অনুবাদ: মশিউল আলম
ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হওয়ার ঠিক আগের মুহূর্তগুলোতে একজন স্বৈরশাসকের মনের অবস্থা কেমন হয়? তাঁর প্রিয় জনগণ যখন তাঁরই রক্ত নেওয়ার জন্য উন্মত্ত হয়ে গর্জে ওঠে, যখন তাঁর ছবিগুলো দুমড়েমুচড়ে পদদলিত করতে থাকে, সেই অকল্পনীয় দৃশ্যগুলো তিনি কীভাবে হজম করেন?
এটি একটি চমৎকার বিষয়; আমি যদি একজন উদ্দীপনাময় যুবক লেখক হতাম, তা হলে এক স্বগতকথনের মধ্য দিয়ে তা প্রকাশ করার চেষ্টা করতাম। স্থান, কাল, অতীতের গৌরব, বিজয়োল্লাসে সরব কুচকাওয়াজ, জনগণের উদ্দেশে ছুড়ে দেওয়া আমার ক্ষমতা, মদে মাতাল চুম্বন—এ সবকিছু মিশিয়ে রচনা করতাম সেই স্বগতকথন।
এই ভাবনা আমাকে প্রলুব্ধ করেছিল চসেস্কুর পতন ও হত্যার সময়। এবং আবার তা প্রলুব্ধ করল উত্তর আফ্রিকায় শৃঙ্খলমুক্তির তুফানের এই মুহূর্তে। উপন্যাসের আকারে নয়, বরং চলমান ঘটনাবলির ঘূর্ণি-তাণ্ডবের পটভূমিতে নির্মিত এক আধা প্রামাণ্য চলচ্চিত্রের মতো করে। আত্মপ্রসাদে সুখী বেন আলীর চেহারাটি শেষ মুহূর্তে ক্যামেরার সামনে এসে আকস্মিকভাবে মুখব্যাদান করা উৎপীড়কের চেহারা পাওয়া, অথবা জৌলুসে পরিপূর্ণ হিতৈষী ফেরাউন থেকে অথর্ব বৃদ্ধে রূপান্তরিত হোসনি মোবারককে অনিরাপদ নির্বাসনের দিকে যাত্রার সময় বিমানে উঠতে বাহু ধরে সাহায্য করার দৃশ্য—এই সবকিছুই চমৎকার দৃশ্যময় শিল্পসৃষ্টির উন্মুক্ত আমন্ত্রণ, যা সাহিত্যে রূপান্তরিত হতে পারে এক সুস্পষ্ট রদবদলের খেলার দ্বারা: সার্বভৌম বস্তিকোটরের আরামদায়ক উপবেশনের জন্য নির্মিত মূল্যবান ধাতু-প্রলেপিত কারুকার্যময় চেয়ার আর তার বিপরীতে ওই সব মানুষের শোচনীয়, বসবাসের অযোগ্য জীর্ণ কুটির, যারা তাদের নেতাকে দৃশ্যত ভালোবাসত। নেকটাই-বাঁধা আর সব সময়ের মতো নিখুঁতভাবে পরা জ্বলজ্বলে টুপি মাথায় বেন আলীর মমিতে রূপান্তরিত মুখে স্থির হাসি, কিন্তু ঠিক কাকে লক্ষ্য করে সেই হাসি তা বোঝা যাচ্ছে না; তার ঠিক পরই হাসপাতালের বিছানায় মুমূর্ষু মোহামেদ বুআজিজের বিগ ক্লোজআপ—এ সবই একজন শিল্পীর জন্য অসীম সম্ভাবনা নিয়ে হাজির হয়েছে।
কিন্তু সব থেকে বড় হলো, ৪২ বছর আগে লিবিয়ায় রাজতন্ত্র উৎখাত করেছিলেন যে লিবীয় তরুণ কর্নেল, তাঁর রূপান্তর; ভুতুড়ে এক মুখোশে রূপান্তর ঘটেছে তাঁর, যে মুখোশ তার অনুগতদের লেলিয়ে দিয়েছে ‘ইঁদুরগুলোকে’ তাদের গর্তের মধ্যেই সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করতে, ক্রোধে উন্মত্ত হয়ে যে মুখোশ তার মুঠো ঝাঁকাচ্ছে—এই দৃশ্য থেকে রচিত হতে পারে দারুণ এক সলিলকি বা স্বগতকথন, এক স্বৈরশাসকের বিশ্বনেতায় উন্নীত হওয়ার স্মৃতিকথায় ভরপুর স্বগতকথন, বিশ্বরাজনীতির রঙ্গমঞ্চে যার তেলপিপাসু সহযোগীরা তাকে বরণ করে নিয়েছিল হাসিমুখে আলিঙ্গনে জড়িয়ে, যেন তা ঘটেছিল আফ্রিকার রাজা হওয়ার দিবাস্বপ্নের মধ্যে: তার বিরুদ্ধচারীরা ডজনে ডজনে ঝুলছে ফাঁসিকাষ্ঠে, বন্দী হয়েছে বেনগাজির প্রাসাদের অন্ধকার ভূতলের কারাপ্রকোষ্ঠগুলোতে এবং একটি ডেমোক্র্যাটিক পিপলস রিপাবলিক পরিণত হয়, তার নিজের ও তার পুত্রদের ব্যক্তিগত সম্পত্তিতে। লিবিয়ার স্বঘোষিত পিতার মাথায় ভিড় করে আসা এসব স্মৃতির বাহন হবে, স্বচ্ছ বর্ণনাভঙ্গি আর রূপান্তরধর্মী ব্যাকরণ: তার আতঙ্ক ম্যাকবেথসম ডাইনিদের মতো, তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের ভয়, ইউরোপের দেশগুলোর বিভিন্ন রাজধানীর প্রাসাদ-চত্বরে স্থাপিত তার বেদুইন তাঁবু, তার নির্যাতনকক্ষগুলো, বুলগেরীয় নার্সদের বিভীষিকাময় নির্যাতন। এই আখ্যান রচনা করা বিরাট এক চ্যালেঞ্জ বটে কিন্তু আমি আশা করি, আরব লেখকদের কেউ কেউ এই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করবেন।
আর আমরা যখন তাঁর শেষ পরিণতি (সম্ভবত রক্তাক্ত) কী হয় তা দেখার জন্য অপেক্ষা করছি, তখন আমাদের সন্তুষ্ট থাকতে হবে সোপ অপেরাগুলোতেই (আরব টিভিতে সেগুলো ভীষণ জনপ্রিয়)। কেশ পরিচর্যাকারী থেকে তিউনিসিয়ার রানি বনে গেছেন—এই ভূমিকায় অভিনয় করবেন কে? আলুথালু চুলে, পয়মাল মেকআপ নিয়ে তিনি কি ব্যাংকে হাজির হবেন তাঁর সব টাকা তুলে নেওয়ার জন্য? সেই তরুণী আর তাঁর বৃদ্ধ, ক্ষমতাহীন, অথর্ব স্বামীর মধ্যে এখন কি পাল্টাপাল্টি অভিযোগের ঝড় উঠবে? ত্রাবেলসি গোত্রের ওই গুন্ডাদের চরিত্রে এখন অভিনয় করবেন কোন অভিনেতারা? আমরা কি দেখতে পাব যে লজ্জাজনকভাবে পালিয়ে যাওয়ার মুহূর্তে তাঁরা নিজেদের আঙুল কামড়াচ্ছে?
তারপর কল্পনা করুন, আগামী রমজানে কী নাটক মঞ্চস্থ হতে পারে মিসরে। ক্ষমতাহারা, কম্পমান স্বামীকে লক্ষ্য করে তারস্বরে চেঁচাচ্ছেন মোবারকপত্নী; চৌর্যবৃত্তির জন্য মা ও ভাইকে গালাগাল করছে অপেক্ষাকৃত ভালো (কম লোভী) পুত্রটি; বিশ্বস্ত অনুগতরা শেষ মুহূর্তে ল্যাজ গুটিয়ে নিয়েছে; আর কল্পনা করুন সেই লোকটির অবিশ্বাসভরা চেহারাখানি, যে ভেবেছিল সে আজীবন রাজাই থেকে যাবে; কিন্তু তার জীবনের সমস্ত কর্ম পয়মাল, কেড়ে নেওয়া হয়েছে তার সব সম্পদ।
কিন্তু এসব সোপ অপেরা যথেষ্ট নয়। এত বিশাল বিপুল ঘটনাবলি যথার্থই কাজে লাগাতে পারবেন, এমন একজন লেখকের আবির্ভাব অবশ্যই ঘটবে একদিন।
হুয়ান গোইতিসোলো
(জন্ম: ৬ জানুয়ারি ১৯৩১, স্পেনের বার্সিলোনায়)
একাধারে কবি, প্রাবন্ধিক ঔপন্যাসিক। বর্তমানে স্বেচ্ছা নির্বাসনে আছেন মরক্কোয়। আইন পাঠ শেষ করে গোইতিসোলো তাঁর প্রথম উপন্যাস দি ইয়ং অ্যাসাসিন রচনা করেন। বন্ধু কার্লোস ফুয়েন্তেস মনে করেন গোইতিসোলো জেমস জয়েস ও জোনাথন সুইফটের মতোই শক্তিশালী লেখক। নোবেল বিজয়ী লেখক মারিও বার্গাস য়োসার মতে তাঁর তুলনা চলে গার্সিয়া মার্কেস আর হুলিও কোর্তাসারের সঙ্গে। ইসলামি সংস্কৃতির প্রতি দারুণ অনুরক্ত গোইতিসোলোর আছে একাধিক ভাষায় দক্ষতা: মাগরেবি, কাস্তালিয়ান, কাতালান, ফরাসি ও তুর্কি। পেয়েছেন স্প্যানিশভাষী সাহিত্যজগতের প্রায় সব পুরস্কার। তাঁর সর্বশেষ উপন্যাস এ ককআইড কমেডি।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, মার্চ ১৮, ২০১১
Leave a Reply