উইলিয়াম র্যাডিচি মেঘনাদবধকাব্য প্রকাশিত হয়েছিল ঠিক দেড় শ বছর আগে, প্রথম খণ্ড ১৮৬১ সালের জানুয়ারি মাসে; দ্বিতীয় খণ্ড আগস্টে। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে আগে অথবা পরে এর কোনো জুড়ি নেই—না, বিষয়বস্তুর দিক দিয়ে; না আঙ্গিকের মাপে; না রসের বিচারে। ব্যতিক্রমধর্মী এই কাব্য প্রচলিত মূল্যবোধে প্রচণ্ড একটা আঘাত দিয়েছিল। তার ওপর এর ভাষা এবং ছন্দ এমন অভিনব ছিল যে তা বোঝার ক্ষমতা অনেকেরই ছিল না। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের মতো পণ্ডিতও প্রথমে এর রস গ্রহণ করতে সমর্থ হননি অথবা পারেননি এর প্রশংসায় পঞ্চমুখ হতে। এমনকি দুই দশক পর তরুণ রবীন্দ্রনাথও এর প্রশংসা করতে পারেননি, বরং উল্টো নিন্দাই করেছেন। তা থেকেই সন্দেহ হয় সাধারণ পাঠকেরা এ কাব্য পড়ে এর স্বাদ কতটা পেয়েছিলেন। এসব সত্ত্বেও ক্রেতার কোনো অভাব হয়নি। অল্পকালের মধ্যেই তাই এর একাধিক সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছিল। প্রথম আট বছরে এ কাব্যের সংস্করণ হয়েছিল ছয়টি, সে কালের জন্য যা ছিল একেবারে কল্পনাতীত। প্রথম প্রকাশের পর থেকে গত দেড় শ বছরে এর কতগুলো সংস্করণ হয়েছে, তার কোনো সঠিক হিসাব নেই। কিন্তু নিঃসন্দেহে অনেকগুলো।
নিজের রচনা তিনি নিজেই অনুবাদ করতে শুরু করেছিলেন। পরে তাঁর রচনার সংখ্যা এবং জীবনে ব্যস্ততা যখন বৃদ্ধি পায় তখন থেকে অবশ্য তিনি আর অনুবাদ করেননি অথবা করার সুযোগ পাননি। এমনও হওয়া সম্ভব যে নিজের প্রতিষ্ঠা সম্পর্কে এতটা আত্মবিশ্বাস অর্জন করেছিলেন যে অনুবাদ করার প্রয়োজনীয়তাও অনুভব করেননি। নয়তো বীরাঙ্গনা কাব্য এবং চতুর্দশপদী কবিতাবলি, মেঘনাদবধকাব্যের তো কথাই নেই—এগুলোর অনুবাদ থাকলে সেটা উত্তরসূরিদের জন্য বিশেষ করে এ যুগে পৃথিবীটা যখন ছোট হয়ে প্রায় একটা বিশ্বপল্লিতে পরিণত হয়েছে, তখনকার জন্য খুব উপযোগী বলে বিবেচিত হতো। তাঁর কাব্যে সম্যক অর্থ বুঝতে এবং তার রস আস্বাদনে সেসব অনুবাদ সহায়তা করত নিঃসন্দেহে।
তিনি নিজে তাঁর শেষ দিকের কাব্যগুলোর অনুবাদ না করলেও তাঁর রচনার অনুবাদ বন্ধ থাকেনি। অন্যরা এগিয়ে এসেছেন এই কাজে। ক্যাপটিভ লেডির একাধিক বাংলা অনুবাদ যেমন প্রকাশিত হয়েছিল, তেমনি মেঘনাদবধকাব্যের ইংরেজি অনুবাদেরও চেষ্টা চলেছিল। তবে আগ্রহী অনুবাদকদের জন্য কাজটা খুব সহজ ছিল না। এ কাব্যের দৈর্ঘ্যই এর একমাত্র কারণ নয়। ভাষা, ভঙ্গি, উপমা, অলংকার এবং পঙিক্ততে পঙিক্ততে পুরাণের ছড়াছড়ির ফলে এ কাব্যটি খুবই জটিল বলে বিবেচিত হতে পারে। সে জন্য এর অনুবাদ করতে কেউই তেমন একটা উৎসাহ দেখাননি। অথবা উৎসাহ দেখালেও শেষ পর্যন্ত পিছিয়ে গেছেন। তা সত্ত্বেও রাজেন্দ্রনাথ সেন এই দুরূহ কার্যটি সমাধান করেন ১৯২৬ সালে। হয়তো বেনারস থেকে প্রকাশিত হওয়ার কারণে এ অনুবাদের খবর বাঙালি পাঠকদের অনেকের কাছেই পৌঁছায়নি। এক কথায় বলা যেতে পারে, সমালোচকদের দৃষ্টি এবং পাঠকদের প্রশংসা লাভ করতে ব্যর্থ হয়েছিল এই মূল্যবান অনুবাদকর্মটি।
রাজেন্দ্রনাথ সেনের ৬০ বছর পর মেঘনাদবধকাব্য অনুবাদে এগিয়ে আসেন শ্যামল বন্দ্যোপাধ্যায়। কলকাতা থেকে তাঁর অনুবাদ প্রকাশিত হয় ১৯৮৬ সালে। অমিত্রাক্ষর ছন্দে অনুবাদ করেছেন বলে তিনি দাবি করলেও উইলিয়াম র্যাডিচির মতে, তাঁর ছন্দকে মুক্তছন্দ ছাড়া অন্য কিছু বলা যায় না। এ ছাড়া তাঁর অনুবাদে এমন কোনো বৈশিষ্ট্য ছিল না যা পাঠকসমাজে কোনো আলোড়ন তুলতে পারবে। তাই খোদ কলকাতা থেকে প্রকাশিত হলেও শ্যামল বন্দ্যোপাধ্যায়ের অনুবাদ যথেষ্ট প্রচার লাভ করতে পারেনি।
এ কাব্যের তৃতীয় অনুবাদ করেন ক্লিন্টন সিলি, ২০০৪ সালে। কিন্তু ভারত অথবা বাংলাদেশে এ অনুবাদ খুব বেশি পাঠকের মনোযোগ আকর্ষণ করেছে বলে শুনিনি। হতে পারে এ গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছিল সুদূর নিউইয়র্ক থেকে, সেটা একটা কারণ। তা ছাড়া বাংলাদেশে আগ্রহ দেখা দেয়নি আরও দুই কারণে: একদিকে ইংরেজির চর্চা সেখানে ইদানীং খুবই হ্রাস পেয়েছে; অন্যদিকে বাংলায় লেখা কাব্য ইংরেজি অনুবাদের মাধ্যমে পড়ার কথাটা অনেকেরই আদৌ মনেই হয়নি। অতি সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে মেঘনাদবধকাব্যের চতুর্থ অনুবাদ। আর এ অনুবাদ করেছেন উইলিয়াম র্যাডিচি, যিনি ১৯৮০-এর দশকে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাইকেলের সাহিত্যকর্ম নিয়ে ডিফিল ডিগ্রি করেন এবং তারপর প্রকাশ করেন মাইকেলের সাহিত্যকর্মের বিভিন্ন দিক নিয়ে মূল্যবান অনেকগুলো প্রবন্ধ। মাইকেলের সাহিত্যকর্মের বিচিত্র দিক নিয়ে এত প্রবন্ধ অন্য কেউ লিখেছেন বলে আমার জানা নেই।
বাঙালি পাঠকদের দৃষ্টি এড়িয়ে যায় এবং তাদের মনে কোনো কৌতূহল জাগায় না, এমন বহু দিকের প্রতি নজর দিয়েছেন সিলি এবং র্যাডিচি দুজনই, র্যাডিচিই বেশি। মনে পড়ছে সিলি তাঁর একটি প্রবন্ধে দেখিয়েছিলেন যে মুখে রামের প্রতি অশ্রদ্ধা এবং রাবণের প্রতি প্রশংসা প্রকাশ করলেও, মাইকেলের উপমাগুলো বিশ্লেষণ করলে লক্ষ করা যায় যে তিনি বিস্তর জায়গায় রামের ওপর রীতিমতো গৌরব আরোপ করেছেন; অপরপক্ষে তুচ্ছতা প্রকাশ করেছেন রাবণের প্রতি। উপমা-অলংকার বিশ্লেষণ করে প্রায় দেড় শতাব্দীতেও এ রকম উপসংহারে পৌঁছাতে পারেননি কোনো বাঙালি সমালোচক। যেমন ভিনজাতি-ভীতির সঙ্গে র্যাডিচি ভিন্নজাতি-প্রীতিও দেখিয়েছেন একটি প্রবন্ধে। অন্য একটি প্রবন্ধে বিশ্লেষণ করেছেন ইতালীয় প্রভাব। মেঘনাদবধকাব্য বুঝতে এসবই সাহায্য করেছে বাঙালি পাঠকদের।
মেঘনাদবধকাব্য লিখতে শুরু করার সময় থেকে প্রকাশিত হওয়ার পর পর্যন্ত রাজনারায়ণ বসুকে লেখা অনেকগুলো চিঠির মাধ্যমে মাইকেল উচ্চকণ্ঠে ঘোষণা করেছিলেন যে তাঁর ওপর প্রবলভাবে ছাপ ফেলেছে ইউরোপীয় ধ্রুপদী সাহিত্য। এ কাব্যের কোনো কোনো জায়গায় বিষয়বস্তুর কল্পনায় এবং কোথাও কোথাও উপমা-অলংকারও তিনি ধার করেছিলেন ইউরোপীয় কবিদের রচনা থেকে। মূলে কী ছিল এবং তিনি কতটুকু পরিবর্তন করে নিয়েছেন, তাও কবি রীতিমতো দৃষ্টান্ত দিয়ে দেখিয়েছিলেন। তা না হলে তিনি কোথায় কোথায় প্রভাবিত হয়েছিলেন, ইউরোপীয় ধ্রুপদী কবিদের রচনার ঠিক কোন জায়গাটা দিয়ে, সমালোচকেরা তা অত সহজে বলতে পারতেন না। হয়তো পারতেনই না। একমাত্র ব্যতিক্রম ইংরেজ কবি জন মিল্টন। বাঙালি পাঠকেরা মিল্টন পড়তে পারেন। সে কারণে তাঁর প্রভাব কোথায় পড়েছে, সমালোচকদের পক্ষে তা আবিষ্কার করা অসম্ভব ছিল না। কিন্তু ইতালিয়ান আর ল্যাটিন ভাষায় হোমার, দান্তে, ভ্যর্জিল অথবা তাসো পড়ে এই ধ্রুপদী কবিদের প্রভাব আবিষ্কার করার ক্ষমতা সাধারণ বাঙালি পাঠক অথবা অনেক সমালোচকের ছিল না।
সুতরাং সমালোচকেরা তাঁদের প্রবন্ধে অথবা গ্রন্থে ইউরোপীয় প্রভাবের কথা লিখলেও সত্যি সত্যি মিল-অমিলের পরিমাণ অথবা ধরন পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বিশ্লেষণ করে দেখাতে পারেননি। সেই দুরূহ কাজটা করেছেন উইলিয়াম র্যাডিচি। ইউরোপীয় কবিদের রচনা উদ্ধৃতি দিয়ে বিচার-বিশ্লেষণ করে তিনি এই সাদৃশ্যের মাত্রা এবং স্বরূপ বুঝিয়ে দিয়েছেন তাঁর আগেকার প্রবন্ধগুলোতে এবং এবারের অনূদিত মেঘনাদবধের টীকাটিপ্পনীতে। তাই তাঁর প্রবন্ধগুলো এবং অনূদিত মেঘনাদবধের টিকাটিপ্পনীগুলো অমূল্য বলে বিবেচিত হতে পারবে বাঙালি পাঠকদের কাছে।
র্যাডিচি নিজে কবি এবং ভাষাবিদ পণ্ডিত। এ পর্যন্ত বাংলা ভাষা থেকে যাঁরা ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন তাঁদের মধ্যে তিনি সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ বলে আমার মনে হয়। তিনি অনুবাদ করতে গিয়ে কেবল মূল কথাগুলোর অনুবাদ করেন না। বাংলা ভাষার ভাব এবং ধারণাকেও ইংরেজিতে সার্থকভাবে আমদানি করেন। হেক্টর-বধের ভূমিকায় মাইকেলও অনুবাদের এই চরিত্রের কথা উল্লেখ করেছিলেন। ‘বিদেশি একখানি কাব্য দত্তক পুত্ররূপে গ্রহণ করিয়া আপন গোত্রে আনা বড় সহজ ব্যাপার নয়, কারণ তার মানসিক ও শারীরিক ক্ষেত্র হইতে পর বংশের চিহ্ন ও ভাব সমুদায় দূরীভূত করিতে হয়।’ র্যাডিচি সেটা অনেকাংশে পেরেছেন বলে মনে হয়।
১৯৮৪ সালে তিনি তখন রবীন্দ্রনাথের ৪৮টি নানা জাতের কবিতার অনুবাদ করেছিলেন, তখনো সেই অনুবাদ থেকে মূল রবীন্দ্রনাথের স্বাদ পেয়েছিলাম। ধরা যাক তাঁর ‘শাজাহান’ কবিতা পড়লে মূলের ছন্দটা এসে অশ্রুত শ্রবণে স্পন্দন জাগায়। তাঁর পোস্ট অফিসের অনুবাদ পড়তে গিয়ে মনে হয়েছিল মূল নাটকের সংলাপগুলোই শুনতে পাচ্ছি।
বস্তুত রবীন্দ্র-কবিতার র্যাডিচির করা অনুবাদ প্রকাশিত হওয়ার পর ইংরেজ পাঠকদের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ আবার নতুন করে জীবন লাভ করেছিলেন। প্রসঙ্গত, মনে করা যেতে পারে যে রবীন্দ্রনাথ নোবেল পুরস্কার পাওয়ার পর তাঁর কয়েকটা কবিতা অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় প্রকাশিত ইংরেজি কবিতার সংকলনে অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল। কিন্তু তার পরবর্তী সংস্করণে রবীন্দ্রনাথ বর্জিত হয়েছিলেন। ক্যাথলিন রেইন (১৯০৮-২০০৩) বিশ শতকের শেষ ভাগের নামকরা কবি ও সমালোচক। তিনি র্যাডিচির অনুবাদ পড়ে সমালোচনায় লিখেছিলেন যে রবীন্দ্রনাথ কত বড় কবি ছিলেন সেটা তাঁর ঠিক জানা ছিল না। কিন্তু র্যাডিচির অনুবাদ পড়ে তিনি উপলব্ধি করতে পেরেছেন যে ইয়েটস আর রবীন্দ্রনাথ ছিলেন বিশ শতকের সবচেয়ে প্রধান দুই কবি। র্যাডিচির মেঘনাদবধকাব্যের অনুবাদ পড়েও হয়তো ইংরেজি ভাষাভাষী পাঠক সম্প্রদায় জানতে পারবেন এবং অনুভব করবেন যে মাইকেল মধুসূদন দত্ত নামে একজন বাঙালি কবি ছিলেন, বাঙালির ঘরে জন্ম নিলেও মনেপ্রাণে যিনি ছিলেন আন্তর্জাতিক ভাবধারা দিয়ে উদ্বুদ্ধ।
মাইকেল একদিন একজন শ্রেষ্ঠ ইংরেজ কবি হওয়ার আশা প্রকাশ করেছিলেন। ক্যাপটিভ লেডি প্রকাশিত হওয়ার পর তা লন্ডন থেকে পুনঃপ্রকাশের স্বপ্নও দেখেছিলেন। কিন্তু কোনো বাসনাই তাঁর পূরণ হয়নি। ইংরেজ পাঠকেরা জানেনই না মাইকেল মধুসূদন ডাট নামে একজন কবি ছিলেন। পোশাক-পরিচ্ছদে, কথাবার্তায়, ভাবভঙ্গিতে, বচনবাচনে, পানভোজনে ইংরেজ সাজলেও যিনি খোদ ইংল্যান্ডে ইংরেজ কবি বলে পরিচিত হতে পারেননি, এমনকি একজন কবি বলেও নন। ক্যাপটিভ লেডি যাতে ব্রিটিশ মিউজিয়াম লাইব্রেরিতে রাখা হয় তার জন্য তিনি প্রচ্ছদের ওপর নিজের নামের নিচে হাতে লিখে দিয়েছিলেন ‘অব বিশপস কলেজ, ক্যালকাটা’। আমার ধারণা, র্যাডিচির অনুবাদ থেকে এতকাল পরে মাইকেলের বাসনা চরিতার্থ হবে—ইংরেজ পাঠকেরা অন্তত জানতে পারবেন তিনি একজন কবি ছিলেন—এমনকি বড় কবি ছিলেন।
র্যাডিচির অনুবাদের প্রধান গুণ: অনুবাদের মাধ্যমেই তিনি মূলের ভাষা, ছন্দ এবং আবহের স্বাদ দিতে চেষ্টা করেন। মেঘনাদের অনুবাদও কোনো ব্যতিক্রম নয়। ‘সব লাল হো জায়গা-সব ব্ল্যাঙ্ক ভার্স হো জায়গা’ বলে মাইকেলের সগর্ব ঘোষণার কথা মনে রেখেই র্যাডিচির লেখার একটা ভঙ্গির কথা ভাবতে হয়েছে। এর আগে বাংলার অনুকরণে সিলি চৌদ্দ মাত্রার ছন্দে তাঁর অনুবাদ করেছিলেন। কিন্তু তাতে ব্ল্যাঙ্ক ভার্সের ধ্বনি প্রবাহ, ছন্দের স্পন্দন অথবা স্পিরিট—কোনোটিই তেমন প্রকাশ পেয়েছিল বলে মনে হয় না। বস্তুত মাত্রার হিসাব মেনে লিখলেও সিলির রচনা আদৌ কবিতা হয়ে উঠেছিল কি না তাতেই সন্দেহ আছে। অপরপক্ষে র্যাডিচি চৌদ্দ মাত্রার মতো কোনো বন্ধন মানেননি। তাঁর পঙিক্তগুলো বৃক্ষের ডালপালার মতো ছোট, বড়, মাঝারি নানা মাপের। এর ফলে মহীরুহের মতো একটা স্বাভাবিক সৌন্দর্য ফুটে উঠেছে—চৌদ্দ মাত্রার শৃঙ্খল পরিয়েও সিলি যা করতে পারেননি। পঙিক্তর বিভিন্ন রকমের দৈর্ঘ্য বস্তুত মূলের বিরতি এবং যতিবিন্যাসকে মনে করিয়ে দেয়। সর্বত্র শুনতে পাওয়া যায় মূলের প্রতিধ্বনি। প্রতিটি পঙিক্তর দৈর্ঘ্যের একটাই সংজ্ঞা দেওয়া যায়—প্রতিটি পঙিক্ততে আছে তিনটি করে অনুবাক্য। মেঘনাদবধের একেবারে সূচনার কথাই মনে করা যাক:
সম্মুখ সমরে পড়ি, বীর-চূড়ামণি বীরবাহু,/ চলি যবে গেলা যমপুরে অকালে,/ কহ, হে দেবি অমৃতভাষিণী/ কোন বীরবরে বরি সেনাপতি-পদে,/ পাঠাইলা রণে পুনঃ রক্ষঃকুলনিধি/ রাঘবারি?
র্যাডিচি এর অনুবাদ করতে গিয়ে লিখেছেন:
When Virbahu, crest-jewel of heroes, fell in open combat,/ And went on his untimely way to yama’s city, say, O ambrosia-speaking goddess,/ Which hero of heroes did Raghav’s enemy, the fount of the Raksha race, appoint to the post of general,/ And send once more into battle?
এ পর্যন্ত যে দৃষ্টান্ত দেখলাম তাতে crest-jewel of heroes; ambrosia-speaking goddess; which hero of heroes did Raghav’s enemy; the fount of the Raksha race ইত্যাদি অনুবাক্য পড়ে একে শব্দপ্রধান বলে মনে হওয়াই স্বাভাবিক। কিন্তু তার কারণ মূলেই এই শব্দাড়ম্বর আছে বিষয়বস্তুর সঙ্গে সাদৃশ্য বজায় রাখার জন্য। র্যাডিচি সেই ভঙ্গিই অনুকরণ করতে চেয়েছেন—ভূমিকায়ই সে কথা পরিষ্কার উল্লেখ করেছেন। তাঁর এই স্টাইল ও ভাষা সাম্প্রতিক ইংরেজির মতো নয়। এর মধ্যে আছে আগের যুগের আমেজ। আরও একটি দৃষ্টান্ত দেওয়া যেতে পারে:
এ হেন সভায় বসে রক্ষঃকুলপতি,/ বাক্যহীন পুত্রশোকে ঝর ঝর ঝরে/ অবিরল অশ্রুধারা-তিতিয়া বসনে/ যথা তরু তীক্ষ শর সরস শরীরে/ বাজিলে, কাঁদে নীরবে। কর যোড় করি,/ দাঁড়ায় সম্মুখে ভগ্নদূত, ধূসরিত ধুলায়, শোণিতে আর্দ্র সর্ব্ব কলেবর।
এর অনুবাদ করতে গিয়ে র্যাডিচি লিখেছেন:
In such a chamber sits the lord of the Raksha race, speechless with grief for his son! An incessant stream of tears drips down in drops,/ Soaking his robe, just as a tree, if a keen arrow strikes its juicy body/ Weeps silently. With hands claspsed, a messenger of defeat stands before him,/ Grey with dust, his whole frame wet with blood. Of the hundreds of soldiers who sank,/ With Virbahu, in the ocean of battle only one hero survives./
এখানেও র্যাডিচি ব্যবহার করেছেন ধ্বনিপ্রধান শব্দাবলি। তাঁর এই ভাষা এবং ভঙ্গি একদিকে সাযুজ্যপূর্ণ মহাকাব্যের অনুবাদের জন্য, অন্যদিকে সংগতিপূর্ণ মাইকেলের স্টাইলের জন্য।
বাঙালি পাঠকেরা ইংরেজ অনুবাদের মধ্য দিয়ে মেঘনাদবধকাব্যের স্বাদ লাভ করতে আগ্রহী হবেন বলে আমার তেমন ভরসা হয় না। বরং তাদের মধ্যে যাঁরা সমালোচক তাঁরা র্যাডিচির অনুবাদ পড়ে তাঁর মধ্যে মূলের সঙ্গে কোথাও সামান্যতম অমিল দেখা যায় কি না তা আবিষ্কারে আগ্রহী হবেন। দাঁড়ি-কমার ভুল ধরা সহজ এবং এ রকমের ভুল থাকলে রক্ষা নেই। এ ধরনের ভুল চোখে পড়তে পারে, পড়া স্বাভাবিক। এসব দেখে র্যাডিচির অনুবাদ যে সঠিক হয়নি এবং কোনো বিদেশির পক্ষেই বাংলা থেকে উৎকৃষ্ট অনুবাদ করা সম্ভব নয়, এ কথা ঘোষণা করে সমালোচকেরা তৃপ্তি লাভ করতে পারেন। কিন্তু নির্দ্বিধায় বলতে পারি সে রকমের নেতিবাচক পাঠক-সমালোচকদের জন্যও মূল্যবান অনেক বস্তু আছে এই অনুবাদে।
সবার আগে আছে এর ভূমিকায় মাইকেলের সংক্ষিপ্ত কিন্তু অন্তর্দৃষ্টিপূর্ণ একটি পরিচিতি। সেই পরিচিতিতে সন-তারিখের কচকচানি নেই কিন্তু আছে মাইকেলের অসামান্য চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য নিয়ে অনবদ্য আলোচনা। যেমন বাঙালি পাঠকেরা বিশেষ লক্ষ না করলেও মাইকেলের কৌতুকবোধ র্যাডিচির কাছে অত্যন্ত আকর্ষণীয়।
তিনি তাঁর ভূমিকা সাজিয়েছেন মেঘনাদবধকাব্যের সূচনায় যে নকশাচিত্র আছে তার আদলে। এই নকশাচিত্রে আছে মধ্যখানে সূর্য, তার বাঁয়ে একটি হাতি আর ডানে একটি সিংহ। এ চিত্রের যে কোনো গুরুত্ব থাকতে পারে বাঙালি পাঠক-সমালোচকেরা তা সম্ভবত কোনো দিন ভেবেও দেখেননি। কিন্তু র্যাডিচি এই প্রতীকের মধ্যে দেখতে পেয়েছেন মেঘনাদবধকাব্য তথা মাইকেলের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যকে। সূর্যের সঙ্গে তিনি তুলনা করেছেন মাইকেলের জীবন, ব্যক্তিত্ব ও প্রতিভাকে। সিংহ হলো ইউরোপের প্রতীক। এই অংশে র্যাডিচি দেখিয়েছেন, ইউরোপীয় ভাবধারা কীভাবে কবিকে একেবারে নিমজ্জিত করেছিল এবং তিনি কীভাবে সেই প্রভাবকে আত্মসাৎ নয়, একেবারে নিজের করে নিয়েছিলেন। ইউরোপের আধুনিকতা, তেজ ও কর্মদক্ষতার সঙ্গে মিলেছিল ভারতীয় ঐতিহ্য। কবি হাতিকে ব্যবহার করেছিলেন ভারতের প্রতীক হিসেবে। এই তিন অংশে প্রায় ১০০ পৃষ্ঠা ধরে র্যাডিচি মাইকেলের ব্যক্তিজীবন এবং মনোজীবন ফুটিয়ে তুলেছেন, যা পাঠককে এই কাব্যের আস্বাদ নিতে সাহায্য করবে। তাঁর ব্যাখ্যাই চূড়ান্ত এবং অভ্রান্ত—সে কথা বলছি না, কিন্তু মেঘনাদবধকাব্যের এ যাবৎ দেওয়া সব পুনর্ব্যাখ্যার সেরা এই অনুবাদ। কাব্যের কোন কাণ্ডে কী আছে, তার সংক্ষিপ্ত পরিচিতি এবং মাইকেল-জীবনের ঘটনাপঞ্জির তালিকা দেওয়ার পর র্যাডিচি মূল অনুবাদে প্রবেশ করেছেন। ৩ থেকে ৩০০ পৃষ্ঠা পর্যন্ত বিস্তৃত এই অনুবাদ।
এই অনুবাদ বাঙালি পাঠক পড়তে পারেন অথবা নাও পড়তে পারেন। কিন্তু পড়লে লাভবান হবেন। আমরা যখন রাঘব বলি তখন কি তার অর্থের কথা মনে রাখি? অথবা রাঘবারি বললে তার অর্থের কথা? রাঘব বললে অর্থের কথা না ভেবে আমরা এককথায় রামকে বুঝি; রাঘবারি বললে বুঝি রাবণকে। কিন্তু র্যাডিচির অনুবাদ পড়লে উপলব্ধি করতে পারি, কেবল ছন্দের কথা মনে রেখে নয়, মধুসূদন কীভাবে ব্যঞ্জনার কথা মনে রেখে স্পর্শকাতর হূদয় নিয়ে তাঁর শব্দাবলি বেছে নিয়েছিলেন। পদে পদে পাঠকের কাছে নতুন দ্যোতনা নিয়ে ধরা পড়বে নতুন এক মেঘনাদবধকাব্য।
তা ছাড়া অমূল্য বলে মনে হবে ৩০১ থেকে ৩৯৭ পৃষ্ঠা পর্যন্ত টীকাটিপ্পনীকে। এখানে আছে মধুসূদনের ওপর অন্যান্য ধ্রুপদী কবির যেসব প্রভাব পড়েছে তার বিস্তারিত পরিচয়। এর কথা বাঙালি পাঠকেরা শুনেছেন কিন্তু দেখেননি। এই অংশ তাই এত মূল্যবান যে আমার ধারণা, বাংলায় এর অনুবাদ প্রকাশ করা বাঞ্ছনীয়। প্রকাশ করলে দেখা যাবে, মাইকেলের ওপর কোথায় কোথায় প্রভাব পড়েছিল একদিকে কালিদাস আর ব্যাসের; অন্যদিকে মিল্টন, হোমার, দান্তে, ভার্জিল আর তাসোর। কেবল কোথায় নয়, সেই সঙ্গে দেখা যাবে সে প্রভাব কীভাবে পড়েছিল এবং কবি তার কী ব্যাখ্যা দিয়ে তাকে কতটা নিজের মতো করে নিয়ে ব্যবহার করেছিলেন। নির্ঘণ্টটিও অত্যন্ত মূল্যবান। এখানে পাঠক একনজরে আগে থেকেই জানতে পারেন, কোন সর্গের কোন জায়গায় কোন চরিত্রের সঙ্গে দেখা মিলবে।
আমার ধারণা, এ পর্যন্ত যেসব অনুবাদ প্রকাশিত হয়েছে তার মধ্যে র্যাডিচির অনুবাদ কেবল সবচেয়ে ভালো এবং এককথায় চূড়ান্ত অনুবাদই নয়, বরং কেউ মেঘনাদবধকাব্য পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পড়ে নতুন করে স্বাদ নিতে চাইলে র্যাডিচির অনুবাদ পড়তে পারেন। দু-একটা মুদ্রণপ্রমাদ আছে ভূমিকায়। আগেই বলেছি, বাঙালি সমালোচকেরা লিখতে যেমনই পারুন, মোচা যম। দাঁড়ি-কমার ভুল তাঁদের চোখে পড়বেই, হয়তো সহজেই পড়বে। কিন্তু তাতে র্যাডিচির অনুবাদের শ্রেষ্ঠত্ব একটুও ম্লান হবে না।
মাইকেল ছিলেন বাংলা ভাষায় প্রকাশিত একমাত্র মহাকাব্যের সফল কবি। কিন্তু তাঁর অবদান কেবল এই মহাকাব্যের মধ্যে সীমিত নয়। তিনি বাংলা ভাষায় প্রথম সার্থক নাটক রচনা করেছিলেন। প্রথম ব্ল্যাংক ভার্স সাফল্যের সঙ্গে প্রয়োগ করেছিলেন। প্রথম বলিষ্ঠ একটি নারীবাদী পত্রকাব্য রচনা করেছিলেন। নতুন করে ‘মিসেস রাধা’কে নিয়ে বৈষ্ণব পদাবলি লিখেছিলেন। রচনা করেছিলেন বাংলা ভাষায় প্রথম এবং এ পর্যন্ত সর্বশ্রেষ্ঠ সনেট। বঙ্গীয় রেনেসন্সের স্পিরিট সবচেয়ে ঘনিষ্ঠভাবে তাঁর পাঁচটি কাব্যে ফুটিয়ে তুলেছিলেন। নির্মাণ করেছিলেন নিজের কাব্যভাষা। তিনি ছিলেন বাংলা ভাষার প্রথম আধুনিক কবি। আর তাঁর ব্যক্তিত্ব? তা ছিল অতুলনীয়, একক এবং বর্ণাঢ্য। অনেকের ভিড়ে তিনি ছিলেন একজন, একক জন। প্রতিভা ও পাণ্ডিত্যের দ্যুতিতে তাঁর কোনো তুলনা নেই। জীবদ্দশাতেই তিনি তাই পরিণত হয়েছিলেন কিংবদন্তিতে।
চন্দ্রসূর্য আকাশে ওঠে প্রতিদিন—মাঝেমধ্যে তারাও চমক লাগায়; কিন্তু আকাশে যখন ধূমকেতুর আবির্ভাব ঘটে, তখন বিস্ময়ে সবাই তার দিকে তাকায়। মাইকেল নিজেই বলেছিলেন, তিনি আবির্ভূত হয়েছিলেন ধূমকেতুর মতো। সাহিত্যগগনে তাঁর অবস্থানও ছিল ধূমকেতুর মতোই স্বল্পকালীন।
তাঁর শ্রেষ্ঠ রচনা মেঘনাদবধকাব্য পাঠ্যপুস্তকের বাইরে কম লোকেই পড়েছেন। তা সত্ত্বেও কাব্যটির আজও সংস্করণ হয়, আজও তার অনুবাদ প্রকাশিত হয়। বাংলা সাহিত্যের এই অনন্য কাব্যের শতবর্ষপূর্তি হলো এবার। এ উপলক্ষে একটি ইংরেজি সংস্করণের মাধ্যমে হয়তো এই প্রথমবারের মতো তিনি বড় কবি বলে স্বীকৃতি পাবেন ইংরেজি পাঠককুলের মধ্যে। নবরূপে মেঘনাদ মাইকেলের প্রতি এবং সার্ধশতবর্ষে মেঘনাদবধকাব্যের প্রতি সত্যিকারের উপযুক্ত উপহার। বাঙালিদের তরফ থেকে মাইকেলকে সেই উপহার দিলেন উইলিয়াম র্যাডিচি।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, মে ১৩, ২০১১
Leave a Reply