১৯ মে ১৯৩৩, আন্দামান সেলুলার জেলে অনশনরত বিপ্লবী মহাবীর সিংকে ‘ফোর্সড ফিডিং’ জোর করে খাওয়ানোর নামে জেলখানার সেপাইরা তাঁকে মেরেই ফেলে। সেপাইরা কারা প্রকোষ্ঠে ঢুকে তাঁর বুকে, পেটে ও হাঁটুতে চেপে বসে, মাথাটা একজন সেপাইয়ের দুই পায়ের মাঝখানে ঠেসে ধরে, তারপর নাক দিয়ে ঢুকিয়ে দেওয়া হয় পুরু নল। মহাবীর সিং প্রতিরোধের আপ্রাণ চেষ্টা অব্যাহত রাখেন। কালিপদ চক্রবর্তী আন্দামানে মহাবীর সিংয়ের সহবন্দী লিখছেন: হিংস্র সেপাইদল এতটাই ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে যে, তাদের বর্বরতা ও জবরদস্তি চরমে ওঠে। কোনো রকম ভ্রুক্ষেপ না করে এমন জোরে তারা নল ঢুকিয়ে দেয় যে, তা গলনালি দিয়ে না ঢুকে শ্বাসনালিতে ঢুকে যায়।
পাশের কারাকক্ষে সিরাজুল ও মনোরঞ্জন তাঁর আত্মচিৎকার শুনেছে, কিন্তু কিছুই করার ছিল না তাদের। কালিপদ চক্রবর্তী লিখেছেন, কারা কর্তৃপক্ষ মহাবীরের কোনো চিহ্নই রাখেনি। ‘গোপনে রাতের আঁধারে জেল থেকে তাঁর মৃতদেহ বের করে নিয়ে ভারী পাথর বেঁধে তা সমুদ্রগর্ভে ডুবিয়ে দেওয়া হয়েছিল।’
মহাবীর সিং লাহোর ষড়যন্ত্র মামলায় জগৎ সিং, রাজগুরু ও সুখদেব প্রমুখের সঙ্গে যাবজ্জীবন দ্বীপান্তর দণ্ডে দণ্ডিত হন। তাঁর ছোট্ট নেট বইয়ের প্রথম পাতায় তাঁরই হাতে লেখা আলেকজান্ডার পুশকিনের কবিতার কয়েকটি পঙিক্ত:
আমি জানি ধ্বংস তার জন্য অপেক্ষা করছে/ অত্যাচারীর জোয়াল ঠেলে/ যে উঠে দাঁড়ায়;/ কিন্তু আমাকে বল/ ক্ষতি না মেনে কবে কোথায়/ কে স্বাধীনতা পেয়েছে?
মহাবীর সিং জানতেন, তাঁর মাটি স্বাধীন করতে তাঁকে চরম মূল্য দিতেই হবে। তিনি তা-ই দিয়েছেন।
ঊনবিংশ শতকের শেষার্ধ এবং বিংশ শতকের প্রথমার্ধে বঙ্গোপসাগরে অর্ধবৃত্তের মতো ছড়ানো প্রকতির অঢেল বৈভব ও বৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ আন্দামান ও নিকোবার দ্বীপপুঞ্জের নাম উচ্চারিত হলেই চোখের সামনে ভেসে উঠেছে অন্ধকার কারাপ্রকোষ্ঠের ছবি, যেখানে ‘ভয়ংকর অপরাধী’দের চিরজনমের নির্বাসনে পাঠানো হয়েছে। জনসাধারণের মনে এই বিশ্বাসই ছিল—অগম্য এই সাগরদ্বীপে একবার পাঠাতে পারলে কেউ আর মূল ভূখণ্ডে ফিরে আসতে পারবে না।
কালাপানিই হচ্ছে কারাবন্দীদের অনেকেরই অন্তিম আস্তানা। বাংলার রাজবন্দীরা সেলুলার জেলে পা রেখেই কারাবিদ্রোহ উসকে দেন। ১৯৩৩ সালের শুরুতেই কারাগার উত্তাল, বিক্ষুব্ধ বন্দীদের রোষ কারা প্রশাসনের ওপর—তাঁদের অন্যতম দাবি, তৃতীয় শ্রেণীর কয়েদিদের খাবারটা ভালো হতে হবে, এটা উপলক্ষ; মূল আন্দোলন তো ঔপনিবেশিক শাসকদের বিরুদ্ধে।
সেই আন্দামানই ভারতবর্ষের জনমানুষের কাছে কালাপানি। কলকাতা থেকে এক হাজার ১০০ কিলোমিটার দক্ষিণে ভারত মহাসাগরের বিভিন্ন আকারের ১৮৪টি দ্বীপ নিয়ে আন্দামান দ্বীপপুঞ্জ। বড় দ্বীপটির দৈর্ঘ্য ৩৫৫ কিলোমিটার এবং প্রস্থে ৬০ কিলোমিটার। ১৮৫৭ সালের সিপাহি বিদ্রোহের পর বিদ্রোহীদের নৃশংসভাবে হত্যা করার পর আন্দোলনের মূলোৎপাটন করার জন্য যেসব বিদ্রোহী ফাঁসিকাষ্ঠ এড়াতে সমর্থ হয়েছেন, তাঁদের দূরবর্তী স্থানে বন্দী করার লক্ষ্যে ১৮৫৮ সালের জানুয়ারি মাসে ব্রিটিশরা দ্বীপটি পুনর্দখল করে। কারাবন্দী ২০০ স্বাধীনতার সৈনিককে নিয়ে ১০ মার্চ ১৮৫৮ সুপারিনটেনডেন্ট জেবি ওয়াকার আন্দামান পৌঁছেন। ৭৩৩ জন বিদ্রোহীর দ্বিতীয় দলটি আসে করাচি থেকে ১০ বছর পর ১৮৬৮ সালের এপ্রিলে। তাদের সবাই যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত কয়েদি। এই দুই দলের সবাই স্বাধীনতার প্রথম যুদ্ধের সৈনিক। তারপর কলকাতা, মুম্বাই ও মাদ্রাজ থেকে বিদ্রোহীদের পাঠানো অব্যাহত রাখা হয়।
পায়ে শিকল পড়া অবস্থায় জোঁক ও সাপ-বিচ্ছু পরিপূর্ণ জলা ও জংলাভূমি পরিষ্কার করে পথঘাট তৈরি করাই ছিল এই কয়েদিদের দিন-রাতের কাজ। কাজে মন্থরতা দেখা দিলে তাঁদের কঠোর শাস্তি ভোগ করতে হতো। ১৮৬৮ সালের মার্চে ২৩৮ জন কয়েদি আন্দামান থেকে পালাতে চেষ্টা করেন। এপ্রিলের মধ্যে সবাই ধরা পড়েন। একজন আত্মহত্যা করেন এবং সুপারিনটেনডেন্ট ওয়াকার নিজেই আদেশ দিয়ে ৮৭ জনের ফাঁসিতে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করেন।
১৮৭২ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি ভাইসরয় লর্ড মেয়েরকে ছুরিকাঘাতে হত্যাকারী শের আলীকে ভাইপার দ্বীপে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করা হয়।
চারদিকে অথৈ সাগর, পালানোরও নেই; তার পরও ১৮৯৬ সালে সেলুলার জেল নির্মাণ শুরু হয়। ৬৯৮টি সেলবিশিষ্ট এই কুখ্যাত কারাগারের নির্মাণকাজ শেষ হয় ১৯০৬ সালে। সাতটি ভাগে সজ্জিত হয় এই তিলতলা কারাগার।
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় আন্দামান জাপানিদের দখলে চলে যায় এবং পরবর্তী সময় বলা হয়, তখনই জেলখানার সব দলিল-দস্তাবেজ বিনষ্ট করা হয়েছে। উপমহাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত আন্দামান দ্বীপপুঞ্জ ও সেলুলার জেলের স্মৃতি ও দুঃস্বপ্ন।
ওহাবি আন্দোলন (১৮৩০-১৮৬৯), মোপলা বিদ্রোহ (১৭৯২-১৯৪৭), রামপা বিদ্রোহ (১৮৭৮-১৮৭৯, ১৯২২-১৯২৪), বার্মার কৃষক বিদ্রোহ, বাংলা ও পাঞ্জাবের ব্রিটিশ তাড়ানোর আন্দোলন, সচিন সান্যালের হিন্দুস্তান রিপাবলিকান অ্যাসোসিয়েশন, মহারাষ্ট্রের সাভারকার ভ্রাতৃবৃন্দ বাংলা গুপ্ত সমিতি আন্দামানের সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে। ১৯০৮ সালে আলিপুর বোমা মামলায় ৩৪ জন বিপ্লবীকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়, এঁদের মধ্যে ছিলেন বারিন ঘোষ, উল্লাসকর দত্ত, হেমচন্দ্র দাস, উপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ। ১৯০৯ সালে তাঁদের নির্বাসিত করা হয় আন্দামানে।
অ্যাসেম্বলি বোমা মামলা এবং লাহোর ষড়যন্ত্র মামলার অভিযুক্তদের ঠাঁই হয় আন্দামানে।
চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন মামলায় ১২ জানুয়ারি ১৯৩৪ ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করা হয় মাস্টারদা সূর্যসেনকে। আর সেলুলার জেলে পাঠানো হয় অম্বিকা চক্রবর্তী, গণেশ ঘোষ, অনন্ত সিং, লোকনাথ বল, আনন্দ গুপ্ত, রণবীর দাস গুপ্তসহ অন্যান্য সহযোগীকে।
আন্দামান জেলে কয়েদিদের ওপর নির্মম শারীরিক অত্যাচার ছিল নিত্যকার ঘটনা। বিচ্ছিন্ন ও শ্যাওলাপড়া প্রকোষ্ঠে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্নভাবে তাঁদের থাকতে হতো; মানুষের ভক্ষণের অযোগ্য চালের ভাত রান্না হতো, ঘাস-বিচালি সেদ্ধ করে দেওয়া হতো তরকারি হিসেবে, খাবার পানিও ছিল আবর্জনা ও কীটপতঙ্গপূর্ণ, টয়লেট ছিল না, আলোর ব্যবস্থা ছিল না।
কাদের পাঠানো হয়েছে আন্দামান? অগ্নিযুগের কালীপদ চক্রবর্তীর একটি বিবরণীই যথেষ্ট। ১৮ আগস্ট ১৯৩২ দুপুর ১২টা কি একটায় জাহাজ এসে ভিড়ল আন্দামান নিকোবার দ্বীপপুঞ্জের রাজধানী পোর্ট ব্লেয়ার। ‘রাজবন্দী’দের দলে আমরা ছিলাম ২৩ জন। এঁদের মধ্যে ছিলেন চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন মামলার আসামি গণেশ ঘোষ, অনন্ত সিংহ, লোকনাথ বল এবং আরও নয় জন। মেছুয়াবাজার বোমা মামলার আসামি মুকুল সেন ও নিশিকান্ত রায় চৌধুরী, আমানুল্লা হত্যা মামলার আসামি হরিপদ ভট্টাচার্য, বরিশাল পুলিশ হত্যা মামলার আসামি রমেশ চ্যাটার্জি, ময়মনসিংহ অস্ত্র মামলার বন্দী প্রবীর গোস্বামী, কলকাতা অস্ত্র মামলায় অভিযুক্ত বন্দী মনোরঞ্জন গুহঠাকুরতা ও অন্য কয়েকজন বন্দী এবং চাঁদপুর পুলিশ হত্যা মামলার আসামি আমি নিজে। ১৯৩৩ সালের সেই অনশনে শরিক হয়েছেন বাংলা থেকে দীপান্তরিত প্রায় সবাই।
১৯১৮ সালে ‘প্রথম লাহোর ষড়যন্ত্র’ মামলায় অভিযুক্ত বিপ্লবীরা হাজারীবাগ জেলে প্রথম বড় ধরনের অনশন ধর্মঘট করেন। ১৯২৯ সালে ‘দ্বিতীয় লাহোর ষড়যন্ত্র মামলা’য় অভিযুক্ত হিন্দুস্থান সোশ্যালিস্ট রিপাবলিকান অ্যাসোসিয়েশনের সদস্য যতীন্দ্রনাথ দাস ৬৩ দিন টানা অনশনের পর ১৩ সেপ্টেম্বর ১৯২৯ মৃত্যুবরণ করেন।
বাংলা থেকে বিপ্লবী কয়েদির ২৫ জনের প্রথম ব্যাচটি পাঠানো হয় ১৫ আগস্ট ১৯৩২। বাংলার বিপ্লবীরা আন্দামানে পৌঁছার পর পরই কারা কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে অনাচারের প্রতিবাদ আরও তীব্র হয়ে ওঠে। ৩ জানুয়ারি ১৯৩৩ বাংলার সাতজন কয়েদি—বিমল কুমার দাসগুপ্ত, সুশীল কুমার দাসগুপ্ত, প্রবোধচন্দ্র রায়, প্রবীর গোস্বামী, বিমলেন্দু চক্রবর্তী, বীরেন্দ্র কুমার ঘোষ ও সুবোধ রায় ১৫টি দাবি আদায়ের উদ্দেশ্যে অনশন শুরু করেন।
অনশনকারীদের একজন অচ্যুত ঘটক তৃতীয় ব্যাচে আন্দামান যান, তিনি কখনো জীবিত অবস্থায় মূল ভূখণ্ডে ফিরতে পারবেন ভাবেননি। মানিকতলা ডাকাতি মামলার অভিযুক্ত বীরেন্দ্রনাথ চৌধুরী তাঁর প্রকোষ্ঠের বৃশ্চিকের বিবরণ দিয়েছেন—প্রতিটি কামড়ে প্রচণ্ড জ্বরে ককাতে হতো তাঁকে। দ্বিতীয় অনশন শুরু হয় ১২ মে ১৯৩৩। এবারের অনশনে দুজন মুখ্য প্ররোচনাকারী বি কে দত্ত ও কমলনাথকে শুরুতেই বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হয়। অনশনকারীদের অবস্থা সংকটাপন্ন হয়ে পড়েছে বিবেচনা করে ১৭ মে থেকে শুরু হয় বলপূর্বক খাওয়ানো নামক আদিম অত্যাচার। কয়েদিদের মেঝেতে শুইয়ে রাবারের নল নাকে ঢুকিয়ে কুখাদ্য প্রবেশ করানো হতো, অনশনকারীরা এই খাবার প্রত্যাখ্যানের আপ্রাণ চেষ্টা করতেন। ৫ জুন অনশনকারীর সংখ্যা ৪৫-এ পৌঁছে।
‘ফোর্সড ফিডিং’-এর দানবীয় যন্ত্রণায় ১৮ মে ১৯৩৩ মহাবীর সিং মৃত্যুবরণ করেন। আঘাতপ্রাপ্ত হয় বিধুভূষণ সেনের ফুসফস, তাঁর নাক দিয়ে অবিরাম রক্ত ঝরতে থাকে। মোহন কিশোর দাস মৃত্যুবরণ করলেন ২৬ মে। ২৮ মে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন মোহিত মৈত্র।
আন্দামান সেলুলার জেলে বিপ্লবীদের শেষ অনশন ধর্মঘট শুরু হয় ২৪ জুলাই ১৯৩৭। তত দিনে পরিস্থিতি পাল্টে গেছে। ভাইসরয় লর্ড লিনলিথগো তখন এতটাই নমনীয় হতে বাধ্য হয়েছেন যে ‘আন্দামানের এসব সন্ত্রাসী’ ভবিষ্যতে ভালো আচরণ করবে—এই হলফনামা দিলেই মুক্তি পেতে পারে। ফলে আন্দামানের আতঙ্ক হ্রাস পেতে থাকে। শুরু হলো মূল ভূখণ্ডে প্রত্যাবর্তন।
১৮ জানুয়ারি ১৯৩৮, আন্দামান সেলুলার জেলের শেষ ১০৯ জন কয়েদি প্রত্যাবর্তনের জাহাজে ওঠেন।
২৩ মার্চ ১৯৪২ জাপানি সেনাবাহিনী আন্দামান দখল করে নেয়। নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু ৩০ ডিসেম্বর ১৯৪৩ আন্দামানে তিন-রং স্বাধীনতার পতাকা উত্তোলন করেন।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, মে ০৬, ২০১১
আলি মেহেবুব হাসান
আসাধারন লাগলো, না জানা ইতিহাস জেনে রক্ত গরম হয়ে গেল্রে ভাই, খুব ভাল লাগল। ধন্যবাদ