লাতিন আমেরিকার অন্যতম শ্রেষ্ঠ লেখক রোবেরতো বোলানিওকে বলা হয় বোর্হেসের যোগ্য উত্তরসূরি। রোবেরতো বোলানিওর জন্ম ১৯৫৩ সালের ২৮ এপ্রিল চিলির সান্তিয়াগোতে। বাবা ছিলেন ট্রাকচালক আর মা স্কুলশিক্ষিকা। ১৯৬৮ সালে তাঁদের পরিবার মেক্সিকো সিটিতে চলে যায় জীবিকার অন্বেষণে। বোলানিওর পড়াশোনায় ছেদ পড়ে। তিনি সাংবাদিকতা শুরু করেন, যুক্ত হন বাম রাজনীতির সঙ্গে। চিলির প্রেসিডেন্ট সালবাদর আয়েন্দের নেতৃত্বাধীন সরকারের বিপ্লবী কর্মকাণ্ডে সহযোগিতার জন্য বোলানিও ১৯৭৩ সালে চিলিতে ফিরে আসেন আর সে বছরই মার্কিন সাম্রাজ্যবাদীদের সমর্থনপুষ্ট জেনারেল পিনেশে পরিচালিত রক্তক্ষয়ী সামরিক অভ্যুত্থানে নিহত হন আয়েন্দে। ব্যাপক ধরপাকড়ে বোলানিও গ্রেপ্তার হন। পরে ছাড়া পেয়ে আবার মেক্সিকোতে ফিরে যান। ওখানে কয়েকজন কবিকে সঙ্গে নিয়ে ‘মোবিমিয়েন্তো ইনফ্রার রিয়ালিস্তা’ নামক কাব্য-আন্দোলন গড়ে তোলেন। তাঁদের আরাধ্য ছিল বিট জেনারেশন। খ্যাতনামা মেক্সিকান কবি ওক্তাবিও পাসের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিলেন তাঁরা। বোলানিও ছিলেন কবি, গল্পকার ও ঔপন্যাসিক। তাঁর গ্রন্থগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে: রোমান্টিক ডগ (কবিতা), স্যাভেজ ডিটেকটিভ, আমুলেট, বাই নাইট ইন চিলি, লাস্ট ইভনিংস অন আর্থ, দ্য ইনসাফারেবল গাউশো, দ্য সিক্রেট ইভিল, বিটুইন প্যারানথিসিস ও ২৬৬৬। ২০০৩ সালের ২৮ জুলাই বার্সেলোনায় বোলানিও মারা যান। তখন তাঁর বয়স মাত্র ৫০। তাঁর শেষ সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয় প্লেবয় মেক্সিকো পত্রিকায় সাক্ষাৎকারটি নিয়েছিলেন মনিকা ম্যারিস্টেন। পরে সেটি রোবেরতো বোলানিও: দ্য লাস্ট ইন্টারভিউ অ্যান্ড আদার কনভারসেশন বইয়ে স্থান পায়। ওই সাক্ষাৎকারের একটি অংশ এখানে পত্রস্থ করা হলো। ইংরেজি থেকে অনুবাদ করেছেন দিলওয়ার হাসান
প্রশ্ন: আপনি লেখক না হলে কী হতেন?
বোলানিও: লেখক হওয়ার চেয়ে আমি খুনখারাবি তদন্তের গোয়েন্দা হতে বেশি আগ্রহ পোষণ করতাম। এ ব্যাপারে আমি নিশ্চিত। কোথাও হত্যাকাণ্ড-টাণ্ড ঘটলে সিধে পৌঁছে যেতাম অকুস্থলে, হোক সে রাত কিংবা দিন ভূতটুতের ভয় না করেই। হয়তো সে সময় সত্যিকার একটা উন্মাদনা কাজ করত।
প্রশ্ন: শত্রুদের মুখ থেকে বিস্তর সমালোচনা শোনার পর কি আপনার কি অনুভূতি হতো?
বোলানিও: কান্না পেত ভীষণরকম, খিদে মরে যেত, কম সিগারেট খেতাম, খেলাধুলায় মগ্ন হতাম, হাঁটতে যেতাম সমুদ্রের পাড়ে; ওই জায়গাটা ছিল আমার বাড়ি থেকে ৩০ মিটারেরও কম দূরে আর গাঙচিলদের প্রশ্ন করতাম, যাদের পূর্বপুরুষেরা মাছ খেত আর তারা খেত ইউলিসিস: আমি কেন সমালোচনার বাণে বিদ্ধ হব, কেন? আমি তো তোমাদের কোনো ক্ষতি করিনি!
প্রশ্ন:কোন পাঁচটি বই আপনার জীবনে গেঁথে আছে?
বোলানিও: সত্যি কথা বলতে কী ওই পাঁচ বই পাঁচ হাজার বইয়ের চেয়েও বেশি কিছু। বর্শার ডগার মতো নামগুলো কেবল বলে যাই: দোন কিহোতে—সের্বান্তেস; মবি ডিক—মেলভিল। বোর্হেসের রচনা সমগ্র, হপসকচ—কোর্তাসার, আ কনফিডেরাসি অব ডান্সেস—টুলি। আরও কয়েকখানা বইয়ের নাম করতে চাই: নাজদা—ব্রেতোঁ, দ্য লেটার্স অব জাক ভাস, এনিথিং উবু—জারি, লাইফ: আ উয়ুজার্স ম্যানুয়াল—পার্সি, দ্য ক্যাসেল ও দ্য ট্রায়াল—কাফকা, আফোরিজমস—লিশটেনবার্গ, দ্য ট্রাকটাটাস—উইটজেনস্টেন, দ্য ইনভেনশন অব মোরেল—বিঅয় ক্যাসারেস, দ্য স্যাটাইরিকন—পেট্রোনিয়াস, দ্য হিস্ট্রি অব রোম—টিটো লিভিও ও পেনসিস—পাস্কাল।
প্রশ্ন: কে বেশি প্রিয়জন লেনন, লেডি ডি না এলভিস প্রিসলি?
বোলানিও: দ্য পোগুয়েস কিংবা আত্মহত্যা। কিংবা বব ডিলান। বেশ ভালোকথা, ভানটান না করেই বলে ফেলি নামটা—চিরকালের এলভিস প্রিসলি। এলভিস আর তার স্বর্ণ-কণ্ঠ, কাঁধে শেরিফের ব্যাজ, একটা মুসটাং গাড়ি চালাচ্ছেন আর গলাধঃকরণ করেছেন বেশ কিছু পিল…
প্রশ্ন: দুনিয়ার সবচেয়ে সুন্দরীকে দেখেছেন কখনো?
বোলানিও: হ্যাঁ, দেখেছি। সেটা ১৯৮৪ সাল। একটা দোকানে কাজ করতাম। সেদিন ভিড় ছিল না দোকানে, এক রকম ফাঁকাই ছিল বলা যায়—সে সময় এক হিন্দু মহিলা দোকানে ঢুকলেন। তিনি দেখতে ছিলেন রাজকুমারীর মতো, কিংবা তার চেয়েও সুন্দরী। তিনি কিছু পোশাক আর অলংকার কিনলেন। একটা পর্যায়ে এসে আমার মনে হলো, মূর্ছা যাব। তাঁর গায়ের রং ছিল তামাটে, দীর্ঘ কেশ আর তাঁর অন্য অঙ্গপ্রত্যঙ্গও চমৎকার। যাকে বলে চিরন্তন সুন্দরী। দাম নেওয়ার সময় ভীষণ বিব্রত হলাম। মনে হলো তিনি যেন আমার মনের কথা বুঝতে পেরেছেন, আর আমাকে ভাবতে মানা করছেন। আমার দিকে তাকিয়ে হাসলেন। তারপর চলে গেলেন তিনি। জীবনে আর কোনো দিন দেখা হয়নি তাঁর সঙ্গে। কখনো কখনো আমার মনে হয়েছে, তিনি ছিলেন দেবী কালী। ওই হিন্দু মহিলা দুনিয়ার সবচেয়ে সুন্দরী নারীই শুধু ছিলেন না—তিনি ছিলেন—খুবই নম্র আর বিনয়ী
প্রশ্ন: মৃত্যুর আগে কী কী করে যেতে চান?
বোলানিও: বিশেষ কিছু নয়। প্রথম কথা হচ্ছে—আমি মরতে চাই না। কিন্তু আজ হোক কাল হোক মৃত্যু এসে হাজির হবে।
প্রশ্ন: মরণোত্তর কাজ আপনার ভেতর কেমন অনুভূতির জন্ম দেয়?
বোলানিও: মরণোত্তর কথাটা শুনলেই রোমান গ্ল্যাডিয়েটরদের (মল্লযোদ্ধা—যারা হিংস্র পশুদের সঙ্গে লড়ত) কথা মনে করিয়ে দেয়; একজন গ্ল্যাডিয়েটর যাকে কখনো পরাস্ত করা যায়নি। অন্তত একজন দরিদ্র মরণোত্তর তাই বিশ্বাস করতে চায়। এটা তাকে সাহস জোগায়…।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, মে ০৬, ২০১১
জালাল আহমেদ
ভালো