অনুবাদ: সাজ্জাদ শরিফ
উর্দু ভাষার নন্দিত কবি ফয়েজ আহমেদ ফয়েজের জন্মশত বছর চলছে। তিনি জন্মেছিলেন পাঞ্জাবের শিয়ালকোটের এক গ্রামে, ১৯১১ সালে। প্রগতিশীল বামপন্থী এই কবির স্থান আমাদের কাছে নানা কারণে বিশিষ্ট। স্বাধীনতার পর এসেছিলেন ঢাকায়। ফিরে গিয়ে লিখেছিলেন তাঁর অসামান্য কবিতা ‘ঢাকা সে ওয়াপসি পার’। মুক্তিযুদ্ধে বাঙালিদের ওপর পাকিস্তানি বর্বরতা, ইতিহাসের ছেদ ও বেদনা এবং একজন পাকিস্তানি হিসেবে তার মানবিক দায় নিয়ে বাংলাদেশের ওপর তিনি লিখেছিলেন আরও দুটি কবিতা। তাঁর জন্মশতবর্ষে, মুক্তিযুদ্ধের ৪০তম বছরে স্বাধীনতার এই মাসে, তাঁকে শ্রদ্ধা জানিয়ে সে কবিতা তিনটির অনুবাদ ছাপা হলো।
ঢাকা থেকে ফিরে
অনেক মেলামেশার পরও রয়ে গেলাম পরের মতো,
আর কতবার মিলন হলে বন্ধু হব অবশ্যত?
আর কতবার বর্ষা হলে মুছবে গাছের রক্তরেখা,
চোখ জুড়াবে হিল্লোলিত খেতের সবুজ দৃশ্য যত?
বন্ধুভাবে হতাশ হলাম, বিফল অনুরোধের পালা—
হূদয় ছিল পিষ্ট, মনস্কামনা তার কী বিব্রত!
ভালোবাসার মৃত্যু হলো হূদয়বিহীন প্রত্যাঘাতে,
মধুর রাত্রিশেষের পরে প্রভাত এল কী উদ্ধত!
জীবন বাজি রেখে, ফয়েজ, যা বলতে আজ সমুদ্যত
না বলা সেই চর্যাবচন সবই পড়ে রইল হত।
আমার সামনে এসো না (বাংলাদেশ: ১)
আমি কী করে দিই এই হত্যা-উৎসবের বিবরণ,
কী করে সাজাই এই ধ্বংসলীলা?
আমার খরখরে হাড়ের এই শরীর তো এখন প্রায় রক্তহীন
সামান্য যা আছে
তেল হয়ে প্রদীপ জ্বালানোর যোগ্য তা নয়,
অক্ষম কোনো পানপাত্র ভরিয়ে তুলতে।
হতে পারবে না কোনো আগুনের জ্বালানিও,
মেটাতে পারবে না তৃষ্ণা।
এই ছিন্নভিন্ন শরীরে আজ রক্তের বড় অভাব—
এর ভেতরে এখন বইছে তীব্র বিষ।
যদি কাটো আমার শিরা, এর প্রতিটি ফোঁটা ফেনিয়ে উঠবে
গোখরোর ছোবলের বিষের মতো।
এর প্রতিটি ফোঁটা যুগান্তের ব্যথিত বাসনা,
বহু বছরের চাপা ক্ষোভের জ্বলন্ত সিলমোহর।
আমার থেকে সাবধান। আমার শরীর এক বিষের নদী।
আমার সামনে এসো না। আমার শরীর মরুভূমিতে একটি শুকনো ডাল।
যদি এতে আগুন দাও, কোনো সাইপ্রেস বা চামেলি দেখতে পাবে না আর।
অথচ আমার হাড় ফুটে উঠছে ফণীমনসার কাঁটার মতো।
প্রভাতি সুগন্ধের বদলে যদি একে ছুড়ে দাও বনে,
আমার আত্মার অগ্নিদগ্ধ ধূলিকে ত্রস্ত করে দেবে তুমি।
তাই আমার সামনে এসো না। আমি রক্তের জন্য পিপাসিত।
বাংলাদেশ: ২
এভাবেই আমার দুঃখ হয়ে ওঠে দৃশ্যমান।
এ তো ধুলো, বছরের পর বছর জমেছে আমার হূদয়ে,
শেষে উঠে এসেছে আমার চোখ বরাবর,
তিক্ততা এখন এতই স্পষ্ট যে
আমার বন্ধুরা যখন আমার চোখ রক্তে ধুয়ে ফেলতে বলে
আমাকে তা মেনে নিতে হয়।
আমার রক্তে লহমায় এলোমেলো হয়ে যায় সব—
সব চেহারা, সব প্রতিমা, সবখানেই লাল।
রক্ত উপচে পড়ে সূর্যে, ধুয়ে দেয় ওর সোনালি।
রক্ত নিয়ে উগড়ে আসে চাঁদ, মুছে যায় ওর রুপালি।
আকাশ প্রতিশ্রুতি দেয় এক রক্তপ্রভাতের
আর রাত ঝরায় শুধু রক্ত-অশ্রু।
গাছেরা জমে গিয়ে গাঢ় লাল স্তম্ভ।
ফুলেরা নিজেদের চোখ ভরে নেয় রক্তে।
আর প্রতিটি চাহনিই যেন তীর,
প্রত্যেকেই বিদ্ধ করে রক্তচিত্র। এই রক্ত
—শহীদের জন্য ক্রন্দসী নদী—
বয়ে যায় তার বাসনা নিয়ে। দুঃখে, রাগে, ভালোবাসায়।
একে বয়ে যেতে দাও। একে বাধা দিলে
থেকে যাবে মৃত্যুরঙা ছদ্মবেশী ঘৃণা।
তা যেন না হয়, বন্ধুরা,
বরং ফিরিয়ে আনো সব অশ্রু,
আমার ধূলিধূসর চোখ ভাসিয়ে দাও বন্যায়,
আমার চোখের এই রক্ত চিরকালের জন্য ধুয়েমুছে যাক।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, মার্চ ০৪, ২০১১
Leave a Reply