পঁচাশি বছর বয়সে তিনি লিখেছেন এক অমূল্য স্মৃতিকথা—প্রসঙ্গ সত্যজিৎ: ছবি ও কথা। দুর্লভ অনেক আলোকচিত্র আর আন্তরিক আবেগময় অনেক কথায় ভরা এই অ্যালবাম কেবল একজন ব্যক্তির সান্নিধ্যলাভের স্মৃতিচারণাই নয়, আমাদের জাতীয় ইতিহাসের অনেক উপাদানও রয়েছে এতে। এ ধরনের বই আমাদের দেশে অত্যন্ত বিরল। স্মৃতি ও অভিজ্ঞতা হয়তো অনেকেরই আছে, কিন্তু সবাইকে তার ভাগ দিতে পারেন, সাজিয়ে-গুছিয়ে গ্রন্থাকারে হাজির করতে পারেন, এমন মানুষের সংখ্যা তো বেশি নয়।
আলোকচিত্রশিল্পী আমানুল হক আমাদের জন্য সেই কাজটি করেছেন। যশস্বী চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়, তাঁর পরিবার, চলচ্চিত্র ও শিল্পজগতের অনেক মানুষের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক, কাজকর্ম দেখার যে বিরল সৌভাগ্য তাঁর হয়েছে, সেসবের স্মৃতি একলা রোমন্থন করেই একদিন পৃথিবী থেকে বিদায় নেবেন—এমনটি তিনি হতে দেননি। তাঁর বিশাল স্মৃতিভান্ডার তিনি মেলে ধরেছেন আমাদের জন্য। সত্যজিৎ রায়কে নিয়ে জীবনীগ্রন্থ রচিত হয়েছে একাধিক, সেগুলোতে গবেষণালব্ধ তথ্য রয়েছে অনেক। কিন্তু আমানুল হকের এই অ্যালবাম সেসবের থেকে খুব আলাদা: এটি একান্তই এক ব্যক্তিগত রচনা, এর প্রধান মূল্য আমানুল হকের আন্তরিক অনুভব। শুধু সত্যজিৎ রায়ের কর্মসাধনার সচিত্র বিবরণ এটি নয়। তাঁর ব্যক্তিত্ব, তাঁর মন, সহকর্মীদের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক, দেশ, মাতৃভাষা ও আপন সংস্কৃতির প্রতি তাঁর দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয়ও পরিষ্কারভাবে পরস্ফুিট হয়েছে আমানুল হকের এই লেখায়। সেই সঙ্গে এখানে উন্মোচিত হয়েছে আমানুল হকের মনও। ব্যক্তিগত হয়েও এ লেখা ভিতর-বাহির মিলিয়ে হয়ে উঠেছে সর্বজনীন। ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রের আচরণের এই সচিত্র আন্তরিক বিবরণ ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাসের খুব গুরুত্বপূর্ণ এক কালপর্বেরও স্মারক।
একসময় ঢাকা আর্ট কলেজের ছাত্র আমানুল হক ছবি আঁকার প্রাতিষ্ঠানিক বিদ্যা শেষ করতে পারেননি। পঞ্চাশের দশকের শুরুতে তিনি ঢাকা মেডিকেল কলেজে আর্টিস্ট ফটোগ্রাফারের চাকরি করতেন। ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের মিছিলে পুলিশের গুলিতে শহীদ রফিকউদ্দিনের ছবি তোলায় পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর কোপানলে পড়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজের চাকরি হারান। শুধু যে বেকার হয়ে পড়েন তা-ই নয়, আরও নিগ্রহ-নিপীড়নের ভয় তাঁকে তাড়া করে ফেরে। শেষে তিনি পালিয়ে চলে যান কলকাতা। কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে পূর্ব পরিচয়ের সুবাদে তিনি সুযোগ পান সত্যজিৎ রায়ের সাক্ষাৎলাভের। সত্যজিৎ তাঁর তোলা আলোকচিত্র দেখে বুঝতে পারেন, তাঁর পূর্বপুরুষের সেই বাঙাল মুলুক থেকে আসা এই তরুণটি এক প্রতিভাবান আলোকচিত্রশিল্পী। তাঁর চলচ্চিত্র নির্মাণযজ্ঞে অনায়াসে প্রবেশের সুযোগ ঘটে যায় চিররুগ্ন, চিরদরিদ্র আমানুল হকের।
কিন্তু আমানুল হক যে এক বিরল সৌভাগ্যের অধিকারী আলোকচিত্রী, তাঁর প্রমাণ পাওয়া যায় তাঁর রচিত এই অ্যালবামের বিবরণ থেকে। সত্যজিতের দেবী, তিন কন্যা, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাঞ্চনজঙ্ঘা, অভিযান, মহানগর, চারুলতা, কাপুরুষ ও মহাপুরুষ, নায়ক ইত্যাদি চলচ্চিত্র নির্মাণের কাজে তিনি অংশগ্রহণের সুযোগ পেয়েছেন স্থির আলোকচিত্রী হিসেবে। এই সুবাদে অত্যন্ত ঘনিষ্ঠভাবে দেখার সুযোগ পেয়েছেন সত্যজিতের মা সুপ্রভা রায় ও স্ত্রী বিজয়া রায়কে। লাভ করেছেন তাঁদের স্নেহ। চোখের সামনে তিনি বেড়ে উঠতে দেখেছেন সত্যজিৎপুত্র সন্দীপ রায়কে। একই সঙ্গে তিনি দেখেছেন সত্যজিতের চলচ্চিত্রের নায়ক-নায়িকাদের, তাঁদের কে কেমন করে শিল্পী হয়ে উঠলেন, কার সম্পর্কে সত্যজিতের মূল্যায়ন কেমন ইত্যাদি জেনেছেন। শুধু সত্যজিৎ রায় নন, গোটা কলকাতার সেই সময়ে সাহিত্য-সাংস্কৃতিক জগৎ ও তার কুশীলবদেরও খুব কাছে থেকে দেখার ও জানার সুযোগ পেয়েছেন আমানুল হক। তুলেছেন তাঁদের অনেক বিরল মুহূর্তের ছবি। বিশ্বখ্যাত সোভিয়েত চলচ্চিত্রকার সের্গেই আইজেনস্টাইনের জীবনীকার মারি সিটন সত্যজিৎ রায়ের জীবনী লেখার জন্য কলকাতায় বাস করেছেন অনেক দিন, আমানুল হক তাঁরও ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্য পেয়েছেন। মারি সিটনের লেখা সত্যজিৎ রায়ের জীবনীতে আমানুলের দেওয়া অনেক তথ্যের উল্লেখ রয়েছে। পরবর্তী সময়ে আমানুল হক ঢাকা চলে আসার পর সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে তাঁর যেসব পত্রবিনিময় হতো, তাতে সত্যজিৎ প্রায়ই আমানুল হককে লিখতেন: ‘মারি সিটন এখনো তোমার কথা বলেন।’
এসব এবং আরও অনেক কিছুর বিবরণ রয়েছে এ বইতে। ভগ্নস্বাস্থ্যে ৮৫ বছর বয়সে আমানুল হকের স্মৃতিশক্তি বিস্ময়কর। বইটি পড়ে বুঝতে কষ্ট হয় না, স্বভাবগতভাবেই তিনি এক স্মৃতিরক্ষক। চিঠিপত্র, ছবি, পুরোনো ভাঙা ক্যামেরা বা কোনো বাদ্যযন্ত্র, এমনকি সত্যজিতের চলচ্চিত্রে ব্যবহূত কোনো প্রপস—এমন অনেক কিছুই তিনি পরম যত্নে সংরক্ষণ করছেন বহু বছর ধরে। যেমন, কলকাতা থেকে স্থায়ীভাবে চলে আসার ১৮ বছর পরে আবার যখন কলকাতা বেড়াতে গিয়েছেন, সত্যজিতের বাড়ি গেলে বিজয়া রায় তাঁকে ‘তোমার শীত লাগছে না?’ বলে এনে দিয়েছিলেন সত্যজিতের এক জোড়া কটকি চাদরের একটি। আমানুল হক লিখেছেন: ‘দেশে ফিরে এসে শীতের সময় অল্প কিছুদিন পরার পর চাদরটি বাক্সে উঠিয়ে রেখে বাড়ির সবাইকে বললাম: “এ চাদরটি এখন আর আমি পরব না। মৃত্যুর পরে এই চাদরটি দিয়েই যেন আমার শবদেহ ঢেকে দেওয়া হয়”।’
প্রসঙ্গ সত্যজিৎ: ছবি ও কথা চলচ্চিত্রকার ও ব্যক্তি সত্যজিৎ রায়ের প্রতি আমানুল হকের এক গভীর শ্রদ্ধার্ঘ্য। এখন আমাদের কর্তব্য আমানুল হককে গভীর শ্রদ্ধায় সালাম জানানো।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, মার্চ ০৪, ২০১১
Leave a Reply