বোর্হেস ও বিক্তোরিয়ার সংলাপ
রফিক-উম-মুনীর চৌধুরী
বোর্হেসের সঙ্গে কথোপকথন—অনুবাদ: আলম খোরশেদ \ প্রকাশক: বিশদ বাঙলা \ এপ্রিল ২০১০ \ দাম: ১২৫ টাকা
আর্হেন্তিনার সাহিত্যের দুই দিকপাল বিক্তোরিয়া ওকাম্পো (১৮৯০-১৯৭৯) এবং হোর্হে লুইস বোর্হেসের (১৮৯৯-১৯৮৬) কথোপকথনভিত্তিক Dialogo con Borges নামের বইটির বাংলা অনুবাদ বোর্হেসের সঙ্গে কথোপকথন। মূল স্প্যানিশ থেকে বাংলায় অনুবাদ (আমাদের দেশের অনুবাদের অঙ্গনে যা খুব একটা ঘটে না)। অনুবাদক আলম খোরশেদ আমাদের অনুবাদ সাহিত্যের ভুবনে একটি সুপরিচিত নাম। তাঁর অনূদিত গ্রন্থের তালিকায় এটি একটি উল্লেখযোগ্য সংযোজন।
আলোচ্য অনূদিত গ্রন্থটির প্রধানতম বৈশিষ্ট্য, এটি সরাসরি স্প্যানিশ থেকে বাংলায় অনূদিত। মূল স্প্যানিশ উচ্চারণের বাংলায় প্রতিবর্ণীকরণে ছোটখাটো কিছু ত্রুটি (যেমন ‘ভিক্তোরিয়া’ নয়, হবে ‘বিক্তোরিয়া’; ‘বুয়েনস আইরেস’ নয়, হবে ‘বুয়েনোস আইরেস’; ‘এল ফাসুন্দো’ নয়, হবে ‘এল ফাকুন্দো’ [পৃষ্ঠা ২১]; কিংবা ‘এল কদিয়ো’ [পৃষ্ঠা ২৫] না হয়ে হবে ‘এল কাউদিইয়ো’) ছাড়া সুসম্পাদিত গ্রন্থটিতে উল্লেখ করার মতো কোনো ভুল চোখে পড়ে না। গদ্য ঝরঝরে এবং গতিশীল, যা পাঠকদের ব্যক্তি ও লেখক বোর্হেসের ভুবনে নিয়ে যায়।
২১ নম্বর পৃষ্ঠায় বিক্তোরিয়া ওকাম্পোর এক প্রশ্নের উত্তরে বোর্হেস বলছেন, ‘ছবি স্মৃতিতে সহজেই শিকড় গাড়ে, কেননা সে স্থির।’ বোর্হেসের পারিবারিক অ্যালবামের ১৪টি ছবি সন্নিহিত হয়েছে গ্রন্থটিতে, যেগুলো ধরে ধরে বিক্তোরিয়া এবং বোর্হেসের আলাপচারিতা এগোয়। বিক্তোরিয়া প্রশ্ন করেন আর বোর্হেস সেগুলোর উত্তর দেন। তাঁদের কথাবার্তায় উঠে আসে বোর্হেসের পরিবার-শৈশব-কৈশোর, তারুণ্যের নানা প্রসঙ্গের সঙ্গে তাঁদের সমকালীন আর্হেন্তাইন সাহিত্য ও সংস্কৃতির নানা দিক। আছে তাঁদের পূর্বসূরি অসাধারণ বাগ্মী মাসেদোনিও ফের্নান্দেস, রিকার্দো গুইরালদেস, সের্মিয়েন্তো, লেওপোলদো লুগোনেস প্রমুখের প্রসঙ্গ। আছে জুল সোলারের প্রসঙ্গ, যাঁকে বোর্হেস বলতেন, ‘আমাদের উইলিয়াম ব্লেক।’ আছে বোর্হেসের ছেলেবেলায় পড়া বই, বিশেষ করে আর্হেন্তাইন ক্ল্যাসিকগুলোর কথা। আছে বোর্হেসের সৈনিক ও যোদ্ধা পূর্বপুরুষ, পিতামাতা এবং একমাত্র বোন নোরাহর সঙ্গে কাটানো শৈশবের প্রসঙ্গ। রয়েছে তাঁর সময়কালের ছুরি ও ক্রোধের সংস্কৃতি (বোর্হেসকে বোঝার জন্য যা অপরিহার্য) এবং তাঙ্গো সংগীত ও নৃত্যের কথা। স্প্যানিশ ভাষার চমৎকার দুই গদ্যশিল্পী পল গ্রুসাক এবং আলফোনসো রেইয়েসের প্রসঙ্গও আছে। রেইয়েসের গতিশীল গদ্যের তারিফ করে বোর্হেস অন্যত্র তাঁর আত্মজীবনীতে বলেছেন, ‘রেইয়েস হলেন আমাদের ভাষার শ্রেষ্ঠ গদ্যশিল্পী।’ আর আছে বন্ধু বিওই কাসারেসের (যাঁর স্ত্রী সিলবিনা ওকাম্পো ছিলেন বিক্তোরিয়ার ছোট বোন) সঙ্গে বন্ধুত্ব এবং দুজন মিলে যাঁর যাঁর প্রপিতামহের নাম জুড়ে দিয়ে তৃতীয় সত্তা বুস্তোস দুমেক নামে লেখালেখির মজার কাহিনি। তাঁর চেয়ে প্রায় ১৪ বছরের ছোট এই বিওই কাসারেসই বোর্হেসকে জটিল বারোক ভেঙে সারল্যমাখা গদ্য লিখতে উদ্বুদ্ধ করেন। পৃষ্ঠা ২৯-এ উল্লিখিত এ বক্তব্যটি বোর্হেস-গবেষকদের জন্য তাৎপর্যপূর্ণ। ২৫ নম্বর পৃষ্ঠায় আমরা বিক্তোরিয়া ও বোর্হেসকে স্প্যানিশ ভাষাবিষয়ক আলোচনার গুরুত্বপূর্ণ একটি আলোচনায় শামিল হতে দেখি, যেখানে ‘হন্টেড’, ‘ইরি’, ‘আনক্যানি’, ‘উইস্টফুল’ ইত্যাদি ইংরেজি শব্দের কোনো প্রতিশব্দ স্প্যানিশে কেন নেই, এ নিয়ে তাঁরা প্রশ্ন তোলেন। বাংলার ক্ষেত্রেও আমরা এ রকম কিছু প্রশ্ন তুলতে পারি, নয় কি? যাঁরা সাহিত্যের অনুবাদ করেন, বাংলায় প্রতিশব্দ খুঁজতে গিয়ে তাঁরা এ রকম খাবি খান কখনো কখনো।
বিক্তোরিয়ার সান ইসিদ্রোর বাড়িতে (যে বাড়িতে ১৯২৪ সালে রবীন্দ্রনাথ ছিলেন) হওয়া ১৯৬৭ সালে কথোপকথনের শেষের দিকে অনেকাংশজুড়ে রবীন্দ্রনাথের ‘বিজয়া’ মানে বিক্তোরিয়া ওকাম্পো প্রতিষ্ঠিত সুর সাহিত্য পত্রিকা বিষয়ে দুজনের কথাবার্তা আছে। অন্তর্মুখী এই বিশ্ববরেণ্য ব্যক্তিত্বের জীবন ও সাহিত্যের নানা প্রসঙ্গ ছাড়াও পাঠকেরা বাড়তি আকর্ষণ হিসেবে এ গ্রন্থে পাবেন নারী-অধিকার আদায় আন্দোলনের নেত্রী আর্হেন্তিনার কৃতী সন্তান বিক্তোরিয়া ওকাম্পোর একটি প্রবন্ধের অনুবাদ এবং বোর্হেসের অন্যতম আত্মজৈবনিক গল্প ‘এল সুর’-এর অনুবাদ ‘দক্ষিণী’ (দুটোই ইংরেজি থেকে অনূদিত)।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, মার্চ ১৮, ২০১১
Leave a Reply