বুদ্ধদেব বসু (৩০ নভেম্বর ১৯০৮—১৮ মার্চ ১৯৭৪) কবি, প্রাবন্ধিক, নাট্যকার, কথাসাহিত্যিক, অনুবাদক ও সম্পাদক। উল্লেখযোগ্য বই: মরচেপড়া পেরেকের গান, তিথিডোর, রাত ভ’র বৃষ্টি, বিপন্ন বিস্ময়।
বুদ্ধদেব বসুর নামের সঙ্গে তিরিশের আধুনিক কবিদের উদ্ভব ও পরিণতির অনুষঙ্গ সাহিত্য পাঠকের মনে সার্বক্ষণিক অবস্থান করে। সাম্প্রতিককালে যাঁরা তাঁকে নতুন করে মূল্যায়ন করছেন, তাঁদের অনেকেই তাঁর কবিতার বিরূপ সমালোচনা করলেও স্বীকার করেন যে তিনি আধুনিক কবিতার সৃজনে ও প্রতিষ্ঠায় বাংলা সাহিত্যে অনেকটা ঘটকের কাজ করেছেন। তাঁরা এটাও স্বীকার করেন, তাঁর রচনাবলির যে বিস্তৃৃতি ও বৈচিত্র্য তাও তাঁর অসাধারণ প্রতিভার স্বাক্ষর। তাঁর সাহিত্যকর্মের বিস্তৃতি ও পরিসর পরিমাপ করতে গেলে দেখা যাবে যে সেদিক থেকে এক রবীন্দ্রনাথকে বাদ দিলে আর কারও সঙ্গে তাঁর তুলনা চলে না। প্রায় কৈশোর থেকে শুরু করে জীবনের পরিণত সময় পর্যন্ত তিনি একাধিক্রমে কবিতা, ছোটগল্প, উপন্যাস, নাটক ও সমালোচনা—সবকিছুতেই তাঁর পরিশ্রম ও ঐকান্তিকতার সুস্পষ্ট স্বাক্ষর রেখেছেন; এবং সঙ্গে সঙ্গে বিপুল পরিমাণ পত্র রচনাতেও ছিলেন সমান সিদ্ধহস্ত। ভাবতে অবাক লাগে যে এই অসাধারণ ক্ষমতা তিনি কী করে অর্জন করেছিলেন? ‘প্রগতি’ ও ‘কবিতা’তে তাঁর ধীমান আলোচনা ও বিশ্লেষণ-প্রক্রিয়া বারবার এলিয়টের প্রোগ্রামেটিক ক্রিটিসিজমের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়, যে ঘরানার সমালোচনা এক অর্থে নিজেকে তৈরি করে, বিস্তৃততর অর্থে নিজের পরিমণ্ডলকে নির্মাণ করে এবং একই সঙ্গে সমকালীন ও পূর্ববর্তী সাহিত্যকর্মীদের যথাস্থানে স্থাপিত করে আমাদের বোধকে শাণিত করে, বোঝার ক্ষমতাকে উজ্জ্বল করে ও পাঠ্য প্রসঙ্গকে নতুন ব্যঞ্জনায় প্রজ্বলিত করে তোলে। তিরিশের দশকের বাংলা কবিতা এবং প্রকৃতপক্ষে রবীন্দ্র-পরবর্তী যে কবিতা আমাদের সত্যিকার অর্থে বিংশ শতাব্দীতে উপনীত করেছে, যদি কোনো একজনকে তার পরিচর্যার প্রধান পুরুষ বলে চিহ্নিত করতে হয়, তাহলে তিনি এখনো এক ও অদ্বিতীয় বুদ্ধদেব বসু।
আজকের দিনে আমরা নিঃসন্দেহে বলতে পারি, জীবনানন্দ দাশই আধুনিক বাংলা কবিতার শ্রেষ্ঠতম কবি এবং সম্ভবত বিশ্ব কবিতার পরিপ্রেক্ষিতেও যথার্থ বিচারে একদিন তাঁর স্থান শ্রেষ্ঠতমদের মধ্যেই থাকবে। নতুন ভাষায়, নতুন অনুভবে ও গভীর সংজ্ঞায় তিনি এক অতুলনীয় কাব্য ভাষা ও কাব্য জগৎ নির্মাণ করেছিলেন, যা কালোত্তর। কিন্তু জীবনানন্দ দাশ তাঁর জীবদ্দশায় সেভাবে সমাদৃত হননি। তাঁকে যথার্থভাবে চিনতে পেরেছি আমরা অনেক পরে। নিদারুণ কষ্টে ও যন্ত্রণায় তাঁর জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটেছিল এবং সমস্ত সম্মাননাও তিনি পেয়েছেন মৃত্যুর পরেই। অথচ জীবনানন্দকে বলতে গেলে আবিষ্কারই করেছিলেন বুদ্ধদেব বসু এবং তাঁর সমূহ পরিচিতিও রচনা করেছিলেন তাঁর প্রাথমিক উন্মোচনের সময়েই। সমালোচক হিসেবে বুদ্ধদেব বসুর এই প্রজ্ঞা তাঁর কট্টর সমালোচকের পক্ষেও অস্বীকার করা অসম্ভব। জীবনানন্দের মধ্যে লোকোত্তর প্রতিভা ছিল। বুদ্ধদেব বসু সেটা সর্বাগ্রে চিহ্নিত করেছিলেন। সুধীন দত্ত ও তাঁর কবিকর্মকে যথার্থ ভূমিকায় স্থাপিত করেছিলেন তিনি। আধুনিক কবিতার যে নান্দনিক দিকটি যেখানে বোধ, বুদ্ধি ও পরিমার্জনার শিল্পমগ্নতা বিদ্যমান, তা হয়তো এত দ্রুত একটা পরিণতির দিকে ধাবিত হতে পারত না, যদি একজন বুদ্ধদেব বসু না জন্মাতেন।
বোদলেয়ার অনুবাদ করে তিনি ষাটের দশকের তরুণদের যেভাবে আপ্লুত করেছিলেন, তাতে বাংলা কবিতায় আধুনিকতার একটা নতুন মাত্রা যুক্ত হয়েছিল। যদিও এই কীর্তি, অন্যদিকে আবার সহজপ্রবণ কিছুসংখ্যক তরুণের কবিতায় দুর্ভাগ্যজনকভাবে বিপর্যয় ঘটিয়েছে। আবার ‘প্রতিভাবান বালক’ বলে নজরুলকে তিনি যে ছাপ লাগিয়ে দিয়েছিলেন, তা দুঃখজনকভাবে অন্তর্দৃষ্টিহীন ও উন্নাসিকতার পরিচয় বহন করে। কিন্তু বুদ্ধদেব বসু যখন তাঁর সামগ্রিকতা নিয়ে আমাদের সম্মুখে উপস্থিত হন, তখন তাঁর বিপুল-বিশাল শাণিত দীপ্যমান উপস্থিতিতে আমরা অভিভূত হই।
সমকালীন প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্য বিষয়ে তাঁর সুস্পষ্ট বক্তব্য ছিল। তাঁর সেই বক্তব্যসমূহের ভেতর দিয়ে তাঁর ব্যক্তিত্বকে, তাঁর নান্দনিক শিক্ষাকে আমাদের মধ্যে তিনি অবিনশ্বরভাবে সঞ্চারিত করে গেছেন। ইংরেজি সাহিত্য ও তার মাধ্যমে পাশ্চাত্যের চৈতন্যকে পরিপূর্ণভাবে ধারণ করেও প্রাচ্যের প্রাজ্ঞ গভীরতা ছিল তাঁর নিত্যসঙ্গী। ফলে তাঁর চেতনায় ও বক্তব্যে এসেছে সুস্পষ্ট এক স্বস্তি ও স্থৈর্য। তিনি বারবার সীমাহীন মমতা ও শ্রদ্ধায় নিজের ভাষা এবং সাহিত্যের ভাবমূর্তি রচনা করেছেন দক্ষ ও বলিষ্ঠ হাতে নিরুত্তাপ ভাস্করের মতো। যতবার তাঁর দেশ ভারতে হিন্দির মতো একটি ভাষাকে নিখিল ভারতীয় ভাষা হিসেবে সবার ওপরে চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চলেছে, তিনি তাঁর স্বাভাবিক পাণ্ডিত্য, বিরল বিশ্লেষণী শক্তি ও গভীর নান্দনিক অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে কেন্দ্রের বক্তব্য খণ্ডন করেছেন। ঠিক একইভাবে তাঁর পরিণত বয়সে ‘বীটনিক’দের সম্পর্কে যে গভীর দূরদৃষ্টির পরিচয় তিনি দিয়েছিলেন, তা আজকের দিনেও তাঁর তৎকালীন রচনার ভেতর থেকে বিদ্যুচ্চমকের মতো ঝলসে ওঠে। এই ‘বীটনিক’দের সম্পর্কেই ১৯৬১-তে যখন উত্তর-কৈশোর আমি এবং তাদের নিয়ে মারাত্মক আপ্লুুত, তখন বুদ্ধদেব বসুই বলেছিলেন, ‘আশঙ্কা জাগে তাদের হূদয়ের ‘অকথ্য আগুন’ অবশেষে না ব্রডওয়ের নিয়ন বাতিতে পর্যবসিত হয়, কিংবা দু চারটে চকমকি জ্বেলেই নিভে যায়, কেননা কবিদের যা সবচেয়ে সব শত্রু, তা দারিদ্র্য নয়, অবহেলা নয়, উৎপীড়নও নয়—তা অত্যধিক সাফল্য, তা বহু বিস্তৃত বিজ্ঞাপন।’ সেদিন কথাগুলো আমার কাছে সহজপাচ্য ছিল না কিন্তু দীর্ঘকাল অতিক্রান্তির পরও বাংলাদেশের অনেকেই এই হার্দ্য উচ্চারণ অনুধাবন করার চেষ্টা করলে আমাদের সাহিত্যের ভবিষ্যৎ হয়তো আরও কিছুটা উজ্জ্বল হতে পারে।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, মার্চ ১৮, ২০১১
Leave a Reply