নিজের অগোচরেই কখন কিভাবে যে বইয়ের সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধা হয়ে গেল ভাবলে এখন আর কোন কুল কিনারা পাই না। আর কি যে কঠিন এই গাঁটছড়া, হাজার চেষ্টায়ও গত ৪৩ বছরে ছিঁড়তে পারিনি। অথচ বইয়ের কারণে সইতে হয়েছে কত বিড়ম্বনা কত অপমান, কতবার কতরকম বিব্রতকর অবস্থায় যে পড়েছি তা না হয় না-ই বললাম। কিন্তু বহুকাঙ্ক্ষিত, বহু মূল্যবান বইটি হাতে পাওয়ার পর—সে যে আনন্দ, পুরনো বইয়ের সেই গন্ধ—এর সঙ্গে আর কোনো প্রাপ্তিরই বোধকরি তুলনা চলে না। তখন সমস্ত বিড়ম্বনা, অপমান মুহূর্তে সব যেন অকিঞ্চিৎকর হয়ে যায়। তাই তো এত বছর হয়ে গেল, এখনো বইয়ের নেশায় সময় নেই অসময় নেই, কোনো কিছুই তোয়াক্কা না করে ঘুর ঘুর করি বইয়ের দোকানে।
শৈশবের কথা মনে পড়ে, আজ থেকে প্রায় ৪৩ বছর আগে, বাবার বদলির চাকরি সূত্রে তখন বান্দরবানে, বাবার অফিসের পিয়ন সিদ্দিক ভাইয়ের সঙ্গে গিয়ে লাইব্রেরি থেকে দুটো বই কিনে নিয়ে আসি। একটা বইয়ের নাম মনে আছে এখনও, সোনার কমলা, অন্যটার নাম মনে নেই। তবে বইটার প্রচ্ছদের ছবি এবং একটা গল্প আমাকে অনেক দিন তাড়া করে ফেরে। বহুল প্রচলিত সেই গল্পটা ছিল বাঘ ও রাখালের। ‘বাঘ আসিয়াছে, বাঘ আসিয়াছে বলিয়া যে রাখাল একাধিকবার তামাশা করিয়া মানুষকে ধোঁকা দিয়েছিল, শেষে যেদিন সত্যিই বাঘ আসিল সেইদিন রাখালকে রক্ষা করিবার জন্য কেহই আগাইয়া আসে নাই।’ প্রচ্ছদের ছবিটা মনে গেথে আছে, বাঘের রাখাল ছেলেটার ঘাড় মটকানোর দৃশ্য। রাখালটার জন্য আমার কান্না পেত। গল্পটার অন্তর্নিহিত উপদেশ বোঝার বয়স তখনো আমার হয়নি। আর, সেই শুরু। নিজের জন্য বই কেনা যে আরম্ভ হলো, তা চলছে আজ অবধি।
আমার সংগ্রহের বেশির ভাগ বই এসেছে পুরোনো বইয়ের দোকান থেকে। একসময় পুরনো পল্টনে পাঁচ-ছয়টা পুরনো বইয়ের দোকান ছিল, সেখানে যাতায়াত ছিল অনেক বিখ্যাত সাংবাদিক-কবি-লেখকদের, নিয়মিত যেতেন শাহাদাত চৌধুরী, আঁকিয়ে ও বিচিত্রা সম্পাদক, দেখেছি ঔপন্যাসিক রাহাত খানকে, মাঝেসাঝে ঢু মারতেন মাসুদ রানা খ্যাত কাজী আনোয়ার হোসেনও—পুরনো পল্টনের সেসব বইয়ের দোকান ওঠে গেছে অনেক কাল। বইয়ের দোকান মালিক হাসেম মারা গেছে অনেক আগেই, রেডিও সারাইয়ের ব্যবসা ছেড়ে বিচিত্র কারণে পুরনো বইয়ের পেশায় আসা কাদের মিয়াও ঘরে বসে গেছে অনেক দিন, সেগুন বাগিচার কমিশনার নির্বাচন করা বাবু, তার রাস্তার পাশের বিশাল দোকান ছিল, সেও বেঁচে নেই। এদের ছেলেদের কেউ কেউ এই ব্যবসায় এসেছে, কিন্তু তাদের পাকা দোকান নেই। তারা বসে পল্টনের হাউজ বিল্ডিংয়ের সামনে ফুটপাতে। পল্টনের রাস্তায় এখনো মাঝে মাঝে দেখা হয়ে যায় কবি বেলাল চৌধুরীর সঙ্গে। এখন বেশির ভাগ দোকান নীলক্ষেতে, তবে সেখানেও পাঠ্যবই আর ফটোকপির বইয়ের দোকানে কমে আসছে পুরনো বইয়ের দোকান। সদরঘাটেও বেশ কিছু দোকান ছিল, সব বন্ধ হয়ে গেছে। চট্টগ্রামের স্টেশন রোড থেকে প্রচুর বই সংগ্রহ করেছি, সম্ভবত সেই দোকানের নাম ছিল অমর বুক স্টোর, স্মৃতি যদি বিশ্বাসঘাতকতা না করে থাকে।
পুরানা পল্টনের দোকান ওঠে যাবার পর বইয়ের জন্য একমাত্র গন্তব্য অনেক দিন ধরে নীলক্ষেত। যেখানে সব সময়ই থাকে এক অপার সম্ভাবনা ও অপ্রত্যাশিত প্রাপ্তির হাতছানি। কখন কোন বই যে আপনি নীলক্ষেতে পেয়ে যাবেন, তা আগেভাগে চিন্তা করা অসম্ভব। বিচিত্র পেশার বিভিন্ন বয়সের ক্রেতা সমাগমে গমগম করে নীলক্ষেত। অন্য সবার কাছে প্রধানত পাঠ্যবই এবং পাঠ উপকরণের মার্কেট হলো নীলক্ষেত। কিন্তু আমরা যারা পাঠ্যবইয়ের বাইরে বই খুঁজি, তাদের জন্য এখন এক পরম ভরসার জায়গা হলো এই নীলক্ষেত। এখানেও বই খুঁজতে গিয়ে বেশ কিছু পাঠক-ক্রেতার সঙ্গে পরিচয় হয়েছে, যাঁদের অনেকেই এখন আমার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধুবান্ধব। তাদের বন্ধুবাৎসল্যে আমি একই সঙ্গে ঋণী ও ঋদ্ধ।
শুরুতে বলেছি বই কেনার ঝক্কি-ঝামেলা বা বিড়ম্বনার কথা। প্রশ্ন হতে পারে বই কেনায় টাকা থাকলে আবার বিড়ম্বনার কিসের। বিড়ম্বনা আছে, এই বিড়ম্বনার নানা ধরন, ঘরের ও বাইরের। ধরেন, বাজার করতে বেরিয়েছি, মনে হলো নীলক্ষেতে একটু চোখ বুলিয়েই নিউমার্কেটে কাঁচাবাজারটা সেরে বাসায় যাব। কোনো বই কিনব না। কিন্তু নীলক্ষেতে গিয়েই আটকে গেলাম। একগাদা পছন্দসই বই পেয়ে পকেটের প্রায় পুরো টাকা খরচ করে এবং কিছু টাকা বাকি রেখে বাজারের ব্যাগ খালি নিয়ে বাসায় ফিরতে হলো। তখন কী অবস্থা হয় সেটা আর নাই বা বললাম। আবার অনেক সময় এ রকমও হয়েছে যে দু-একটা বই পছন্দ করে বিক্রেতার কাছে রেখে এসেছি, পরের দিন নেব বলে। কিন্তু পরের দিন গিয়ে দেখি, বিক্রেতাকে বুঝিয়ে-শুনিয়ে বইগুলো আমারই এক বন্ধু নিয়ে গেছেন এবং আমাকে পেয়ে সেই মজার ঘটনার বর্ণনা করছেন। এ রকম অনেক মজার ঘটনাই ঘটে। তবে নীলক্ষেতের সবচেয়ে বড় ব্যাপারটা হলো হঠাৎ করে কোনো দুষ্প্রাপ্য বই পেয়ে যাওয়া। আর দুষ্প্রাপ্য না হলেও পছন্দের অনেক বই নীলক্ষেতে প্রায়ই মেলে, যা আমাদের নতুন বইয়ের দোকানগুলোতে পাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। এখানে একটা কথা উল্লেখ করা অপ্রাসঙ্গিক হবে বলে মনে করি না যে, নতুন বই যাঁরা আমাদের এখানে আমদানি করেন বা বিক্রি করেন তাঁরা এক অর্থে অনুসন্ধিৎসু পাঠকদের চাহিদা মেটাতে ব্যর্থ। তাঁরা গৎবাঁধা কিছু বিষয়ের বইয়ের গণ্ডি থেকে বেরোতে পারছেন না। সত্যিকার অর্থে বই আমদানি করতে যেন তাঁদের চরম অনীহা।
মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত নাইজেরিয়ান লেখক ও মানবাধিকারকর্মী কেন সারো উইয়া-র লেখা বই, ভারতের প্রয়াত মন্ত্রী হুমায়ুন কবীরের সই করা কাউকে উপহার দেওয়া তাঁরই কোনো বইয়ের প্রথম সংস্করণ, লাতিন আমেরিকান নারী লেখক ইসাবেলা আলেন্দে-র সই করা বই বা দেশি-বিদেশি হরেক রকমের বই যেমন: আ হিস্ট্রি অব আমব্রেলা, আ হিস্ট্রি অব বাইসাইকেল ইত্যাদি বই নীলক্ষেত ছাড়া আর কোথায় পাওয়া যাবে? সাহিত্যের পাঁড় পাঠক হতে পেরেছি কিনা জানি না তবে খেয়ে না খেয়ে বইয়ের পেছনেই ছুটেছি সারা জীবন। যখন অবসর সময়ে তাকে থরে থরে সাজানো বিশ্বসাহিত্যের সব সোনা ফলানো লেখক, দার্শনিকের বইগুলো দেখি, নাড়াচাড়া করি আজকাল প্রায়ই মনে হয়, এত বই সব তো পড়া হয়নি, আর হবেও না। যে সংগ্রহ গড়ে তুলেছি তার সব বই যদি পড়তে চাই তাহলে এক জীবন কিছুই না। অথচ বই কেনার সময় আমার চেয়ে সতর্ক ক্রেতা তো আর কেউ না, কোনো অকিঞ্চিৎকর, গৌণ বই কখনই কিনিনি। তাকে সাজানো বইয়ে জ্বল জ্বল করছে সব দুনিয়া সেরাদের নাম, এদের কারো কারো বই একটি শেষ করতে না করতেই কখন চলে গেছি অন্য বইয়ে, এভাবেও অনেক বই শেষ পর্যন্ত শেষ করা হয়নি। আর কোনো দিনই হবে না। যদি সব বই পড়তে চাই তাহলে আমাকে বাঁচতে আরও শ খানেক বছর।
এখন আরো বাছাই করে বই কিনি, পড়িও অনেক বাছাই করে, তারপরও নীলক্ষেতে নিয়ম করে যাওয়া হয়, এখনও সেই তরুণ বয়সের মতো্ই তীব্র উত্তেজনা নিয়ে দুষ্প্রাপ্য, দুর্লভ বই দেখলে বুক কেঁপে ওঠে, এখনও পছন্দের কোনো বই বগলদাবা করে রিকশায় উঠে নাড়াচাড়া করতে করতে বাসায় ফেরার আনন্দ আগের মতোই অমলিন।
বাসায় এখন আর বই-এর জন্য জায়গার সংকুলান হয় না। অতি কষ্টে ঝাড়াবাছাই করে মাঝে মাঝে কিছু পুরনো জার্নাল, সাহিত্যের কাগজ, বই অনিচ্ছাসত্ত্বেও বিক্রি করি। কিন্তু বিক্রি করার সময় টের পাই মন সায় দিচ্ছে না। এই বই তো শুধু একটা বই বা জার্নাল না, এর সঙ্গে জড়িয়ে কত স্মৃতি, সময়।
পরম যত্নে এখনও বই আগলে রাখার চেষ্টা করি। বই-এর প্রতি এই অসম্ভব টান দেখে মা একদিন বলেছিলেন বইকে যেভাবে যত্ন করি এই যত্ন কিংবা মনযোগ যদি তাদের প্রতি থাকত—কথাটা শুনে আমি থমকে যাই। বই তো মানুষের চেয়ে বড় নয়। বই তো মানুষকে বোঝার জন্যেই, জানার জন্যেই। বই মানুষে মানুষে চিন্তার ঐক্য, বিনিময় গড়ার এক অনন্য মাধ্যম। এই জীবনে কেউই সব বই পড়তে পারবে না, কত কত মহান লেখকের মহান রচনা অপঠিত থেকে যাবে। সত্যজিৎ রায় তলস্তয়ের ওয়ার অ্যান্ড পিস পড়া শুরু করেছিলেন শেষ জীবনে, হাসপাতালে। আমারও কত বই পড়া হলো না, কিন্তু আমারই অপঠিত বই হয়তো একদিন হাতে তুলে নেবে আমার সন্তান, আরো পরে হয়তো তার সন্তান। তাই এটা বলতে পারি, আমি অনেক বিত্তবৈভব রেখে যেতে না পারলেও, নিশ্চিত রেখে যাচ্ছি জ্ঞানের এক অফুরান জগৎ।
লেখক: বিশ্ব সাহিত্যের একজন একনিষ্ঠ পাঠক। তাঁর ব্যক্তিগত সংগ্রহে আছে প্রায়বার হাজারের বেশি বই।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, এপ্রিল ০১, ২০১১
Leave a Reply