মুস্তফার কাঁধে পিআইএর বিমানের ছাপমারা একটি হলুদ পুরোনো রংচটা ছেঁড়া জিপারের ট্র্যাভেলিং ব্যাগ। সে দোলখোলার মোড়ে এসে রিকশা খুঁজতে থাকে। এখন বৃষ্টি নেই, আকাশ মেঘাচ্ছন্ন ও গুমোট। রাস্তাঘাট ভেজা, বিল্ডিংয়ের কার্নিশ ও দোকানগুলোর চাল থেকে ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টির জমে থাকা পানি পড়ছে। বৃষ্টির কারণে রিকশাচালকেরা ভাড়া হাঁকাচ্ছে দ্বিগুণ। একটি রিকশা দরদাম করে আইডব্লিউটিএ ঘাটের দিকে যেতে থাকে। পাওয়ার হাউসের মোড়ে এসে রিকশা আটকে যায়। যশোর রোড ধরে বিশাল মিছিল চলছে। হাজার হাজার শ্রমিক ছোট ছোট লাল পতাকা দুলিয়ে ও প্ল্যাকার্ড কাঁধে ছুটছে মিউনিসিপ্যাল পার্কের দিকে। তাদের স্লোগানে আকাশ-বাতাস মুখরিত।
সামনে ঝাঁকবাঁধা রিকশার দঙ্গল, মালবোঝাই কয়েকটি ঠেলাও আটকে পড়েছে। রিকশার উৎসুক যাত্রীরা বলছে, ‘দৌলতপুর কুলিবাগান থেকে জুটপ্রেসের শ্রমিকেরা মিছিল নিয়ে আসছে।’
মুস্তফা এক তরুণ রিকশাযাত্রীকে জিজ্ঞেস করে, ‘এরা কিসের মিছিল করছে?’
তাকে বেশ উত্তেজিত মনে হয়, বলে, ‘আমার দেশের পাট বিক্রির টাকা চলে যায় পশ্চিম পাকিস্তানে আর ভুখানাঙ্গা পাটশ্রমিদের ন্যায্য মজুরি দেওয়া হয় না। তাদের সন্তানেরা খেতে পায় না। কতকাল তারা মুখ বুজে সহ্য করবে?’
মিছিলের গগনবিদারি স্লোগানে তার বক্তৃতা ঢাকা পড়ে যায়, মুস্তফা আর কিছুই বুঝতে পারে না।
মামাবাড়ি থেকে বেরিয়ে একবার সে নতুন বাজারে যেতে চেয়েছিল, কিন্তু নতুন বাজারে সব লঞ্চ থামে না, তাই সে সিদ্ধান্ত পাল্টায়। আইডব্লিউটিএ ঘাট থেকে তাদের ধানুয়াবাদ লাইনের অনেক লঞ্চ ছাড়ে। ভাঙ্গনপাড়, কুড়িকাহুনি, চালনা, মোঙ্গলাপোর্ট এসব লঞ্চ নালুয়া নদী দিয়েই যায়। তাই মনে মনে সে সিদ্ধান্ত নেয়, এই বৃষ্টিবাদলের দিনে আইডব্লিউটিএ ঘাটে যেয়ে দেখেশুনে আজদাহা বড় একটি লঞ্চে উঠবে। কিন্ত এখন ভারি কিচাইনে পড়েছে, মিছিলের যেন শেষ নেই। সে শিববাড়ীর দিকে তাকায়, পিঁপড়ের সারির মতো লাল পতাকায় রাঙানো জনস্রোত আসছে।
অগত্যা রিকশা থেকে নেমে পড়ে।
লঞ্চ টার্মিনালে এসে মোকছেদ মেম্বারের সঙ্গে দেখা, তাঁর সঙ্গে কথা বলে জেনে নিল সাড়ে চারটায় কুড়িকাহুনির বড় লঞ্চটি ছাড়বে। মেসার্স ছোমেদউদ্দিন সান অ্যান্ড কোং নামের বেশ বড় জাব্দাজোব্দা একটি লঞ্চ, সে এই লঞ্চের টিকিট কেটে উঠে পড়ে। সাধারণত মুস্তফা আপার ক্লাসে বসে না, ডাবল ভাড়া। তাছাড়া এখানে গ্রাম্য এলিট-টাউট কিসিমের লোকেরা ও কিছু সিনিয়র কলেজ ছাত্ররা বসে। তবে এবার সে নব্য কলেজ স্টুডেন্ট, একটা স্ট্যটাস আছে না, আর কলেজছাত্রদের হাফ ভাড়া, সে নুতন আইডেন্টি কার্ডও সঙ্গে এনেছে।
মোকছেদ মেম্বার আপার ক্লাসে বসে সিগারেট টানছে। মুস্তফা তার ব্যাগটি মেম্বারের উল্টো দিকে সিটের ওপর রেখে বলে, ‘মেম্বর কাকা আমার ব্যাগটি থাকল, দেখবেন, আমি একটু ঘুরে আসি।’
‘আরে ভাইপো, আমার কাছেই বসো, ব্যাগ ইহেনি রাখো।’
‘না না, আপনি মুরুব্বি মানুষ, লঞ্চে আমার আবার ঝিমোনর অভ্যেস আছে।’
সে মোকছেদ মেম্বারকে দু-চোখে দেখতে পারে না। এই বিডি মেম্বার মুসলিম লীগের টাকা খেয়ে আইয়ুব খানকে ভোট দিয়েছিল, পরে দেখা গেল, এক শ টাকার জিন্নাহ মার্কা সব নোট ছিল জাল। তা ছাড়া ধানুয়াবাদ হাটখোলায় তারা যখন পাঠাগার করেছিল, তখন এই মেম্বার কোনো সহায়তা তো করেইনি, বরঞ্চ অনেক পানি ঘোলা করেছিল।
লঞ্চ ছেড়ে দেওয়ার সময় হলো, মুস্তফা লঞ্চে উঠে নিচে ডেকের ভেতর দিয়ে হেঁটে যায়। এখন বৃষ্টি নেই, তবে বাতাস শুরু হয়েছে। টিকিট কেটে কিছু আনি-দোয়ানি তার পকেটে রয়েছে। একটি বেঞ্চে বসে সে তিলের খাজাওয়ালাকে ডেকে দুই আনার তিলের খাজা কিনে চিবুতে থাকে, এক প্যাকেট বাড়ির ছোট ভাইবোনদের জন্য নেয়। গুড় ও তিলমিশ্রিত উপাদেয় তিলের খাজা। তাদের গ্রামে তিল চাষ হলেও কেউ খাজা বানানোর রেসিপি জানে না। এই মুখরোচক মালটি যশোরের দিক থেকে এখানে আসে।
ভৈরব পেছনে ফেলে লঞ্চ এখন ফরেস্ট ঘাটের কাছে রূপসা নদীতে। ঘাটে ‘বনরানী’ ছোট বাহারি স্টিমারটি বটগাছের মোটা শেকলের সঙ্গে বাঁধা। এই স্টিমারে মন্ত্রী-মিনিস্টার—আয়ুব খানের পেয়ারের লোকেরা বাদায় যায় বাঘ, হরিণ ও কুমির শিকার করতে। মোগলরা মৃগয়ায় যেত হাতিতে চড়ে। ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট, নদীনালার ব্যারিকেড, এখানে হাতি অচল তাই আজকের নব্য মোগলদের জন্য এই বিলাসী কলের নৌযানের আয়োজন। ঝির ঝির করে বৃষ্টি শুরু হলো, অগত্যা গা বাঁচাতে মুস্তফা আপার ক্লাসের ভেতর ঢোকে।
‘মোকছেদ মেম্বার মুস্তফাকে বলে, কোয়ানে ছিলে এতক্ষণ? তোমার সিট আমি ঠেকায় রাহিছি।’
সিটে বসে ব্যাগটি বেঞ্চির নিচে চালান করে দিয়ে সে একবার চারদিকে চোখ ঘুরিয়ে দেখে নিয়ে বসে।
নুতন বাজার এসে লঞ্চ থামে। আরও কয়েকটি লঞ্চ এলোমেলোভাবে ঘাটে ভিড়ে আছে। অনেক প্যাঁচ কষে ঘাই-গুঁতো মেরে মেসার্স ছোমেদউদ্দিন সানা ঘাটে ভিড়ল। পিচ্ছিল কাঠের জেটি। সাবধানে পা টিপে টিপে যাত্রীরা উঠছে। অনেককে হাত ধরে কাঠের সিঁড়ি দিয়ে ওপরে তুলে দিচ্ছে হেলপার। একজন অন্ধ ভিক্ষুক একতারা নিয়ে উঠল।
দশাসই মোটা-তাজা মিশমিশে কাল রঙের একজন লোক, পরনে ঢোলা পাজামা ও সিল্কের মিহি পাঞ্জাবি, আপার ক্লাসের দরজায় একটু মাথা নিচু করে ঢোকে। লঞ্চের তেল-মবিলের আদিম খনিজ গন্ধ ছাপিয়ে একটা ভুরভুরে সুবাস চারদিক ছড়িয়ে পড়ে। মুস্তফা একটু আড়চোখে দেখে, তাঁর পাঞ্জাবিতে সোনার চেন ও সোনার বোতাম লাগানো। তাঁর পেছন পেছন হালকা-পাতলা ঢেঙ্গামতো, দেখতে তালপাতার সেপাই, লুঙ্গি ও হাওয়াই শার্ট পরে এক লোক এক হাতে অ্যাটাচি ব্যাগ এবং অন্য হাতে একটা ডাঙর চটের ব্যাগভর্তি সওদাপাতি নিয়ে ঢোকে।
মুস্তফার পাশে বসা মাঝারি সাইজের লুঙ্গি ও নীল খাটো পাঞ্জাবি পরা লোকটি উঠে দাঁড়ায়।
এবার দশাসই মাঝবয়সি লোকটি ডাকতে থাকে, ‘ও কেষ্ট, আমার সিট কোয়ানে রাখিছিস?’
‘আজ্ঞে, চ্যারমান সাহেব, এহিনি বসেন।’
সে মুস্তফাকে হালকাভাবে গায়ে হাত দিয়ে বলে ওঠে, ‘চ্যারমান সাব বসপেন, আপনি এট্টু সরেসুরে বসেন।’
চেয়ারম্যান সাহেব তার সঙ্গী টেন্ডলকে বলেন, ‘ও কাদের, অ্যাটাচি ব্যাগডা টেবিলির ওপর রাখ আর থলেডা টেবিলির নিচের দিকে রাখ।’
এবার মোটা বাচ্চা হাতির মতো লোকটি এসে মুস্তফার পাশে ফাঁকা করে দেওয়া সিটে পাছা গলাতে চেষ্টা করে, কিন্তু জায়গায় সংকুলান হচ্ছে না।
এবার টেন্ডল তালপাতার সেপাই বলে, ‘আপনারা এট্টু চাপে-চুপে বসেন, চ্যারম্যান সাহেবরে জায়গা করে দেন।’
সবার তখন নজর এই বাচ্চা হাতি চেয়ারম্যানের দশাসই শরীরের দিকে। কেউ কেউ একটু নড়েচড়ে তার জন্য জায়গা করে দিল।
মোকছেদ মেম্বার তার সিট থেকে উঠে দাঁড়িয়ে সালাম দিয়ে বলেন, ‘চেয়ারম্যান সহেব, কেমন আছেন?’
‘আরে, মোকছেদ না, তা তোমার খবর কী?’
‘আল্লার রহমতে সহিসালামতে আছি। তা আপনি কেমন আছেন?’
‘আর দেহোনা খুল্লের বাড়িতে আট-দশ দিন পড়ে ছিলাম, সাহেবের রাওয়ালপিন্ডিরতে আসার কথা ছেলো কিন্তু আসতি পারেনি, আউয়ুব খানের সাথে জরুলি কাজে আটকে গেছেন। পিসিডেন্ট হলি কী হবে, সাহেবরে ছাড়া তিনি কিছু করতি চান না।’
তিনি আবার হাঁক ছাড়েন, ‘ও কাদের, তোরা কনে। যেন বড় কালো মাইটের ভেতর থেকে আওয়াজ বেরোচ্ছে, তার উচ্চকণ্ঠের গমগমে আওয়াজে আপার ক্লাসের এই ক্যাবিন প্রকম্পিত হচ্ছে।
লঞ্চের সুমতি হয়েছে। আশপাশে ঠেলাধাক্কা দিয়ে লঞ্চটিকে অবমুক্ত করে সারেং দক্ষিণ দিকে মুখ করে চালাতে শুরু করে। বৃষ্টির সঙ্গে বাতাসও বইছে। জোয়ারের প্রতিকূল স্রোত, স্রোতের বাধা ঠেলে অনেক শক্তি খরচ ও কসরৎ করে লঞ্চটিকে সামনে এগোতে হচ্ছে। বাচ্চা হাতি চেয়ারম্যান সামনের গোলটেবিলের ওপর থেকে চামড়ার ব্যাগ খুলে লুঙ্গি বের করেন। বেশ কড়কড়ে নুতন প্ল্যাকার্ড লুঙ্গি। এবার তিনি দাঁড়িয়ে পাঞ্জাবি উঁচু করে লুঙ্গি পরে তাঁর পাজামার ফিতে খুলতে শুরু করেন।
লুঙ্গি পরা কমপ্লিট করে, পকেট থেকে একটি চেন লাগানো সোনালি রঙের গোলগাল চকচকে ঘড়ি বের করে সময় দেখলেন। ব্যাগ থেকে একটি খবরের কাগজ বের করে মেলে ধরলেন, আজকের সংখ্যা দৈনিক পাকিস্তান। পাঞ্জাবির ঝুলপকেট থেকে চশমার খাপ বের করে, খাপ খুলে সোনালি রঙের চশমা পরলেন।
‘কেষ্ট ও কেষ্ট’—
কেষ্টরা ধারে-কাছেই প্রস্তুত ছিল।
‘আজ্ঞে সাহেপ, কিছু নাগবে নাকি।’
‘নিচে যেয়ে চা’র অর্ডার দে!’
বলে তিনি এবার জোরে জোরে কাগজ পড়তে শুরু করেন: মওলানা ভসানীর চিকিৎসার জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজে মেডিকেল বোর্ড গঠন। বৃটেন প্রবাসী বাঙ্গালীরা তাকে লন্ডনে লইয়া চিকিৎসা করানোর প্রস্তাব পাঠাইয়াছেন। চীন ও সোভিয়েত রাশিয়া তাকে তাদের দেশে লইয়া চিকিৎসার প্রস্তাব পাঠাইয়াছে। কিন্তু তিনি বিদেশে যাইবেন না দেশেই চিকিৎসা লইবার ইচ্ছা প্রকাশ করিয়াছেন।
এবার তিনি পড়া বাদ দিয়ে মোকছেদ মেম্বারের দিকে তাকিয়ে বলতে থাকেন, ‘আরে ও মেম্বার, আমাগে মোসলেম লীগ সরকারের কাণ্ড দ্যাহো, ভাসানীর ট্রিটমেন্ট করতি টাহা খরচ করতিছে। জামাই আদরে শত্রু পালন।
জানালার পাশ থেকে তার টেন্ডল কাদের বলে ওঠে, ‘এই কারণে তো চ্যারমেন সাহেব আমাগে পাইটিতে মানুষজন আসতি চায় না।’
‘চুপ হারামজাদা, পার্টিতি কি মানুষজনের অভাব, তাহলি আমি চ্যারম্যান হলাম কি এরে, পাবলিক তো আমারে ভোট দেছে। মোসলেম লীগ আর সবুর সাহেবের লোক বলেই তো পাবলিক আমারে ভলোবাসে।’
এতক্ষণ বাইরের বাতাস ও চেয়ারম্যনের ধমকে টেন্ডল কাদের ম্যাকচা মেরে গিয়েছিল। এবার সে মোসাহেবির সুযোগ নিল, ‘চ্যারম্যান সাহেব, সবুর সাহেব আপনারে খুব ভালোবাসে, আপনি তারে এসব কথা কবেনদি, এই শালার ভাসানীর চ্যালাব্যালারা আমাগে বটবুনে, তিলডাঙ্গা, খোনা, খাটালিতি মাথাচাড়া দিয়ে উঠিছে। তারা কয়কি জানেন, ‘‘নাঙ্গল যার, জমি তার’’, তারা নাকি গরিব বড়লোক সব সুমান করবে।’
বাচ্চা হাতি এবার নড়াচাড়া দিয়ে ওঠেন, ‘আরে থাম, এইসব কথা খিডা কয়, ওই খাটালির রুস্তম সানার ছাওয়াল, কী যেন নাম আর বোধহয় বটবুনের বীরেনের ছাওয়াল বিধান। এই ওরা নাকি মিটিং করে আমারে গালাগালি এরে বেড়াচ্ছে।’
‘শুধুই কি গালাগালি আইয়ুব খান আর সবুর সাহেবের চৌদ্দ পুরুষ উদ্ধার করতিছে।’
‘আরে থাম, অত ফচর ফচর করিসনে, আমার মাথায় রক্ত উঠে যাচ্ছে। কত ধানে কত চাল, আমি তা দিখায় দেব। ওই সব মাঠ-মারানির ছাওয়ালগে পাছায় নাথি মারে, সব কয়ডারে রাঙ্গা দালানে ঢোকাব। আমারে তো চেনে না, পিপীলিকার পাখা গজাইছে, পাখনা সব মুচড়ায়ে ভাঙ্গে দেব।’
উত্তেজিত চেয়্যারম্যানের আস্ফাালন ও নড়াচাড়ায় এবং তাঁর ওজনদার শরীরের ঠেলাগুতোয় মুস্তফার অবস্থা খুব কাহিল। আপার ক্লাসে সর্বসাকল্যে জনাত্রিশেক পুরুষ যাত্রী; বাচ্চা হাতি ও তাঁর টেন্ডলের এসব ফাল্টুকুলুস মার্কা কথাবার্তায় অনেক তরুণ-যুবক তাঁর দিকে আড়চোখে তাকায়।
তিনি খবরের কাগজ মেলে ধরে, চশমা খুলে একটু তুলোট কাপড়ে মুছে আবার জোরে জোরে পড়তে থাকেন—
আওয়ামী লীগ বিভক্তির পথে। শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ৬ দফাপন্থী ও নবাবজাদা নসরুল্লাহ খানের নেতৃত্বে পিডিএমপন্থী।
টেন্ডল তালপাতার সেপাই বলে ওঠে, ‘সাহেব আম’লীগ তাহলি তো কাত।’
‘আরে বাবা, খানগে সাথে পারা কি মুহির কথা। আইয়ুব খানের এট্টা নোমার সমান এই দ্যাশে খিডা আছে?’
এবার ফেরদৌস হাতা গুটিয়ে হাত নেড়ে খুব উত্তেজিতভাবে বলে ওঠে, ‘চেয়ারম্যান সাহেব, শেখ মুজিব ও আওয়ামী লীগ বাঙালির মুক্তির সনদ ৬ দফা প্রণয়ন করেছে। আওয়ামী লীগ বাঙ্গালীর জাতীয় দল, এখানে এই সব পাঞ্জাবি নবাবজাদাদের কোন স্থান নাই।’
‘৬ দফা দিয়ে শেখ সাহেব কী এরতি চায়, পাকিস্তান ভাঙ্গতি চায়?’
‘পাকিস্তান ভাঙ্গবে ক্যান? বাাঙালি জাতির শত্রু ২২ পরিবারের প্রতিনিধি আইয়ুবকে গদি থেকে নামাতে হবে, আমাদের চাই স্বায়ত্তশাসন,ব্যস। শেখ মুজিব বাঙ্গালীর প্রিয় নেতা…।’
বাজান, তোমরা ছাত্র মানুষ, ল্যাহাপড়া শিখতিছ, তোমাগে বয়স কম। খালি গরম কথা কলি তো হবে না। আরে, তোমরা তো ইতিহাস জান না, শোনো, শেখ মুজিব, ভাসানী আগে মোসলেম লীগে ছেল। এরা সারা জীবন দল ভাঙ্গা আর নতুন দল বানানোর পায়তারা করিছে। এই সব লিডাররা চলে ইন্ডিয়া, চীন, রাশিয়ার ইশারায়। বিদেশের টাকা খায়ে ইরা দ্যাশের মধ্যি গন্ডগোল পাকাচ্ছে।’
সামনের দিক থেকে শ্যামলা রঙের, একটু লম্বা মাথায় ঝাঁকড়া চুলের একজন সিনিয়র গোছের ছাত্র বলে ওঠে, ‘এতক্ষণ আপনার ও আপনার চামচা ইচ্ছামতো যা খুশি তা-ই বলছেন, কী মনে করেন, এই বনে কি বাঘ নেই?’
এবার বাচ্চা হাতি একটু বিব্রত ও হতচকিত হয়ে একটু তোঁতলাতে থাকেন, ‘বাব্বরাহ… ইহানে বাঘের নাম আআ…সতিছে কেন? আরে বাজান, তুমি এট্টু ঠান্ডা হও। শোনো, তোমরা তো সেদিনের ছাওয়াল, বৃটিশ টাইমি কি অত্যাচার ছেল হিন্দুগের, তোমরা তো তা দেহনি, তোমরা তো সেদিনের জিহুত। বাবুগে পায় সেলাম দিয়েও রক্ষে পায়া যাতো না। শৈলেন ঘোষের বাড়ির সামনে দিয়ে ছাতি মাথায় দিয়ে কোনো মিঞার বিটা যাতি পার তো কওদি? গেলি তার খবর ছেল, অন্ধকূপে আটকায়ে চাবুক মারা হতো।’
‘শৈলেন ঘোষ ছিল অত্যাচারী জমিদার আর ইংরেজের দালাল। নুনের ব্যাপারি থেকে জমিদার হয়েছিল। সে হিন্দু-মুসলিম সব গরিব কৃষককে অত্যাচার করেছে। ‘এখানে হিন্দু-মুসলমানের কথা আনছেন কেন? আপনারা যারা মুসলিম লীগের হোমরা-চোমরা তারাই তো হিন্দুদের বাড়িঘর, জমিজাতি আত্মসাৎ করিছেন, এখন আপনাদের খেল খতম।’
‘আরে, আমারে অত লিকচার দিয়ে না বুইছ, আমার কথা শোনো, খুলনে পাকিস্তান নাহলি তোমরা ল্যাহাপড়া শিখতি পারতে না; সবুর খান খুল্লেরে পাকিস্তানে আনিছে, তাই আমাগে মোসলমানগে সে কথা মনে রাখতি হবে আর মেসলমান সব এক থাকতি হবে।’
এবার একটি কিশোর ছেলে ফর্সা, বেশ সুদর্শন, চোখে পাওয়ার চশমা, বসে বসে এতক্ষণ কী একটা ইংরেজি বই পড়ছিল। এবার সে বই বন্ধ করে উঠে দাঁড়িয়ে বেশ উত্তেজিতভঙ্গিতে বলে ওঠে, ‘মুসলমান এক হবে কীভাবে? আদমজী দাদা বাওয়ানি তো মুসলমান আর আমরাও মুসলমান। এই বাইশ পরিবার আমাদের পাট, চা ও চামড়া বিদেশে রপ্তানি করে সেই টাকা দিয়ে করাচি, পিন্ডি, লাহোর, ইসলামাবাদে আলিশান বিল্ডিং, বড় বড় রাজপথ, কলকারখানা বানাচ্ছে, আর আমাদের কী হচ্ছে। চাকরি-বাকরি কিছুই তো জুটছে না কপালে?’
এবার মোকছেদ মেম্বার বাচ্চা হাতিকে একটু পেলা দেওয়ার চেষ্টা করে,
‘বাঙ্গালিরা যদি ল্যাহাপড়া না শেখে, তাহলে বড় চাকরি কী এরে পাবে। এডা তো গাছের ফল না যে পাড়ে সবাইরে ভাগ করে দিলাম। আর আমাগে সবুর সাহেব তো খুল্লেয় অনেক মিল ফ্যাক্টরি বানাইছে, অনেক ছোয়াল পোয়াল সিহানে চাকরি করতিছে।’
এবার ফেরদৌস রাগে গজরাতে গজরাতে বলে ওঠে,‘আরে, আপনি আবার কোয়নতে নামলেন হায়ারে খেলতি। পাঞ্জাবিগে আর সবুর খানের এই ধামাধরা চেয়ারম্যানের পায়রাবি করতিছেন। সবুর খান দেশের কী করিছে, ছিলো কংগ্রেসে, সেখানে পাত্তা না পেয়ে মুসলিম লীগে চলে আসে। নিজে তো নামাজ-রোজা করে না, মদ আর ফুর্তি-ফার্তা করে, বাগানবাড়িতে মত্ত। সামান্য মাড়োয়ারিদের টালি ক্লার্ক থেকে এতগুলো বাড়ি, টাকা-পয়সা কীভাবে হইছে, জানেন? খালি তো মুসলিম লীগ করেন, এট্টু পানিতে ঢেউ মারে দ্যাহেন সব কিলিয়ার হবে।’
তরুণ ছাত্রদের উত্তপ্ত আবেগপূর্ণ আক্রমণে বাচ্চা হাতি ভাঁজ খেয়ে গেল। চতুর ও ধুরন্ধর এই ব্যক্তিটি এবার বললেন, ‘মোকছেদ মেম্বর, তুমি থামো। যাক বাবারা, তোমরা ল্যাহাপড়া শিহিছ, তোমরাই দেশের ভূত-ভবিষ্যৎ, আমরা আর কয় দিন, যা দেখে আইছি, তা-ই কই। বাবারা, আকাশের অবস্থা ভালো ঠেকতিছে না, বৃষ্টির তোড় বাড়ে গেছে আর গাঙ্গে বিজায় তুফোন হচ্ছে; সহিসালামতে আমাগে বাড়ি ফেরা দরকার, এহোন সবাই তোমরা আল্লা আল্লা করো।’
আকাশ ভেঙে মুষলধারে বৃষ্টি নেমে এসেছে। বাতাসে বৃষ্টির ঝাপটা ও নদীর উথাল-পাথাল ঢেউ এই বড় লঞ্চকে বেসামাল করে ফেলছে।
এবার বাচ্চা হাতি উঠে দাড়িয়ে বলল, ‘দেখি, আমি সামনের দিকি যাই, আবহাওয়া খারাপ সারেংরে একটু গাইড করতি হবে আর মহিলা কেবিনে মা-বোনেরা ভয় পাচ্ছে, তাগে সাহস দিতি হবে।’
দক্ষিণ বাংলার লোনা মাটির এই দেশে বঙ্গোপসাগরের উত্তাল ঝোড়ো হাওয়া আর আসমান ভাঙা বাদলের মাঝে বেড়ে ওঠা মুস্তফা, প্রকৃতির সামান্য বেয়াড়াপনাকে খুব একটা গ্রাহ্যে আনল না। বরং সে ভাবতে থাকে, এখনকার তরুণরা রুখে উঠছে তাহলে কি দেশে কোনো নুহের প্লাবন আসছে, যাতে সব অন্যায়, জুলুম-অত্যাচার ভাসিয়ে নিয়ে যাবে। সেখানে তার ভূমিকা কী হবে? ডাক তো আসবেই, সে কি তখন শুধু দর্শক থাকবে; না অন্য কিছু?
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, মার্চ ২৫, ২০১১
Leave a Reply