শিল্পী নাজিয়া আন্দালিব প্রিমার শিল্পমাধ্যম বর্তমানে ভিডিও আর্ট। তাঁর একটি ভিডিও আর্টের শিরোনাম ‘অ্যান্ড স্টেয়ার কনটিনিউস’ (And Stare Continues)। চার মিনিট সাত সেকেন্ডের এই ভিডিও আর্টে দেখা যায়, হিজাব পরা একজন নারী (প্রিমা নিজে) বেলুন ফোলাচ্ছেন। ফোলাতে ফোলাতে তিনি ক্লান্ত হয়ে পড়ছেন। তাঁর চোখ দিয়ে পানি ঝরছে, তাঁর নিঃশ্বাস প্রায় বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, কিন্তু তার পরও তাঁকে বেলুন ফোলাতে হচ্ছে। একসময় বেলুনটা এত বড় হয়ে যায় যে তাঁর মুখটা আর দেখা যায় না।
এ কাজের দুটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো, এর মাধ্যম ভিডিও আর্ট। বাংলাদেশে যার খুব বেশি প্রচলন নেই এবং এটি একটি কনসেপচুয়াল কাজ। নাজিয়া আন্দালিব তাঁর ভেতরের সত্তাকে ইমোশনালি প্রকাশ করেছেন এখানে।
শুরুর দিকে নাজিয়া আন্দালিব কনভেনশনাল মিডিয়াতেই কাজ করতেন। তাঁর যাত্রা শুরু হয়েছিল তেলরং ও ইনস্টলেশন দিয়ে। এরপর আলো ব্যবহার করে লাইটিং বক্স। কিন্তু এতেও তিনি সন্তুষ্ট হতে পারছিলেন না। ছোটবেলায় তাঁর ঝোঁক ছিল অভিনয়ের দিকে। তাই বেছে নিলেন ভিডিও আর্ট। তাঁর মনে হলো, এই মাধ্যমেই তিনি মানুষের সঙ্গে বেশি যোগাযোগ করতে পারছেন।
কিছুদিন আগে বেঙ্গল গ্যালারিতে অনুষ্ঠিত হলো ‘সৃজনে ও শেকড়ে’-এর প্রদর্শনী। এখানে নাজিয়া আন্দালিব প্রিমার ‘ম্যারি মাই এগ’ শিরোনামে একটি ভিডিও আর্ট প্রদর্শিত হয়। পাঁচ মিনিট ৪৩ সেকেন্ডের এই ভিডিও আর্টে দেখা যায় একটি মেয়ে বিয়ের সাজে সজ্জিত। তাঁর পরনে লাল শাড়ি, গয়না ও মাথায় ওড়না। মেয়েটির সামনে একটি টেবিলে প্লেটে অনেকগুলো ডিমপোচ রাখা এবং প্লেটের চারপাশ, টেবিলে অনেক ডিম ও ডিমের খোসা ছড়ানো আছে। মেয়েটি কাঁটা চামচ আর ছুরি দিয়ে ডিম কাটছেন এবং খাচ্ছেন। নির্লিপ্তভাবে তিনি একই কাজ বারবার করছেন। কিছুক্ষণ পর দৃশ্য বদল হয়, এবার দেখা যায়, মেয়েটি কালো হিজাবে আবৃত এবং ছুরি, কাঁটা চামচ দিয়ে ডিমপোচগুলো নাড়াচাড়া করছেন। এ সময় প্লেটের ভেতর লাল রং ছড়িয়ে পড়ে। পুরো ভিডিওতে মেয়েটির মুখ ভাবলেশহীন থাকে, শুধু মাঝেমধ্যে তাঁর চাহনিতে যেন যৌনতার আভাস পাওয়া যায়। মেয়েটির চরিত্রে প্রিমা নিজেই অভিনয় করেছেন। শিল্পী এই কনসেপচুয়াল আর্টে তাঁর নিজস্ব অনুভূতি ও দর্শন তুলে ধরেছেন। এ শিল্পকর্ম সম্পর্কে তিনি বলেন, পৃথিবীতে সবচেয়ে খারাপ ব্র্যান্ডিং হলো মা ব্র্যান্ডিং। মেয়েদের ইমোশনালি দুর্বল করার একটি প্রক্রিয়া। মেয়েরা এখানে পরাজিত। প্রতিটি মেয়েই চান মা হতে। তাঁর নিজের সন্তান ধারণ করতে। আমার মনেও এ ভাবনা আসে কিন্তু তখনই ভাবি, কেন আমার নিজেরই সন্তান লাগবে? মা মানেই তো নিজের রক্তজাত সন্তান নয়। মাদার তেরেসা একজন গ্রেট মাদার। এভাবেই দেখি ব্যাপারটি। তো আমি নিজেই প্ল্যাটফরমে দাঁড়িয়ে এ কথাটি বলতে চাইলাম। একটি মেয়েকে ধুমধাম অনুষ্ঠান করে বিয়ে দেওয়া হয় কিন্তু তিনি যদি বাচ্চা জন্ম দিতে না পারেন, তাহলে বাড়ির কাজের বুয়ার চেয়েও তাঁর খারাপ অবস্থা হয়। এই সমাজ মেয়েদেরই শুধু নয়, মানুষ যে যেভাবে পারছে, ব্যবহার করছে।
বিয়ে, বাচ্চা আর সেক্স একই সঙ্গে জড়িত। তাই বিয়ের গোটা প্রক্রিয়াই মাঝেমধ্যে আমার কাছে হাস্যকর লাগে। ডিম একটা সেক্সুয়াল সিম্বল। সোসাইটি আসলে আমার ডিম আমাকেই খাওয়াচ্ছে। যেন আমার আর কোনো ক্ষমতা নেই, আমি আসলে কী করছি, কেন করছি। আমার কী লাভ।
ভিডিও আর্টের পরের দৃশ্যে হিজাব পরা মেয়েটি সম্পর্কে প্রিমা বলেন, বিবাহিত মেয়েটির পরে যে রূপান্তর ঘটে এটি তারই প্রকাশ। আর প্লেটের লাল রং হলো মেয়েটির এই রূপান্তরের কারণে তাঁর ভেতর যে ক্ষরণ হয় তার সিম্বল।
নাজিয়া আন্দালিব প্রিমা ১৯৭৪ সালে ঢাকায় জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ২০০০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফাইন আর্টস ইনস্টিটিউট থেকে এমএফএ ডিগ্রি লাভ করেন। দেশ-বিদেশে এ পর্যন্ত ১১টি সলো প্রদর্শনী করেছেন। অংশ নিয়েছেন বহু গ্রুপ প্রদর্শনীতে।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, মার্চ ১৮, ২০১১
Leave a Reply