‘কবিতা কী করে
বায়ুমণ্ডলে আরও
অক্সিজেন ছড়ায়। কবিতা
শ্বাস-প্রশ্বাস সহজ করে দেয়।’
কবিতাকে এভাবেই দেখেন কবিতায় সদ্য পুলিৎজার পাওয়া কবি কে রায়ান। ২০১১-এর পুলিৎজার পুরস্কার ও প্রধান দুটি শাখায় কবিতা ও কথাসাহিত্যে নারী লেখকদেরই জয়জয়কার। এমিলি ডিকিনসন, ম্যারিয়ান মুরের সফল উত্তরসূরি কে রায়ান (জন্ম ২১ সেপ্টেম্বর ১৯৪৩) ২০০৮-১০ যুক্তরাষ্ট্রের পোয়েট লোরিয়েটও ছিলেন। ২০১০-এ প্রকাশিত The Best of It New and selected Poems-এর জন্য কে রায়ানের পুলিৎজার পুরস্কারপ্রাপ্তি।
জেনিফার এগান ফিকশন শাখায় পুরস্কার পেয়েছেন ২০১০-এ প্রকাশিত তাঁর উপন্যাস A Visit from the Goon squad উপন্যাসের জন্য।
জেনিফার এগানকে (জন্ম ৬ সেপ্টেম্বর ১৯৬২) ঔপন্যাসিক হিসেবে কোনো নির্দিষ্ট ঘরানা কিংবা ধারার সঙ্গে চিহ্নিত করা কঠিন বলেই তিনি ‘আনক্লাসিফায়েবল নভেলিট’ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছেন। তাঁর পুরস্কারপ্রাপ্ত গ্রন্থ গুন্ডাপান্ডাদের আখড়া ঘুরে এসে বিচ্ছিন্নভাবে কতগুলো গল্পের সমষ্টি, সমন্বিতভাবে একটি উপন্যাস। পুলিৎজার লাভের কিছু আগে এই বই ন্যাশনাল বুক ক্রিটিকস অ্যাওয়ার্ডও পেয়েছে। কে রায়ানকে যখন পোয়েট লোরিয়েট করা হলো, তিনি বললেন, ‘কবিতা তো পুরোপুরি ব্যক্তিগত একটা উদ্যোগ—আমি রাজকবি হতে চাই না।’
এটা অনেকটা কবিতার ‘সিইও’ সাজার মতো: ‘আমি পণ্ডিত কবি নই, কবিতার শিক্ষকও নই।’ তিনি কমিউনিটি কলেজে ইংরেজি পড়ান, সেটা ইংরেজি সাহিত্য নয়।
‘আমি কবিতাকে সবকিছু থেকে আলাদা করে রেখেছি, আমি কবিতা সম্পর্কেও কথা বলতে চাই না।’
তিনি কবিতার আড্ডায় নেই, কবিদের সঙ্গেও মেলামেশা করেন না। সময় পেলে একাই সাইকেলে চেপে ঘুরে বেড়ান। এর মধ্যে পুরস্কার ও সম্মান ঢের পেয়েছেন। প্যারিস রিভিও তাঁর একটি দীর্ঘ সাক্ষাৎকার প্রকাশ করেছিল। সেই সাক্ষাৎকারের একাংশ:
প্রশ্ন: আপনি যখন বলেন কবিতাকে খালি স্যুটকেসের কাজটা করতে হবে, তখন কী বোঝাতে চান?
কে রায়ান: এটা ক্লাউনের স্যুটকেস—যেখান থেকে ক্লাউন টনের পর টন মালামাল বের করে নিয়ে আসতে পারে। কবিতাও তেমনি খালি স্যুটকেস—একেবারে সবকিছু বের করে শূন্য স্যুটকেস রেখে আপনি চলে যেতে পারেন না।
প্রশ্ন: অনেক সমালোচক আপনাকে এমিলি ডিকিনসনের মতো মনে করেন? আপনিও কি তা-ই মনে করেন?
কে রায়ান: প্রশ্নটা অনেকটা এ রকম—আপনি কি ঈশ্বরের মতো? প্রশ্নটা অন্যের কাছে আকর্ষণীয় হতে পারে, আমার কাছে নয়। তবে এ প্রশ্ন আমাকে দিয়ে কাজ করিয়ে নেয়—যে কাজ অন্যের করার কথা। তা ছাড়া আপনি কেমন করে ঈশ্বরের সঙ্গে তুলনীয় হতে চান?
প্রশ্ন: আপনি যখন গ্রামের পথে সাইকেল চালিয়ে যান, আপনি আবিষ্কার করেন যে আপনি লেখক হওয়ার জন্য জন্মেছেন, কিন্তু কোন প্রায়োগিক পদ্ধতিতে আপনি নিজেকে লিখতে শিখিয়েছেন? এ প্রশ্নের দীর্ঘ জবাবে তিনি বলেন, সেই সফরগুলোর বিবরণী তিনি প্রতিদিনই লিখতেন, যা অভ্যাসে পরিণত হয়। সত্তরের দশকে কেমন করে ট্যারট কার্ড ব্যবহার করতেন: ‘আমি সব সময় বুঝতাম, কবিতা লিখতে হলে আমাকে সম্পূর্ণভাবে প্রকাশ করতে হবে। কিন্তু সত্তরের দশকে নিজেকে সম্পূর্ণ প্রকাশ করতে কাপড় ছিঁড়ে নগ্ন হওয়ার মডেল সামনে ছিল—তা যে আমার পক্ষে সম্ভব নয়। আমার মস্তিষ্ক নগ্ন হতে পারে কিন্তু আমি যে নগ্ন হতে পারি না। হূদয় কিংবা ভালোবাসাতে আমার আগ্রহ নেই। ট্যারট কার্ড আমাকে শিখিয়েছে, আমি যেকোনো বিষয়ে লিখতে পারি। প্রয়োজন হলে প্রেম দিয়েও এবং প্রকাশিত না হওয়ার যে “মায়া”, তা-ও ধরে রাখতে পারি। কেউ একজন যখন ভালো লিখে নিজেকে সম্পূর্ণভাবে প্রকাশ করে আর একই সঙ্গে তাকে মুখোশাবৃত ও সুরক্ষিতও বোধ করতে হয়।’
প্রশ্ন: আপনি কাঠামোবদ্ধ কবিতা লেখেন।
কে রায়ান: আমার সে মেধা নেই, এটা আমার জন্য বিব্রতকর। (রবার্ট) ফ্রস্ট যদি তা পছন্দ করেন, (ফিলিপ) ভারকিজ যদি তা পছন্দ করেন, আমি যাঁদের সম্মান করি, আনন্দিত হই। কিন্তু আমার বেলায় তা হবে ভুল পোশাক পরার মতো।
প্রশ্ন: দুটি কাব্যগ্রন্থ রচনার মাঝখানে আপনি বড় দীর্ঘ সময় নিয়ে থাকেন?
কে রায়ান: আমার মনে হয়, অনেক কবিতা বেরিয়ে আসছে। আমার এর সঙ্গে যোগ করার প্রয়োজন নেই।
প্রশ্ন: নিজের কবিতার ওপর আপনার আস্থা ছিল কি? একেবারে শুরু থেকেই?
কে রায়ান: শুরুটায় আমি জানতামই না কতটা বাজে লিখছি। সেটাই ছিল আশীর্বাদ। গোড়াতেই যদি সবাইকে বোকা না ভাবতাম—যেন সবাই আমার কবিতাকে আমি যতটা ভালো মনে করি, তারাও ততটা করে, তাহলে কেমন করে টিকে থাকতাম জানি না। এখনো আমাকে আমার কবিতার পক্ষে দাঁড়াতে হয়—লেখালেখির শুরুতে একজন লেখকের বৈধতা বলে কিছু নেই। আমাকে শ্রদ্ধাভরে তার পরিচর্যা করতে হয়। শিখতে হয় শৈলী।
(কে রায়ানের তিন দশকের বেশি সময়ের বিবাহিত নারীসঙ্গী ক্যারল: উভয়ের সমলিঙ্গ বিয়েও আলোচনায় উঠে এসেছে।)
প্রশ্ন: কেমন করে কবিতা প্রকাশ করতে শুরু করলেন?
কে রায়ান: আমার কোনো পদ্ধতিই জানা ছিল না। সম্পূর্ণ নৈরাজ্যকর ও হতাশাব্যঞ্জক অবস্থায় ছিলাম। আমার কাজ জমে জমে উঁচু টাওয়ার হয়েছে, কিন্তু এসব দিয়ে কী করব কোনো ধারণাই আমার নেই। তখন ক্যারল হাত বাড়িয়ে দিল, আমাকে গুছিয়ে তুলল। প্রতি প্যাকেটে পাঁচটা-দশটা-বিশটা করে কবিতা কয়েক সপ্তাহ অবিরাম পাঠিয়ে চলল। তারপর ১০ বছর আমাদের কেবল সহ্য করতে হলো—অগ্রগতি অতি সামান্য। এই ধৈর্য ধরা আমাকে রীতিমতো অসুস্থ করে ফেলল। এ ছাড়া আর তো কোনো উপায়ও নেই। আমার ধৈর্য নেই—আবার শর্টকাট কোনো পথও নেই। কীভাবে দ্রুত এগোব, তা-ও জানা নেই।
কবিতা পাঠাতে হবে, সম্পূর্ণ অচেনা কেউ তা পড়বে—এই ভেবে আমি কবিতা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করতে শুরু করলাম। যখন এগুলো প্রত্যাখ্যাত হলো—শীতল চোখে তা আবার দেখতে হলো।
প্রশ্ন: আপনি কি সাফল্যের জন্য লালায়িত ছিলেন?
কে রায়ান: আমি মরিয়া হয়ে উঠেছিলাম। এটা অবশ্যই এমিলি ডিকিনসন মেজাজের পরিপন্থী, কিন্তু আমি তা-ই করেছি। একবার নিউ ইয়কার-এর কবিতা সম্পাদক এলিস কুইন কোনো একটা উৎসব বা সম্মেলনে বক্তৃতা দিতে এলেন। আমি টিকিট কেটে অনুষ্ঠানে গেলাম, আমি ভেবেছি আমাকে কোনো না কোনো যোগসূত্র স্থাপন করতে হবে, কিন্তু ভেতরে গিয়ে আর এগোতে পারলাম না। আমি খুব অহংকারী মানুষও। আমি তার সমকক্ষ বা প্রায় সমকক্ষ না হলে দেখা করতে যাব কেন?
(কে রায়ান তার পরও কবিতা ছেড়ে দেওয়ার কথা ভাবেননি। বছরের পর বছর ভেবেছিলেন ম্যাগাজিন থেকে তাঁর কবিতার জন্য অনুরোধ আসছে—হয়নি। প্রথম কাব্যগ্রন্থটি নিজেকেই প্রকাশ করতে হয়েছে।
প্রশ্ন: আপনার নিজের কবিতা পাঠের অনুভূতি কী?
কে রায়ান: নিজের কবিতা পড়ে শোনাতে পছন্দ করি। কিন্তু অন্যদের লেখা কবিতা তারা আমাকে পড়ে শোনাক, সেটা আমার পছন্দ নয়।
প্রশ্ন: আপনার কি মনে হয়, আপনার বইগুলো আগের চেয়ে ভালো হচ্ছে?
কে রায়ান: অগ্রগতি—আমার কাছে এই অগ্রগতির ধারণাটির কোনো মানেই নেই। আমার বই আগের চেয়ে ভালো হচ্ছে, এটা আমার ভাবার কোনো দরকারই নেই। আর একটু পানীয়ের জন্য আমি সেই একই কুয়ার কাছে ফিরে যাওয়া অব্যাহত রাখতে চাই।
প্রশ্ন: আপনি কখনো কথাসাহিত্য রচনার চেষ্টা করেছেন?
কে রায়ান: আমি জীবনে কখনো তা লিখতে পারব না। কারণ, অন্য লোকজন কী ভাবছে, সে সম্পর্কে আমার কোনো ধারণাই নেই।
(সাক্ষাৎকারে বাবা, মা ও ক্যারল সম্পর্কে দীর্ঘ প্রশ্নোত্তর রয়েছে।)
প্রশ্ন: যখন কেউ বলে যে আপনার কবিতা বোঝে না, তাদের কী বলবেন?
কে রায়ান: একজন বিখ্যাত শিল্পী, সম্ভবত পিকাসো বলেছেন, যখন কেউ তাঁকে চিনত না, তখন ছয়জন তাঁর ছবি বুঝত। যখন লাখ লাখ লোক তাঁকে চেনে, তখনো কেবল ছয়জনই তাঁর ছবি বোঝে।…
কে রায়ানের দুটি কবিতা
অ্যাটলাস
চরম প্রচেষ্টা
সাহায্য থেকে
মানুষকে বিচ্ছিন্ন করে,
আবিষ্কার করেছেন অ্যাটলাস।
এক সময়কার নিশ্চিত
কাঁধে কাঁধ মেলানো
অনুপাত ভেঙে পড়ে,
অন্যদের তেমন কিছু
করারই থাকে না:
তারা পারে না
ব্রাজিলকে বাড়াতে
সাহায্যের হাত
পারে না দাঁড়াতে
পেরুর মাটিতে।
নায়াগ্রা নদী
নদীটা
যেন
একটি মেঝে, আমরা এর ওপর
আমাদের চেয়ার ও টেবিল
ঠিকঠাক বসাই, এবং
আমরা আলাপ করি।
এটা চলতে থাকে
আমরা অবলোকন করি
যেন নিঃশব্দে ডাইনিংরুমের
পেইন্টিংসগুলো ধীরে ধীরে
অপসারণ করে
তীরের বদলে যাওয়া
সব দৃশ্যপট। আমরা
জানি, আমরা
জানি যে এটা নায়াগ্রা নদী
কিন্তু এর মানে কী
মনে রাখা বড় শক্ত।
ভূমিকা ও অনুবাদ: আন্দালিব রাশদী
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, এপ্রিল ২৯, ২০১১
Leave a Reply