ছয় ব্যক্তিত্বের তত্ত্বতালাশ
আখতার জামান
বাংলাদেশ-এন ইন্টারকালচারাল প্যানারোমা—আনোয়ার দিল \ অ্যাডর্ন \ ফেব্রুয়ারি ২০১১ \ মূল্য ৯০০ টাকা \ ৪০৮ পৃষ্ঠা
জনগণই সংস্কৃতি তৈরি করে। আর ওই সংস্কৃতি একক কোনো সত্তার প্রতিনিধিত্ব করে না। বরং তা বহুমাত্রিক। অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বাংলাদেশ-এন ইন্টারকালচারাল প্যানারোমা বইয়ের মুখবন্ধ এমন আলাপ দিয়েই শুরু করেছেন। পাকিস্তানের স্বনামখ্যাত অধ্যাপক আনোয়ার দিল বাংলাদেশবিষয়ক তাঁর এই গ্রন্থে বিস্তৃত সংস্কৃতিকে খুঁজে বেড়িয়েছেন। শুরু করেছেন বহু ভাষাবিদ ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহকে দিয়ে। শেষ করেছেন আবদুল কাইয়ুমকে দিয়ে। এই আবদুল কাইয়ুম শহীদ বুদ্ধিজীবী মুনীর চৌধুরীর ভাই। তাঁদের আরেক ভাই কবীর চৌধুরী। মুনীর চৌধুরী শহীদ হলেও বেঁচে আছেন কবীর চৌধুরী। ভাষা আন্দোলনের উত্তাল সময়ে মুনীর চৌধুরী যখন পাকিস্তান রাষ্ট্রের কারাগারে বন্দী, তাঁর ভাই আবদুল কাইয়ুম তখন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর স্বীকৃতি ‘দ্য সোর্ড অব অনার’ গ্রহণ করছেন। আবদুল কাইয়ুম তাঁর পরিবারের সদস্যদের পছন্দ করতেন না। বিয়ে করেছেন এক পাঞ্জাবি নারীকে। ভিন্ন ভাষা, ভিন্ন দেশ আর একাত্তর যখন মুখোমুখি এবং যাঁর ভাইয়েরা পাকিস্তানবিরোধী আন্দোলনে কারাভোগ করছেন, নিহত হয়েছেন অথচ তিনি পাড়ি জমালেন সেই পাকিস্তানে। সেখানেই থাকলেন। মুক্তিযুদ্ধের দীর্ঘ সময় পার করে সংস্কৃতিকে দেখার এই দৃষ্টিভঙ্গি জরুরি হয়ে ওঠে।
আনোয়ার দিল জন্মেছেন পাঞ্জাবে। ভাষা ও সমাজবিজ্ঞান বিষয়ে তাঁর পাণ্ডিত্য সমাদৃত হয়েছে বিভিন্ন দেশেই। নিজে বিয়ে করেছেন আফিয়া দিল নামের এক বাঙালি পণ্ডিতকে। বাংলাদেশ বিষয়ে তাঁর গভীর অধ্যয়নের প্রকাশ পাওয়া যায় তাঁর রচিত গ্রন্থে। এর আগেও তিনি বাংলাদেশের শিল্প ও ইতিহাসভিত্তিক গ্রন্থ রচনা করেছেন। সংস্কৃতিকে উপলব্ধি করতে হলে জনগোষ্ঠীর ইতিহাস আর ঘটনাপরম্পরা, ব্যক্তিবিশেষের বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চাও জরুরি। এই গ্রন্থে আনোয়ার দিল বিশিষ্ট ছয়জনের জীবনী আর তাঁদের কাজের ধরন ও মতাদর্শ হাজির করেছেন। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, তাঁর সন্তান চিত্রশিল্পী মুর্তজা বশীর, তিন ভাই মুনীর চৌধুরী, কবীর চৌধুরী ও আবদুল কাইয়ুম। সঙ্গে আছেন পল্লিকবি জসীমউদ্দীন। এই ছয় ব্যক্তিত্বের প্রসঙ্গে তিনি তালাশ করে ফিরেছেন বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক আর বুদ্ধিবৃত্তিক চলাচলকে। জরুরি প্রসঙ্গ হিসেবে উপস্থাপন করছেন ‘ইসলাম’কে।
ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর সঙ্গে লেখকের সাক্ষাৎ প্রসঙ্গে তিনি উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছেন। ওই সময় এই পণ্ডিতের কাজ ও গবেষণা কাছে থেকে পর্যবেক্ষণ করেছেন। তিনি উপলব্ধি করেছেন এ উপমহাদেশের ভাষা আর সংস্কৃতির নৈকট্যকে। শহীদুল্লাহর সন্তান মুর্তজা বশীরের সঙ্গেও তাঁর সাক্ষাৎ হয়। পিতা-পুত্রের সম্পর্কও সংস্কৃতিকে উপস্থাপন করেন। তাঁদের মধ্যকার পারিবারিক আর আদর্শিক দ্বন্দ্ব সন্ধান করেছেন লেখক। মুর্তজা বশীরের চিত্রশিল্পী হয়ে ওঠার পথে শহীদুল্লাহর ‘অনভ্যস্ততা’, ‘সামাজিকতা’ আর এর টানাপোড়েন, প্রজন্মান্তরে বুদ্ধিবৃত্তিক বদলকেও চিহ্নিত করেছেন আনোয়ার দিল।
জসীমউদ্দীন শহুরে বুদ্ধিবৃত্তির বাইরে অবস্থান করলেও তিনিও ‘মুসলমান’ পরিচয় ধারণ করেন। নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করার সংগ্রামে জসীমউদ্দীনের অবদান আর সংগ্রামকে তুলে ধরেছেন লেখক এ বইয়ে। মুক্তিযুদ্ধ-পূর্ববর্তী সময়ে হিন্দু-মুসলমান সংঘর্ষ নিয়ে চিন্তিত জসীমউদ্দীনের মুখাবয়ব বোঝার চেষ্টা করেছেন। তাঁর মতে, জসীমউদ্দীনের উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলোর মধ্যে প্রথমেই থাকবে বালুচর। জসীমউদ্দীনের এই গ্রন্থের কবিতাকে লেখক বুঝেছেন এভাবে যে জীবন আসলে বালুচরের মতো, যার পাশেই জীবন্ত নদী বয়ে চলে।
মুনীর চৌধুরী আর কবীর চৌধুরীর জীবনী এবং তাঁদের কাজ নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে লেখক তুলে এনেছেন মুক্তিযুদ্ধের সময় এবং স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়কে। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছেন আবদুল কাইয়ুম। তিনি একইভাবে তাঁর দুই ভাইকে অস্বীকার করলেন, আবার তাঁদের বিষয়ে তাঁর আগ্রহও প্রকাশিত হয়েছে বিভিন্ন গবেষণাকর্মে। আবদুল কাইয়ুম পাকিস্তানেই থেকেছেন। পাকিস্তানের রাজনৈতিক দুর্যোগের তিনি একজন সাক্ষী। তাঁর কলমে ফুটে উঠেছে ওই দেশের সংকট আর সম্ভাবনা। তাঁর কাজের গুরুত্বপূর্ণ অংশ ধর্ম হিসেবে ইসলাম। পাকিস্তানের সামাজিক প্রেক্ষাপটে ইসলামকে বুঝতে চেয়েছেন তিনি। তাঁর এই দর্শন অনেক বেশি, আবার বাংলাদেশের জন্যও জরুরি হয়ে ওঠে।
গ্রন্থে এই ছয়জনকে বিশিষ্ট হিসেবে চিহ্নিত করার মধ্য দিয়ে আনোয়ার দিল এই ভূখণ্ডের সংস্কৃতি আর জাতীয়তার প্রশ্নে নানা প্রপঞ্চ হাজির করেছেন। মুক্তিযুদ্ধ এবং এর প্রেক্ষাপট ও পরবর্তী সময়ের সামাজিক-বুদ্ধিবৃত্তিক প্রসঙ্গে আনোয়ার দিলের গ্রন্থ গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, এপ্রিল ০৮, ২০১১
Leave a Reply