুলের সঙ্গে দেখা হলেই প্রথমে বলে উঠলেন: ‘আমি আপনাকে খুঁজছি।’
গ্রামোফোন কোম্পানির রিহার্সেল রুমে এমন ডাকসাইটে সুন্দরীর আবির্ভাব আগে কখনো হয়নি। এর চত্বরে আগমন কিন্নরকণ্ঠীদের, কিন্নরী নন। আঙ্গুরবালা, ইন্দুবালা প্রস্থান করেছেন কিছুক্ষণ আগে।
পৃথিবীর আলো অর্থাৎ জাহানারা তার সামনে আবির্ভূত, পরিধান করে এসেছেন লাল টকটকে শাড়ি, ম্যাচিং ব্লাউজ। নজরুল প্রথমে কী বলবেন ভেবে পাচ্ছেন না। শেষে বলতেই হলো, ‘আমি জনম জনম খুঁজছি আপনার মতো একজনকে।’
দুজনই একসঙ্গে হেসে উঠলেন। এরপর তাঁদের বাড়িতে গিয়েছিলেন কবি। সেখানে বসে অনায়াসে বের হলো দু-তিন পৃষ্ঠার কবিতা। সেই কবিতা বড় বড় লেখকের বিস্ময়। সেই দিনে মুসলমান মেয়েরা সামনে বেরোতেন না, জাহানারা ব্যতিক্রম।
কার্সিয়াংয়ে বেড়াতে এসেছেন নজরুল। সঙ্গে এস ওয়াজেদ আলী। চা-বাগানের এক অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজারের বাংলো সংলগ্ন একটি ঘর। সেখানে পাশাপাশি দুজন। একজন কবি আরেকজন লেখক।
পাহাড় মনে আনে সজীবতা, বায়ু সঞ্চালনে পাতার ঝিরিঝিরি হাওয়া, কমলালেবুর গায়ে ভোরের শিশিরের ছোঁয়া, পাহাড়ি পাখিদের অশ্রুত সংগীত নিয়ে আসে বসন্তের প্রতিশ্রুত সকাল।
দুই বন্ধু সকালে এক পেয়ালা ধূমায়িত চা পান করে বেড়াতে বের হন কার্ট রোড ধরে। ঝরনার কুলকুল ধ্বনি মস্তিষ্কের ধারগুলোতে এনে দেয় শীতল বৃষ্টি।
ওয়াজেদ আলী ব্যারিস্টার, ওকালতিতে কেটে যায় সারা দিন, মন পড়ে থাকে সাহিত্যের সচল প্রাঙ্গণে। নজরুলকে প্রাণ দিয়ে যাঁরা ভালোবাসেন, তাঁদের সংখ্যা যেমন অগুনতি, তাঁদের মধ্যে কয়েকজন আলাদা। বাবরিওয়ালা কবি মঈনুদ্দিন, আরেক বাবরি চুল আব্বাসউদ্দীন, বাল্যবন্ধু শৈলজা এবং আরেক সঙ্গী ওয়াজেদ আলী। চারজনই যেন কবিকে বাইরের কোলাহল থেকে বাঁচিয়ে রাখতে সদাসচেষ্ট।
মঈনুদ্দিন পান সাপ্লাই করেন, সঙ্গে খুচরো টাকা যখন যা লাগে, যা অফেরতযোগ্য। মাঝেমধ্যে পাজামা-পাঞ্জাবি কিনে নিয়ে আসেন ওয়াসেল মোল্লার দোকান থেকে। ওয়াজেদ আলীর সাহিত্য বাসরে অন্তত ৮০-৯০ জন নজরুলের আবৃত্তি শোনার জন্য আসেন। ড্রয়িংরুমের পাশে একটি কামরায় মহিলাদের চুড়ির টুংটাং ক্বচিৎ শোনা যায়। আর আব্বাসউদ্দীন নিয়ে আসেন কোচবিহার থেকে সদ্য আহরিত ভাওয়াইয়া-চটকা-পালাগান-বিষহরি গান-ভাটিয়ালি-মারফতি-মুর্শিদি। শৈলজা শিয়ারসোল থেকে আজ পর্যন্ত তাঁকে ছেড়ে যাননি।
ওয়াজেদ আলী নজরুলকে নিয়ে এসেছেন কার্সিয়াং। কারণ নিশ্চয়ই থাকবে। তা হলো জাহানারা।
কয়েকটি বাড়ির পরেই ব্রেকফাস্ট নিয়ে অপেক্ষমাণ কাব্য আমোদিতা জাহানারা। জগতের সব কবিকে তিনি ভালোবাসেন। প্রথম কবি রবীন্দ্রনাথ, এর পরেই নজরুল, এঁদের অর্ধেক কবিতাই কণ্ঠস্থ। আবৃত্তির ভঙ্গি নতুন, অনাস্বাদিত, বাক্যে, স্তবকে, কোথায় ওঠাতে হবে, নামাতে হবে, মহিলা কেমন করে আয়ত্ত করলেন বগুড়ায় বসে।
বগুড়ার মেয়ে জাহানারা, যেন আলোর দ্যুতি। মুসলমান মেয়েদের মধ্যে সবচেয়ে ফরওয়ার্ড রংপুর ও বগুড়ার মেয়েরা। শোনা যায়, সেই আমলেই বগুড়ার মেয়েরা সাইকেল চালাত। জাহানারাকে দিয়েই বোঝা যায় এরা সেই প্রজাতির।
ব্রেকফাস্ট নিয়ে বসেন জাহানারা। দাঁড়িয়ে উঠে নজরুল ও ওয়াজেদ আলীকে ঘরে নিয়ে বসালেন। নজরুল জানতেন না এই পরিকল্পিত ব্রেকফাস্টের কথা।
নজরুল বললেন, ‘আপনার সঙ্গে আজ দেখা, এ ছিল আমার স্বপ্নেরও অতীত।’
‘আপনার স্বপ্নে কারা আসেন তা আপনার কবিতাতেই। এদের হয় আসতে হবে ইরান থেকে অথবা নীলপরীদের দেশ থেকে। আমি সামান্য নারী। আপনাদের দুজনের জন্য আমি সকাল থেকে প্রস্তুত করেছি যৎসামান্য প্রাতঃরাশ। আমার জানা আছে কী কী পছন্দ আপনাদের।’
নজরুল টেবিলে গিয়ে দেখলেন এমন কোনো আইটেম নেই, যা তিনি খেতে চেয়েছেন অথচ নেই। সবচেয়ে উপাদেয় পাখির গোশত।
‘বেহেশতের বর্ণনায় পাখির গোশতের কথা আছে। এই চারটি চখা শেষ উড়েছিল বগুড়ার নারায়ণী নদীর কূলে। তাদের বন্দী করে আনা হয়েছে কার্সিয়াংয়ে আপনাদের টেবিলে পরিবেশন করা হবে বলে। এর সঙ্গে আমাদের দেশে যা খাওয়া হয়, তা হলো চালরুটি। গতকাল রাতেই চালের আটা প্রস্তুত করা হয়েছে এবং মিনিট দশেক আগে এ রুটি সেঁকানো হয়েছে।’
চালরুটি, পাখির গোশত ও তার সঙ্গে পুদিনার চাটনি, কয়েক রকম মোরব্বা শেষ হতে বেশি সময় লাগল না। ধূমায়িত কফির সঙ্গে অপেক্ষা করছে কার্সিয়াং ক্লাবের কেক পেস্ট্রি, কয়েক রকমের বিস্কুট ও আরেকটি টেবিলে কমলা, বেদানা, আঙুর, কলা। এস ওয়াজেদ আলী বললেন: ‘আপনার বাসায় আমি খেয়েছি, বগুড়ায়। আজকের টেবিলেও সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলেছে।’
ধূমায়িত কফিতে চুমুক দিতে দিতে জাহানারা খুলে দিলেন কাব্যের কেশহার। বললেন, ‘আপনার “চিরজনমের প্রিয়া” থেকে কয়েক লাইন পড়ে শোনাই?’
আজ মুখপানে চেয়ে দেখি, তব মুখে সেই মধু আছে,
আজও বিরহের ছায়া দোলে তব চোখের কোলের কাছে! …
এর পরে কলকাতায় জাহানারার বাড়িতে নজরুলের পদার্পণ কারণে-অকারণে। একটি গান তাঁকে নিয়ে লেখা:
‘বন বিহারিণী চপল হরিণী’। পরের গান: ‘ফুলে ফুলে বন ফুলেলা’।
খবর এল। চপলা হরিণীর বিয়ে হয়ে গেছে। কোনো এক নবাব পরিবারের ছেলের সঙ্গে। নজরুল বিবাহিত, তাঁর হতাশার ভাগ কম। হতাশাগ্রস্ত বাংলার আরেক কবি, যাঁর নাম পল্লীকবি।
[নজরুলকে নিয়ে লেখা মুস্তাফা জামান আব্বাসীর প্রকাশিতব্য বৃহৎ উপন্যাস ‘পুড়িব একাকী’র একটি অধ্যায়]
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, মে ২০, ২০১১
Leave a Reply