রহস্যের রূপায়ন
সোহরাব হাসান
রবীন্দ্র-চিত্রকলা—ভূমিকা: আবুল হাসনাত \ ছায়ানট \ জানুয়ারি ২০১১, মূল্য: ৩৫০ টাকা
গত জানুয়ারিতে ছায়ানট প্রকাশ করেছে রবীন্দ্র চিত্রকলা নামে কবির চিত্রকলার অ্যালবাম। এটি সম্পাদনা করেছেন আবুল হাসনাত। অ্যালবামে রবীন্দ্রনাথের ৬৪টি সাদা-কালো ও রঙিন চিত্র স্থান পেয়েছে। এ ছাড়া ছবি সম্পর্কে তিনটি লেখাও সংযোজিত হয়েছে, যার একটি কবির। শিরোনাম ‘আমার ছবি’। অন্য দুটি নিবন্ধ হলো প্রতিমা ঠাকুরের ‘গুরুদেবের চিত্রকর্ম’ ও আবুল মনসুরের ‘রবীন্দ্র মানসের অন্তিম বিক্ষেপ ও চিত্রকৃতির স্বাতন্ত্র্য’।
লেখাগুলো রবীন্দ্রনাথের ছবিগুলোর মর্ম বুঝতে ও জানতে সহায়ক হবে। চেনা যাবে চিত্রকর রবীন্দ্রনাথকেও।
সম্পাদক ভূমিকায় লিখেছেন, ‘অত্যুক্তি হলেও সত্য, রবীন্দ্রনাথের চিত্রগুলোর যে রহস্য আমাদের মুগ্ধ করে, আবিষ্ট করে, সৌন্দর্যচেতনার জিজ্ঞাসায় উৎসুক করে, সৃজনের অনন্যতায় তা ভারতবর্ষের আধুনিক শিক্ষা-ইতিহাসের চিত্রচর্চায় এক দৃষ্টান্ত হয়ে থাকে।’
চিত্র সমালোচক আবুল মনসুরের ভাষায়, ‘আধুনিক ভারতবর্ষে রবীন্দ্রনাথই সর্বপ্রথম তাঁর চিত্রের মাধ্যমে আমাদের দেখালেন, ছবি একটি স্বাধীন ও স্বতন্ত্র সৃষ্টি, অন্য কিছুর মুখচেয়ে এর কাজ নেই। রূপ ও ছন্দের মিলনে শিল্পীর অনুভূতির গোপন গভীরে এর জন্ম।’
নিজের ছবি সম্পর্কে কবির মূল্যায়ন হচ্ছে: ‘আমি বিশ্ব সংসারকে কল্পনা করতে পারি রেখার জগৎ সংসার হিসেবে যেগুলো তাদেরকে মূর্ত প্রবাহের অন্তহীন শৃঙ্খলে পর্বতশ্রেণী ও মেঘমালা, বৃক্ষরাজি, ঝর্ণাধারা, অগ্নিগর্ভ জ্যোতিষ্কমণ্ডল, নিরন্তর জীবনস্রোত; নিশ্চুপ মহাকাল নিরবধি মহাশূন্য পেরিয়ে ভঙ্গিমারাজির মহাসংগীত মিলিত হয়ে যায় রেখাপুঞ্জের আর্তনাদে; যেন তারা আকস্মিক ইচ্ছাপূরণের আকাঙ্ক্ষায় সংগীহীনা বেদেনীর লক্ষ্যহীন ঘুরে বেড়ানো।’
কবিতায় রবীন্দ্রনাথ ধ্যানী, বিন্যস্ত ও নিয়মরীতির অনুসারী হলেও চিত্রে তার ঠিক বিপরীতই লক্ষ করা যায়। চিত্রকর রবীন্দ্রনাথ সুন্দরের পাশাপাশি জীবন ও জগতের কুৎসিত ও বিকট রূপও তুলে ধরেছেন। তাঁর ছবিতে অসম্ভব গতি আছে, আছে অফুরন্ত প্রাণশক্তি, কখনো কখনো যা ধ্বংসকে আহ্বান করে। তিনি এঁকেছেন আত্মপ্রতিকৃতি, নৃত্যরতা নারী, সাঁওতাল মেয়ে, আলো-আঁধারির খেলা, এঁকেছেন পশুপাখির ছবি, কিন্তু তাতেও আকৃতি বা অবয়ব নয় বড় হয়ে উঠেছে ভেতরের প্রাণশক্তিই । তাঁর কোনো কোনো মানবমুখ বেদনার্ত, বীতশ্রদ্ধ, আবার কোনো কোনোটি জীবনজয়ী চেতনায় উদ্ভাসিত।
৬৭ বছর বয়সে রবীন্দ্রনাথ ছবি আঁকা শুরু করেন। এরপর আর ক্ষান্ত দেননি। অসুস্থ থাকার সময় আক্ষেপ করে বলেছেন, সুস্থ থাকলে তিনি ছবি আঁকতেন। আমাদের ধারণা কবিতা ও সংগীতে যেসব কথা ও ভাবের কথা বলতে পারেননিসেসবই চিত্রকলায় ফুটিয়ে তুলেছেন। তাঁর প্রতিকৃতিগুলোতে অস্তিত্বের গভীর অন্তর্দ্বন্দ্ব আছে, আছে মানবমনের নানা রহস্যের রূপায়ন। কবির ভাষায়, ‘ছবির কাজ প্রকাশ করা, ব্যাখ্যা করা নয়।’ সে কথা অবশ্য কবিতার বেলায়ও খাটে।
রবীন্দ্রনাথের ছবি সম্পর্কে প্রতিমা ঠাকুর বলেছেন, ‘মর্ত্যনেশার সীমা ছাড়িয়ে বিশ্বসত্তার সঙ্গে মিলিত হওয়ার অজর বাসনাই শিল্পীর ব্যাকুল হূদয়কে চিরদিন হাতছানি দিয়েছে। সৃষ্টিশীলতার গভীর আরতি থেকেই তিনি তুলে ধরেছেন গতিময়তার সীমাহীন গুরুত্ব, জীবনের বহুবিচিত্র রূপ, কথা ও ভাষা নতুন নতুন রূপে, কখনো সত্যে বিদ্যমান আনন্দের ছন্দে ছন্দে, সর্বোপরি রোদ ও বর্ণের স্বর্গীয় ইঙ্গিতে।’
ভারতবর্ষের প্রথম আধুনিক চিত্রকর রবীন্দ্রনাথের ছবি সম্পর্কে অনেকেই জানেন না। জানলেও তাঁর চিত্রকলাগুলো একসঙ্গে পাওয়া যায় না। সেই দুর্লভকে সুলভ করেছে ছায়ানট। এ জন্য তারা ধন্যবাদ পেতে পারে। রবীন্দ্রনাথের ৪৪টি ছবির এই অ্যালবামের দাম রাখা হয়েছে মাত্র ৩৫০ টাকা। ফলে এটি শিল্পবোদ্ধা তো বটেই, সাধারণ পাঠকও কিনতে আগ্রহী হবেন।
রবীন্দ্র সার্ধশত জন্মবর্ষে এই মহৎ উদ্যোগের জন্য ছায়ানটকে অভিনন্দন। তবে অ্যালবামটির একটি অপূর্ণতার কথা উল্লেখ করতে হয়। ছবিগুলোর কোনো পরিচিতি নেই। ছবিগুলোর পরিচিতি থাকলে সাধারণ দর্শক-পাঠকদের বুঝতে সুবিধা হত।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, এপ্রিল ০১, ২০১১
Leave a Reply