বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের অনন্য ইতিহাস নিয়ে রচিত হয়েছে অগণিত বই। এসব বইয়ে মুক্তিযুদ্ধ উপস্থাপিত হয়েছে নানাভাবে। এ বছর পূর্ণ হচ্ছে বাংলাদেশের স্বাধীনতার চার দশক। এ উপলক্ষে আমাদের বিশেষ আয়োজন মুক্তিযুদ্ধের ১০ বই।
রুমির মায়ের দিনলিপি
এ জেড এম আবদুল আলী
একাত্তরের দিনগুলি: জাহানারা ইমাম \ জুন ২০০৫ \ সন্ধানী প্রকাশনী
শোককে শক্তিতে রূপান্তর করার কথা আমরা প্রায়ই বলে থাকি। একাত্তরের দিনগুলির লেখক জাহানারা ইমামের জীবনে এটি আমরা প্রত্যক্ষ করেছি। একাত্তরে সবকিছু হারিয়ে তিনি নতুন শক্তিতে বলীয়ান হয়ে ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি গঠন করেছেন। তাঁর বইটি পাঠ করা রীতিমতো একটি অভিজ্ঞতা। ওই দিনলিপির প্রথমেই তিনি তাঁর ভয় ও শোকের যাত্রা শুরু করেন এবং এই বইয়ের শেষের পৃষ্ঠাগুলোতে দেখা যাচ্ছে যে তিনি তাঁর পুত্র ও স্বামীকে হারিয়ে আপন শক্তিতে জ্বলে উঠেছেন। তাঁর দিনলিপির প্রথম পৃষ্ঠা শুরু হচ্ছে ১৯৭১-এর পয়লা মার্চ সোমবার, আর শেষ হচ্ছে ওই বছরের ১৭ ডিসেম্বর শুক্রবার। রমনার মাঠে যেদিন পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ করে তার পরের দিন। এই নয় মাসের মধ্যে একদিন আগস্ট মাসে পাক হানাদার বাহিনী তাঁর স্বামী এবং পুত্রদের বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে যায়। কয়েক দিন পর অনেক নির্যাতনের শেষে তাঁর স্বামী শরিফ ইমাম এবং দ্বিতীয় পুত্র জামী এবং অন্য কয়েকজন ফিরে আসেন। কিন্তু রুমি আর ফিরে আসেনি। যুদ্ধের শেষের দিকে তাঁর স্বামী হূদযন্ত্রের প্রক্রিয়া শেষ হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। ১৪ ডিসেম্বর যেদিন পাকিস্তানের দোসর রাজাকার আল-বদরেরা ঢাকার বাড়ি বাড়ি থেকে দেশের বুদ্ধিজীবীদের ধরে নিয়ে রায়েরবাজারের বধ্যভূমিতে হত্যা করে, সেদিন শরিফ ইমামের লাশ দাফন করতে বের হয়ে যায় জাহানারা ইমামের আত্মীয়স্বজনেরা। দুই দিন পরে দিনলিপি শেষ হওয়ার এক দিন পর সাতমসজিদ রোডের রায়েরবাজারে বধ্যভূমিতে ১৪ তারিখে ধরে নিয়ে যাওয়া বুদ্ধিজীবীদের গলিত লাশ পাওয়া যায়। রুমির দেহ সেখানে বা অন্য কোথাও পাওয়া যায়নি।
আরও পরে তিনি ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির প্রধান হয়ে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে সোচ্চার হন। সেই সময় বিএনপি সরকারের সঙ্গে জোটবদ্ধ কয়েকটি দলের মানুষেরা ওঁর নাম বিকৃত করে বলত ‘জাহান্নামের ইমাম’। এসবে ওঁর কিছুই যেত-আসত না। তিনি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন এবং কখনো লক্ষ্যভ্রষ্ট হননি। যদিও অজান্তে তখন তাঁঁর দেহে মরণব্যাধি ক্যানসার বাসা বেঁধেছে।
যাই হোক, ফিরে যাই আবার ওই বইটির কথায়। কীভাবে আবেগবর্জিত ভাষায় একেকটি দুঃখের দিনের কথা লিখে যাচ্ছেন লেখক যে পাঠকের পক্ষে আশ্চর্য হওয়া ছাড়া আরও কিছু করার থাকে না। একটি দিনের বর্ণনা এ রকম, ‘১৪ই ডিসেম্বর, মঙ্গলবার ১৯৭১: শরিফকে বাসায় আনা হয়েছে সকাল দশটার দিকে। মঞ্জুর, মিকি… এরা দু’জন ওদের পরিচিত ও আত্মীয় পুলিশ অফিসার ধ’রে গাড়িতে আর্মড পুলিশ নিয়ে অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে একটা পিকআপ যোগাড় করে হাসপাতাল থেকে ওকে নিয়ে এসেছেন।
‘সকাল বেলা প্লেনের আনাগোনা একটু কমই ছিল। আজ কারফিউ ওঠে নি। তবু আমাদের গলিটা কানা বলে, খবর পেয়ে সব বাড়ির লোকেরা এসে জড়ো হতে পেরেছেন। খবর পেয়ে আনোয়ার তার বোর্ড অফিসের মাইক্রোবাসটা অনেক ঝঞ্ঝাট করে নিয়ে এসেছে। সঙ্গে এসেছে শেলী আর সালাম। ওই মাইক্রোবাস পাঠিয়ে মা আর লুলুকে আনা হয়েছে ধানমন্ডীর বাসা থেকে। মঞ্জুর তার গাড়িতে কয়েকটা ট্রিপ দিয়ে এনেছেন বাঁকাকে, ফকিরকে, আমিনুল ইসলামকে। ডব্লিউ আর খান যোগাড় করে দিয়েছেন…’
এ পর্যন্ত বোঝাই যাচ্ছে না যে মৃত শরিফকে আনা হয়েছে, না জীবিত কিন্তু অসুস্থ শরিফকে আনা হয়েছে। এমন নির্মোহ ভাষায় লেখা বইটি। সত্যিকার বলতে গেলে মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস আমরা যারা দেশে ছিলাম, ভারতে গিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে যোগ দিতে পারিনি, প্রতিদিন মধ্যরাতে দরজায় কড়া নাড়া শোনার ভয়ে কাটিয়েছি, এই বইয়ে আমাদের প্রত্যেকের কথাই বলা হয়েছে।
আজ যাঁরা এই বইটি পড়েননি তাঁদের প্রতি অনুরোধ, রুমির মায়ের এই দিনলিপি পড়ুন—তাহলেই পরিষ্কারভাবে জানতে পারবেন সেদিনের পরিস্থিতি।
জেগে থাকি আমরা
মফিদুল হক
একাত্তর: করতলেছিন্নমাথা: হাসান আজিজুলহক \ ফেব্রুয়ারি: ১৯৯৫ \ সাহিত্য প্রকাশ
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের পর অনেক অনেক বছর লেগেছে দেশের অগ্রণী কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হকের সেই দিনগুলোর স্মৃতিভাষ্য লিখতে। টুকরো টুকরোভাবে লেখা এইসব স্মৃতিকণিকা একত্রে প্রকাশ পেল ১৯৯৫ সালে, ‘করতলে ছিন্নমাথা’ গ্রন্থনামে। মনে হতে পারে এই নাম বোধকরি প্রতীকী উপমা কোনো, জীবনের নির্মম রসিকতার পরিচয়বহ, কিন্তু এ যে কী নিষ্ঠুর বাস্তবের প্রত্যক্ষ উপস্থাপন যার মধ্যে উপমা-উৎপ্রেক্ষার আড়াল নেই, আবরণ নেই, সজ্জা নেই, পাঠক তা ধীরে ধীরে অনুধাবন করবেন গ্রন্থের পাঠগ্রহণের মাধ্যমে। ধীরে ধীরে বললাম, কেননা এমন গ্রন্থ দ্রুত পড়বার কোনো উপায় নেই, মাঝেমধ্যে পড়া বন্ধ করে পাঠককে শূন্য মনে উদাস তাকিয়ে থাকতে হবে, চারপাশের কোলাহলময় বাস্তবতা থেকে একেবারে বিচ্ছিন্ন হয়ে, যেমন তাকিয়েছিলেন উকিলবাবু, শেক্সপিয়র মিল্টন-পড়া সেই উকিল, যাঁর তিন পুত্রের লাশ পড়ে আছে রাস্তায়, “কি বিচিত্র শোয়ার ভঙ্গি তাদের! মাটিকে ভূমিবাহু ধরলে একজনের পা ত্রিভুজের মতো ভাঁজ করা, অন্য পা মেলে দেওয়া। ছোট ছেলেটি, রাজপুত্রের মতো চেহারা, টকটকে ফর্সা রঙ, টিকোলো নাক, লাল গোলাপের পাঁপড়ির মতো ঠোঁট, হাঁটু ভাঁজ করে তলপেটের কাছে গুটিয়ে নিয়ে যেন নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছে। মেজভাই দলামোচড়ানো, ডান বাহুর নিচে প্রায় ছিন্ন মাথা, দুই চোখ চেয়ে চেয়ে রয়েছে, বাঁ হাতটি বড়ো ভাইয়ের গলার ওপর মেলে দেওয়া। কি নিশ্চিন্তে আরামের শুয়ে থাকা।” এই দৃশ্য অবলোকনের পরপরই হাসান আজিজুল হক দেখতে পান সামনের দোতলার বারান্দায় উকিলবাবু আকাশের দিকে মুখ তুলে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছেন। “আমি একদৃষ্টে তাঁর দিকে চেয়ে থাকি, এই ভেবে যে তিনি দৃষ্টি নামাবেন, হয়তো আবার, আবার দেখে নিতে চাইবেন তাঁর তিন আত্মজের মুখ; কিন্তু আমার অপেক্ষা বৃথা হলো, আকাশের দিকে চেয়ে রইলেন, তাঁর মৃত সন্তানেরা শুয়ে রইলো শেষ মার্চের তীব্র রোদে পিচ গলে-যাওয়া রাজপথে।”
নিরাবেগ নিষ্পৃহ ভঙ্গিতে লিখে গেছেন হাসান আজিজুল হক, শক্তহাতে শাসন করেন আবেগের সমস্ত প্রকাশ, কিন্তু কীভাবে যেন রচনার ছত্রে ছত্রে জড়িয়ে পড়ে পরম সংবেদনশীলতা ও নিবিড় মমতা, যদিও তার কোনো ছাপই খুঁজে পাওয়া যাবে না তাঁর বর্ণনায় কিংবা গদ্যে। যে-দৃশ্য উকিলবাবু দেখছেন না, দেখতে পারছেন না, তাই আচ্ছন্ন করে রাখে তাঁর দৃষ্টি, তেমনি পাঠকের মনও আচ্ছন্ন করবে যা লেখা হয়েছে তা নয়, যা লেখা হয়নি, দুই লাইনের মধ্যকার সেই ফাঁকা অংশ, দুই শব্দের মধ্যকার চুপকথা, সেসবই হয়ে উঠবে সর্বনাশের কিনার-ঘেষা বিশাল গহ্বর, দৃষ্টি ও মনকে টেনে নিয়ে যাবে অসীম অতলে, চোখে ভর করবে এমন আঁধি, তাকানো আর তাকানো থাকবে না, দৃষ্টিতে থাকবে না কোনো অবলোকন।
একাত্তরের ঘটনাধারার টুকরো ছবিতে মিলবে দুই মানুষের প্রতিকৃতি, খুলনার সুন্দরবন কলেজের পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপক খালেদ রশীদ, নকশাল আদর্শে উদ্বেলিত হয়ে নিজেকে করেছিলেন সমাজচ্যুত। তারপর পাক হানাদার বাহিনীর মোকাবিলা করতে গিয়ে এপ্রিলের প্রান্তিক কোনো এক দিনে হারিয়ে গেলেন চিরতরে। আর দশজনের সঙ্গে খালেদ রশীদের সখ্য ও প্রীতির বন্ধনের পরিচয় দেন হাসান, বলেন না কেবল আপনকার অনুভূতি, বরং চরম এক শৈত্যে চাপা দিতে চান অন্তরের উষ্ণতা।
শ্রমিক-কৃষকের মধ্যে কাজ করা রফির পরিচয় তিনি দিয়েছেন তাঁর স্বভাবসুলভ পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ দিয়ে আর এই রফিকে হত্যার পর নির্দয় রাজাকার তাঁর মুণ্ডু যখন ঝুলিয়ে দেয় গুড়িয়ে-দেয়া শহীদ মিনার-সংলগ্ন সুপারি গাছটায়, তখন আবার এমন নিস্পৃহ বর্ণনায় মেতে ওঠেন হাসান, পড়তে পারা যায় না সেসব কথা, ভাবতে অবাক লাগে কেমন করে নিষ্ঠুরতার এমন ভাষ্য লিখতে পারলেন তিনি!
না, তিনি লেখেন নি, ইতিহাসই তাঁকে দিয়ে লিখিয়ে নিয়েছে এইসব কথকতা, ভয়ঙ্করতম ইতিহাসের দায়মোচনের জন্য হূদয়কে পাথর করে কষ্ট বুকচাপা দিয়ে কলম হাতে লেখালেখি, আকারে বিশাল নয় কিন্তু তাৎপর্যে অপরিসীম। সেই প্রথম যখন গদ্যচর্চা শুরু করেন হাসান আজিজুল হক, আমাদের মতো তরুণদের মাতিয়ে তুলেছিলেন তাঁর সম্পূর্ণ ব্যতিক্রমী গদ্যভঙ্গি দ্বারা। মনে পড়ে ‘আত্মজা ও একটি করবী গাছ’ গল্পের সূচনাংশের সেই অসাধারণ বর্ণনা, “অল্প বাতাসে একটা কচি কলার পাতা একবার বুক দেখায় একবার পিঠ দেখায়।” এরপর প্রায় পঁচিশ বছরের অপেক্ষান্তে প্রণীত একাত্তরের কথকতার এই গ্রন্থের শুরুর বাক্যে তিনি লিখলেন, “আমার জানা ছিল না যে পানিতে ভাসিয়ে দিলে পুরুষের লাশ চিৎ হয়ে ভাসে আর নারীর লাশ ভাসে উপুড় হয়ে।”
একটি মাত্র বাক্য যেন সুনামির মতো আছড়ে পড়ে বুকে, জাগায় তোলপাড়, অল্প বাতাসে একটা কচি কলার পাতা পানিতে ভাসিয়ে দিলে একবার বুক দেখায় পুরুষের লাশ চিৎ একবার পিঠ দেখায় আর নারীর লাশ উপুড়— একাকার হয়ে যায় অতীত ও বর্তমান, অস্তিত্ব ও অনস্তিত্ব, খসে পড়ে জীবনের সব উপমা ও অলঙ্কার। জেগে থাকি আমরা, করতলে ছিন্নমাথা, যে ছিন্নমস্তার দিকে ফেরাই না চোখ, ফেরাতে পারা যায় না, পারেন কেবল একজন, তিনি আমাদের সন্তসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হক, দেখেন এবং আমাদের দেখান।
অবশ্য পাঠ্য ইতিহাস
মুহাম্মদ লুৎফুল হক
লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে: রফিকুল ইসলাম বীর উত্তম \ অক্টোবর ১৯৮১
স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে রফিকুল ইসলাম বীর উত্তম রচিত লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে গ্রন্থটি ১৯৮১ সালে প্রকাশিত হয়। তবে এর ইংরেজি সংস্করণ (A Tale of Millions) প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৭৪ সালে। বাংলা সংস্করণটি মূল ইংরেজি সংস্করণের বর্ধিত সংস্করণ। এতে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা লেখক সন্নিবেশিত করেছেন, যা আগের ইংরেজি সংস্করণে ছিল না। এর আগে স্বাধীনতা যুদ্ধের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিশ্লেষণ নিয়ে বেশ কিছু মূল্যবান গ্রন্থ প্রকাশিত হলেও সশস্ত্র যুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে এই গ্রন্থটি প্রথম পূর্ণাঙ্গ গ্রন্থ হিসেবে স্বীকৃত। এ গ্রন্থের আগে যুদ্ধসংক্রান্ত প্রকাশিত বেশির ভাগ গ্রন্থই স্মৃতিকথা হিসেবে লিখিত। আরেকটি বিষয় বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে এটিই কোনো সেক্টর কমান্ডারের লিখিত মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক প্রথম গ্রন্থ। বেশির ভাগ সেক্টর কমান্ডার যুদ্ধের বিবরণ গ্রন্থিত করেননি, যে দু-একজন করেছেন তাঁরা তা করেছেন অনেক পরে।
বইয়ের বিষয়বস্তু সম্পর্কে লেখক ভূমিকায় উল্লেখ করেছেন, ‘লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে গ্রন্থটির মূল অংশে সামরিক ও গেরিলা তৎপরতার বিবরণ এবং রাজনৈতিক অন্যান্য প্রাসঙ্গিক বিষয়ে আলোকপাত করা হয়েছে।’ বইয়ের প্রথম প্রায় ৫০ পৃষ্ঠায় লেখক স্বাধীনতা যুদ্ধের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কারণ বিশ্লেষণ করেছেন। এতে নতুন কোনো তথ্য না থাকলেও যুদ্ধের আবশ্যকতা প্রমাণ এবং পরবর্তী অধ্যায়গুলো বুঝতে সাহায্য করে। এরপর বাকি বইয়ে সশস্ত্র যুদ্ধের বিভিন্ন পর্যায়ে ঘটে যাওয়া বিষয়গুলোর উল্লেখ আছে। লেখক নিজে সশস্ত্র যুদ্ধের প্রস্তুতি পর্ব থেকে সংযুক্ত থাকা ও একটি সেক্টরের দায়িত্বে ছিলেন, তাই যুদ্ধের অনেক কিছুই প্রত্যক্ষ করেছেন। যুদ্ধের নীতিনির্ধারণ ও সম্পাদনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন বলে তাঁর বর্ণনাকে অনেকটাই বস্তুনিষ্ঠ মনে করা যায় এবং দলিল হিসেবে গ্রহণ করা যায়। তবে কোথাও কোথাও সহনশীল পর্যায়ের আমিত্বও নজরে পড়ে। যুদ্ধের নয় মাসে বিভিন্ন ব্যক্তি ও গোষ্ঠীকে তিনি যেভাবে দেখেছেন, গ্রন্থে তার মূল্যায়ন আছে, যা মুক্তিযুদ্ধের গবেষকদের জন্য অত্যন্ত সহায়ক হবে। যেমন শরণার্থী শিবিরের সদস্যরা মুক্তিযুদ্ধে খুব বেশি যোগ দেননি, ক্ষমতাসীন দল মুক্তিযুদ্ধকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করছে, যা যুদ্ধের সফলতার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছিল। যুদ্ধের ময়দানে আদেশ-নির্দেশ অস্পষ্ট বা দ্বিধান্বিত হলে জীবনহানির আশঙ্কা থাকে। অথচ কখনো কখনো বাংলাদেশ বাহিনীর সদর দপ্তর এবং ভারতীয় সামরিক কর্তৃপক্ষের মধ্যকার আদেশ-নির্দেশ পরস্পরবিরোধী হতো। কিছু পরিশিষ্ট একান্তই ব্যক্তিগত, যা গ্রন্থের জন্য প্রয়োজনীয়তা মনে হয়নি এবং বইয়ের সঙ্গে খুব একটা সংশ্লিষ্টও মনে হয়নি।
স্বাধীনতা যুদ্ধের অংশীদার হওয়ার কারণে গ্রন্থটি শতভাগ নিরপেক্ষ হয়নি বা আত্মজীবনীর ছাপ লক্ষ করা যায় বলে লেখক নিজেই স্বীকার করেছেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে আমি গভীরভাবে সম্পৃক্ত ও একাত্ম থাকার কারণে ইতিহাস রচনার নৈর্ব্যক্তিক ভঙ্গিতে বইটি লেখা হয়ে ওঠেনি। তাই বইটির কোনো কোনো অংশে জীবনচরিত বা আত্মকথার ছোঁয়া অনুভূত হতে পারে।’
গ্রন্থটি প্রশংসনীয় উল্লেখ করার পর শাহরিয়ার কবির বলেন, ‘মেজর রফিকুল ইসলাম তাঁর স্মৃতিকথায় অন্য সব প্রসঙ্গ উত্থাপনের ক্ষেত্রে বিশ্বস্ততার পরিচয় দিলেও জিয়াউর রহমানের ক্ষেত্রে যে তিনি কাল ও প্রেক্ষিতের সুযোগ গ্রহণ করেছেন—এ কথা অনিচ্ছা সত্ত্বেও বলতে হচ্ছে।’
লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে স্বাধীনতাযুদ্ধবিষয়ক একটি মৌলিক গ্রন্থ এবং ইতিহাসের ছাত্রের জন্য অবশ্যপাঠ্য।
বন্দিজীবনে মুক্তির স্পৃহা
সোহরাব হাসান
পূর্বাপর ১৯৭১: মেজর জেনারেল মুহাম্মদ খলিলুর রহমান (অব.) \ সাহিত্য প্রকাশ
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ ছিল একটি মহাযজ্ঞ। এই যজ্ঞের কুশীলব ছিলেন এই ভূখণ্ডের ভেতরের মানুষ, দেশান্তরি মানুষ। আবার যাঁরা অনেক দূরে ছিলেন, তাঁরাও নতুন দেশের জন্মযন্ত্রণা অনুভব করেছেন। পারিপার্শ্বিক অবস্থার কারণে অনেকের পক্ষেই যুদ্ধে যাওয়া সম্ভব হয়নি, হূদয়ে-মননে তারাও স্বাধীনতাকে ধারণ করেছেন। হুমায়ুন আজাদের ভাষায়, তখন বেঁচে থাকাটাই ছিল একটি যুদ্ধ।
সে সময়ে অনেক সামরিক ও বেসামরিক ব্যক্তি পাকিস্তানে আটকা পড়েছিলেন, কেউ বন্দি ছিলেন, কেউ বা ইচ্ছের বিরুদ্ধে চাকরি করে গেছেন। তাঁদেরই একজন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মুহাম্মদ খলিলুর রহমান। ১৯৪৮ সালে সেনাবাহিনীতে যোগদানের পর বেশির ভাগ সময়ই তাঁকে পশ্চিম পাকিস্তানে থাকতে হয়েছে। একাত্তরেও ছিলেন। ‘শত্রুদেশে’ বসে থেকে একজন বাঙালি সেনা কর্মকর্তা কীভাবে দেশকে অনুভব করেছেন, কীভাবে জাতীয় মুক্তি সংগ্রামে যোগদানের জন্য ব্যাকুল ছিলেন, তারই বিবরণ আছে তাঁর পূর্বাপর ১৯৭১: পাকিস্তানি সেনা গহবর থেকে বইয়ে।
বইটি ইতিহাস নয়। প্রতি দিনের ছোট ছোট ঘটনা ও অভিজ্ঞতার বিবরণ। তাতে ব্যক্তিগত কথা আছে, পারিবারিক কথা আছে। আছে একটি রাষ্ট্রের ভাঙন এবং আরেকটি রাষ্ট্রের উত্থানের কাহিনি। নিজের দেখা ও জানাশোনা জগত নিয়েই কথা বলেছেন তিনি। বাঙালিদের প্রতি পাকিস্তানি তথা পাঞ্জাবিরা কী ধরনের বৈরী ও বিদ্বেষমূলক আচরণ করতেন লেখক সেসব তুলে ধরেছেন বিভিন্ন ঘটনার আলোকে। কীভাবে নানা ছলছুতায় বাঙালি সেনা কর্মকর্তাদের অপমান ও অপদস্ত করত তারা। যদিও একাত্তরে তার উচিত শিক্ষা পেয়েছে, যে বাঙালিকে ভিরু ও অযোদ্ধার জাতি বলে হাসিঠাট্টা করত তাদের কাছেই লজ্জাজনক পরাজয় স্বীকার করেছে পাকিস্তানি সেনা কর্মকর্তারা।
মুহাম্মদ খলিলুর রহমানের বইটি শুরু হয়েছে ২৫ মার্চের হত্যাযজ্ঞ স্বাধীনতা সংগ্রামের খবর দিয়ে। তখন তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ১ নম্বর কোর-এর সদর দপ্তর মংলায় (পশ্চিম পাকিস্তানের মংলা)। এখানে মূলত সেনাবাহিনীর কর্মকৌশল নির্ধারিত হতো। ২৫ মার্চের পর স্বভাবতই সে দায়িত্ব থেকে তাঁকে বাদ দেওয়া হয়েছিল। তাঁর কাজ ছিল অফিসে আসা-যাওয়া, বৈঠকে অংশ নেওয়া। এ অবস্থায় সুযোগ পেলে অন্য বাঙালি কর্মকর্তাদের সঙ্গে নিজেদের ও দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোচনা করতেন, নানা সূত্রে জানতে পেরে তিনি এই সিদ্ধান্তে এসেছিলেন যে পাকিস্তানিরাই পাকিস্তানের মৃত্যু পরোয়ানা লিখে দিয়েছে।
সে ক্ষেত্রে খলিলুর রহমানের একমাত্র ধ্যান-জ্ঞান হলো দেশে পালিয়ে যাওয়া। সেই চেষ্টা করেও সফল হননি। ফলে ভবিতব্য মেনে নিয়ে মুক্তির অপেক্ষা করছেন। এরপর ক্রমশ ঘটনা এগোতে থাকে, যুদ্ধ ভয়াবহ রূপ নেয়। বাংলাদেশে এত উথালপাতাল ঘটনা ঘটছে, প্রতিরোধ যুদ্ধ গড়ে তুলছে বাঙালি সেনা পুলিশ ইপিআর এবং সর্বস্তরের মানুষ। বিশ্ব গণমাধ্যম যখন পাকিস্তানিদের পরাজয় অবধারিত বলে প্রচার চালাচ্ছে, তখনো তাদের ভাবখানা হলো, সব কিছু ঠিক হ্যায়। শেষ পর্যন্ত সব কিছু ঠিক হয়নি। বাংলাদেশের মাটিতে পাকিস্তানিদের লজ্জাজনকভাবে পরাজিত হতে হয়েছে।
১৬ ডিসেম্বর যখন নিয়াজি আত্মসমর্পণ দলিলে সই করেন, তখন পাকিস্তানে আটকে পড়া সব বাঙালি সেনা ও বেসামরিক নাগরিককে বন্দিজীবন বেছে নিতে হয়। তাদের জীবন ছিল অসহায়, অমানবিক। তবে এই দুঃসময়ে কিছু পাকিস্তানি সেনা কর্মকর্তার সহূদয় ব্যবহার পেয়েছেন, সে কথা বলতেও ভোলেননি খলিলুর রহমান। আবার এসময়ে বাঙালিদের মধ্যে কেউ কেউ দালালি করেছেন, তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন মেজর কাইউম চৌধুরী, রিয়াজ রহমান এবং বাংলাদেশ থেকে সফরে যাওয়া কাজী দীন মুহাম্মদ প্রমুখ।
জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা হওয়ার কারণে ব্রিগেডিয়ার খলিল পাকিস্তানি সেনা সদর দপ্তরের হাঁড়ির খবরও পেতেন, তাদের মধ্যে দলাদলি, ঈর্ষা ও হিংসা ছিল প্রকটতর। তার চেয়ে বেশি ছিল ক্ষমতার লিপ্সা। পাকিস্তানের দুই সামরিক শাসক আইউব খান ও ইয়াহিয়া খান সেনা কর্মকর্তাদের মধ্যে রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ জাগিয়ে তুলেছিলেন। সেনা কর্মকর্তারা রাজনীতিকদের ঘৃণা করলেও রাজনৈতিক ক্ষমতা লাভে ছিলেন উন্মুখ।
এই বইয়ের সবচেয়ে মর্মস্পর্শী অধ্যায় হলো তিনজন বাঙালি সেনা কর্মকর্তার ওপর পাকিস্তানিদের বর্বর ও বীভৎস নির্যাতন। বর্তমানে গুয়ানতানামো বেতে ইরাকি ও আফগান যোদ্ধাদের ওপর যেভাবে আমেরিকান বাহিনী নির্যাতন চালিয়েছে, তার চেয়েও নৃশংস ছিল পাকিস্তানিদের আচরণ। তাদের নির্যাতনের কারণে ব্রিগেডিয়ার মজুমদার, কর্নেল মাসুদ ও কর্নেল মুহাম্মদ ইয়াসিন চিরতরে পঙ্গু ও অসুস্থ হয়ে পড়েন। রাষ্ট্রদ্রোহী মামলায় অভিযুক্ত শেখ মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে মিথ্যা সাক্ষী দেওয়ানোর জন্যই এই নির্যাতন চালানো হয়।
এ ছাড়া বইয়ে আছে পাকিস্তানে শাসকগোষ্ঠীর মধ্যে ক্ষমতা নিয়ে যে ষড়যন্ত্র চলছিল, তার কথা। ১৯৭১ সালে কীভাবে গুলহাসান চক্র ভুট্টোর সঙ্গে আঁতাত করেছিলেন, আবার যুদ্ধের পর সেই গুলহাসান কীভাবে সেনাবাহিনী থেকে বিতাড়িত হলেন সেসবও আমরা জানতে পারি খলিলুর রহমানের বইয়ে। যাঁদের সহায়তায় ক্ষমতায় এসেছেন প্রথম সুযোগে তাঁদের কী নির্দয়ভাবে বিদায় করেছিলেন, সেই বিবরণও আছে। ভুট্টো কখনোই প্রতিপক্ষকে সহ্য করেননি।
নওশের মান্ডি বাহাউদ্দিনে বন্দী জীবনযাপন করেছেন ব্রিগেডিয়ার খলিলসহ আরও অনেক বাঙালি সেনা কর্মকর্তা। বন্দিজীবনে তাঁরা যেমন ভালো পাকিস্তানিদের দেখা পেয়েছেন তেমনি মন্দ পাকিস্তানিদের সংখ্যাও কম ছিল না। তবে সেটি ছিল ব্যক্তিগত পর্যায়ে। বাঙালিদের বঞ্চনার কথা বলতে গেলে কেউ-ই স্বীকার করেনি।
বইটি সাজানো হয়েছে আটটি অধ্যায়ে, যথাক্রমে মুক্তিযুদ্ধের প্রারম্ভিক ঘটনাবলি ও পাকিস্তানি সেনা কর্তৃপক্ষের মনোভাব, ১৯৭১ সালের কয়েকটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা, পাকিস্তানিদের সীমাহীন অজ্ঞতা, বাঙালিদের সম্পর্কে পাকিস্তানি তথা পাঞ্জাবিদের মনোভাব, বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলা, পাকিস্তানিদের পরাজয় ও নতুন পরিস্থিতিতে ক্ষমতার লড়াই, বন্দিজীবন—কোহাট ও অন্যত্র, মুক্তি ও স্বদেশ প্রত্যাবর্তন।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে এটি ভিন্নধারার বই, যাতে অজানা এক অধ্যায় উঠে এসেছে, আমাদের ধারণা ছিল, যারা দেশ ত্যাগ করেছেন এবং দেশের ভেতরে ছিলেন তাঁরাই নির্যাতন-হয়রানির শিকার হয়েছেন। কিন্তু দেশে ফিরতে ব্যাকুল এবং পাকিস্তানে বন্দি আরেক জনগোষ্ঠী যে কি দুঃসহ যন্ত্রণা ও অপমান সহ্য করেছেন, তারই প্রামাণ্য দলিল পূর্বাপর: ১৯৭১।
নিষ্ঠুর বাস্তবতার দলিল
আহমাদ মাযহার
হায়েনার খাঁচায় অদম্য জীবন: মন্টু খান \ ফেব্রুয়ারি ১৯৯০ \ উত্তরণ
স্বাধীনতার মাত্র কয়েক বছরের মধ্যেই বাংলাদেশে ক্ষমতাসীনদের কাছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা অনেকটাই হয়ে পড়েছিল ভূলুণ্ঠিত। রাষ্ট্রের প্ররোচনায়ই নানাভাবে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে বিকৃত করা হচ্ছিল, বাঙালির আত্মত্যাগের মর্যাদাকে করা হচ্ছিল অবমাননা; উন্নয়নের নামে ইতিহাসের অমোঘ সত্যকেও করা হচ্ছিল অস্বীকার। এ রকম একটা সময়েই প্রকাশিত হয়েছিল মন্টু খানের হায়েনার খাঁচায় অদম্য জীবন বইটি। একাত্তরে পাকিস্তানি সামরিক জান্তা রাজনৈতিক-অরাজনৈতিক বাঙালি মাত্রের ওপর কি রকম নির্বিচার গণহত্যা ও বর্বর অত্যাচার চালিয়েছিল, এ বই তার প্রত্যক্ষ ও প্রামাণ্য দলিল। এর পাঠকদের মনে পড়বে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নাৎসি বন্দিশিবিরের অকথ্য অত্যাচারের কাহিনি কিংবা আনা ফ্রাঙ্কের ডায়েরির বিভীষিকাময় বর্ণনার কথা।
একাত্তরে লেখক ছিলেন বাঙালি পরিচালিত একমাত্র ব্যাংক ইস্টার্ন ব্যাংকিং করপোরেশনে কর্মরত। পাকিস্তানি হানাদারদের চোখে একসময়ের বাম রাজনীতির কর্মী মন্টু খানের এটাও ছিল এক অপরাধ। পাঁচ মাসের বন্দিজীবনের বর্ণনায় নিজের ওপর তাদের সেই অকথ্য নির্যাতনের কথা তো আছেই, আর আছে অন্যদের ওপর অত্যাচারের বিবরণও। ছোট্ট একটু উদ্ধৃতি:
‘শরীরের কোথায় কোথায় কেটে গেছে বুঝতে পারার মতো অনুভূতিও নেই তখন। তবে দেখলাম মেঝেতে বেশ রক্ত। কখন কোথা থেকে যে রক্ত পড়ছে কিছু বুঝতেই পারিনি। গায়ের নানা জায়গাতেও কিছু রক্ত লেগে আছে চোখে পড়লো। মলদ্বার দিয়ে রক্ত পড়ছিল। সেই রক্তের ওপর শুইয়ে মারপিট করেছে আর সেই রক্তই গায়ে-বুকে লেগেছে।’ [পৃ. ৪৪]
বাঙালিদের সম্পর্কে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সে সময়ের সামগ্রিক মনোভঙ্গিও উঠে এসেছে এতে। মুক্তিযুদ্ধে যোগ না দিয়েও এবং রাজনৈতিক ক্রিয়াকলাপ থেকে দূরে থাকা সত্ত্বেও হানাদারদের হাত থেকে রক্ষা পাননি লেখক। তাঁর সিদ্ধান্ত ছিল এই যে নির্যাতনের কোনো পরিস্থিতিতেই সহকর্মী বা পরিচিত কাউকে নিজের সঙ্গে জড়াবেন না। ভেবেছিলেন, পরিণতিতে মৃত্যুর চেয়ে ভয়াবহতর কিছু তো আর সামনে নেই! সুতরাং নির্যাতনের মুখে সংশ্লিষ্ট কারও নাম প্রকাশ না করাকে তিনি রাজনৈতিক আদর্শের সংগ্রামের একটি পরীক্ষা হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন।
বইটি প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার স্মৃতিচারণা হলেও পাঠক এর মধ্যে উপন্যাসের স্বাদ পাবেন। বন্দি মানুষগুলোর ব্যক্তিক সংকটের কথা যেভাবে বর্ণিত হয়েছে, তাতে তাঁরা একেকজন হয়ে উঠেছেন উপন্যাসের চরিত্র। প্রসঙ্গত হাজী মোরশেদের কথা বলা যেতে পারে, যিনি মন্টু খানের মতোই অবর্ণনীয় নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন। নিজে সিগারেট খেতেন না, কিন্তু অনেক ঝুঁকি নিয়ে সিগারেট জোগাড় করে দিতেন সহবন্দীদের।
মন্টু খান নিজেকে সাহিত্যিক বলে দাবি করেননি; কিন্তু এই বইয়ের ভাষানির্মোহতা ও পরিহাস-রসিকতায় অসাধারণ সাহিত্য গুণসম্পন্ন হয়ে উঠেছে। নিজের ওপর নির্যাতনকে এমন নৈর্ব্যক্তিক পরিহাসের সঙ্গে বর্ণনার ক্ষমতা শক্তিমান সাহিত্যিকেরই থাকে। এই বইয়ে তিনি যা লিখেছেন, তা আড়ম্বরহীন ও অভিজ্ঞতা-উজ্জ্বল ভাষার গুণে হয়ে উঠেছে অনবদ্য! বর্বর অত্যাচারের মধ্যেও লেখকীয় নির্মোহ দৃষ্টির পরিচয় মেলে হানাদার পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ভেতরেও মানবিক বোধসম্পন্ন মানুষের দেখা পাওয়ার বর্ণনায়। সব মিলিয়ে বলা যায়, বইটিতে এক দিকে যেমন রয়েছে মানবতার চরম লাঞ্ছনার ছবি, তেমনই অন্য দিকে আছে মানবিকতার দৃষ্টান্ত। কাজেই বইটিকে বলা যায় দালিলিকতা ও সাহিত্যিকতার এক অসামান্য নিদর্শন।
‘গেরিলা থেকে সম্মুখযুদ্ধে’ সংগ্রহে আছে তো?
আনিসুল হক
গেরিরা যুদ্ধ থেকে সম্মুখ যুদ্ধে: মাহবুব আলম \ ফেব্রুয়ারি ১৯৯২ \ সাহিত্য প্রকাশ
বাংলাদেশের ঘরে ঘরে সঞ্চয়িতা, গল্পগুচ্ছ, সঞ্চিতা, রূপসীবাংলা, বিষাদসিন্ধুর মতো বইগুলোর পাশাপাশি গেরিলা থেকে সম্মুখযুদ্ধে বইও থাকা জরুরি। এই বইটা মুক্তিযুদ্ধের বই বলে নয়, এই বইটা একজন সাধারণ ছাত্রমুক্তিযোদ্ধা গেরিলা মাহবুব আলমের, যিনি গেরিলা যুদ্ধ থেকে শুরু করে অংশ নিয়েছেন ডিসেম্বরের সম্মুখযুদ্ধে। তাঁর ডায়েরি শুধু এই জন্য নয়, এই বইটায় আমরা পাব উনিশ শ একাত্তর সালের অবরুদ্ধ দিনরাত্রিগুলোয় বিশাল বিস্তারিত বাংলাদেশের জনপদগুলোকে, যেখানে লেখকের বর্ণনার গুণে প্রতিটা চরিত্র জীবন্ত মানুষ হয়ে উঠেছে। সেই চরিত্রের মধ্যে বিএসএফের হিন্দিভাষী কমান্ডার যেমন আছেন, তেমনি আছে গ্রামবাংলার কিশোর রাখাল বালক, গ্রাম্য গৃহবধূ, লাজুক তরুণী। মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার মাহবুব আলমের সহযোদ্ধাদের প্রত্যেকের চরিত্র এই বইয়ে ফুটে উঠেছে উপন্যাসের চেয়েও প্রাণবন্ত ভাষায়। মুক্তিযুদ্ধ যে কেবল নেতাদের যুদ্ধ নয়, কেবল সৈনিকদের যুদ্ধ নয়, সাধারণ মানুষের যুদ্ধ, সেই বিবরণ গেরিলা থেকে সম্মুখযুদ্ধে এত জীবন্তভাবে ফুটে উঠেছে যে মনে হয় ফিরে গেছি একাত্তরের দিনাজপুরের বীরগঞ্জে বা সীমান্ত এলাকায়। একটু উদ্ধৃত করি:
‘সজিম উদ্দিন আজকের রাতের গাইড। … যাত্রার আগে নিজের গ্রামে ছুটে যেতে হবে শুনে ওর চোখমুখ উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে এক অনাবিল আনন্দে। এ অপারেশনে গেলে সে তার বাড়িতে যেতে পারবে, আর সেখানে অপেক্ষা করছে ফুটফুটে এক সুশ্যামলা নারী, সজিম উদ্দিনের স্ত্রী।…
একটা কুপি হাতে সজিম উদ্দিনের বউ পথ দেখিয়ে চললো। সজিম উদ্দিন তার পাশে পাশে। যেতে যেতে অনুচ্চ স্বরে তার বউকে বলছে, খোকার মা, তুই ভালে আছিস গে? মাথার আলগা আঁচল খসে পড়েছে, কুপির কাঁপা নরম আলোয় উদ্ভাসিত এক উচ্ছল মুখ। বাংলার চিরন্তন নারীর এক ভালোবাসার মুখ সেটা। দ্রুতই সিদ্ধান্ত নিই, একজন গ্রামের সামান্য নারীর অনাবিল খুশির আনন্দটুকু কেড়ে নেয়া ঠিক হবে না। যা হবে হোক। সজিম উদ্দিন আজ থাকবে বাড়িতে। আজকে রাতে ওর ছুটি।’ কী আর এমন ঘটে এই বর্ণিত অংশে, যুদ্ধ নয়, গোলাগুলি নয়, সামান্য একটু বর্ণনা। কিন্তু মনটা ছুঁয়ে যায় একেবারে।
আবার আছে সহযোদ্ধা হারানোর কষ্টকর বর্ণনা। ‘আক্কাস গুলি খেলো। আক্কাসের সেকশনের সাথে আমার নিজের অবস্থান। যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকেই আমার পাশে শোয়া অবস্থানে থেকে শত্রুর মোকাবিলা করছিল সে। সুঠাম শরীরের অধিকারী, ঠাণ্ডা মেজাজের মিতভাষী ছেলে, সেকশন কমান্ডার আক্কাস। রংপুর জেলার কালীগঞ্জ এলাকায় তার বাড়ি। ম্যাট্রিক পাস করে কলেজে প্রথম বর্ষে পড়ার সময় প্রাণের টানে চলে এসেছে সরাসরি যুদ্ধের ময়দানে। যুদ্ধের মাস খানেক আগে তার বিয়ে হয়েছে।…আক্কাস দাঁড়িয়ে তার হাত স্টেনগানে ম্যাগাজিন ভরছে। ঠিক এই সময় হঠাৎ করে বাঁ হাতে বুক চেপে ধরে ও হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে। তারপরেই আর্তচিৎকার করে ওঠে সে, …গুলি লেগেছে মাহবুব ভাই, আমাকে বাঁচান।’
আহারে, আমার মন কেমন করে। কত বয়স ছিল আক্কাসের? ১৮? কত বয়স ছিল তার সদ্যবিধবা কিশোরী বউটির? বেরুবাড়ি-হাড়িভাসা সড়ক, যার নাম দেওয়া হয়েছিল জয়বাংলা সড়ক, সেখানে সমাহিত করা হয়েছিল আক্কাসকে। এই আক্কাসদের কথা কেউ জানবে না? কোথাও লেখা থাকবে না?
মাহবুব আলম ভূমিকায় লিখেছেন, ‘শহীদুল ইসলাম বাবলু, আমার সে দিনের যুদ্ধ সময়কার সাথী, তার অভিযোগ ছিল, আমাদের কথা তো কেউ লিখল না।… মেরুদণ্ডে গুলি খাওয়া হাসান, রংপুরের গঙ্গাচড়ার ছেলে, তারও অভিযোগ, তার কথা কেউ লিখল না। পঞ্চগড়ের ছেলে জহিরুল, গ্রেনেডের আঘাতে ছিন্নভিন্ন হয়ে গিয়েছিল যার শরীর, কিছুদিন আগে অভিমানাহত হয়ে বলেছিলো, সবকিছু ব্যর্থ হয়ে গেল।’
না, সবকিছু ব্যর্থ হয়নি। এই সব নাম না জানা যোদ্ধা আর শহীদের অনেকের কথা লেখা হয়েছে দুই খণ্ডের বই গেরিলা থেকে সম্মুখযুদ্ধেতে, যে বই ইতিহাসের ইতিহাস, উপন্যাসের উপন্যাস, মহাকাব্যের মহাকাব্য। এটি আমার পড়া শ্রেষ্ঠ গ্রন্থগুলোর একটা। সব বাংলাদেশির অবশ্যপাঠ্য।
বইটা শুরু হয়েছে অবশ্য ১৭ ডিসেম্বর দিয়ে। পরের পৃষ্ঠাতেই ১৬ ডিসেম্বরের ডায়েরির পাতা।
‘১৬ তারিখে বিকেল চারটার দিকে ওয়াকিটকি সেটে ক্যাপ্টেন শাহরিয়ারের গলা ভেসে এসেছিল হঠাৎ করে।
—টু ফোর ওয়ান টু ফোর ওয়ান—ক্যান ইউ হিয়ার মি? ওভার।
—ওয়ান ফোর টু ওয়ান ফোর টু—লাউড এন্ড ক্লিয়ার— ওভার।
—কংগ্রাচুলেশন্স মাহবুব। বিরাট সুখবর। আজ বিকেলে ঢাকা রেসকোর্সে পাকবাহিনী সারেন্ডার করেছে। ওভার।
—কংগ্রাচুলেশন্স স্যার। বিরাট সুখবর। যুদ্ধ তাহলে শেষ। স্বাধীনতা এলো, ওভার। …
‘কথোপকথন শেষে সুবেদার খালেক জড়িয়ে ধরলেন। হাউমাউ করে কেঁদে ফেললেন। পাশে দাঁড়ানো আমার কোম্পানি সেকেন্ড ইন কমান্ড পিন্টু। সেও জাপ্টে জড়িয়ে ধরল আমাকে। তারপর ছেড়ে দিয়ে নাচার ভঙ্গিতে হাত ওপরে তুলে চিৎকার করতে লাগল, ‘স্বাধীনতা স্বাধীনতা— মুক্তি মুক্তি—সারেন্ডার সারেন্ডার’ এবং সবশেষে তার কণ্ঠ থেকে বেরিয়ে এলো সেই চিরায়ত শ্লোগান, জয় বাংলা।’
মাহবুব আলম, আপনার কাছে একজন বাঙালি হিসেবে আমি ক্ষমা চাই, আপনার সরকারি চাকরিজীবনে মুক্তিযোদ্ধা হওয়ার অপরাধে আপনার পদোন্নতি হয়নি, কিন্তু তারও চেয়ে বেশি ক্ষমা চাই যখন লোকে বলে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে এই দেশে ভালো বই লেখা হয়নি। তারা এ কথা বলে, কারণ তারা আপনার বই দুটো পড়েনি। পড়েনি, কারণ আমরা তাদের জানাতে পারিনি এই বইয়ের খবর। আমি আমার পাঠকদের মিনতি করি, বাংলাদেশে ভালো বই লেখা হয়নি, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে ভালো বই নেই, এ কথা বলার আগে যেন তাঁরা মাহবুব আলমের লেখা গেরিলা থেকে সম্মুখযুদ্ধে বইটা মন দিয়ে পড়েন।
‘বাতাসে লাশের গন্ধ’
সৈয়দ আজিজুল হক
১৯৭১: ভয়াবহ অভিজ্ঞতা: সম্পাদনা: রশীদ হায়দার \ ১৬ ডিসেম্বর ১৯৮৯ \ সাহিত্য প্রকাশ
রশীদ হায়দার সম্পাদিত ১৯৭১: ভয়াবহ অভিজ্ঞতা শীর্ষক বইটি পড়ার পর মনে যে তীব্র যন্ত্রণাকর অনুভূতি হয়, তা রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহর কবিতার ভাষায় এ রকম: ‘আজো আমি বাতাসে লাশের গন্ধ পাই,/ আজো আমি মাটিতে মৃত্যুর নগ্ননৃত্য দেখি,/ ধর্ষিতার কাতর চিৎকার শুনি তন্দ্রার ভেতরে—/ এ দেশ কি ভুলে গেছে সেই দুঃস্বপ্নের রাত, সেই রক্তাক্ত সময়?’ কিংবা ‘নদীতে পানার মতো ভেসে থাকা মানুষের পচা লাশ,/ মুণ্ডুহীন বালিকার কুকুরে খাওয়া বীভৎস শরীর/ ভেসে ওঠে চোখের ভেতরে—আমি ঘুমুতে পারি না, আমি/ ঘুমুতে পারি না…’।
শুধু ২৫-২৬ মার্চের মধ্যবর্তী রাতটিই নয়, তখন থেকে ১৬ ডিসেম্বর সকাল পর্যন্ত পুরো নয় মাসই যেন ছিল মুক্তিকামী বাঙালির জন্য এক দুঃস্বপ্নের কালরাত। গণহত্যা, অগ্নিসংযোগ, লুটপাট, নারীর সম্ভ্রমহানি, বন্দীদের ওপর অমানুষিক নির্যাতন-নিপীড়ন প্রভৃতির মাধ্যমে পুরো দেশটি এক আতঙ্কগ্রস্ত মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয়েছিল। এসবই শুরু হয়েছিল ঢাকা থেকে এবং দ্রুত তা ছড়িয়ে পড়েছিল সারা দেশে। জেলা মহকুমা, থানার শহর বন্দর থেকে প্রত্যন্ত গ্রাম পর্যন্ত পাকিস্তানি বাহিনীর হত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ পরিচালিত হয়েছে। ধর্ম-বর্ণ-জেন্ডার-বয়স নির্বিশেষে ওই বর্বর বাহিনীর আক্রমণের শিকার হয়েছে সর্বস্তরের মানুষ। শান্তি কমিটি, রাজাকার এবং আলবদর ও আল শামস বাহিনী গঠনের মাধ্যমে তাদের সহযোগিতা করেছে এ দেশের অবাঙালিরা এবং ধর্মোন্মাদ রাজনৈতিক দলগুলো। ১৯৭১-এর বাঙালি নিধন কোনো কোনো ক্ষেত্রে হিটলারের ইহুদি নিধনযজ্ঞকেও হার মানিয়েছে। এ বইটির বিশেষত্ব হলো, এটি কোনো শোনা কাহিনির সংকলন নয়, এর প্রতিটি লেখাই প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার মর্মস্তুদ বিবরণে ভাস্বর। এতে বিধৃত হয়েছে মৃত্যুপুরী থেকে বেঁচে যাওয়া মানুষগুলোর গভীর মর্মবেদনার জীবন্ত ভাষ্য।
এ গ্রন্থের বিবরণী থেকে পাকিস্তানি বাহিনী ও তার এ দেশীয় দোসরদের বর্বর ও পাশবিক কর্মকাণ্ড এবং বাঙালিদের প্রতি তাদের ঘৃণার পাশাপাশি বাংলাদেশের মানুষের মনে স্বাধীনতার স্পৃহা কেন এত তীব্র হয়ে উঠেছিল, তারও স্বরূপ উপলব্ধি করা যায়। এ গ্রন্থ পাঠে মুক্তিযোদ্ধাদের দুঃসাহসিক অভিযানের কাহিনি যেমন অবহিত হওয়া যায়, তেমনি দেখা যায়, ভয়াবহ মৃত্যুভীতি উপেক্ষা করে শত্রুর কাছে সঠিক তথ্য গোপন রাখার ব্যাপারে তারা কতটা অবিচল ছিল। এ গ্রন্থে ব্যক্ত হয়েছে হানাদারদের নিষ্ঠুর আক্রমণ থেকে আত্মরক্ষার জন্য সাধারণ মানুষের গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে নির্বান্ধর পরিবেশে পলায়নপরতার দুঃসহ সব স্মৃতি। একই সঙ্গে বর্বরতার বিপরীতে উপস্থাপিত হয়েছে সাধারণ মানুষের পরস্পরের প্রতি অবিশ্বাস্য সহানুভূতি ও অপার মানবিক মহিমার প্রাণস্পর্শী সব আখ্যান।
এ গ্রন্থে সংকলিত হয়েছে পঞ্চাশ ব্যক্তির নির্মম অভিজ্ঞতার চিত্র। ২৫ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর এই নয় মাসেরই চিত্র এসব লেখার মধ্যে বিভিন্নভাবে পরস্ফুিটিত। ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা, পাবনা, বগুড়া, রংপুর, দিনাজপুর, ময়মনসিংহ, বরিশাল, সিলেট, কুমিল্লা, কুষ্টিয়া, ঝিনাইদহ, নরসিংদী, নেত্রকোনা প্রভৃতি অঞ্চলের বিক্ষিপ্ত চিত্র পরিবেশিত হয়েছে। লেখক তালিকায় রয়েছেন নীলিমা ইব্রাহীম, জাহানারা ইমাম, হাসান আজিজুল হক, সেলিনা হোসেন, হুমায়ূন আহমেদ, কে এম সফিউল্লাহ, শমসের মবিন চৌধুরী, ইয়াফেস ওসমান, আবুল বার্ক আলভী, মাকিদ হায়দার প্রমুখ।
এঁদের লেখায় প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছে সেই মৃত্যুপুরীর বাস্তবতা। তবে এ গ্রন্থ নিশ্চয়ই ওই নয় মাসের কোনো সামগ্রিক চিত্র নয়, খণ্ডচিত্র মাত্র। সামগ্রিক চিত্র পরিবেশনের কোনো লক্ষ্যও ছিল না লেখকদের কিংবা সম্পাদকের। কিন্তু পাঠক এসব খণ্ডচিত্র থেকে সামগ্রিকতাকে অনুধাবন করতে পারেন। এই বিন্দুর মধ্যে থেকেই তাঁরা বৃত্তকে ভরাট করে তুলতে পারেন কিংবা পারেন সিন্ধুর গভীরতাকে উপলব্ধি করতে। পাকিস্তানি বাহিনী ও তার এ দেশীয় দোসরদের বর্বরতাকে অনুধাবনের জন্য এটি একটি অবশ্যপাঠ্য গ্রন্থ।
স্মৃতিকথায় মুক্তিযুদ্ধের নিষ্ঠ ইতিহাস
বিশ্বজিৎ ঘোষ
আমার একাত্তর: আনিসুজ্জামান \ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৭ \ সাহিত্য প্রকাশ
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের গৌরবোজ্জ্বল মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে প্রকাশিত হয়েছে অনেক বই, বেরিয়েছে নানাজনের নানামাত্রিক স্মৃতিকথা। এ ধারায় ধীমান অধ্যাপক, নিষ্ঠ গবেষক বাঙালি মননের উজ্জ্বল প্রতিনিধি আনিসুজ্জামানের আমার একাত্তর (১৯৯৭) স্মৃতিকথা নানা কারণেই বিশিষ্টতা দাবি করতে পারে। মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক ছিলেন অধ্যাপক আনিসুজ্জামান। তিনি ছিলেন প্রবাসী সরকার-গঠিত প্ল্যানিং সেলের সদস্য। প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীনের অধিকাংশ ভাষণের লেখক ছিলেন তিনি। তিনি ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে সাক্ষাৎকারী বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলের অন্যতম সদস্য ছিলেন। ভাবতে বিস্ময় লাগে, এসব কাজ তিনি যখন করেছেন, একটি বিপ্লবী সরকার যখন তাঁর ওপর এসব গুরুদায়িত্ব বহনের ক্ষমতা সম্পর্কে আস্থা স্থাপন করেছে, তখন তাঁর বয়স ছিল মাত্র ৩৪ বছর। রাজনীতির সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত না থেকেও আনিসুজ্জামান সেদিন যে রাজনৈতিক প্রজ্ঞার পরিচয় দিয়েছিলেন, রাজনীতির খুঁটিনাটি চাল সম্পর্কে যে বিশ্লেষণ উপস্থাপন করেছেন, তা অনেকের কাছেই শিক্ষণীয় হতে পারে।
আনিসুজ্জামানের ব্যক্তি-অভিজ্ঞতা ও একাত্তরের রাষ্ট্রীয় ঘটনা ধারা আলোচ্য গ্রন্থে একাকার হয়ে গেছে। অন্তিমে ব্যক্তি তাঁর কাছে গৌণ হয়ে গেছে, মুখ্য হয়েছে রাষ্ট্র। স্মৃতিকথা বলার সময় নিজেকে উহ্য রাখার প্রায় অসম্ভব এক ক্ষমতা আছে আনিসুজ্জামানের। এ গ্রন্থেও এর পরিচয় পাওয়া যায়। তিনি মুক্তিযুদ্ধের মূল ঘটনা ধারা দেখেছেন ও বিশ্লেষণ করেছেন ঘটনার কেন্দ্রে থেকে, গাল-গল্প করে নিজেকে জাহির করে নয়, বরং উহ্য রেখে।
মুক্তিযুদ্ধের সময় আওয়ামী লীগের অভ্যন্তর দ্বন্দ্ব, বিশেষত তাজউদ্দীনের বিরুদ্ধ পক্ষের নানা প্রয়াস আনিসুজ্জামানের ভাষ্য থেকে লাভ করা যায়। ঘরে-বাইরে তাজউদ্দীন যে কতভাবে বিরোধিতার মুখোমুখি হয়েছেন, এ রচনায় তার আভাস স্পষ্ট। তাহেরউদ্দিন ঠাকুর, খন্দকার মোশতাক আহমেদরা যে মুক্তিযুদ্ধের সময়েই নানামাত্রিক স্যাবোটাজ করেছেন, তারও ইঙ্গিত পাই আলোচ্য গ্রন্থে। সর্বদলীয় জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের প্রতি আওয়ামী লীগ যে সুপ্রসন্ন ছিল না, বরং তারা যে চাইত আওয়ামী লীগের নেতৃত্বেই মুক্তিসংগ্রাম সংগঠিত হবে—এমন ভাবনারও পরিচয় আছে আলোচ্য গ্রন্থে।
আনিসুজ্জামানের বক্ষ্যমাণ গ্রন্থ থেকে মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা সম্পর্কে একটা পূর্ণাঙ্গ ধারণা পাওয়া যায়। যুদ্ধের সময় ভারতসহ বিদেশের কোনো ব্যক্তি বা সংস্থা আমাদের পক্ষে কাজ করেছে, কারা বিরোধিতা করেছে, এর স্পষ্ট ভাষ্য আছে এ গ্রন্থে। ইউরোপ-আমেরিকার অনেক ব্যক্তি ও সংস্থার সাহায্য-সহযোগের কথাও এখানে পাওয়া যায়। আনিসুজ্জামানের আন্তর্জাতিক সংযোগ যে কত ব্যাপক, এ বই তারও কিছু সাক্ষ্য বহন করে।
স্মৃতিকথা বলতে বলতে, চট্টগ্রাম-রামগড়-আগড়তলা-কলকাতার কথা জানাতে জানাতে আনিসুজ্জামান নানা খণ্ডকথার মধ্য দিয়ে যেভাবে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস তুলে ধরেছেন, এক কথায় তা অসাধারণ। অনুপম এক ভাষায় অন্তরঙ্গ ভঙ্গিতে ব্যক্তিগত অবলোকনের যে চিত্র আনিসুজ্জামান তুলে ধরেছেন, তা হয়ে উঠেছে আমাদের জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের অনুপম এক দলিল।
মূলধারা ’৭১: ইতিহাসের অজানা অধ্যায়
আহমাদ মোস্তফা কামাল
মূলধারা ’৭১: মঈদুল হাসান \ ফেব্রুয়ারি ১৯৮৬ \ ইউপিএল
যেকোনো যুদ্ধের ইতিহাসই নানা রকম জটিল উপাদানের সমন্বয়ে গড়ে ওঠার কথা, ওঠেও। বিশেষ করে, এ যুগের যুদ্ধগুলো শুধু অঞ্চলভিত্তিক যুদ্ধেই সীমাবদ্ধ থাকে না, তার এক বা একাধিক আন্তর্জাতিক প্রভাব ও পরিপ্রেক্ষিতও থাকে। আমাদের মুক্তিযুদ্ধও তেমনই একটি বিষয়। মূলধারা ’৭১ গ্রন্থে মঈদুল হাসান বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের এমন একটি অধ্যায়ের—‘মুক্তিযুদ্ধের পরিকল্পনা, উদ্যোগ ও মূল ঘটনাধারা’— প্রকৃত স্বরূপ তুলে এনেছেন, যেটি মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস আলোচনায় প্রায় উপেক্ষিতই থাকে, আর এ জন্য তিনি বেছে নিয়েছেন প্রবাসী সরকারের কর্মকাণ্ড ও আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটকে। যুদ্ধের সময় এই লেখক অস্থায়ী সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে জড়িত হয়ে পড়েছিলেন এবং সংগ্রামের সাংগঠনিক পরিকল্পনা ও ব্যবস্থাপনার বিভিন্ন দিক সম্বন্ধে অবহিত ছিলেন। সংগত কারণেই সেসবের একটি নির্ভরযোগ্য বিবরণ এ গ্রন্থে রয়েছে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, পাকিস্তান যে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান চালাতে পারে, ২৫ মার্চের অনেক আগেই শেখ মুজিব সেটি অনুমান ও আশঙ্কা করেছিলেন এবং সে রকম কিছু ঘটলে প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের কাছ থেকে কী ধরনের সহায়তা পাওয়া যেতে পারে, সেটি জানার জন্য তাজউদ্দীন আহমদকে ৫ বা ৬ মার্চ ঢাকাস্থ ভারতীয় ডেপুটি হাইকমিশনার কে সি সেনগুপ্তের সঙ্গে আলোচনা করতে পাঠিয়েছিলেন। সেনগুপ্ত এর উত্তর সন্ধানে দিল্লিতে যান এবং ফিরে এসে তাজউদ্দীনকে ভাসাভাসাভাবে জানান, ‘পাকিস্তানি আঘাতের সম্ভাবনা সম্পর্কে ইসলামাবাদে ভারতীয় হাইকমিশন সম্পূর্ণ বিপরীত মত পোষণ করেন; তবু “আঘাত যদি নিতান্তই আসে” তবে ভারত আক্রান্ত মানুষের জন্য “সম্ভাব্য সকল সহযোগিতা” প্রদান করবে।’ ২৪ মার্চ সেনগুপ্তের সঙ্গে তাজউদ্দীনের পরবর্তী বৈঠক হওয়ার কথা থাকলেও সেটা হতে পারেনি। ফলে ২৫ মার্চের হামলার পর ভারতের কাছ থেকে কী ধরনের সহযোগিতা পাওয়া যাবে বা আদৌ পাওয়া যাবে কি না, এই অনিশ্চয়তা মাথায় নিয়েই তাজউদ্দীন তাঁর তরুণ সহকর্মী ব্যারিস্টার আমীর উল ইসলামকে নিয়ে সীমান্তে পৌঁছান। কিন্তু অচিরেই তিনি উপলব্ধি করেন যে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর কাছে বাংলাদেশকে সহায়তা করার জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কোনো নির্দেশ এসে পৌঁছেনি। ৩ এপ্রিল তিনি ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে সাক্ষাতের সুযোগ পান এবং তাঁর জিজ্ঞাসার জবাবে জানান যে শেখ মুজিবের নেতৃত্বে ২৬ বা ২৭ মার্চেই একটি সরকার গঠিত হয়েছে এবং তিনি সেই সরকারের প্রধানমন্ত্রী। এই সরকারকে কূটনৈতিক স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য তিনি ভারতকে অনুরোধও জানান। কিন্তু তখন পর্যন্ত সরকার গঠন তো দূরের কথা, সহকর্মীরা বেঁচে আছেন কি না, সেটাও তাজউদ্দীনের জানা ছিল না! উল্লেখ্য, স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী সরকার গঠিত হয় ১০ এপ্রিল, শপথ গ্রহণ করে ১৭ এপ্রিল ১৯৭১। যদিও এর আগেই ১১ এপ্রিল তাজউদ্দীন আহমদ বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বেতার ভাষণ দেন। তিনি যে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর কাছে নিজেকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে পরিচয় দিয়েছিলেন, এর পেছনে একটি তাৎপর্যপূর্ণ কারণ ছিল। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে প্রতিরোধযুদ্ধে সহায়তা চাওয়া আর বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে সহায়তা চাওয়া যে সম্পূর্ণ ভিন্ন ব্যাপার এবং ভিন্ন মাত্রাযুক্ত, সেটা তাজউদ্দীন আহমদ যথার্থই উপলব্ধি করেছিলেন। আগেই উল্লেখ করেছি, সাক্ষাতের শুরুতেই ইন্দিরা গান্ধী জানতে চেয়েছিলেন, ‘আওয়ামী লীগ ইতিমধ্যেই কোনো সরকার গঠন করেছে কি না!’ ইতিবাচক উত্তর পেয়ে তিনি ‘বাংলাদেশ সরকারের আবেদন অনুসারে বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামকে সম্ভাব্য সকল প্রকার সহযোগিতা প্রদানের প্রতিশ্রুতি জ্ঞাপন করেন।’ তাজউদ্দীন আহমদের এই দূরদর্শিতা তাঁর ‘প্রধানমন্ত্রিত্বের’ নয় মাস ধরেই কার্যকর ছিল। আরেকটি উদাহরণ দিলে সেটি আরও পরিষ্কারভাবে বোঝা যাবে, ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে প্রথম সাক্ষাতেই তিনি বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য অনুরোধ করলেও এটিকে তিনি স্রেফ ‘দাবি’ হিসেবেই জিইয়ে রাখতে চেয়েছিলেন, কোনো চাপ বা তদবির করে একে ত্বরান্বিত করতে চাননি। কারণ, একদিকে বাংলাদেশকে কূটনৈতিক স্বীকৃতি দেওয়ার ব্যাপারে ভারতের বাস্তবসম্মত কিছু অসুবিধা ছিল; সেটি যেমন তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, অন্যদিকে প্রতিরোধযুদ্ধ শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ভারতীয় স্বীকৃতি পেলে পাকিস্তান একে ‘ভারতীয় ষড়যন্ত্র’ বলে বিশ্বের কাছে প্রতিষ্ঠিত করার সুযোগ পেত এবং একে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ বলে চালিয়ে আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপে যুদ্ধবিরতি কার্যকর করার চেষ্টা করত, যা পরিশেষে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে অঙ্কুরেই মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিত—সেটিও উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। তাজউদ্দীন আহমদ তাঁর রাজনৈতিক ও দার্শনিক প্রজ্ঞার কারণে বিষয়গুলো উপলব্ধি করতে পারলেও আওয়ামী লীগের অধিকাংশ নেতাই সেটি পারেননি। ফলে সরকার গঠনের পর থেকেই তাজউদ্দীন আহমদকে নানা রকম উপদলীয় ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করতে হয়। সেসবের বিস্তারিত বিবরণও আছে এই গ্রন্থে।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারত প্রথম থেকেই নানাভাবে সহায়তা করেছিল এবং এসব সহযোগিতা ছাড়া বাংলাদেশের পক্ষে এত দ্রুত জয়লাভ করা কঠিন হতো—এ কথা অনস্বীকার্য, কিন্তু এ-ও মনে রাখা দরকার যে ২৬ মার্চ থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত মুক্তিযোদ্ধারই পাকিস্তানিদের ব্যতিব্যস্ত রেখেছিলেন, নাস্তানাবুদ করে ছেড়েছিলেন, ওদের মনোবলকে নিয়ে এসেছিলেন শূন্যের কোঠায়। এটা না করতে পারলে সক্রিয় অংশগ্রহণের মাত্র ১২ দিনের মাথায় পাকিস্তানিদের পরাজিত করা ভারতীয়দের পক্ষে কোনোভাবেই সম্ভব হতো না। উল্লেখ্য, ভারতীয় স্থলবাহিনী বাংলাদেশে অভিযান শুরু করে ৪ ডিসেম্বর ১৯৭১ এবং আনুষ্ঠানিক কূটনৈতিক স্বীকৃতি দেয় ৬ ডিসেম্বর ১৯৭১। মুক্তিযোদ্ধাদের দুঃসাহসিক অভিযানে পাকিস্তানিরা যখন পলায়নপর এবং মানসিকভাবে পরাজিত, তখন ভারতীয় বাহিনীর অংশগ্রহণ তাদের এই পরাজয়কে কেবল ত্বরান্বিত ও অনিবার্য করে তুলেছিল। মূলধারা ’৭১ গ্রন্থে লেখক বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ঘটে যাওয়া মুক্তিযোদ্ধাদের এসব দুঃসাহসিক অভিযান ও এর ফলাফলের বিস্তারিত বিবরণ দেননি, তাঁর মনোযোগের কেন্দ্রে ছিল প্রবাসী সরকারের কর্মকাণ্ড ও আন্তর্জাতিক রাজনীতি। ফলে এই গ্রন্থটিও মুক্তিযুদ্ধের পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস নয়। তবে একটি অজানা অধ্যায়ের উন্মোচন করে তিনি আমাদেরকে চির কৃতজ্ঞতাপাশে আবদ্ধ করেছেন।
একাত্তর—নারীর চোখে দেখা
তানজিনা হোসেন
মুক্তিযুদ্ধে নারী: মালেকা বেগম \ ফেব্রুয়ারি ২০১১ \ প্রথমা
জন্মের ৪০ বছর পরও জন্মলাভের পেছনে কার অবদান বেশি আর কার একটু কম—এখনো এ নিয়ে বিতর্ক চলমান। দুর্ভাগ্য এই বাংলাদেশের। স্বাধীনতা-পরবর্তী বছরগুলোয় গণমানুষের এই যুদ্ধের এবং তার জয়লাভের কৃতিত্ব একবার এদল তো আরেকবার ওদল আর সামরিক লোকজনের গলা অলংকৃত করলেও হিসাবের খাতিরে এখনো উচ্চারণ করতে হয় ‘তিরিশ লাখ শহীদ আর আড়াই লাখ মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতা’র কথা। এই তিরিশ লাখ আর আড়াই লাখ কারা? তাঁরা কি সবাই রাজনীতি করতেন? তাঁরা কি সবাই সামরিক বাহিনীর সদস্য ছিলেন? সবাই কি তাঁরা গেরিলা ট্রেনিং নিয়েছিলেন? ওই তিরিশ লাখের মধ্যে নারী-শিশু ছিলেন না? তবে তাঁরা শহীদের মর্যাদা পেলেন না কেন? আর ওই হতভাগী আড়াই লাখ কেবল ইজ্জতই দিয়েছেন? তাঁরা মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অবদানকারী বা যুদ্ধাহত নন? তবে তাঁরা কেন যুদ্ধ-পরবর্তীকালে গৌরবান্বিত হওয়ার বদলে লজ্জায় মুখ লুকিয়ে পালিয়েছেন? আর এই তিরিশ লাখ-আড়াই লাখের বাইরে আরও যে কোটি কোটি বাঙালি, তারা? যে কৃষক ধানের আড়ালে অস্ত্র লুকিয়ে এনে ক্যাম্পে পৌঁছে দিয়েছেন, যে মাঝি জীবন বাজি রেখে রাতের আঁধারে মুক্তিযোদ্ধাদের পৌঁছে দিয়েছেন নিরাপদে, যে হতদরিদ্র নারী হাসিমুখে একমাত্র ডিম পাড়া মুরগিটা জবাই করে তুলে দিয়েছেন মুক্তিযোদ্ধাদের পাতে কিংবা যে কিশোর ঝুঁকির মুখে একটুও বিচলিত না হয়ে এনে দিয়েছে শত্রুর খবর—তারা মুক্তিযোদ্ধা নন? যে মা নিজ হাতে টগবগে তাজা তরুণ ছেলের হাতে স্টেনগান তুলে দিয়েছেন—সেই মা? তাঁদের মহিমার জয়গান কই? তাঁদের কে মনে রাখে? যেখানে গুটিকয় দালাল ও সুবিধালোভী ছাড়া আর সবাই ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা, সেখানে মুক্তিযোদ্ধার তালিকা বা মুক্তিযোদ্ধার সনদপ্রাপ্তদের কীভাবে আলাদা করা যাবে? অবধারিতভাবেই সেই সনদ আর তালিকায় দেশের প্রান্তিক জনগণ বাদ পড়ে গেছে। আর নারী তো প্রান্তিকদের মধ্যে আরও প্রান্তিক।
আশার কথা, এত বছর পর আজ ইতিহাস নিজেই কথা কইতে শুরু করেছে। দেশের প্রান্তে প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা নারীরাও মুখ খুলছেন। একজন গুলি খাওয়া পঙ্গু পুরুষ মুক্তিযোদ্ধা আর একজন জরায়ুতে জখম হওয়া নারীর আত্মত্যাগে যে তফাত খুব বেশি নেই, দুজনই যুদ্ধের নৃশংসতার শিকার, তাও ইদানীং অনেকেই অনুভব করতে পারছে। এতকাল যে অধ্যায় লুকিয়ে রাখা হতো, এতকাল নারীর যে অবদান ও আত্মত্যাগের কথা গৌরব নয়, বরং লজ্জা ও ধিক্কার ছড়াত আমরা তার মহিমার জয়গান আজকাল শুনতে পাচ্ছি। গণহত্যা ও ধর্ষণ দুই-ই আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে যুদ্ধকালীন অপরাধের বিষয় হিসেবে বিচারের যোগ্য বলে বিবেচিত হওয়ায় এই ইতিহাস জানা ও বোঝার নতুন ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়েছে। মালেকা বেগমের মুক্তিযুদ্ধে নারী বইটি এই ধারাবাহিক প্রয়াসের একটি অংশ। নতুন প্রজন্মের পাঠক হয়তো চমৎকৃত ও বিস্মিত হয়ে পড়বে বরিশালের মুলাদী থানার কুতুব বাহিনীর করুণা কেমন করে গ্রেনেড ছুড়তে গিয়ে পায়ে গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন অথচ আজও যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধার সম্মান পাননি। কীভাবে অপারেশনের আগে সাঁথিয়ার ভানু নেছা ওসির কাছ থেকে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের এনে দিয়েছেন গোলাবারুদ, কেমন করে ঢাকার রওশন আরা বুকে মাইন বেঁধে হানাদার বাহিনীর ট্যাংকের নিচে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন, স্বরূপকাঠিতে নদীতে নোঙর ফেলা পাকিস্তানি গানবোটের গায়ে রাতের আঁধারে সাঁতরে গিয়ে গ্রেনেড চার্জ করে এসেছেন বীথিকা বিশ্বাস আর শিশির কণা নামের দুই অসম সাহসী তরুণী, গল্পের মতো শোনাবে যে ছেলেদের পোশাক পরে চুল ছোট করে কেটে পুরুষ পরিচয়ে ক্যাম্পে নিশ্চিন্তে সহযোদ্ধাদের সঙ্গে রাত কাটিয়েছেন পাবনার শিরিন বানু মিতিল। রাখাইন কিশোরী প্রিনছা খেঁ কিংবা সিন্দুরখান চা-বাগানের সালগী খাড়িয়ার মতো আদিবাসী নারীদের অসামান্য ভূমিকার কথাও আমাদের কাছে নতুন ও বিস্ময়করই ঠেকবে।
‘বাংলার ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো’ যুদ্ধে নামার এই অমোঘ আহ্বানের মধ্যে ঘোষিত হয়েছে যে এই যুদ্ধ সত্যিকার অর্থেই গণমানুষের যুদ্ধ, নারী ও পুরুষ, তরুণ ও বুড়ো অর্থাৎ ঘরে ঘরে সবারই অংশগ্রহণে ফলবান হবে সেই যুদ্ধ। যুদ্ধ হলো, সংঘটিত হলো ইতিহাসের নৃশংসতম হত্যাকাণ্ড ও ধর্ষণলীলা, সব কিছুর বিনিময়ে একদিন বিজয়ও এল; কিন্তু সেই স্বাধীনতা ও বিজয়ের ফল চলে গেল একাংশের হাতে। তা নিয়ে লোফালুফিও কম হলো না। কেবল হারিয়ে গেল সাধারণ ও প্রান্তিক জনসাধারণের অবদানের কথা, নিরন্ন দুঃখী-দরিদ্র কোটি বাঙালির আত্মদান ও গৌরবের মহিমা। একাত্তরের ইতিহাস থেকে নারীর হারিয়ে যাওয়া পুরুষের চোখে দেখা ও লেখা সেই বৈষম্যেরই পরিণাম। সময় এসেছে এই উদাসীনতা, অবহেলা ও বৈষম্যের ভুল অসমাপ্ত ইতিহাস থেকে বেরিয়ে আসার। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানের সামরিক পতিতালয়ে ধর্ষিত কোরিয়ান ও ফিলিপিনো নারীরা দীর্ঘ ৫০ বছর পর জাপান সরকারের ক্ষমাভিক্ষার দাবি জানিয়েছেন। কাজেই নতুন করে এক বৈষম্যহীন বহুমাত্রিক ও সামগ্রিক ইতিহাস রচনার সময় এখনো শেষ হয়ে যায়নি। মুক্তিযুদ্ধে নারী গ্রন্থটি হয়তো সেই নতুন ইতিহাসেরই মুখবন্ধ।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, মার্চ ২৫, ২০১১
Leave a Reply