পুলিৎজার-বিজয়ী ঔপন্যাসিক ঝুম্পা লাহিড়ির এই সাক্ষাৎকারটি প্রকাশিত হয় দি আটলান্টিক পত্রিকায়। আইজাক চটিনারের নেওয়া সাক্ষাৎকারটি ভাষান্তর করেছেন পবন চক্রবর্তী
প্রশ্ন: আপনার প্রথম বইটা ছিল একটা ছোটগল্পের সংকলন, ইন্টারপ্রেটার অব ম্যালাডিস। বইটা পুলিৎজার পুরস্কার পেয়েছিল। ঠিক পরের বইটা উপন্যাস, দ্য নেমসেক। এরপর আপনি আবার গল্পের বই করলেন। ছোটগল্পে ফিরে এলেন কেন?
ঝুম্পা লাহিড়ি: না, খুব প্ল্যান করে ছোটগল্প লিখিনি। দ্য নেমসেক লিখে ফেলার পর পুরোনো কিছু গল্পের আইডিয়া আমাকে ভারি খোঁচাচ্ছিল। সেসব লিখতে শুরু করে দিলাম। একসময় গল্পের মধ্যে ডুবে গেলাম। এর মধ্যে কয়েকটা গল্প নিয়ে আমি দীর্ঘদিন ধরে ভাবছি। আমি নতুন কিছু খুঁজে মরছিলাম—এ রকম না।
প্রশ্ন: একটি ছোটগল্প যেভাবে লেখা হয়, উপন্যাসও কি সেভাবেই লেখা হয়? আপনি এই দুই মাধ্যমে কাজ করতে গেলে কি আলাদা আলাদা পথে এগোন?
ঝুম্পা লাহিড়ি: না, আমি এই দুটি ধরনের মধ্যে খুব বেশি ফারাক করতে পারি না। এখানে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো আইডিয়া। দ্য নেমসেক-এর কথা যখন আমার মাথায় এল, আমার মনে হলো, এটা উপন্যাস; গল্পে এই আইডিয়া দাঁড়াবে না। আইডিয়াটাই ঠিক করে দেয়—গল্প হবে, না উপন্যাস।
প্রশ্ন: আপনার লেখালেখির একটি কেন্দ্রীয় বিষয় হলো নির্বাসন। অভিবাসী মানুষের ঠিক কোন দিকটি আপনাকে কৌতূহলী করে?
ঝুম্পা লাহিড়ি: এ রকম চরিত্র ভাবতেই আমি ভালোবাসি, যারা এক রকম স্থান বা অবস্থান ছেড়ে অন্যত্র চলে গেছে। আমার প্রথম গল্পগ্রন্থের চরিত্রগুলোর সবাই কমবেশি একই কারণে হিজরত করছিল (একই কারণে আমার বাবা-মাও যুক্তরাষ্ট্রে এসেছিলেন) চাকরি বা ভাগ্যের অন্বেষণে।
আনঅ্যাকাসটমড আর্থ-এ আমার মনোযোগ ছিল তাদের ওপর, যারা কেউ নিজেরা অভিবাসী নয়, অভিবাসীদের সন্তান। এটা আমার কাছে অসাধারণ মনে হয়েছিল। যখন কেউ অভিবাসীর সন্তান হিসেবে বেড়ে ওঠে, সে সব সময় তখন শিকড়চ্যুত হওয়ার মানে কি, সে বিষয়ে খুব হুঁশিয়ার থাকে; অন্তত আমি তা-ই ছিলাম।
প্রশ্ন: আপনার আগের গল্পগুলোতে একটা জিনিস আমাকে মুগ্ধ করেছে। আপনি যেভাবে আপনার বাবার আমলের বিয়েশাদিগুলো দেখেন, সেই ব্যাপারটা দুর্দান্ত। বিষয়টা আপনাকে বোধহয় খুব টানে?
ঝুম্পা লাহিড়ি: আমি ঠিক বলতে পারব না, কেন এটা হয়েছে। কিন্তু আমার বয়স যত বাড়ছিল, আমি তত বেশি বাবা-মায়ের বিয়ের ব্যাপারে আগ্রহী হয়ে উঠছিলাম। আর যখন আপনি নিজেই বিয়ে করেন, তখন এটা আরও বেশি আকর্ষণীয় হয়ে দাঁড়ায়; একটা তুলনা তখন অবধারিতভাবে মনে উঠবেই।
প্রশ্ন: আপনার ‘এ চয়েজ অব অ্যাকমডেশন’ গল্পটি পরিষ্কারভাবেই একটা বিয়ের গল্প। আপনি চরিত্র দুটিকে নিভৃত সময় কাটাতে দিলেন, তারা প্রচুর কথাবার্তা বলল, সেক্স করল। অথচ আগের প্রজন্মের বিয়ের গল্প যখন আপনি বলেছেন, তখন মনে হয়েছে, আপনি বাইরে থেকে বিয়েটাকে দেখছেন।
ঝুম্পা লাহিড়ি: হ্যাঁ, ওই প্রজন্মের ক্ষেত্রে আমি তো একজন বহিরাগতই। কিন্তু এই গল্পে যে জুটির বিয়ের কথা হচ্ছে, সেখানে তো আমি অনায়াসে নিজেকে বসিয়ে নিয়ে ভাবতে পারি। ব্যাপারটা যদিও কল্পিত, তবু তো আমি ভাবতে পারি যে ওই মেয়েটির সঙ্গে আমার বিয়ে হচ্ছে। আমি তার গতিবিধি বা রসায়ন বুঝতে পারি।
প্রশ্ন: পুরোনো লেখকদের মধ্যে কাদের লেখা বারবার পড়তে ভালো লাগে?
ঝুম্পা লাহিড়ি: ইদানিং উনিশ শতকের অনেকগুলো উপন্যাস আমি খুব মনোযোগ দিয়ে পড়ছি। চেখভ আর তলস্তয় এই দুজনকে আমার সব সময় ভালো লাগত। এঁদের সঙ্গে পরে যুক্ত হয়েছেন হার্ডি। তিনি সেইসব ঔপন্যাসিকের একজন, যাঁদের লেখা যেকোনো সময় আমি পড়তে ভালোবাসি। এসব উপন্যাস পড়ে আমি কখনো ক্লান্তি বোধ করব না। যখন এসব বই পড়ি, মনে হয়, আমি একটি সমৃদ্ধ, তৃপ্তিকর, পূর্ণাঙ্গ কিছুর মধ্যে ঢুকে পড়েছি। জীবনের নাটকীয়তা ও চারপাশের দুনিয়ার মধ্যে এখানে একটা সুন্দর সাম্য আছে। বয়স যত বাড়ছে, তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এ দিকটায় আমার টান বাড়ছে: মাটির সঙ্গে সম্পর্ক এবং এখানকার প্রবল নাড়ির টান। আমার পড়া বইগুলো থেকে অনেক কিছু ধার করেছি আমি।
প্রশ্ন: সমকালীন লেখকদের ব্যাপারে আপনি কী ভাবেন?
ঝুম্পা লাহিড়ি: আমি প্রায় নেশাগ্রস্তের মতো পড়ি উইলিয়ম ট্রেভর, এলিস মুনরো, মাভিস গ্যালান্ট।
প্রশ্ন: আপনার প্রথম বইটির আলোচনা করতে গিয়ে একজন ক্রিটিক বলেছেন, আপনার গদ্য চূড়ান্ত অর্থেই আত্মসচেতন নয়, দেখানোপনা একদম নেই। আপনার কি মনে হয়—তিনি ঠিক বলেছেন?
ঝুম্পা লাহিড়ি: আমি সহজ থাকতে ভালোবাসি। আমার কাছে এর আবেদন খুব বেশি। আমি কখনো শুধু ফর্মের ন্যাওটা ছিলাম না। আমার স্বামীর সঙ্গে ফার্নিচার কিনতে গেলে এই একটা তর্ক নিয়মিত হয়। সে সুন্দর, বেদস্তুর চেয়ার খোঁজে; আর তেমন চেয়ার আমি মোটেই পছন্দ করি না, যাতে বসতে আরাম নেই। আপনি যদি নবোকভ পড়েন, যাঁকে খুব পছন্দ আমার, দেখবেন, তাঁর ভাষাটা সুন্দর। কিন্তু এই ভাষাটাই নিখুঁতভাবে গল্পটাকে গড়েপিঠে দেয়, গল্পের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য হয়ে যায় ভাষা। এখনো আমি যদি লিখতে বসি, ভাষাটাকে আরও নিরাভরণ করতে চাই।
প্রশ্ন: বিরাট কোনো দৃশ্যপট নিয়ে ঢাউস উপন্যাস লেখার কোনো সংকল্প আছে আপনার?
ঝুম্পা লাহিড়ি: আমার মনে হয়, না। আমি খুব উচ্ছ্বসিত লেখক নই। আমার লেখা বিস্তৃত হতে চায় না, বরং ঘন হতে চায়। আমি যদি আরও উপন্যাস লিখি, তবে সেগুলো হবে আরও গতিময়, আরও নিবদ্ধ।
প্রশ্ন: সমকালীন ঔপন্যাসিকদের অনেকেই, যেমন জেডি স্মিথ বা মার্টিন অ্যামিস এখন ক্রিটিসিজম লিখছেন। এ দিকটায় আপনি কখনো আগ্রহী হয়েছেন?
ঝুম্পা লাহিড়ি: তেমন না; বিচার করাটা আমার ধাতে নেই। তাই বলে বিচার করাটা আমার কাছে লঘু কিছু নয়। শিল্প-সাহিত্য-সংগীতে সমালোচনা খুবই মূল্যবান ব্যাপার। বই লেখার আগে আমি কিছু রিভিউ লিখেছি। মুফতে বই পাওয়া যেত, একটু-আধটু লিখতাম। কিন্তু নিজের বই শুরু করার পর ব্যাপারটা বদলে গেল। আপনাকে সত্যি বলছি, আমি সমকালীন সাহিত্য থেকে যথাসম্ভব নিজেকে সরিয়ে রাখতে চেয়েছি। আমার মনে হয়েছে, নিজের লেখালেখির জন্য এই বন্দোবস্তই সব থেকে ভালো।
প্রশ্ন: আপনার নিজের বইয়ের রিভিউ বের হলে পড়েন?
ঝুম্পা লাহিড়ি: না, এই বইটা নিয়ে লেখা একটি রিভিউও আমি পড়ে দেখিনি। প্রথম বইটা যখন বেরোল, তখন অবশ্য সব রিভিউ পড়েছি। অনেকটা প্রথম সন্তানের মতো, আপনি তার লাখ লাখ ছবি তুলছেন, যেন প্রতিটি মুহূর্তই বিশিষ্ট। দ্য নেমসেক-এর সময় এই আগ্রহে চূড়ান্ত ভাটা পড়ে গেল।
প্রশ্ন: তাহলে দ্য নিউইয়র্ক টাইমস যখন ভোরে আপনার বাড়িতে আসে, আপনি একটু ফিরেও তাকান না, কোনো রিভিউ হলো কি না?
ঝুম্পা লাহিড়ি: (হাসি) আসলে শনিবার সকালে পত্রিকা দেখে আমার স্বামী। সে আগে থেকেই বুক রিভিউ অংশটা কেটে রেখে দেয়, আমি যাতে না দেখি। কিছু দিন ধরে আমার জন্য সে এটা করছে। অনেক মহৎ সাহিত্যিক আছেন, আমি কেন লিখছি—এ রকম মনোভাব খুব দ্রুত আমার মধ্যে গড়ে উঠতে পারে। যত দেখব নানা রকম বই আসছে, ততই আমি একটি ভীতিকর অবস্থার মধ্যে পড়ে যাব। এটা আমি ভালোই বুঝি। তাই পত্রিকা না দেখলে আমার নিজেকে নিরাপদ লাগে।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, মার্চ ১৮, ২০১১
Leave a Reply