মনে পড়ে বন্ধুদের
সাক্ষাৎকার গ্রহণ: হামিদ কায়সার
ড্রয়িংরুমের টেলিভিশনে ফুল ভলিউমে বেজে চলেছে, ‘তোমায় নতুন করে পাব বলে’। এত জোরে বাজছে গানটা যে আর কোনো শব্দ, কোলাহল সব চাপা পড়ে গেছে। সেই ১৯৯২ সালে পক্ষাঘাত রোগে আক্রান্ত হয়ে ঘরবন্দী হওয়ার পর, বলা যায়, একমাত্র রবীন্দ্রসংগীত শুনেই তাঁর সময় কাটে! আমাকে দেখামাত্রই চোখ-মুখে সেই একই বাৎসল্যের হাসি, বুদ্ধিদীপ্তির ছটা—প্রায় এক দশক আগে যা দেখেছিলাম। খুব একটা বদলাননি, বাংলাদেশের আধুনিক উপন্যাস ধারার এক প্রধান কথাকার রশীদ করীম, যাঁর উত্তম পুরুষ উপন্যাসের প্রকাশনা এ বছর ৫০ বছরে পড়ল। মূলত সে কারণেই তাঁর মুখোমুখি হওয়া। অন্যান্য উল্লেখযোগ্য উপন্যাসের মধ্যে প্রসন্ন পাষাণ, আমার যত গ্লানি, প্রেম একটি লাল গোলাপ, সাধারণ লোকের কাহিনী প্রভৃতি অন্যতম ।
প্রশ্ন: প্রথমেই বললাম, ‘আপনার সময় তাহলে রবীন্দ্রসংগীত শুনেই কেটে যায়?’
রশীদ করীম: সময় কীভাবে কাটে, আমি নিজেও জানি না। আমার একটা নির্দিষ্ট কামরা আছে। সেই কামরায় সকাল-দুপুর-সন্ধ্যা—সব বেলাই কেটে যায়। রবীন্দ্রসংগীতের আমি বিশেষ অনুরক্ত।
প্রশ্ন: রবীন্দ্রসংগীতের প্রতি আপনার তীব্র অনুরাগ আপনার প্রবন্ধ সংগ্রহ পড়লেই বোঝা যায়। অসংখ্য প্রবন্ধের শিরোনাম রবীন্দ্রনাথের গানের লাইন থেকে নিয়েছেন, রবীন্দ্রনাথের গান নিয়ে আপনার প্রবন্ধও রয়েছে।
রশীদ করীম: আমি অতি অল্প বয়স থেকে রবীন্দ্রসংগীত শুনি। পাঁচ-ছয় বছর বয়স থেকেই। কিছু না বুঝেই। আমার এক ছোট মামা রবীন্দ্রসংগীত পছন্দ করতেন। তাঁর সুবাদেই রবীন্দ্রসংগীত শোনা হতো।
প্রশ্ন: আপনি রবীন্দ্রসংগীত পছন্দ করেন বলে ভাবি চ্যানেলে চ্যানেলে রবীন্দ্রসংগীত অনুসন্ধান করেন—আপনার প্রতি এখনো ওনার ভালোবাসা কী তীব্র এবং গভীর!
রশীদ করীম: তা করেন (মুচকি হাসি মুখজুড়ে)।
প্রশ্ন: আপনার লেখালেখির পেছনেও তো তাঁর যথেষ্ট অবদান আছে।
রশীদ করীম: তা আছে।
প্রশ্ন: কোনো শিল্পীর নামই কি আপনার স্মরণে নেই, যাঁদের রবীন্দ্রসংগীত আপনার ভালো লাগে?
রশীদ করীম: কয়েকজনের নাম বলতে পারি—যাঁরা তত আধুনিক নন, যেমন—কলিম শরাফী, রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা, মিতা হক, পাপিয়া সারোয়ার—এরই মধ্যে মনে পড়ল, অতি পরিচিত একজনের কথা, যেমন রুবি রহমান। আজকাল অবশ্য তাঁকে তেমন দেখা যায় না।
প্রশ্ন: রুবি রহমান তো এ বছর কবিতার জন্য বাংলা একাডেমী পুরস্কার পেলেন।
রশীদ করীম: তাই নাকি? আমি জানি না তো! কেউ আমাকে কিছু বলেনি তো! (তিনি ব্যস্ত হয়ে উঠলেন রুবি রহমানের সঙ্গে কথা বলতে) এত ভালো একটা খবর আমি জানলাম না! (রুবি রহমানকে মোবাইলে ধরিয়ে দিতেই রুবি রহমানের প্রতি তাঁর অনুযোগ) এত ভালো একটা খবর আমাকে জানাওনি!
প্রশ্ন: এই যে বাংলা একাডেমী পুরস্কার, বইমেলা হয়ে গেল—এসবের প্রতি আপনি কি এখনো আগ্রহ বোধ করেন?
রশীদ করীম: বইমেলায় যাইনি। কোনো খবরও জানি না। না, কোনো অনুভূতিই হয় না আজকাল। পড়াশোনাই তো করতে পারি না। চোখ অপারেশন করিয়েছি দৃষ্টিশক্তি ফিরে পাওয়ার আশায়। পেয়েছিও। কিন্তু পুরোনো আলস্য অনুসারে বই পড়া হয় না। কেউ পড়ে দেয়। ছোট লেখা। খুব দীর্ঘ লেখা ভালো লাগে না। জানো, শহীদ কাদরীর একুশে পদক পাওয়ার খবর আমি সম্প্রতি পেলাম। সে আমেরিকায় থাকে। সে আমার অন্তরঙ্গ বন্ধু। যেমন শামসুর রাহমান ছিলেন।
প্রশ্ন: শামসুর রাহমানকে মনে পড়ে?
রশীদ করীম: মনে পড়ে, হঠাৎ হঠাৎই মনে পড়ে। মাঝেমধ্যে আড্ডার সেই পুরোনো বন্ধুদের কথা মনে পড়ে। তখন মনে হয়, দিনগুলো বেশ ছিল। পুরোনো বন্ধু এবং আড্ডা বেশ ছিল।
প্রশ্ন: এবারের বইমেলায় আপনার কয়েকটি সাক্ষাৎকার নিয়ে একটি সংকলন বেরিয়েছে, আপনি কি জানেন?
রশীদ করীম: জানি না তো। (তরুণ আলোয় রশীদ করীম বইটি ওনার হাতে ধরিয়ে দিতেই নেড়েচেড়ে দেখলেন)। রশীদ করীম এবার জানতে চাইলেন, ‘তরুণ আলোয় মানে?’
প্রশ্ন: এই সংকলনে যেসব তরুণ আপনার সাক্ষাৎকার নিয়েছেন, তাঁরা বিভিন্ন দশকের প্রতিনিধি। আশির দশক থেকে শুরু করে একেবারে সাম্প্রতিক কালের তরুণ আপনার কাছে এসেছেন, আপনার সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছেন এবং তাঁদের দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই তুলে ধরা হয়েছে আপনাকে। আর যতই দিন যাচ্ছে, আপনার প্রতি তরুণদের আগ্রহ বাড়ছে।
রশীদ করীম: আচ্ছা, ভালো।
প্রশ্ন: রশীদ ভাই, আপনি কি জানেন, আপনার প্রথম উপন্যাস উত্তম পুরুষ এবার ৫০ বছরে পা ফেলেছে?
রশীদ করীম: জানি না তো!
প্রশ্ন: উত্তম পুরুষ প্রকাশের ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে আপনার প্রতিক্রিয়া জানতে চাইছি।
রশীদ করীম: উত্তম পুরুষ-এর ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে আমার প্রতিক্রিয়া শুধু এই যে, আমার এই প্রকাশনা উপলক্ষে আমার আর কোনো হাত থাকল না। যথা ইচ্ছা সবাই প্রকাশ করতে পারেন। তবে আমার আশঙ্কা শুধু এই যে, বইয়ের মাঝখানে বা অন্য কোনোখানে অদল-বদল করে দিতে পারে—
প্রশ্ন: অদল-বদল করে দিতে পারে?
রশীদ করীম: (কোনোভাবেই হাসি চেপে রাখতে পারলেন না) অদল-বদল করে দিতে পারে (আবারও হাসি)।
প্রশ্ন: উত্তম পুরুষসহ আপনি ১২টি উপন্যাস লিখেছেন? আপনার কাছে কোন উপন্যাসটি সবচেয়ে প্রিয়?
রশীদ করীম: সে আমি বলতে পারব না। কারণ, কোনো বিশেষ মুহূর্তে বিশেষ একটি উপন্যাস হয়তো ভালো লাগে। যা-ই হোক, এ বিষয়ে কোনো মত দিতে পারব না।
প্রশ্ন: তবুও যদি কিছু বলেন, ১৯৬১ তে প্রকাশিত উপন্যাস উত্তম পুরুষ প্রকাশনার ৫০ বছর উপলক্ষে?
রশীদ করীম: উত্তম পুরুষ নিশ্চয়ই আমার অন্যতম প্রিয় বই। এটি সর্বাগ্রে লেখা এবং বহুজন কর্তৃক প্রশংসিত। সে জন্য বইটির প্রতি একটি দুর্বলতা আছে। তবে প্রসন্ন পাষাণ কিংবা আমার যত গ্লানি ইত্যাদি বইয়ের প্রতিও আমার দুর্বলতা কোনো অংশে কম নয়।
প্রশ্ন: লেখালেখি নিয়ে আপনার কোনো আক্ষেপ আছে?
রশীদ করীম: না। কোনো আক্ষেপ নেই।
প্রশ্ন: হয় না এ রকম, যে একটি বিষয় নিয়ে উপন্যাস লেখার পরিকল্পনা করেছিলেন। তবে তা আর লেখা হয়ে ওঠেনি।
রশীদ করীম: আমার কোনো উপন্যাসই পরিকল্পিতভাবে লেখা হয়নি বা পরিকল্পিত নয় বলে দুঃখ পেয়েছি। তাও নয়।
প্রশ্ন: জীবনের এ পর্যায়ে এসে জীবন সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন কী?
রশীদ করীম: জীবন সম্পর্কে মূল্যায়ন করেছি। তা-ও না। যেমন খুশি লিখে গেছি। কখনো দুঃখ পাইনি।
তোমাকে তো ডালপুরিও খাওয়াতে পারছি না। নিষেধ! [কথার মাঝে ঢুকে পড়লেন মিসেস রশীদ করিম। বললেন, নিজে খেতে পাচ্ছেন না সেটা বলেন! আপনার তো ডালপুরি, শিঙাড়া—সব নিষেধ।
কথা বলতে বলতেই হঠাৎ এক কাণ্ড করে বসলেন, আমার জন্য টেবিলে দেওয়া দুটো সমুচার একটি হাতে তুলে নিলেন। কিন্তু মিসেস রশীদ করীম নির্দয়ের মতো সেটা লুফে নিয়ে চলে গেলেন, একটু পরই সেটার বদলে ভেজিটেবল রোল এনে উত্তম পুরুষ-এর লেখককে শান্ত করলেন।]
প্রশ্ন: ডায়াবেটিস … কিন্তু আপনার শরীর দেখে কিন্তু ভালো লাগছে।
রশীদ করীম: আমার জন্ম ১৯২৫ সালে। এখন কত বয়স গোনো। (কড়ে গুনে গুনে গোনালেন) ৮৬ বছর। এখন সেই বয়সের কথা ভাবলে আমার নিজেরই মাথা ঘোরে।
প্রশ্ন: রশীদ ভাই। বাংলাদেশে যে এখন ক্রিকেট নিয়ে কত আনন্দ-বেদনার গল্প তৈরি হচ্ছে, আপনি কি জানেন কিছু? কিছু টের পান? আমি যত দূর জানি, ক্রিকেট আপনার অসম্ভব প্রিয় ছিল।
রশীদ করীম: না। শুনিনি তো কিছু!
প্রশ্ন: বাংলাদেশে ক্রিকেটের বিশ্বকাপ খেলা হচ্ছে। জানেন, একদিন বাংলাদেশ জেতায় প্রচণ্ড রকমের যেমন আনন্দ-উল্লাস হয়, আরেক দিন হেরে যাওয়াতেও দেশজুড়ে তার চেয়েও অধিক শোকের ছায়া দেখা দেয়।
রশীদ করীম: কিছুই জানিনি, কিছুই শুনিনি।
প্রশ্ন: তরুণ বয়সে সম্ভবত ক্রিকেট দেখার সুযোগ ছিল না আপনাদের। ক্রিকেটের ধারাবিবরণী রেডিওতে শুনেই সন্তুষ্ট থাকতে হতো।
রশীদ করীম: তা ঠিক। আমি ছোটবেলা থেকেই ক্রিকেটের খুব ভক্ত ছিলাম। যখন বয়স হলো নিতান্তই ভক্ত হলাম মুস্তাক আলীর।
প্রশ্ন: পাকিস্তানের মুস্তাক আলী?
রশীদ করীম: না, না। ইন্ডিয়ার। ওর ভক্ত ছিলাম। সি এ নাইডু ওর লেখাও দেখতাম। মুস্তাক আলী ওর কাছ থেকেই খেলাও শেখেন। আজ আর কথা বলতে পারছি না। অনেক তো হলো।
প্রশ্ন: সবশেষে তরুণদের প্রতি যদি আপনার কোনো উপদেশ থাকে, জানতে চাইছি।
রশীদ করীম: তরুণদের প্রতি একমাত্র উপদেশ এই, তাঁরা নিজের লেখার প্রতি নিবিষ্ট থাকবেন। কারও উপদেশ মেনে চলবেন না। কারণ, লেখা তাঁদের ভেতর থেকেই আসবে। আমি নিজেও এ আদর্শে বিশ্বাসী ছিলাম।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, মার্চ ১১, ২০১১
Leave a Reply