জসীমউদ্দীনের ‘সৃজনী প্রতিভা’ কেন অল্পদিনেই নিঃশেষ হইয়া গেল, তাহার এক অভিনব ব্যাখ্যা উপস্থিত করিয়াছিলেন ভারতের বিখ্যাত লেখক হুমায়ুন কবির। হুমায়ুন কবির এক ঢিলে দুই পাখি মারিতে চাহিয়াছিলেন। তাঁহার বিচারে দেশের গণমানসের অন্তর্নিহিত শক্তিকে কাজে রূপান্তরিত করিয়াছিলেন জসীমউদ্দীন। সেই রূপান্তর যতটুকু করিতে পারিয়াছিলেন তিনি, তাঁহার কাব্যসিদ্ধিও ঠিক ততখানিই।
কিন্তু কবির বলিয়াছিলেন, গণমানসের অনুবাদই প্রতিভাবানের একমাত্র ধর্ম নয়। তাঁহাকে সেই মানসের সংগঠনেও রূপান্তর ঘটাইতে হইবে। মানসের সংগঠনে সেই রূপান্তর হয় নাই বলিয়াই জসীমউদ্দীনের ‘সৃজনী প্রতিভা’ অল্পদিনেই শেষ হইয়া আসিল। গণমানসের অন্তর্নিহিত শক্তি তাঁহার ঘাড়ে চড়িয়াছে বটে, তবে ‘কল্পনা ও আবেগের নতুন নতুন রাজ্য’ জয়ে তিনি অগ্রসর হইতে পারেন নাই। আত্মকেন্দ্রিক পুনরাবৃত্তির মধ্যে তাঁহার সাধনার অগতি এই সত্যেরই পরিণতি। (কবির ২০০২: ৬১)
হুমায়ুন কবির যশস্বী বিচারক। তাঁহার কথা অনেকেই মানিয়া লইয়াছেন। (মুখোপাধ্যায় ২০০৪: ৫০-৫১)
সান্ত্বনার কথা, হুমায়ুন কবিরের ধারণা যদি সত্য হয়, তো জসীমউদ্দীন একা নহেন। একজন অন্তত সঙ্গী আছেন তাঁহার। তিনি কাজী নজরুল ইসলাম। হুমায়ুন কবির লিখিয়াছেন, নজরুল ইসলামও নিপীড়িত জনমানসের আশা-আকাঙ্ক্ষাকে রূপ দেওয়ার সাধনা করিয়াছিলেন। তাঁহার বিশ্বাস, নজরুল ইসলাম ‘পুরাতন পুঁথিসাহিত্যের আবহাওয়ায় লালিত’। আর বাংলার বিপুল মুসলমান কৃষকশ্রেণীর সহিত তাঁহার ‘সহজ আত্মীয়তা’ এই কারণেই। পুরাতন ঐতিহ্যের পুনরুজ্জীবনের মধ্যেই—হুমায়ুন কবির দেখিয়াছেন— নজরুল ইসলামের ‘ভাষা ও ভঙ্গিতে বিধৃত বিপ্লবধর্ম’।
নজরুল ইসলাম ও জসীমউদ্দীন দুইজনকেই নির্দ্বিধায় তিনি বলিয়াছেন ‘পশ্চাদমুখী’। এখনকার ভাষায় আমরা হয়তো বলিব ‘প্রতিক্রিয়াশীল’। হুমায়ুন কবিরের প্রবন্ধটি বাহির হইয়াছিল বাংলা ১৩৪৯ সালে। ১৬ বৎসর পরে মুদ্রিত দ্বিতীয় সংস্করণেও তিনি এই মত বদলাইবার প্রয়োজন অনুভব করেন নাই।
হুমায়ুন কবিরের এই অভিমত অবশ্য আচানক কি সম্পূর্ণ আনকোরা ছিল না। নজরুল ইসলাম আর জসীমউদ্দীন দুই জনেরই প্রতিভা কেন অল্পদিনে নিঃশেষ হইয়া যাইবে তাহা খানিক ভবিষ্যদ্বাণী আকারে বলিয়াছিলেন কাজী আবদুল ওদুদও। ইংরেজি ১৯৩২ সালের ২৬ ডিসেম্বর কলিকাতায় বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য-সম্মিলনের পঞ্চম অধিবেশনে তিনি জানাইয়াছিলেন, এই দুইজন মুসলমান সাহিত্যিক ‘ভাগ্যবান’, কেননা তাঁহারা বৃহত্তর দেশের—মানে দেশের শ্রেষ্ঠ সাহিত্যিকদের—সমাদর লাভ করিয়াছেন।
একই কথাটি তিনি আরও সাজাইয়া-গুছাইয়া বলিলেন ইংরেজি ১৯৪৫ সালে। কাজী আবদুল ওদুদের লেখা সাধু বাংলায় তর্জমা করিয়া দিতেছি:
‘নজরুল ইসলাম একালের বাঙালি মুসলমানদের মধ্যে প্রথম সাহিত্যিক যিনি বাংলার মুসলমান ও হিন্দু উভয়ের চিত্ত আন্দোলিত করিতে সক্ষম হইলেন। তাঁহার পূর্বে একালেও শক্তিশালী মুসলিম সাহিত্যিক যে বাংলায় না জন্মিয়াছেন তাহা নয়। মীর মোশাররফ হোসেন, কায়কোবাদ, এয়াকুব আলি চৌধুরী, লুৎফর রহমান, বেগম রোকেয়া, কাজী ইমদাদুল হক প্রভৃতির নাম একালের বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে স্মরণীয় হইয়া থাকিবে। কিন্তু নজরুল ইসলামই হইতেছেন এযুগের প্রথম বাঙালি মুসলমান যিনি সমস্ত দেশের সম্ভ্রম ও সমাদর লাভ করিলেন। শুধু বাংলায় নয় ভারতেও তাঁহার যশ আজ ছড়াইয়া পড়িয়াছে। তাঁহার পরে সমস্ত দেশের সমাদর লাভ করিয়াছেন মুসলমান পল্লী-কবি জসীমউদ্দীন।’ (ওদুদ ১৯৮৩: ৭৬)
কাজী আবদুল ওদুদ সদা সত্যকথা বলিবেন, কদাচ মিথ্যা বলিবেন না। সেই ১৯৩২ সালেই তিনি জানাইয়াছিলেন, ‘এই দুই তরুণ শিল্পী’ ধন্য হইয়াছিলেন সে কালের ‘মুসলমান সমাজের অন্তরে’ তাহার সাহিত্যিক সার্থকতা সম্বন্ধে এক নব আশার সঞ্চার করিবার কারণে।
তাঁহারা যে অদূর ভবিষ্যতে আর ধন্য হইবেন না, অবাঞ্ছিত হইয়া যাইবেন তাহার ইঙ্গিতও তিনি করিতে কসুর করেন নাই। ওদুদ বলিতেছিলেন, ‘বাংলার মুসলমান সমাজে তখন সাহিত্যচর্চার যে অবস্থা, অর্থাৎ লেখক ও পাঠকের যে সমন্ধ’ তাহা শুদ্ধ অসন্তোষজনকই নয়, অনেকখানি আপত্তিকরও। ওদুদের কথার সরল তর্জমা করিতেছি: ‘পাঠক-সমাজের বিচার-শক্তি এখনো অত্যন্ত দুর্বল, সেই দুর্বলতার সুযোগ পুরাপুরি লইবার উদ্দেশ্যে আমাদের অনেক লেখককে অনেক সময়ে দেখিতে পাওয়া যায় অত্যন্ত অকিঞ্চিৎকর রচনায় হাত দিতে।’ (ওদুদ ১৯৮৩: ২৬৯)
১
হুমায়ুন কবির ও কাজী আবদুল ওদুদের কথার জওয়াব লিখিবার সময় নজরুল ইসলামের হয় নাই। জসিমউদ্দীনও সরাসরি জওয়াব লিখিয়াছিলেন কি না আমার তাহা জানিবার সুযোগ ঘটে নাই। তাঁহার অনেক লেখা—বিশেষ প্রবন্ধনিবন্ধ এখনও পত্রপত্রিকায় ছড়ানো। এই বিষয়ে জসীমউদ্দীনকে ভাগ্যবান বলিলে সত্যের অপলাপ হইতে পারে। তাঁহার পুত্র-কন্যারাও এই সম্বন্ধে সত্যকার দায়িত্বশীল বলিয়া গণ্য হইবেন না। রাষ্ট্রের দায়িত্বের কথা তুলিয়া লজ্জা পাইতে চাহি না।
পাকিস্তান আমলে কোন এক লেখায় সৈয়দ আলী আশরাফও একই নালিশের পুনরুক্তি করিলেন। ১৯৫১ নাগাদ মাটির কান্না বইটি পড়িয়া তিনিও বলিলেন জসীমউদ্দীন আর নতুন কিছু লিখিতে পারিতেছেন না। কবির বিদেশি তর্জমাকারিনী শ্রীমতি বার্বারা পেইন্টার জানাইয়াছেন জসীমউদ্দীন সেই নালিশ কবুল করেন নাই। তিনি বরং ঘৃণাভরে এই ব্যাখ্যা নাকচ করিয়াছিলেন। ( জসীমউদ্দীন ১৯৬৯: ২৬)
করাই স্বাভাবিক। তাহার কিছু প্রমাণ আমিও অন্য জায়গায় পাইতেছি। সওগাত পত্রিকায় পত্রস্থ এক লেখায় জসীমউদ্দীনের সাক্ষ্য পাওয়া যায়। তাঁহার দৃষ্টি আলাদা। জসীমউদ্দীন নিজেকে শুদ্ধ মুসলমানের কবি কিংবা গ্রামাঞ্চলের কবি পরিচয়ে আটক রাখিতে চাহেন নাই। তিনি যাহা করিতে চাহিয়াছেন তাহা ‘জনসাধারণের’ সাহিত্য।
পরাধীন যুগে যে বাংলা সাহিত্য গড়িয়া উঠিয়াছিল জসীমউদ্দীন সেই সাহিত্যের নাম দিয়াছেন ‘জমিদার ও ডেপুটি সাহিত্য’। তিনি লিখিয়াছেন, ‘এতদিন সাহিত্য ছিল দেশের বড়লোকদের হাতে। আমাদের বাঙলা-সাহিত্য এই সেদিনও জমিদার ও ডেপুটিদের হাতে ছিল।’ (জসীমউদ্দীন ২০০১খ: ৩১)
ইঁহাদের হাতে দেশের জনসাধারণের সাহিত্য গড়িয়া উঠিবার আশা করা বাতুলতা। কিন্তু তাহার পরও কথা থাকিয়া যায়। জসীমউদ্দীন তাহা আমল করিতে ভুল করেন নাই। তিনি বলিলেন, এই দেশের জনসাধারণ নিজেদের আনন্দ দিবার জন্য যে সাহিত্যের নীড়টি গড়িয়া তুলিয়াছিল, ইঁহারা ‘রুচি, নীতি এবং সমালোচনার কষাঘাতে’ তাহা ভাঙিয়া চুরমার করিয়া দিয়াছেন। এই অপরাধে ‘মহাকালের দরজায়’ ইঁহাদের জবাবদিহি করিতে হইবে।
বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস হইতে জসীমউদ্দীন কিছু সাক্ষ্যসহায় কুড়াইয়া আনিয়াছেন। স্বয়ং বাংলা ভাষার অবস্থিতিতেই প্রমাণ, এই সাহিত্য বড়লোকি সংস্কৃত সাহিত্য বর্জন করিয়াই নিজের পায়ে দাঁড়াইয়াছিল।
জসীমউদ্দীনের কথার সারমর্ম গ্রহণ করিলে এই দাঁড়াইতেছে। বাংলা সাহিত্য একদিন বিরাট সংস্কৃত সাহিত্যের সামনে মাথা তুলিয়া দাঁড়াইয়াছিল। সেই কারণেই সেইদিন জয়যুক্ত হইয়াছিল জনসাধারণের রসপিপাসা। আমরা এখন যে পদার্থকে কখনও ‘জাতীয় সাহিত্য’ বলিয়া শ্লাঘা অনুভব করিতেছি তাহাই জসীমউদ্দীনের বুলিতে শুনাইত ‘জনসাধারণের সাহিত্য’।
তিনি লিখিয়াছেন, আমাদের দেশে ইংরেজের দখল কায়েম হইবার আগে পর্যন্ত বাংলা সাহিত্য বলিতে আমরা ‘জনসাধারণের সাহিত্য’ বুঝিতাম। তিনি অবশ্য একথা কবুলও করিয়াছেন সংস্কৃত সাহিত্য হইতে কোন কোন কবি মণিমাণিক্য আহরণ করিয়াছিলেন, ‘কিন্তু মোটামুটি বাংলা সাহিত্য ছিল জনসাধারণের সাহিত্য।’ বাংলার মনসামঙ্গল, কবিকঙ্কণ চণ্ডী, অগণিত বৈষ্ণব কবিতা—এইগুলিকে জসীমউদ্দীন ‘গণ-সাহিত্যের পর্যায়ে’ ফেলিয়াছিলেন। (জসীমউদ্দীন ২০০১খ: ৩২)
তিনি দেখাইয়াছেন চৈতন্যের আন্দোলন আমাদের কোন ক্ষতি করে নাই। তাঁহারাও জনসাধারণের জন্য সাহিত্য রচনা করিয়াছিলেন। ‘কারণ, চৈতন্যের ধর্ম ছিল জনসাধারণের জন্য।’ কবিকঙ্কণ চণ্ডীর ‘দুর্গার কাঁচলী’ নির্মাণের সঙ্গে গাজীর গানের ‘শাড়ির বর্ণনা’, মনসামঙ্গলের বাইশ কাহন নৌকার বর্ণনার সঙ্গে গ্রাম্যগানের চৌদ্দ ডিঙ্গা মধুকোষের বর্ণনার তুলনা করিবার প্রস্তাবও তিনি পেশ করিয়াছেন। বংশীদাস, লোচনদাস, বলরামদাস, চণ্ডীদাস ও জ্ঞানদাসের পদাবলীর সহিত গ্রাম্যগানের যোগ তিনি আবিষ্কার করিয়াছেন।
হুমায়ুন কবিরের সহিত জসীমউদ্দীনের পার্থক্যের গোড়া আমরা এই জায়গাতেই দেখিতে পাইতেছি। হুমায়ুন কবির লিখিয়াছিলেন, বাংলার জীর্ণ পুরাতন সামন্ততন্ত্রের বোঁটা আলগা হইয়া আসিয়াছিল। এয়ুরোপের পহিলা ধাক্কা লাগিতেই তাহা পাকা ফলের মতন খসিয়া পড়িল। এয়ুরোপের বাড়ন্ত ধনতন্ত্র সেদিন বিপ্লবী শক্তি হিসাবেই বাংলায় আসিয়াছিল। আনিয়াছিল নতুন অর্থনৈতিক সংগঠনের সম্ভাবনা ও নতুন জগতের ভাবধারা। তাহার ফলে বাংলার কাব্যধারার বিপ্লবী রূপান্তর হইল। শুরু হইল বাংলার কাব্যের নবযুগ। তাঁহার উচ্ছ্বাসের সঙ্গে অনেকেই গা ভাসাইয়া দিবেন—বলিবেন এয়ুরোপের ছোঁয়ায় বাংলা কাব্যের পরিণতি হইয়াছে বিস্ময়কর। আজ বাংলার কাব্যসাহিত্য পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সাহিত্যের পর্যায়ে আসিয়া পৌঁছিয়াছে। (কবির ২০০২: ৩৩-৩৪)
২
জসীমউদ্দীনের দেখা একেবারেই আলাদা জায়গা হইতে। তিনি বলিলেন, ইংরেজ জাতির আগমনের পরে এয়ুরোপের ‘তীব্র মদিরা’ পান করিয়া আমরা ধীরে ধীরে সব খোয়াইলাম। খাঁটি এয়ুরোপের ভাবে বিভোর হইয়া সংস্কৃত অলংকার ও শব্দশাস্ত্রের পানপাত্র ভরিয়া মাইকেল যে কাব্যরস আমাদের পরিবেশন করিলেন তাঁহার সঙ্গে সঙ্গেই তাহা নিঃশেষ হইয়া গেল।
মাইকেল—জসীমউদ্দীন বলিতেছেন—অবশ্য বাংলা ভাষায় তাঁহার অসামান্য প্রতিভার জন্য বাঁচিয়া থাকিবেন। কিন্তু কাব্যের যে নতুন নাট্যমঞ্চ তিনি খুলিয়াছিলেন, যেখানে হেমচন্দ্র, নবীনচন্দ্র প্রভৃতি দিকপাল আসর জমাইতে প্রয়াস পাইয়াছিলেন, তাহা অল্পদিনেই ভাঙ্গিয়া গেল। জসীমউদ্দীনের মতে, মাইকেলের কাব্যধারাটি যে বাংলাদেশে টিকিল না, তাহার কারণ বাংলার মাটির সঙ্গে তাঁহার কাব্যের ধারা শিকড় গাড়িতে পারে নাই।
গল্প বুনিবার যে ধারাটি মধুসূদন, হেমচন্দ্র ও নবীনচন্দ্র গ্রহণ করিলেন—জসীমউদ্দীন বলিতেছেন—তাহার সহিত বাংলার মাটির যোগ ছিল না। সেইজন্য বাংলার মাটিতে তাঁহারা শিকড় গাড়িতে পারেন নাই। গল্প বুননের যে ধারাটি চণ্ডীমঙ্গল, মনসামঙ্গল, রামায়ণ প্রভৃতি কাব্যে চলিতেছিল মধু হেম নবীনের ধারা তাহার সহিত কোন যোগ রাখে নাই।
এখন কি কর্তব্য? মনসামঙ্গলের, চণ্ডীমঙ্গলের বুননির উপর যদি কোন কবি মিল্টন ও হোমারের কাব্যধারার সংযোগ স্থাপন করিতে পারেন, তবেই তিনি বাংলায় অমর হইয়া থাকিবেন। জসীমউদ্দীন বলিলেন এ পদার্থ হয়তো অসম্ভব ঠেকিতে পারে। কিন্তু সাহিত্যের ইতিহাস তো ‘অসম্ভবকে সম্ভব করা’রই অপর নাম। এই জায়গায় জসীমউদ্দীন খোদ মধুসূদনকেই সাক্ষী মানিলেন। কে জানিত বাংলা পয়ারের পুরাতন পানপাত্রের মধ্যে ব্ল্যাংক ভার্স তথা খোয়া পদ্যের গতিবৈচিত্র্য ভরা যাইতে পারে?
ইংরেজ এদেশে আসিয়া আমাদের মধ্যে হিন্দু মধ্যবিত্ত সম্প্রদায় সৃষ্টি করিলেন। কারণ সহজ। তাঁহাদের মধ্যেই ইংরেজ জাতি নিজেদের সমর্থক খুঁজিয়া পাইলেন। নতুন যে মধ্যবিত্ত হিন্দু দলটি নতুন শহরে আসিয়া আস্তানা তুলিলেন তাহাতে শহরের কোন বনিয়াদ ছিল না। তাহাতে ইংরেজের নগরে এয়ুরোপের পানপাত্র তাঁহারা পরিপূর্ণ মনে গ্রহণ করিলেন। শুদ্ধ কি তাহাই? নিজের দেশের গ্রাম্য জীবনের প্রাচীন ভাবধারার বনিয়াদও লাথি মারিয়া দূরে ছুঁড়িয়া ফেলিলেন তাঁহারা।
জসীমউদ্দীন সালিশ করিলেন। বলিলেন, বাংলা সাহিত্যের উৎসাহ দিবার ভার যতদিন মুসলমান রাজাদের হাতে ছিল, ততদিন তাহা জনসাধারণের সাহিত্য ছিল। ‘কারণ, আমাদের ধর্ম’, জসীমউদ্দীন বলিতেছেন, ‘জনসাধারণকে নিয়ে’। ইংরেজ আসিবার পরে বাংলাদেশ হইতে মুসলমানের প্রভাব নষ্ট হইয়া গেল। বাংলা সাহিত্য মুষ্টিমেয় কয়েকজন ভদ্রলোকের সাহিত্য হইয়া দাঁড়াইল। (জসীমউদ্দীন ২০০১খ: ৩৩-৩৪)
এদিকে হুমায়ুন কবিরের রায় ইহার ষোল আনাই বিপরীত। বাংলার ইতিহাস তিনি অন্য জায়গা হইতে পড়িয়াছেন। তাঁহার বিচারে নবাবী আমলে ফারসি সাহিত্যের প্রভাব বাংলাকে নানাভাবে আচ্ছন্ন করিয়াছে কিন্তু সে প্রভাব ছিল ভারতের আর দশ ভাষার উপরেও সমান কার্যকর। তাঁহার যুক্তি অনুসারে, অন্যান্য দেশজ ভাষার তুলনায় বিকাশের বিচারে বাংলার কাব্য সর্বশ্রেষ্ঠ। আর কোন ভারতীয় ভাষাতেই সাহিত্য সাধনা বোধ হয় এতখানি সিদ্ধিলাভ করে নাই। কিন্তু তিনি দাবি করিতেছেন ফারসির এই সর্বভারতীয় প্রভাবের ফলে ভারতের অন্যান্য ভাষার কাব্যের তুলনায় বাংলার কাব্যে কোন মূলগত পার্থক্য দেখা দেয় নাই। কবিরের ভাষায়, ‘সেদিনকার বাংলা কাব্যের উৎকর্ষ তাই গুণে এবং পরিমাণে—স্বভাবে নয়।’
কবির সিদ্ধান্ত করিয়াছেন উনিশ শতকের মাঝামাঝি হইতে বাংলার কাব্য বিকাশের যে নতুন ধারা শুরু হইল, তাহা আগাগোড়াই নতুন। ভারতের আর দশ ভাষা হইতে শুদ্ধ গুণে বা পরিমাণে নয়, গোত্রেও আলাদা হইয়া গেল বাংলার কাব্য। এই ঘটনার নাম তিনি রাখিয়াছেন বাংলার কাব্যের ‘বিস্ময়কর পরিণতি’। (কবির ২০০২: ৩৪)
৩
জসীমউদ্দীন স্বভাবতই এই বিচারের সহিত একাত্ম হইবেন না। তিনি মনে করেন বাংলার নতুন কবিতার মধ্যেও দেশের ধারা কতক মিলিয়াছে। আর ইহাই রবীন্দ্রনাথকে মধুসূদন হইতে আলাদা করিবার কারণ। বাঙালি রবীন্দ্রনাথকে কতক গ্রহণ করিয়াছে, কারণ তাঁহার কবিতায় রহিয়াছে চারিশক্তির সমাহার—সংস্কৃত, বৈষ্ণব, বাংলার জাতীয় বা লোকজ এবং এয়ুরোপীয়। জসীমউদ্দীনের কথায়, ‘বিহারীলালের লিরিকের ধারাটি’ রবীন্দ্রনাথে আসিয়া টিকিয়া রহিল। (জসীমউদ্দীন ২০০১খ: ৩৩)
হুমায়ুন কবির ও কাজী আবদুল ওদুদের মতন অনেক মনীষী দাবি করিয়াছেন ‘পুরাতন ঐতিহ্যের পুনরুজ্জীবন’ ছাড়া নজরুল ইসলাম ও জসীমউদ্দীন আর কিছুই করেন নাই। জসীমউদ্দীন বলিলেন কথাটি পুরাপুরি সত্য নয়। নজরুল ইসলাম তাঁহার রচনায় আরবি, পারসি বহু শব্দ প্রয়োগ করিয়াছেন একথা অসত্য নয়। কিন্তু একটা পার্থক্যের কথাও এখানে মনে রাখিতে হইবে। তিনি বাংলা সাহিত্যকে হিন্দু ও মুসলমান ভাগে ভাগ করিবার চেষ্টা করেন নাই।
জসীমউদ্দীন লিখিয়াছেন, নজরুল ইসলাম পুঁথি সাহিত্যের মানসপুত্র নহেন। তিনি তাঁহার অনেক লেখায় বরং পুঁথি সাহিত্যকে অবহেলা আর বিদ্রূপই করিয়াছেন। জসীমউদ্দীন কহিতেছেন, ‘তিনি যে কোনদিন শ্রদ্ধার সঙ্গে এই পুঁথি সাহিত্য উপভোগ করিয়াছিলেন তাহারও প্রমাণ পাওয়া যায় না।’ তাঁহার রচনা হইতে খানিক তুলিয়া লইতেছি:
‘পুঁথি সাহিত্যের লেখকরা আরবী, পারসী শব্দের ধ্বনিতরঙ্গ না বুঝিয়াই এবড়োথেবড়োভাবে যেখানে ভাব প্রকাশের উপযুক্ত বাঙলা শব্দ খুঁজিয়া পান নাই সেখানে ইচ্ছামত আরবী পারসী শব্দ ব্যবহার করিয়াছেন। নজরুল আরবী, পারসী শব্দের ধ্বনিতরঙ্গ বুঝিয়া কোন [কোন] রচনার মধ্যে মুসলমানী আবহাওয়া ফুটাইয়া তুলিতে এইসব শব্দ ব্যবহার করিয়াছেন।’ (জসীমউদ্দীন ২০০১ক: ১০২-৩)
আমাকে লেখা এখানেই শেষ করিতে হইতেছে। শুদ্ধ একটি কথা যোগ করিয়া শেষ করিব। জসীমউদ্দীন নজরুল ইসলামকে ভর করিয়া পরোক্ষে নিজের সাফাইও গাহিয়াছেন। গাহিয়া মোটেও অন্যায় করেন নাই। তাঁহার নালিশের জবাব হুমায়ুন কবির কেন, কেহই দিতে পারিবে না। বাংলা ১৩৫০ সালে জসীমউদ্দীন লিখিয়াছিলেন, বাংলা সাহিত্য শুদ্ধমাত্র দেশের মধ্যবিত্ত সমাজের পকেটেই আবদ্ধ রহিল। দেশের জনসাধারণ আর ইহার অন্দর মহলে প্রবেশ করিতে পারিল না। আবদুল কাদিরকে লেখা পত্রের এক জায়গায় এই দুঃখই বিশদ করিতেছেন তিনি। আমি সাধু ভাষায় তাঁহার তর্জমা লিখিলাম:
‘আজ যত করিয়াই আমরা বঙ্কিমচন্দ্র, হেমচন্দ্র, নবীনচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্রের জন্য গৌরব বোধ করি না কেন, একথা ভাবিতে সত্যই বড় কষ্ট। আজ বঙ্গভাষার বংশীধ্বনিতে যমুনা উজান বহে না, শ্যামলী ধবলী গৃহে চলে না। বাংলার নবেল উপন্যাস শুধু কলিকাতাবাসী কয়েকজন মধ্যবিত্ত লোকের কথায় ভরা। দেশের জনসাধারণ তাহার ভিতরে নিজেদের খুঁজিয়া পায় না।’ (জসীমউদ্দীন ২০০১ক: ৩৪)
জসীমউদ্দীনের সিদ্ধান্ত আজ এই অভাজন আমাকেও নতুন করিয়া ভাবাইতেছে। কারণ আমি তাঁহার বাজে লিখিতেছি। তিনি বলিতেন, সাহিত্য যেমন বিশ্বের তেমনি তাহা ঘরেরও। বিশ্বসাহিত্যই বল আর সাম্প্রদায়িক সাহিত্যই বল, সব সাহিত্যই তৈরি হয় ঘরের প্রদীপ জ্বালাইবার জন্য। যে সাহিত্য ঘরে প্রদীপ জ্বালাইল না, সে সাহিত্য বিশ্বেও আলোকপাত করিতে পারিবে না। দেশের জনসাধারণের জন্যই এ সাহিত্য তৈরি হয়।
দোহাই
১. কাজী আবদুল ওদুদ, শাশ্বত বঙ্গ, ২য় মুদ্রণ (ঢাকা: ব্র্যাক প্রকাশনা, ১৯৮৩)।
২. জসীমউদ্দীন, জসীমউদ্দীনের প্রবন্ধসমূহ, ১ম খণ্ড, ২য় মুদ্রণ (ঢাকা: পলাশ প্রকাশনী, ২০০১ক)।
৩. জসীমউদ্দীন, জসীমউদ্দীনের প্রবন্ধসমূহ, ২য় খণ্ড, ১ম প্রকাশ (ঢাকা: পলাশ প্রকাশনী, ২০০১খ) ।
৪. হুমায়ুন কবির, বাঙলার কাব্য, ২য় সংস্করণ, পুনর্মুদ্রণ (ঢাকা: বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র, ২০০২)।
৫. সুনীল কুমার মুখোপাধ্যায়, জসীমউদ্দীন: কবি মানস ও কাব্য সাধনা, ২য় মুদ্রণ (ঢাকা: বাংলা একাডেমী, ২০০৪)।
৬. Jasim Uddin, Gipsy Wharf (Sojan Badiar Ghat), B. Painter and Y. Lovelock, trans. (London: George Allen and Unwin, 1969).
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, মার্চ ১৮, ২০১১
Leave a Reply