গ্রামের মুসাফির বোলপুরে। অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে দেখছে ইতিহাসের পাতা থেকে বেরিয়ে আসা শান্তিনিকেতন। ক্ষিতিমোহন বাবু থাকতেন ‘দেহলী’-র পাশেই। তৈরি হচ্ছিল আরেকটি বাড়ি, যাতে কবিগুরুর স্ত্রী ও ছেলেমেয়েরা আশ্রমে এসে কবির সঙ্গেই বসবাস করতে পারেন। নাম তার ‘নতুন বাড়ি’। যেদিন গিয়ে উপস্থিত, সেদিন ‘দেহলী’-র সামনে দ্বারিকের দোতলার কাজ শুরু হয়েছে। বিশ্বভারতীর কলাভবনের পত্তন এখানেই। বিকেলবেলা খানিকটা বিশ্রাম নিয়ে যাই গুরুদেব সন্দর্শনে। মাঝখানের যে হল ঘরটি, সেখানেই কবি দর্শন দিতেন নতুন ছাত্রছাত্রী ও দুদিনের মুসাফিরদের। সুদূর বলরামপুর গ্রাম থেকে এসেছে মুসাফির। দুদিনের পথ, গরুর গাড়ি, রেলগাড়ি, বাস, আবার বাসে শান্তিনিকেতন; হাতে নেই টাকাকড়ি, প্রশংসাপত্র যা নিয়ে কবির সামনে উপস্থিত হওয়া যায়।
গুরুদেবের ছোট মেয়ে মীরাদেবী থাকতেন ‘লেবুকুঞ্জ’-তে। এটি ছিল ‘দ্বারিক’-এর লাগাও বাড়ি। ‘শমীকুটির’-এর সামনের বারান্দাতে কাউকে জিজ্ঞাসা না করেই লম্বা ঘুম দিলাম। কেউ কিছু জিজ্ঞাসা করেনি। সামনের ‘মোহিত কুটির’, ‘সতীশ কুটির’ ও ‘সত্য কুটির’ থেকে যখন অনেকে বেরিয়ে এসেছে, গুরুদেবের সমবেত সান্নিধ্যে তখন আমিও। শমী ছিল গুরুদেবের ছোট ছেলে, আশ্রমের ছাত্র। মারা যায় কম বয়সে, সম্ভবত কালাজ্বরে। বন্ধুর বাড়িতে বেড়াতে গিয়ে অসুখ নিয়ে ফিরে আসে। গুরুদেবের বন্ধু ছিলেন মোহিতচন্দ্র সেন, ভীষণ সাহিত্যরসিক। গুরুদেব তাঁকে কাছে ডাকতেন এবং নতুন রচনাগুলো পড়ে শোনাতেন। তিনি ছিলেন আশ্রমের প্রথম দিককার অধ্যক্ষ। কবির অনেক লেখা তাঁর সম্পাদিত। সম্পাদনার কাজ বাকি রেখেই তিনি চলে যান তাঁর অচেনা গন্তব্যে। তাঁর লেখা গুরুদক্ষিণা বইটি খুঁজে পাওয়া যায়নি আজও। ‘সত্য কুটির’-এর নামের সঙ্গে লুকিয়ে আছে সত্যেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্যের স্মৃতি, যিনি ছিলেন আশ্রমের অধ্যাপক ও চিকিৎসক। কবিগুরু তাঁকে এত ভালোবাসতেন যে, বলার নয়। তাঁর মেজ মেয়ে রেণুকার সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ করেন সত্যেন্দ্রনাথকে। কিন্তু তাঁরও ফেরার তাড়া। জীবনের সমাপ্তিপর্ব তাঁকে কাছে টেনে নিয়ে গেছে। চারটি কুটিরের কাছে ঘুরঘুর করে জানতে পেরেছি আশ্রমবালকদের পঠন ও শয়নের স্থানগুলো। প্রত্যেক কুটিরে থাকতেন দুয়েকজন অধ্যাপক; বালকদের সঙ্গে দিন-রাত সঙ্গ দিতেন। তাঁদের কর্মসূচি টাঙানো থাকত প্রত্যেকটি কুটিরের সামনে, যাতে লেখা ছিল এমনকিছু, যা আজকাল আর খুঁজে পাওয়া যাবে না। যেমন: অতি প্রত্যুষে সূর্যদেব ওঠার আগে গাত্রোত্থান, ঘর ঝাঁড় দেওয়া পালা করে, গোসল, প্রাতঃখাবার, বৈতালিক আসন, এরপর গাছতলায় ক্লাস করতে যাওয়া। এগুলোর ছবি এখনো নানা পত্রিকায় ছাপা হয় বৈকি, কিন্তু সেই অধ্যাপকদের ক্লাসে যোগদানের অভিজ্ঞতা অন্যরূপ। কেমন সুন্দর করে পড়াতেন তাঁরা, প্রত্যেক ছাত্রের জন্য ব্যক্তিগত মনোযোগ, প্রাত্যহিক ব্যায়াম, গোসল, দাঁত মাজা ও খেলাধূলায় সবাই অংশ নিচ্ছে কি না, অধ্যাপকেরা পর্যালোচনা করতেন নিয়মিত। রান্নাঘরে যার যার থালা-বাটি-গ্লাস নিতে হতো, আবার নিজেরাই সেগুলো ধুয়ে ফিরিয়ে নিয়ে আসত যার যার থাকার জায়গায়।
গুরুপল্লির আশ্রমে বাস না করলে কেমন করে বোঝা যাবে, রবিঠাকুর কী চেয়েছিলেন? কোনো দিনই বোঝা যাবে না রবীন্দ্রনাথের পল্লিশিক্ষা ও আশ্রমের নিয়মাধীন দিনগুলোর অন্তর্নিহিত ভাবধারা। শান্তিনিকেতনের আশ্রমে পড়তে আসত যারা, তাদের যেন আর আনন্দ ধরে না। তাদের কথা প্রথম জানতে পারি শৈলনন্দিনী সেনের লেখায়। মেয়েরা গানের অর্থ জানত না, সুরের দোলায় হতো আন্দোলিত। শীতের রাতে বোলপুর স্টেশনের মিটিমিটি আলোতে যখন কোনো ছাত্রছাত্রী এসে পৌঁছাত, তখন যেমন রহস্যাবৃত মনে হতো সবকিছু, তেমনি ধীরে ধীরে এর পরিবেশে, কবির জাদু ও বাউল সম্প্রদায়ের গানের আন্দোলনে এই রহস্য ধীরে ধীরে টুটে যেত। ক্ষিতিমোহন সেনের একটি খাতা ছিল, যেখানে তিনি সব সময়ই পূর্ব বাংলার স্ত্রী-আচার, কনে সাজানো, জলভরা, এমনকি অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার গান লিখে রাখতেন। আশ্রমের ছেলেমেয়েরা পূর্ব বাংলার গান শিখতে বিশেষ আগ্রহী ছিল। শান্তিনিকেতনের পুরোটাই ছিল অন্ধকার। ভোরের আভাস পেয়ে বকুলগাছগুলো থেকে অজস্র পাখি কলকল করে উঠত আর কোথায় যেন ঘণ্টাধ্বনি, কোথায় আবার মন্দির একটাই। সবাই এসে জড় হতো সেখানে। ছেলেমেয়েরা গাইত, ‘ধ্বনিল রে ধ্বনিল রে, ধ্বনিল আহ্বান মধুরও গম্ভীর’। শালবীথিকার তলায় অধ্যাপকেরা, কর্মীরা একজনের পর একজন দাঁড়িয়ে; তাঁরা সবাই জানতেন ছাত্রদের বাবা-মায়ের নাম, কোথায় থাকত—সব কিছু। এগুলো ছিল আত্মীয়তার স্পর্শ মাখানো। সবকিছু রুটিনে মেলান, কোথাও নেই এতটুকু ফাঁকি দেওয়ার জো, তবু তা নয় ক্লান্তিকর। যেমন ছিল মজার গান ও নাচের ক্লাস, তেমনি লাঠি ছোড়া খেলা ও যুযুৎসু। কোথাও রেডিও নেই, নেই টেলিভিশন, নেই ফুটবল-ক্রিকেটের আনন্দোল্লাস। মন্দিরে সবার প্রবেশ শ্রদ্ধাবনত মস্তকে, পায়ের তলায় ঝরে পড়ছে নিমগাছ থেকে অজস্র ফুলের কলি। গুরুদেব এসে দাঁড়ালেন। মন্ত্রোচ্চারণ নামমাত্র ‘ওঁ পিতা নোহসি’। তার পরেই গান, ‘প্রথম আলোর চরণধ্বনি বেজে উঠল যেই’।
গুরুদেবকে সবাই প্রণাম করল। মনে মনে তাঁকে করলাম সালাম। এমন শান্তমূর্তি আর কখনো দেখিনি। অঙ্কের ক্লাসে গুরুদেবের বিশেষ আকর্ষণ। বিশ্বনাথের কাছে সবাই অংক করছে শালবীথিকায়, পেছনে পায়চারি করতে করতে উপস্থিত রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং। বিকেলে এক দিন মুড়ি, আরেক দিন দুধ-কলা। গুরুদেবের ছিল একটি গাড়ি। তিনি পছন্দ করতেন এমন সব মেয়েদের, যারা থাকবে পরিচ্ছন্ন ও পরিপাটি। তিনি মাঝেমধ্যে গাড়ি করে পরিদর্শনে আসতেন। এক দিন বললেন জনা কয়েক অতিথিকে দাওয়াত করে খাওয়াতে। এতে তারা খাবার তৈরি করতে শিখবে, এটি তাঁর ইচ্ছা। রান্নাঘরের তত্ত্বাবধানের ভার একেক দিন একেকটি ছেলে ও মেয়ের ওপর। শ্রীভবনে একটি মেয়ের অসুখ হলো, মেয়েটির বাবা নেই, মা থাকেন মুম্বাইয়ে। অভিভাবক স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ। দুবেলা নিজেই আসেন দেখতে, সঙ্গে ফুল আর বায়োকেমিক ওষুধ। কারও অসুখ—শুনলে নিজেই ওষুধ দিতেন, আর সকালে একটি করে কমলা ও এক গ্লাস ওভালটিন।
উত্তরায়ণের দক্ষিণে ছিল বেল ফুলের বাগান। দুবেলা পানি দিতে হতো সে গাছে, তার ফলেই বেল ফুলের বাগান ছিল তরতাজা। ছেলেমেয়েরা বেল ফুল চুরি করত বৈকি! গুরুদেব বললেন, ‘দিনু, শুনেছিস, ওরা আমার বাগানের ফুল তুলে আমাকেই মালা পরায়।’
এবার দিনুদা (দিনেন্দ্রনাথ) বললেন, ওরা আর ফুল পাবে কোথায়?
গুরুদেব নিজেই একবার ইংরেজি ভাষা শেখানোর ক্লাস শুরু করলেন, যাতে ছাত্রছাত্রীরা ভয় না পায়। অধ্যাপকদের বললেন, ‘তোমরা এবার যাও।’ তাঁর ক্লাসে শুধু স্বাধীনতা। সবাইকে নানা রকম দায়িত্ব দিয়ে তাদের অগাধ বিশ্বাস স্থাপন করতে পেরেছিলেন। মজার ছিল বাগানের ক্লাস। সবজির বাগানে মটরশুঁটি, টমেটো ও অন্যান্য তরকারি ফলানোর জন্য ছিল তার বিশেষ প্রচেষ্টা। ভালো কই মাছের সুরুয়া, মাছের টক ও মাঝেমধ্যে মুরগির গোশত, নানা বৈচিত্র্যের আবরণে ছিল ছাত্রছাত্রীদের খাবার প্লেটটি সাজানো। ফাঁকে ফাঁকে ঋতু-উৎসব, সংবর্ধনা উৎসব, ৭ পৌষ ইত্যাদি নানা উৎসব নিয়ে মাততেন মাস্টার মশায় (নন্দলাল বসু)। ক্ষিতিমোহন বাবু ও মাস্টার মশায় ছিলেন চালচলনে, বেশভূষায়, কথাবার্তায় সুরুচিসম্পন্ন। এতটুকু বাহুল্য কোথাও নেই। সাজ ছিল, বিকেলে গোসল করে মেয়েরা দেবে মাথায় ফুল আর কপালে টিপ, আর ছেলেরা করবে স্বাস্থ্যের যত্ন। ব্রহ্মচর্যাশ্রম ছিল প্রথম নাম। তখন ছিল ১০৫ জন ছাত্র আর ২৫ জন শিক্ষক। বুধবার ছুটি। বাথরুম ছিল না, গরম পানি ছিল না, ভৃত্য কম, ছেলেরাই সব কাজ করত। পৌষের হাড়ভাঙা শীতে মোজা নেই; চটি পায়ে, সাদা পাঞ্জাবির ওপর সাদা চাদর জড়িয়ে লণ্ঠন হাতে রাত তিনটা-সাড়ে তিনটায় ওই যে চলেছেন দীর্ঘকায় ব্যক্তিটি মন্দিরের দিকে। তিনিই রবীন্দ্রনাথ।
গুরুপল্লি দেখিনি; অনুভব করেছি। ভেবেছি, ১৯১৯ সালে যখন আমার জন্মই হয়নি, তখন যদি এমনটি হয়ে থাকে, তাহলে এখন কেন পারব না এমন একটি গ্রামে পল্লির পত্তন করতে, যেখানে প্রত্যেক ছাত্র, প্রত্যেক ছাত্রী অভিভাবকের সোনার কাঠির স্পর্শে হতে পারেন পরিপূর্ণভাবে স্পর্শিত!
মুস্তাফা জামান আব্বাসী
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, মার্চ ২৫, ২০১১
িনর্ঝর
দারুন লাগলো আপনার বর্ণনা। শাতিনিকেতনের কিছুটা বর্ণনা পেলাম। আরো বিশদ জানার সুযোগ থাকলে ভালো লাগতো ।