জীবন ও মৃত্যুর তুল্যবিচারে মৃত্যু সহজ। দুঃখ-কষ্ট, বিপদ-আপদ, জ্বালা-যন্ত্রণা, জীবনে বহমান। মৃত্যু তা থেকে মুক্তি দেয়। অমোঘ বাস্তবতা হলো জীবন যোজন-যোজন স্বপ্ন-সম্ভাবনাকে ধারণ করে। জীবন থেকে তৈরি হয় আগুন, যার নিরিখে ব্যক্তি নন্দিত কিংবা নিন্দিত হয়। ইতিবাচক কিংবা নেতিবাচক মাত্রা নিরূপিত হয়। দ্বিবিধ এই প্রক্রিয়ার মধ্যেই কারও জীবন হয় আগুনের পরশমণি। তবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আহ্বান, আগুনের পরশমণি ছোঁয়াও প্রাণে। ইলা মিত্র হলো আগুনের পরশমণির অনন্য এক উদাহরণ। নানা চড়াই-উতরাই আর প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে যিনি নিজের বিশ্বাস ও আদর্শকে উচ্চকিত ও মহিমান্বিত করেছেন। কৃষিপ্রধান এই শ্যামল মৃত্তিকার অবিস্মরণীয় চরিত্র ইলা মিত্রকে বিস্তৃত পরিসরে জানার সুযোগ করে দিয়েছেন মালেকা বেগম। তাঁর বই ইলা মিত্র: নাচোলের তেভাগা নেত্রীতে।
বাঙালির কয়েক শ বছরের কৃষক বিদ্রোহ ও সংগ্রামের ইতিহাসে তেভাগার ঐতিহাসিক গুরুত্ব অপরিসীম। কৃষকের অধিকার আদায়ের এই সংগ্রামে ইলা মিত্র পালন করেছিলেন অগ্রণী ভূমিকা; যার তুলনা শুধু তেভাগা নয়, শ্রমজীবী সর্বহারা মানুষের অধিকার পূরণের অন্যান্য লড়াই-সংগ্রামের বিচারেও বিরল দৃষ্টান্ত। ইলা মিত্র জীবনভর এ লড়াইয়ে স্থিত ছিলেন। ১৯২৫ সালের ১৮ অক্টোবর তাঁর জন্ম। মৃত্যু ১৩ অক্টোবর ২০০২। ৭৭ বছরের যাপিত জীবনে তিনি স্থাপন করেছেন অনন্য এক নজির। অন্যায়-অত্যাচারের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের অধিকার আদায়ে, কৃষকের ন্যায্য দাবি প্রতিষ্ঠায় তাঁর সংগ্রামী ভূমিকা কিংবদন্তিতে পরিগণিত হয়েছে।
মালেকা বেগম আলোচ্য বইয়ের ভূমিকায় উল্লেখ করেছেন: ‘গল্পকারের লেখনীতে, সাংবাদিকের রিপোর্টে, শিল্পীর তুলিতে নির্বাক, দৃঢ়চেতা ইলা মিত্র বারবার সংগ্রামের প্রতীক হয়েই আমাদের চেতনায় ধ্বনিত করে জীবনের জয়গান। ইতিহাস ইলা মিত্রকে কখনো দাঁড় করায় নাচোলের মাঠে কৃষকের ঘরে ঘরে মূর্তিমতী রানিরূপে, পরক্ষণেই কৃষক বিদ্রোহের নেত্রীরূপে।’
ইলা মিত্রের জন্ম ও মৃত্যু ওপার বাংলায়। তবে জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সময়টা কেটেছে বর্তমান বাংলাদেশ ভূখণ্ডে। নাচোলের তেভাগা আন্দোলনের নেত্রী হিসেবে তাঁর যে পরিচয়, তার পুরোটাই হয়ে ওঠা বর্তমান বাংলাদেশ ভূখণ্ডে।
লেখক-গবেষক-নারীনেত্রী মালেকা বেগমের লেখার মূল ফোকাসও এখানে। অবশ্য তাঁর জীবনের সামগ্রিক দিকও তিনি সংক্ষিপ্ত পরিসরে উপস্থাপন করেছেন। এতে ইলা মিত্রের পূর্ণাঙ্গ পাঠ সম্ভবপর হয়েছে। লেখকের সঙ্গে তাঁর চিঠিপত্রে যোগাযোগ শুধু নয়, ব্যক্তিগত ঘনিষ্ঠতাও ছিল, যা বইটিকে প্রামাণ্য রূপদানে সহায়তা করেছে। ইলা মিত্রের ব্যক্তি, পারিবারিক ও রাজনৈতিক জীবনসহ লড়াই-সংগ্রামের চিত্র যেমন রয়েছে, তেমনিভাবে রয়েছে তাঁকে নিয়ে রচিত কবিতা, ছড়া, গল্প, বিখ্যাতজনদের ডায়েরির স্মৃতিচারণ প্রভৃতি। লেখক এখানে গবেষক ও সংগ্রাহক হিসেবে রীতিমতো ঈর্ষণীয় ভূমিকা পালন করেছেন। ইলা মিত্রের দালিলিক উপস্থাপন হিসেবে বইটির গুরুত্ব অপরিসীম। তথ্য-উপাত্তের দুর্লভ সমাহারের সঙ্গে এখানে যুক্ত হয়েছে বিশ্লেষণ ও মূল্যায়নের যৌথ প্রয়াস। রয়েছে ট্রাভেলগের ভূমিকা, যা একজন গবেষকের জন্য মৌল পাঠ। লেখকের বর্ণনায় যা অঙ্কিত হয়েছে এভাবে:“একদা ছড়িয়ে পড়া লোকগীতির সুর এখনো শোনা যাবে, চাঁপাইনবাবগঞ্জের নাচোলের প্রান্তরে, যদি কান পাতা যায়: ‘লীলা মৈত্রী নারী/ আইন করল জারি/আধি জমি তেকুটিভাগ/ জিন হলো সাত আড়িয়ে ভাই। জিন হলো সাতআড়ি।”
কৃষিপ্রধান দেশ বাংলাদেশ। জমিদার-জোতদার-মহাজনদের বিরুদ্ধে কৃষকের অধিকার আদায়ে ইলা মিত্র সাহসী ভূমিকা পালন করেছিলেন, যা শতবর্ষের ইতিহাসের অনির্বাণ এক অধ্যায়। আমাদের ইতিহাসচর্চায়, বিশেষ করে প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে তাঁর উপস্থিতি দুর্লক্ষ। বাংলা একাডেমীর চরিত্রাভিধানেও ইলা মিত্রের ঠাঁই হয়নি। অথচ ইলা মিত্র আমাদের জাতীয় ইতিহাসে, এই মাটি ও মানুষের আপন আদলে গড়া দেশপ্রেমিকের প্রতিনিধি হিসেবে আগুনের পরশমণিতুল্য এক চরিত্র—যা দিকে দিকে যত ছড়িয়ে যাবে, ততই আমাদের জন্য মঙ্গল। ইতিহাসমনস্ক পাঠক শুধু নন, যাঁরা জীবনে শত ফুল ফোটাতে চান, আলোর বান ডাকতে চান, তাঁদের জন্য মালেকা বেগমের লেখা এই বই অবশ্য পাঠ্য। কেননা ইলা মিত্র কীভাবে আগুনের পরশমণি হয়ে উঠলেন তার বিস্তৃত উপস্থাপনা রয়েছে এখানে। যা জীবন ঘষে আগুন তৈরীতে পালন করতে পারে মূখ্য ভূমিকা।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, মে ০৬, ২০১১
Leave a Reply