রোজ ভোরে উঠে তিনি মহামহিয়ান ঈরম আইকনের সামনে দাঁড়িয়ে প্রার্থনা করেন, আমি তোমার অসীম শক্তিতে বিলীন হয়ে হতে চাই দুনিয়ায় তোমারই মতন সর্বদ্রষ্টা, সর্বগামী, সর্বশক্তিমান। আমাকে তুমি তোমাতে বিলীন হতে দাও কিংবা তুমি তোমার সব গুণাবলিসমেত আমাতে আছর হও। তাহলে আমি যেকোনো সময় যেকোনো মানুষের, প্রয়োজনে শয়তানের রূপ ধরে যা ইচ্ছা তাই করতে পারি।
এভাবে তিনি প্রার্থনায় এবং কর্মে ঈরমচর্চায় লিপ্ত থাকেন। তিনি তাঁর অতিকায় সাদা ভবনের চূড়ায় দাঁড়িয়ে দেখেন তাঁর একচ্ছত্র আধিপত্যের দুনিয়ায় কোথাও কোনো পাতা নড়ে কি না বা কোনো পতঙ্গ ওড়ে কি না তাঁর হুকুম কিংবা ইচ্ছার বাইরে। আসলে তিনি রাজহাঁসের মতো উদ্ধত সাদা তাঁর জগদ্বিখ্যাত দপ্তর ভবনের চূড়ায় উঠে নিশ্চিন্ত হতে চাইলেন এই দেখে যে তাঁর ইচ্ছার বাইরে দুনিয়ার কোথাও কোনো পাখি গান গায় না, তাঁর এমন শুভ্র ভবনে কলঙ্কের দাগ বা ছায়া পড়ার ভয়ে এই দিক করে কেউ তর্জনীও তোলে না। কিন্তু তিনি দেখেন এমন সব আচরণ তো তুচ্ছ, তাঁকে তাক করে ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়া থেকে পারমাণবিক বিস্ফোরণ—কী না হচ্ছে পাজি-পাজুরাদের ওই মর্ত্যে! কত জায়গায় কত গোপনে যে জঙ্গিরা তাঁর ওপর বোমা কি প্লেন নিয়ে হামলে পড়ার ষড়যন্ত্রে ব্যস্ত! ওদের তিনি দেখেন ঠিকই কিন্তু নির্ধারণ করতে পারেন না, তারা এই মহাসাগর বা দুনিয়ার ঠিক কোথায়—তারা সব এমনিই ক্যামুফ্লাজ করে আছে। তারা সব যে কৌশলেই ঘাপটি মেরে থাক, তিনি অন্তত তা দেখেন কিন্তু তাঁর জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ইউল্যান্ড ইন্টেলিজেন্স—ইউআই যে কী দেখে তাই তাঁর মাথায় আসে না। এসবের জন্য কত না অর্থ ঢেলে নির্মাণ করা হয়েছে বিশাল উপগ্রহ বহর, দুনিয়াজোড়া ইলেকট্রনিক নজরদারি। তারা ব্যবহার করছে এমন ডিজিটাল সিস্টেম যার মাধ্যমে যেকোনো দ্বীপের যে কারও সেলফোন, ল্যাপটপ যোগাযোগ ইন্টারসেপ্ট করা যায়। অথচ তারা কিনা তাঁর শত্রুদের ওসব না দেখে একদম ঠিক দেখল রেবেকার ওপর তাঁকে, তার মধ্যে শুক্রপাতের দৃশ্যসমেত। এমনকি শেষে তাদের হাতে তাঁর স্খলিত শুক্রের বাস্তব নমুনা। ওদিকে রেবেকার সুবৃহৎ স্তনসমেত উদ্ভিন্ন বেসামাল শরীর নানা প্রচারমাধ্যমে সচল-সবাক হয়ে সারা দুনিয়ার মানুষের কাম-খিদাকে একটা গোলমালের মধ্যে ঠেসে দেয়। এই সবকিছুর নাটের গুরু অবশ্য ঈরমবাদীরা। এদের রুখতে তাঁকে উপর্যুপরি ঈরমালয়ের প্রার্থনা সভায় যোগ দিয়ে ঘোষণা দিতে হয়, আমি সাচ্চা ঈরমি যেমনটি সুদূর বাংলার মুসলমানদের একদা হানাদার পাঞ্জাবিদের সামনে লুঙ্গি তুলে খতনা দেখিয়ে প্রমাণ দিতে হয়, আমি হিন্দু নই।
এমন শত্রু শুধু ঘরের বিভীষণ! তাঁর জোটবদ্ধ দ্বীপে দ্বীপেও তারা মাথা তুলছে মুক্তবাজার, ইমিগ্র্যান্ট-বিরোধিতা আর ধর্মীয় জাতীয়তাবাদকে পুঁজি করে। ঈফাই জঙ্গিদের চেয়ে এরাই তাঁর বড় আতঙ্কের কারণ হতে পারে। সম্প্রতি তাদেরই এক সাইবার-যোদ্ধা তাঁর আধিপত্য কায়েমের কূটকৌশলের নানা গুরুত্বপূর্ণ রেকর্ড অনলাইনে প্রকাশ করে সারা দুনিয়ায় হইচই ফেলে দিয়েছে। মার্টিন প্রশাসন যে শ্যামদ্বীপে জনবসতি উচ্ছেদ ও পরিবেশের সর্বনাশ করে বিগপন্ড কয়লাখনি থেকে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে মাইনিং করতে দিতে সূঈ সরকারকে কেমনে বাধ্য করেছে তার হাঁড়ি সে হাটে ভেঙেছে।
এর মধ্যে সবচেয়ে নাজুক তথ্যটা হচ্ছে গ্রিন ওশানে কমিউনিজমের বিস্তার ঠেকাতে যে ঈরা মুনকে গণতন্ত্রের মানসকন্যা বলে শান্তি পুরস্কার দিয়ে ক্ষমতাবান করে দ্বীপের সেনাশাসনের পতন ঘটানো হলো তাঁকেই তাঁর ইউআই মাইনাস করে ফেলার উদ্যোগ নিল! তা ছাড়া বড় সব নেতা-নেত্রীর ক্যারিয়ার ধ্বংস। তাতে ইউআইয়ের বিশ্বাস, শ্যামদ্বীপ অন্ধ হবে, তাকে পথ দেখানোর কেউ থাকবে না।
তো এই বিভীষণদের মার্টিন কী করেন!
এদিকে শুধু তাঁর জন্মভূমি ঊষা নয়, গ্রিন ওশানের কোন দ্বীপে কোন প্রশ্নে তাঁর ভূমিকা কী হওয়া উচিত তা নিয়ে লিপ্ত আছে হাজার হাজার গবেষক। এ ক্ষেত্রে তাঁর ইউ গবেষককে সহায়তা দিচ্ছে সংশ্লিষ্ট দ্বীপের চতুর বাঘা বাঘা সব বিশেষজ্ঞ। তারা তাদের সার্ভারে কোটি কোটি গিগাবাইট কাজের পাহাড় গড়ে তুলছে। তো অতিকায় ওই পাহাড় যখন তাঁর মাথায় ঢোকে তখন তার চাপে—বিক্রিয়ায় তাঁর মগজের সব নষ্ট হয়ে যাওয়ার দশা। তাঁকে ঠিক ঠান্ডা মাথার শয়তানের মতো এগোতে হয়—ডিসিশন পয়েন্ট। শেষে কিনা তিনি গড়ে তোলা ওই পাহাড় থেকে জেনে-বুঝে দুই-তিন লাইন মাত্র নেন, নিতে পারেন, কখনো পুরোটাই ফেলে দেন। যেমন, ঊষা ইন্টেলিজেন্সের তথ্যমতো, আত্মঘাতী ঈফাই জঙ্গিদের পাকড়াও করা গেল ঠিকই, কিন্তু কোনোভাবেই তাদের কাছ থেকে কোনো তথ্য উদ্ধার সম্ভব হয় না; বস্তা-ধোলাই, মানে জুটম্যাট বা কার্পেটে শরীর ঢুকিয়ে মুগুর দিয়ে আচ্ছামতো প্যাঁদিয়ে, নুনুতে পাথর বেঁধে বা পাছায় বাঁশ সেঁধিয়ে হাঁটিয়ে, মাথায় ক্রমাগত গরম বা ঠান্ডা জল ঢেলে—কোনোভাবেই না। শেষে তাঁর নির্দেশে ওয়াটারবোর্ডিং। আদতে একেই বলা উচিত জলাতঙ্ক। জঙ্গিরা মরু ভূখণ্ডের। সেখানে জলের যেমন রয়েছে অভাব তেমনি তার বিপরীত ও সমান মাত্রায় আছে জলের আতঙ্ক। তো গোটা দশেক চুবানিতেই পেটে ঢোকা জলের মতো কথা বেরোনো শুরু—রক্ষে, না হলে তার মাথার খুলি হয়তো থাকত কিন্তু মগজটাই যেত! দেহে যেমন মাথা, লোকে বলে, ঊষার তেমনি ইউআই। মাথায় খুলির ভেতর তার মগজের মতোই তিনি নির্মাণ করেছেন ঊষা ইন্টেলিজেন্সের টপ সিক্রেট কমপ্লেক্স—টিসি। ঊষা ইন্টেলিজেন্সের হেড অফিস ঊষার রাজধানী পেন্টুনে। টিসির অস্তিত্ব এক দুর্ভেদ্য রহস্য—গ্রাউন্ড জিরো, যেখানে গড়ে উঠেছে অসংখ্য ভবনগুচ্ছ। তার মধ্যে আছে ওই দক্ষ শীর্ষ কর্মকর্তাদের কড়া নিয়ন্ত্রণে ভাষাবিদ-ইতিহাসবিদ-গণিতজ্ঞ-প্রকৌশলী থেকে কার্পেন্টার, নির্মাণ শ্রমিক। এরা ঘুণ কিংবা উইপোকার মতো তার সিক্রেসি ঝরঝরে করে ফেলে কি না তাও এখানে যথাযথ গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচিত। ক্ষেত্রবিশেষে তাদের দিয়ে পর্যায়ক্রমে কাজগুলো এমনভাবে করা হয় যে তারাই শেষে বুঝতে পারে না তাদের দ্বারা দেয়ালের পলেস্তারার নিচে ফিট করা সিসি ক্যামেরাসমেত অভিনব আড়িপাতা যন্ত্র তাদের ওপরই খবরদারি করছে। তার পরও কে যে কোন কৌশলে কী লিক করে সে ঝুঁকির আশঙ্কা ফুঁ মেরে উড়িয়ে দিতে পারে কেবল খাঁটি নির্বোধই, মার্টিন না!
টিসির অতিকায় ধনুক ধাঁচের ওই ভবনগুচ্ছ বাইরের জগতের সঙ্গে ম্যাচ করে এভাবেই সাজানো, তাতে সামান্য যে অংশটুকু পাবলিকের নজরে আসে, দৃশ্যত তা কাপড় বা পোশাক তৈরি কিংবা ফলের রস-মাছ-মাংস-চামড়া প্রক্রিয়াজাত কারখানা। টিএস সংলগ্ন রাস্তায় পাশে ম্যানহোলের যে ঢাকনা চোখে পড়বে সেখানে কোনো ম্যানহোলই নেই, তা আসলে কনক্রিটের সিলিন্ডার পরিবেষ্টিত টিএসের কেব্ল। এই কেবলের মধ্য দিয়ে টিসির তথ্য মহাসড়কে কী প্রবাহিত তা তো কারও কল্পনায়ও থাকার কথা নয়। যদি কেউ ওই অজ্ঞাতপুরী ভ্রমণকে অ্যাডভেঞ্চার হিসেবে নিয়ে সে-মুখী ধায় তখন সে তার গাড়িসমেত বারবার লাল সংকেত আর রাইট-টার্নের মুখোমুখি হতে হতে ছিটকে পড়বে বহু দূরে। তবে যদি কেউ জেনে-বুঝে এই সব সিগন্যাল উপেক্ষা করে এগোতে থাকে, তবে সে তা পারবে বিনা বাধায় কিন্তু আখেরে সে সোজা পৌঁছে যাবে এই ক্ষণলোক থেকে অনন্ত ঈরমলোকে।
ঈফাই জঙ্গিদের কাছে টিসি শয়তানের ওয়ার্কশপ। জঙ্গিরা তার টিসির অনিষ্ট সাধনের জন্য প্রায়ই তথ্যমহাসড়কে ভাইরাস ছাড়ে। ইন্টারনেট হ্যাকিং করে সিঁধেল চোরের মতো ঢুকে পড়তে চেষ্টা করে কেন্দ্রীয় সার্ভারে। তার বিজ্ঞানীরাও তাই টিসির সুরক্ষার জন্য সৃষ্টি করেছে শক্তিশালী ওয়াচডগ। শত্রু বা অনাকাঙ্ক্ষিত কেউ এই দিকটায় ঢুকতে চাইলেই ওয়াচডগ সংকেত দেয় এবং হামলে পড়ে শত্রুর ওপর। এখন ওরা এমন সব ভাইরাস সৃষ্টির চেষ্টায় আছে যারা এই ওয়াচডগ মেরে তার টিসির জগতে ঢুকে সব খেয়ে একেবারে ঝরঝরে করে দেবে। সম্প্রতি আত্মঘাতী হামলায় খোদ টিসিই উড়িয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা নিয়ে আন্তদ্বীপীয় ঈফাই পার্টি—আইঈপির একটি আত্মঘাতী স্কোয়াড ঊষায় ঢুকে পেন্টুন বিমানবন্দরে ধরা পড়ে যায়। তারও আগে তারা অপারেশন টুইন টাওয়ার ধাঁচে আত্মঘাতী বিমান হামলায় ঊষা ইন্টেলিজেন্সের সদর দপ্তর ধ্বংসের জন্য বার্ডল্যান্ডের একটি পরিত্যক্ত রানওয়ে থেকে পেন্টুনমুখী উড়াল দেয়। কিন্তু তাতে সামান্য বাদ সাধেন স্বয়ং ঈফাই। প্লেনটি এক তিল বাঁক মেরে ঘণ্টায় তিন সেকেন্ড ধীরে উড়ে সদর দপ্তরের একটি ভবনে আঘাত করে, যা কিনা ইকুইপমেন্ট স্টোর, তা ধুলোয় মিশিয়ে দেয় কিন্তু মূল টেকনিক্যাল ও প্রশাসনিক টাওয়ার থাকে অক্ষত। ওয়াটার বোর্ডিং কৌশলে জানা গেল, এবার তাদের লক্ষ্য ছিল গ্রাউন্ড জিরোর খোদ টপ সিক্রেট কমপ্লেক্স। এবারের অঙ্কটি আগের তিল কিংবা সেকেন্ডের ভুল মগজে রেখে কিনা একেবারে নির্ভুল কষা।
যদি তিনি ওয়াটার বোর্ডিংয়ের নির্দেশ না দিতেন, তবে! তবে এবার না হলেও এই আত্মঘাতী ফর্মুলায় তার গোয়েন্দার টপ-সিক্রেট রাজধানী টিসি ধূলি-হাওয়ায় মিশে যেত।
টিসি মানে আশ্চর্য দৃষ্টিধর দুই জ্যোতিষ্কের মতো মার্টিনের জোড়া চোখ, দুনিয়ায় তাঁর দীর্ঘতম হাত। ওই চোখে যত দূর তাঁর দেখার সাধ তত দূর দেখেন, যেখান পর্যন্ত প্রয়োজন সেখান পর্যন্ত হাত বাড়িয়ে যা ইচ্ছা তাই করা যায়; অন্তত তিনি তা দিয়ে তাই করতে চান।
টিসি মানে ইউল্যান্ড বাজেটের সিংহমুখ। বাজেটের যত পারে নিজের মুখে পোরে। মানুষকে বেকার বানায়। দ্বীপে দ্বীপে চালকবিহীন বিমান থেকে বোমা ফেলে।
টিসি মানে ঈরমপাঠের ঈরমদূতকুল। বাইবেলে যেমন দেবদূতেরা প্রভুর বার্তা যথাসময়, যথাস্থানে, যথাজনে পৌঁছে দেয়, টিসি-কর্মীদের দায়দায়িত্বও তাই। তবে কিনা ঈরম বা দেবদূতের যেমন কোনো কার্যালয় ছাড়া চলে, এদের চলে না।
এখন মার্টিন যদি ওদের ওই ঐশী শক্তিটা ঠিকঠিক কাজে লাগাতে পারেন, তবেই যেন তাঁর ঈরম-বাসনা পূর্ণ হয়।
সুতরাং টিসি মানে মার্টিন নামের এক অতিমানবের ঈরমচর্চা। এই সব ব্যবস্থাপনার মানে ঈরমের মতো মার্টিন ইজ ওয়াচিং ইউ এভরিহোয়্যার, অলটাইম। টিসি মানে জর্জ অরওয়েলের নাইনটিন এইটি ফোরের থট-পুলিশ যে মার্টিনের হয়ে নজর রাখছে গ্রিন ওশানের দ্বীপে দ্বীপে মানুষের চিন্তাজগতে, কে কী করার কথা ভাবছে তাও!
কিন্তু মার্টিনের এমন ঈরমচর্চা এক পরিহাসও! ওই ভবন থেকে মাটিতে নামলেই, যেখানে তাঁকে নেমে আসতেই হয়, সমস্যার অক্টোপাস তাঁকে জড়িয়ে পেঁচিয়ে ধরে।
কেউ কয়, অভিনব প্রযুক্তির গাড়ি দিয়ে আমি কী করি, যদি তার জন্য গ্যাস বা তেলই না পাইলাম! তার সমাধান যদি হয়ও, তা কেনার অর্থ আমার কই? কাল থেকে যে আমি বেকার…!
তাদের ক্রোধ তাদের আত্ম-অহংকারের সমান কিংবা তা ছাড়িয়ে, বিকজ গ্রিন ওশানের মধ্যে এখানেই প্রথম সূর্যের আলো পৌঁছায় যা ঊষাবাসীর চেতনাচেতনে এক প্রতীকী ব্যঞ্জনায় শেকড় ছাড়িয়ে, তাদের বিশ্বাস বা আত্মগৌরব, ধর্ম-সভ্যতা-জ্ঞান-বিজ্ঞানের আলো প্রথম ঊষাদ্বীপেই ফোটে। এর বিপরীতে বহির্দ্বীপের দরিদ্র-অচ্ছুৎ পণ্ডিতেরা যতই তত্ত্ব, তথ্য, যুক্তি তুলে ধরুক, এডওয়ার্ড সাঈদের ওরিয়েন্টালিজমের মতো সব তাদের কাছে ভুয়া। আর আজ কিনা এই মার্টিন নামের লোক ক্ষমতায় বসে তাদের পথে বসিয়ে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
কারও ক্ষোভ, এত অস্ত্র বানাইলাম—বাজার কই!
তুমি আমার প্রেমিক হও, যৌন সুখ দাও। এরই মধ্যে দ্বীপে দ্বীপে যুদ্ধে নিহত সৈনিকদের শত শত উদ্ভিন্ন যৌবনা স্ত্রী মার্টিনকে পাকড়াও করে, না হলে আমার দেহ চাবায়া…।
কেউ বলে, তুমি আমার নিহত বাবাতে জীবন দাও।
বুড়ো বাপের দাবি, অন্তত লাশ তো দাও!
তারা সব যখন এভাবে ক্রমশ হিংস্র হয়ে তাঁর দিকে ধেয়ে আসছে, তিনি সিকিউরিটি সিকিউরিটি বলে চেঁচান। যখন তারা তাঁর ওপর হামলে পড়ে পড়ে, তিনি চিৎকার করেন, রেসকিউ, রেসকিউ…!
মজার ব্যাপার হলো মার্টিন এর মধ্য থেকে ছুটে পালাতে পারেন না। কারণ তাঁর সমস্যা মেদ, আবার এই বিক্ষুব্ধরাও তাঁকে পাকড়াও করতে গিয়ে তাঁর সঙ্গে কুলিয়ে উঠতে পারে না। কারণ এখন তো বটেই, অন্যান্য প্রায় সব ক্ষেত্রে তাদেরও প্রধান সমস্যা ওই মেদ। আবার এত কিছুর পর তারা কিনা বারবার ওই একজনকেই প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করে! কারণ শেষ পর্যন্ত নিজেদের নিরাপত্তার প্রশ্নে তারা আর কারও ওপর ভরসা রাখতে পারে না।
তবে কিনা প্রত্যেক নির্বাচনে প্রার্থী হিসেবে ঊষা প্রেসিডেন্টকে তাঁর নাম পাল্টাতে হয় তাঁর আগের টার্মের ব্যর্থতার দায় ঝাড়তে। যেমন, তাঁর গত টার্মের নাম ছিল জন হোস। এরই মধ্যে আগামীবারের জন্য তিনি তাঁর বিবেচনায় মধুরতম নামটি ঠিক করে রেখেছেন—জর্জ প্যারোট। কিন্তু তাঁরও মনে হয়, এটিই হবে একদিন গ্রিন ওশানের সবচেয়ে ঘৃণিত উচ্চারণ, খলনায়কের ঐতিহাসিক প্রতীক। এরপর গ্রিন ওশানের কোনো দ্বীপে, এমনকি সারা দুনিয়ায় কেউ কোনো দিন তাঁর সন্তানের নাম প্যারোট রাখবে না, যেমন রাখে না জুডাস কিংবা এজিদ। তবে কিনা এই প্রেসিডেন্টশিপেরও অনন্তকালীন কোনো গ্যারান্টি নেই, ল্যাটিন ঔপন্যাসিক মার্কেজ তাঁর অটাম অব দ্য প্যাট্রিয়ার্কে দেখান, দুই শ বছর রাজত্ব করার পর এক সামরিক শাসক কীভাবে তাঁর প্রাসাদেই মারা পড়েন।
তিনি ভেবেছিলেন, ভিনদ্বীপের তেল-সোনা লাভের যুদ্ধ একটি নির্ধারিত স্বল্পমেয়াদি প্রকল্প, হয়তো তা ব্যয়বহুল কিন্তু এ যে জাদুর গুঁটি, কোনোভাবেই আর তা গুটিয়ে আনা যাচ্ছে না, না গুটিয়ে আর ফেরাও যে অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে! যেখান থেকে ফায়দা লোটার ধান্ধা করবে তার বিরোধী দল বা জোট-মিত্রগুলোর জাতীয়তাবাদী বিরোধী দল কিংবা কোনো গুপ্তঘাতক।
এদিকে এমন ভুঁড়িদৌড়ের মধ্যে সহসাই চোখে ভাসে, তাঁর দিকে কেউ ছুড়ে দিছে একজোড়া ফুলের তোড়া—আসলে এই তো তাঁর প্রাপ্য। লুফে নেওয়ার আগেই তোড়াগুলো তাঁর ললাটে আঘাত হেনে মাটিতে পড়ে যাচ্ছিল, দ্রুত হাতে সেগুলো বুকে আগলে ধরে দেখেন, এ একজোড়া জুতা, তাও ঊষার টাডা কোম্পানির—মেইড ইন শ্যামল্যান্ড। এই জুতাজোড়ার শ্যামদ্বীপে তৈরি হওয়া কোনো কো-ইনসিডেন্ট না, তা মহান ঈরমের খেলই! হোথায়, মানে শ্যামদ্বীপে যে কেবল কম দামে মজুর মেলে তাই নয়, মজুরকে কাজের সুযোগ দেওয়ার নামে এমন সব মিল-কারখানা করার সুযোগ, যা কিনা এই ঊষায় করা অসম্ভব। ঊষা, এমনকি তাঁর করপোরেট বডিগুলো এখন আর নিজ দ্বীপে কিছু করে না, সব বাইরে। এমনকি বাইরেও তাদের অনেককে কিছু করতে হয় না—দেশে দেশে পেটি বুর্জোয়ারা তার ব্র্যান্ডের জুতা বানিয়ে নিজেরা তো পরেই, পাল্টা কোটি কোটি জোড়া জোতা চালান করে বিশ্বময়। তার ভূমি ও জলে পড়ে থাকে ট্যানারি বর্জ্যসহ সব স্বাস্থ্যহানির লভ্যাংশ—শ্রমে-ঘামে ক্ষয়িত শ্রমিক। তেমনি এক ব্র্যান্ড টাডা জুতা যা কিনা তাঁর কপালে তা কি শ্যামদের উপহার!
এদিকে কিছু করে খাওয়ার সুযোগ দিতে মার্টিন ঊষায় কারখানা করতে যাবেন, বেটারা প্রশ্ন তুলবে পরিবেশ নিয়ে—বর্জ্য শোধনের। যে কারণে কিনা উন্নয়নের ভাইল মেরে শ্যামদ্বীপে…এই জুতা কি তারই প্রতিদান!
এই জুতার জন্যই কি শ্যামদ্বীপে মার্টিনের এমন ভয়াবহ খেলা! প্রতিশোধ! না। সমগ্র গ্রিন ওশান দেখেছে টিভি চ্যানেলে চ্যানেলে মার্টিনকে জুতা ছোড়া বা জুতা মারার এই দৃশ্য—তিনি তা কী বিস্ময়কর কৌশলে গ্রহণ করছেন! এমনিতে তাঁর সেন্স অব উইট অ্যান্ড হিউমার জগদ্বিখ্যাত। সেই বিখ্যাত বদন এমন মুহূর্তে ফুলের তোড়া পেয়ে আনন্দের কান্না দেখাবে নাকি তা ইগনোর! সহসাই ফুলের জায়গায় জুতার ম্যাজিক দেখে এমন কৌতুক মার্টিন করেন যে, মঞ্চে খলনায়কের অভিনয় করে তিনি দর্শককে এমনই বিমোহিত করেছেন, যাতে সে ভুলে গেছে এই রোনাল্ড রিগান আসলে হলিউডের এক বিখ্যাত অভিনেতা, এখানে সে প্রেসিডেন্ট সে-সূত্রেই।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, মে ০৬, ২০১১
Leave a Reply