প্রবাদের জন্মকথা
হোসেন শহীদ
প্রবাদের উৎস সন্ধান—সমর পাল\ প্রথম প্রকাশ ফেব্রুয়ারি ২০১১\ প্রচ্ছদ ধ্রুব এষ\ প্রকাশক শোভা প্রকাশ\ দাম ২০০ টাকা
আবহমানকাল ধরে চলে আসা মানুষের রুচি, বিশ্বাস, আচার-আচরণ, সংস্কার, রসবোধ, সুখ-দুঃখ, উপদেশ, নিষেধ—লোকসাহিত্যের অত্যন্ত মূল্যবান উপাদান প্রবাদ-প্রবচনে অল্প কথায়; ছন্দোবদ্ধ পদে প্রকাশিত হয়। এককথায় বলা যায়, প্রবাদ-প্রবচনের মাধ্যমে সংক্ষেপে যথার্থ অর্থ প্রকাশিত হয়; যা ব্যক্তি-সমাজ-রাষ্ট্রীয় জীবনে যেমন শিক্ষণীয়, তেমনি গুরুত্বপূর্ণও বটে।
‘প্রবাদ-প্রবচন পুরাতন বলিয়া বা পুনঃ পুনঃ ব্যবহূত হইলেও এর রসহানি ঘটে না। রচনাকাল বা রচয়িতার নাম নির্দেশ করা সহজ নয়।
প্রবাদ জনসাধারণের উক্তি, এ জন্য ভাষা সরল, সহজ ও সংক্ষিপ্ত। ‘তোমার প্রতিবেশী তোমার প্রতি যেরূপ ব্যবহার করিবে, তুমিও তার প্রতি তদ্রূপ করিবে—এই সুদীর্ঘ উপদেশটি আরশিতে মুখ দেখা—এই সংক্ষিপ্ত বাক্যে নিহিত আছে। মোটকথা, প্রবাদ হলো সংক্ষিপ্ত, সরল, সরস, অভিজ্ঞতা-প্রসূত উপদেশ বাক্য।’—প্রবাদ-প্রবচন সম্পর্কে সরল বাঙ্গালা অভিধানে সুবল চন্দ্র মিত্র এভাবেই বলেছেন। আর এই আপ্তবাক্যকে ধারণ করেই যেন সমর পাল রচনা করেছেন প্রবাদের উৎসসন্ধান বইটি।
অনেক প্রবাদের অর্থ আমরা সহজেই বলতে পারি। কিন্তু আমরা কজন এসব প্রবাদের উৎসের খোঁজ রাখি বা উৎপত্তির পেছনের ঘটনাপ্রবাহ জানি—সে বিষয়ে অনায়াসে যে কেউ সন্দেহ পোষণ করতে পারেন, যা দূরীকরণে সমর পালের ব্যতিক্রমী; কষ্টসাধ্য গবেষণালব্ধ এই অনন্য প্রয়াস।
প্রবাদের জন্মকথা কিংবা উৎপত্তিস্থল—ইতিহাস, পুরাণ, ধর্মশাস্ত্র, নীতিকথা, লোকাচার ঘেঁটে বের করে যথাযথভাবে উপস্থাপনে শুধু শ্রম নয়; মেধা ও মননের সমন্বয়ও জরুরি। প্রসঙ্গত, গতানুগতিকতার বৃত্তমুক্ত গবেষণাকর্মে নিবিষ্ট লেখক আলোচ্য বইয়ে ইতিহাস, পুরাতত্ত্ব, পুরাণ, ধর্মশাস্ত্র, ভাষাতত্ত্ব, সমাজতত্ত্ব, ভূগোল, সাহিত্য, কিংবদন্তি—সবকিছুর সার্থক মেলবন্ধন ঘটিয়েছেন। শুধু প্রবাদের উৎসসন্ধান নয়, অর্থও উপস্থাপন করেছেন।
বইয়ে ১১০টি প্রবাদের উৎসসন্ধান করা হয়েছে। প্রতিটি বর্ণনাই যুক্তিযুক্ত এবং প্রমাণসাপেক্ষ। যেমন: ১. অতি লোভে তাঁতি নষ্ট—এক রাজার ছিল এক গাই গরু। দুধ দোহানোর সময় প্রায়ই দুরন্তপনা করত গরুটি। একদিন রাজা ওই অবস্থা দেখে রেগেমেগে চেঁচিয়ে বললেন, ‘কাল সকালে ওঠার পর যাকে প্রথমে রাস্তার ধারে দেখব, তাকেই গাইটি দিয়ে দেব।’ এক তাঁতি রাজপ্রাসাদের পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় রাজার কথা শুনতে পেল।…গরুটি পাওয়ার লোভে তাঁতি মনে মনে নানা ভাবনা ভাবতে লাগল। তাঁতি ভাবল, গরু আনতে গেলে তো দড়ি দরকার।…ভেবেচিন্তে ঘরে রাখা কাপড় বোনার সুতা পাকাতে পাকাতে মোটা দড়ি তৈরি করল। দড়ি বেশ শক্ত করতে অনেক দামের সুতা ব্যবহার করতে হলো। তাঁতির ঘরে ছিল বুড়ো মা। বুড়ি যাতে গরুর দুধ বেঁচে পয়সা নিতে না পারে, সে জন্য তাঁতি মায়ের চোখ নষ্ট করে দিল।…পরদিন খুব ভোরে উঠে তাঁতি রাজপ্রাসাদের প্রধান দরজার পাশে রাস্তায় গিয়ে দাঁড়াল।…রাজা তাঁতিকে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তার আগমনের কারণ জিজ্ঞেস করলেন। তাঁতিও অসংকোচে তার কথা নিবেদন করে গরুটি প্রার্থনা করলেন। শুনে রাজা ক্ষিপ্ত হয়ে দারোয়ান দিয়ে পিটিয়ে তাড়িয়ে দিলেন তাঁতিকে। ২. ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠির—ধার্মিক লোকের প্রকৃষ্ট উদাহরণ যুধিষ্ঠির। কোনো কোনো স্থানে অত্যন্ত অধার্মিক ব্যক্তিকে ব্যঙ্গাত্মকভাবে চিহ্নিত করতে এই প্রবাদ ব্যবহূত হয়।…কুন্তি হলেন শ্রীকৃষ্ণের পিসি। কুন্তির আসল নাম পৃথা।…একবার মহর্ষি দুর্বাসা অতিথিরূপে গৃহে এলে কুন্তি তাকে পরিচর্যায় সন্তুষ্ট করেন। দুর্বাসা তাকে এক অমোঘ মন্ত্র শিখিয়ে দিয়ে বলেন যে এই মন্ত্রের প্রভাবে কুন্তি যে দেবতাকে স্মরণ করবেন সেই দেবতাই তার নিকটে আসবেন এবং তার সাহায্যে কুন্তির পুত্রলাভ হবে।…অতঃপর স্বয়ংবর সভার মাধ্যমে কুন্তির সঙ্গে বিয়ে হলো পাণ্ডুর। পাণ্ডু সন্তান উৎপাদনক্ষম ছিলেন না। তখনকার দিনে উত্তম বর্ণের পুরুষ কিংবা জ্ঞানী ঋষি বা দেবতা হতে (দেবতার বর?) পুত্রলাভ বৈধ ছিল। পাণ্ডু কুন্তিকে অনুরোধ করেন এ ধরনের ক্ষেত্রজ সন্তান উৎপাদন করতে। কুন্তি ধর্মদেবতাকে (যম, তিনি স্বর্গের দেবতা আবার নরকেরও অধীশ্বর) আহ্বান করেন। শতশৃঙ্গ পর্বতে যমের (ধর্মের) সঙ্গে সহবাসের ফলে কুন্তির যে পুত্রসন্তান লাভ হয় তিনিই ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠির।
বইটি সব পাঠকের কাছে আদৃত হওয়ার দাবি রাখে। জ্ঞানান্বেষণ ছাড়াও বিচিত্রমুখী তথ্যের জন্য বইটি অত্যন্ত দরকারি।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, মার্চ ১৮, ২০১১
Amin
fantastic book
subrata barman
কি ভাবে পাবো ????