সাক্ষাৎকার নিয়েছেন কাজল রশীদ
আবুল কালাম মোহাম্মদ যাকারিয়া প্রত্নসম্পদ অনুসন্ধান ও আবিষ্কারে তুলনারহিত। অর্ধ শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে শৌখিন পুরাতত্ত্ব, গবেষণা, প্রাচীন পুঁথি সংগ্রহ এবং প্রত্নবস্তু সংগঠনে সংযোজন করে চলেছেন নতুন ইতিহাস। এখন তাঁর বয়স ৯৩, কিন্তু এখনো তিনি কর্মব্যস্ত।
বর্ণাঢ্য এক জীবনের অধিকারী আপনি, চেনা ও জানার জগতের মতোই আপনার দেখার পরিধিও নিশ্চয়ই বিস্তর ও ব্যাপক। এমন কোনো ব্যক্তিত্বের কথা বলবেন কি, যাঁদের সান্নিধ্যে যাওয়ার সুযোগ আপনার হয়েছে?
আমি, একজন সেলফ মেড ম্যান এক জীবনে অনেকের সান্নিধ্যে গেছি, যার সবটা বলা দুরূহ। বায়সিক কারণেই রবীন্দ্রনাথের সান্নিধ্যে যাওয়ার সুযোগ হয়নি। তবে নজরুলের সান্নিধ্য পেয়েছি। স্বাধীনতার পর তাঁকে এ দেশে আনার ক্ষেত্রে মন্ত্রী ইউসুফ আলী ও আমি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করি। আমি জানতাম, কবি ওখানে খুবই কষ্টে রয়েছেন, তাঁকে দেখাশোনা করারও কেউ নেই। ছেলের বউটা পর্যন্ত বিয়ে করে অন্যত্র চলে গেছে। শেখ সাহেবকে বললাম, কাজী নজরুল ইসলামকে এ দেশে আনতে চাই। তিনি এককথায় অনুমতি দিলেন। বুদ্ধদেব বসু ও জ্যোতি বসু আমার ইমিডিয়েট সিনিয়র ছিলেন। তাঁদের সম্পর্কে জানতাম, কিন্তু কাছাকাছি যাওয়ার সুযোগ হয়নি। বুদ্ধদেব বসুর ছোট ভাইয়ের সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতা ছিল।
ব্রিটিশ শাসনাধীন অবস্থায়ই আপনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগ থেকে মাস্টার্স শেষ করেছেন—
হ্যাঁ, চাকরিও শুরু করার কথা ছিল। কিন্তু অ্যাপয়েন্টমেন্ট দেওয়ার পরও চাকরিতে জয়েন করতে দিল না। ৪৭-এর ব্যাচেই আমি ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে কোয়ালিফাই করি। কলকাতায় জয়েন করতে যাই। ওরা বলল, আপনি চলে যান, দেশ ভাগ হয়ে যাচ্ছে। পাকিস্তানে জয়েন করেন।
এক অর্থে আপনাকে ত্রিকালদর্শী বলা যায়! ব্রিটিশ ও পাকিস্তান শাসনামল যেমন দেখেছেন, তেমনি বাংলাদেশ শাসনামলও দেখেছেন। আপনার কাছে এর তফাতটা কোথায়?
যতটা পরিবর্তন প্রত্যাশিত ছিল, ততটা ঘটেনি। বাংলাদেশে আমি মনে করি, প্রধান সমস্যা জনসংখ্যা। এককথায় বলতে পারি, পাকিস্তান শাসনামল হলো ব্রিটিশ শাসনামলের কনটিনিউয়েশন এবং উই টুক ফ্রম দ্য ব্রিটিশ অ্যান্ড পাকিস্তান। এখন সৎ অফিসার পাওয়া খুবই কঠিন। আমি কিন্তু চাকরিতে সময় দিয়েছি যথেষ্ট। এ কারণে আমার লেখালেখির সবটাই হয়েছে অবসরের পর। চাকরির ফাঁকে যতটা সময় বের করতে পেরেছি, সেটুকু কাজে লাগিয়েছি বিভিন্ন জায়গা ঘুরে এবং দুর্লভ সব জিনিসপত্র সংগ্রহ করে।
তাহলে কি দিন যত যাচ্ছে, অবক্ষয় তত বাড়ছে?
বাস্তবতা তো তা-ই, মনে হচ্ছে। আমার ঘরের সোফা তো সেই ১৯৬০ সালের। আমি যতটুকু না হলেই নয়, ততটুকু নিয়েই সন্তুষ্ট থেকেছি। গাড়ি, প্রাইভেট সেক্রেটারি ছাড়াই তো একা জীবন পার করে দিচ্ছি। খুব কি খারাপ আছি? ১৯৬৮ সালে কিংবা তারও আগে আমার কাছে এমন সব প্রত্নসম্পদ ছিল, যা সেই সময় লাখ টাকায় বিদেশিরা নিতে চেয়েছে। আমি তাঁদের দেখানো লোভ-লালসার কাছে পরাস্ত হইনি।
আপনি তো যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকত্ব পেয়েছিলেন—
হ্যাঁ, ১৯৫৮ সালে আমাকে অনারারি নাগরিকত্ব দেওয়া হয়। তবে আমি কখনোই ওখানে থাকতে চাইনি; থাকিনি।
লেখালেখিতে এলেন কীভাবে? প্রথম লেখালেখির কথা মনে আছে কি?
আমি সারা জীবনই লেখালেখি নিয়ে থেকেছি। প্রথম লিখি কবিতা; একটানা অনেক দিন লিখেছিলাম। হারিয়ে ফেলেছি। প্রথম গবেষণামূলক লেখা নৃতত্ত্ব নিয়ে। প্রথম প্রকাশিত বই বাংলা একাডেমী থেকে গুপিচন্দ্রের সন্ন্যাস, যা ১৯৭৪ সালে প্রকাশিত হয়। কবি শুকুর মাহমুদ রচিত এই পুঁথিটি আমি দিনাজপুর থেকে সংগ্রহ করি।
সীতাকোট বিহার আবিষ্কার করলেন কীভাবে; আর কীভাবেই বা এত এত পুঁথি সংগ্রহ করলেন, দিনাজপুরে দেশের তৃতীয় বৃহত্তম প্রত্নসম্পদ সংগ্রহশালা তৈরি করলেন?
চাকরির ফাঁকে ফাঁকে এগুলো করেছি। দেখেছি, পড়েছি, খুঁজেছি। সংগ্রহের জন্য সর্বান্ত হয়েছি। কিন্তু লেখালেখির জন্য যে নিরবচ্ছিন্ন সময় দেওয়ার দরকার, সেটা বের করতে পারিনি। তাহলে চাকরিতে ফাঁকি দিতে হতো।
সীতাকোট বিহার আবিষ্কার করলেন কীভাবে?
এটি দিনাজপুরে অবস্থিত। আমি তখন ওখানকার যুগ্ম সহকারী কমিশনার। সীতাকোট বিহার তখন সীতার বনবাসস্থল হিসেবে স্বীকৃত। ১৯১২ খ্রিস্টাব্দে তদানীন্তন জেলা প্রশাসক এফ ডব্লিউ স্ট্রং স্থানীয় লোকশ্রুতির ওপর ভিত্তি করে জেলা গেজেটিয়ারে তা-ই উল্লেখ করেছিলেন। কেউ কেউ বলত বাঁধানো পুকুর।
১৮৭৪ সালে দিনাজপুরের প্রশাসক ও পুরাতাত্ত্বিক ওয়েস্টম্যাক্ট এই জায়গাটিকে মনে করেছিলেন বাঁধানো পুকুর। আমি কারও কথাই মানিনি। আমি বললাম, এটা একটা বৌদ্ধবিহার। ১৯৬৭ খ্রিষ্টাব্দে দিনাজপুরে বদলি হয়ে গেলাম। সিদ্ধান্ত নিলাম, জায়গাটা খুঁড়ে দেখতে হবে। এরূপ পুরাতাত্ত্বিক খননের জন্য যে পরিমাণ অর্থের দরকার হয়, তা সংগ্রহের জন্য জেলা বোর্ডকে ১০ হাজার টাকা দেওয়ার জন্য রাজি করালাম আর কারিগরি সহায়তার জন্য রাজি করালাম প্রত্নতত্ত্ব বিভাগকে। খননকাজে বিহারের প্রবেশপথ আর ছাত্রাবাসসহ পুরো কাঠামোর যে রূপ বেরিয়ে এল, আনুমানিক ১৯৫৮ খ্রিষ্টাব্দে করা নকশার সঙ্গে তা হুবহু মিলে গেল। শুধু তা-ই নয়, অনেকে বিহারটিকে সপ্তম শতকের বলতে চাইলেও আমি নাকচ করে দিই। আমার বিশ্বাস ছিল, মাঝে মাৎস্যন্যায়ের যুগে এত বড় বিহার কিছুতেই তৈরি হতে পারে না। তা ছাড়া পরবর্তীকালের বিহারগুলোর মতো এখানে কোনো কেন্দ্রীয় মন্দির নেই। তাই অভিমত দিলাম যে এটি পঞ্চম বা ষষ্ঠ শতকের বিহার। আমার কথাই সত্য বলে প্রমাণিত হলো।
ছোটবেলায় কী হওয়ার স্বপ্ন দেখতেন? লেখালেখির জগতে নিজেকে কীভাবে দেখতে চেয়েছিলেন?
ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট হওয়ার স্বপ্ন ছিল; হয়েছিও তাই। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতা করলে বোধ হয় ভালো হতো। লেখালেখিটা বেশি করে করতে পারতাম। লেখালেখির জগতে কবি হওয়ার ইচ্ছা ছিল। এ কারণে এখনো কবিতা লিখি। যদিও আমার ৩৫টি বই বাজারে রয়েছে, কবিতার বই একটিও নেই।
গল্প, কবিতা, উপন্যাসও লেখেন। আমাদের দেশের এই সময়ের সাহিত্য সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন কী?
আমি তো বিশ্বসাহিত্যের পাঠক। ইংরেজি ও ফরাসি সাহিত্য আমার খুবই প্রিয়। আমি নিজে কয়েকটি ভাষা জানি, যেগুলোর সরাসরি পাঠক আমি। বাংলা সাহিত্যে আমি রবীন্দ্রনাথই ঘুরে ফিরে পড়েছি। নজরুল, শরৎচন্দ্র, বঙ্কিম—এঁদের লেখাও পড়েছি। তবে এর বাইরে নয়। সত্যি কথা বলতে কি, এর বাইরে আমি পড়িনি। পড়ার রুচিও হয়নি।
আপনার পুঁথিসাহিত্য সংগ্রহ বাংলা সাহিত্যে গুরুত্বপূর্ণ
দিনাজপুরের সীতাকোট বিহার খনন চলাকালীন ঘুরতে থাকি প্রাচীন পুঁথির খোঁজে। ঘোড়াঘাট ডাকবাংলোর চৌকিদার নইমউদ্দিন সরকারের সঙ্গে পরিচয় হওয়ার পর বুঝতে পারি, প্রাচীন ইতিহাসের একজন বোদ্ধা তিনি। ইতিহাসকেন্দ্রিক অনেক প্রাচীন পুঁথিও তাঁর মুখস্থ। তাঁরই সূত্রে গোবিন্দগঞ্জ থানার চকনেওয়া গ্রামের তৈয়ব আলী সরকারের বাড়ি যাই। তৈয়ব আলী সরকারের বাবা খয়রুজ্জামান সরকার ছিলেন অনেক প্রাচীন পুঁথির লিপিকার। এখান থেকে সংগ্রহ করি দুষ্প্রাপ্য পাঁচটি মূল্যবান প্রাচীন পুঁথি, গুপিচন্দ্রের সন্ন্যাস, কবি শুকুর মাহমুদ; গাজী কালু চম্পাবতী, শেখ খোদা বখশ; বিষহরার পুঁথি, জগজ্জীবন ঘোষাল; বিশ্বকেতু, দ্বিজকাশুপতি এবং সত্যপীরের পুঁথি, কৃষ্ণ হরিদাস। এ ছাড়াও রংপুর, বগুড়া ও চট্টগ্রামের নানা স্থান থেকে সংগ্রহ করেছি বহু বিখ্যাত বাংলা ও সংস্কৃত পুঁথি, যার মধ্যে হালুমীরের পুঁথি ও মালাধর বসুর পুঁথি অন্যতম। এই সময়ই আমি গ্রামবাংলার হাসির গল্প সংগ্রহ করি। এখন পর্যন্ত সংগৃহীত পুঁথির সংখ্যা ১৫।
আপনার করা অনুবাদসাহিত্য—
অনূদিত বইগুলোর মধ্যে রয়েছে তবকাত-ই-নাসিরি, মূল লেখক মিনহাজ-ই-সিরাজ, বাংলা একাডেমী, ঢাকা (১৯৮৩); তারিখ-ই-বাঙ্গালা-ই-মহাবত জঙ্গী; মোজাফফরনামা; নওবাহাব-ই-মরশিদ কুলি খান, মূল লেখক করম আলী, বাংলা একাডেমী, ঢাকা এবং সিয়ারুল মুতাখখিরিন। এসব বই সরাসরি ফারসি থেকে অনূদিত।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, এপ্রিল ০১, ২০১১
Leave a Reply