পৃথিবীতে এখনো যেসব প্রাচীন শিল্পরীতি প্রচলিত আছে তার মধ্যে চীনের শিল্পরীতি অন্যতম। ট্র্যাডিশনালি চৈনিক চিত্রকলাকে তিন ভাগে ভাগ করা যায়, নিসর্গ, ফুল-পাখি ও ফিগার। চৈনিক এই চিত্রকলা নিয়ে গ্যালারি চিত্রকে ২৫ ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হয়েছে এক প্রদর্শনী। চীনের বিখ্যাত তিন শিল্পী এ প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণ করেছেন। তাদের নাম অনুযায়ী এ প্রদর্শনীর নাম দেওয়া হয়েছে ‘মাউই (Mawei), শুয়েহা (Xuehe), জুলিনপিং (Zhou zinping) চাইনিজ পেইন্টিং এক্সিবিশন।’
প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণকারী মাউই চাইনিজ আর্টিস্ট অ্যাসোসিয়েশনের সদস্য। তিনি ট্র্যাডিশনাল চাইনিজ পেইন্টিং বিভাগ থেকে গ্র্যাজুয়েশন করেছেন। তাঁর ছবির বিষয়, ফুল-পাখি, অর্কিড, পাম ব্লসম, ক্রিসেনথিমাম, বাঁশ ইত্যাদি। এর প্রতিটিরই আলাদাভাবে প্রতীকী তাৎপর্য রয়েছে। যেমন, বাঁশ সোজা বলে তা চারিত্রিক ঋজুতাকে বোঝায়, কিন্তু বাঁশ, ছোট ঝোপ এবং পাইনগাছকে একত্রে শীতকালের তিন বন্ধু মনে করা হয়। আবার অর্কিড, বিনয়ী ফুল শিল্পীর সততাকে নির্দেশ করে। শিল্পীর আঁকা বর্ণিল গুচ্ছ গুচ্ছ ফুলের ছবিগুলো চার ঋতুর ফুলের প্রতীক। বিষয়গুলোর সঙ্গে শিল্পীর অনুভূতি, আদর্শ ও ধারণা যুক্ত থাকে।
শিল্পী শুয়েহা নিসর্গশিল্পী। চীনা নিসর্গ শিল্পে পাহাড় একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। পাহাড় দীর্ঘ জীবনের প্রতীক। শিল্পী শুয়েহার বিষয়বস্তু এই পাহাড় নিয়ে। ছবিগুলো তিনি ব্লু অ্যান্ড গ্রিন এবং ইঙ্ক অ্যান্ড ওয়াশ দুটি পদ্ধতিতেই এঁকেছেন। ব্লু অ্যান্ড গ্রিন পদ্ধতিতে ছবিগুলোতে ব্লু, গ্রিন ও রেডের পিগমেন্ট ব্যবহার করেছেন। চার ঋতু (স্প্রিং, সামার, অটাম, উইন্টার) ছবিগুলোতে দেখা যায়, পাহাড়গুলো বার্ডস আই ভিউ থেকে আঁকা হয়েছে। এখানে ট্র্যাডিশনাল নিয়ম অনুযায়ী শিফটিং পারস্পেকটিভের ব্যবহার করা হয়েছে। ফলে দূরের পাহাড়গুলো দেখতেও কোনো সমস্যা হয় না। শিফটিং পারস্পেকটিভের ব্যবহার চীনা চিত্রকলার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। ফলে শিল্পীরা স্বাধীনভাবে নিজেদের চিন্তা প্রকাশ করতে পারেন। দূরের পাহাড়গুলোয় রঙের ব্যবহার নেই বললেই চলে। একদম শেষে সাদা স্পেস রাখা হয়েছে। সাধারণত এ সাদা অংশকে কুয়াশাচ্ছন্ন বোঝানো হয়। আধ্যাত্মিকতার প্রকাশ করতে ও সাধারণ জীবন থেকে আলাদা কিছু ভাবার প্রতি ইঙ্গিত দেওয়া হয়, উইন্টার ছবিটি ইঙ্ক অ্যান্ড ওয়াশ পদ্ধতিতে আঁকা হয়েছে। এখানে শুধু কালো লাইনের মাধ্যমে বরফাচ্ছন্ন বরফের পাহাড় আঁকা হয়েছে, ছবির সামনের দিকে কালো শেডের ব্যবহার করা হয়েছে।
শিল্পী জুলিনপিং তাঁর প্রতিটি ছবিরই ফিগার ড্রয়িং নাম দিয়েছেন। রীতি অনুযায়ী প্রতিটি ছবিতেই আছে ক্যালিওগ্রাফির ব্যবহার। ছবিগুলোতে শিল্পী নারী ও পুরুষের অনেকগুলো ফিগার এঁকেছেন, যা দেখলে মনে হয়, শিল্পী ছবিগুলোর মাধ্যমে কোনো গল্প বলছেন। ট্র্যাডিশনাল নিয়মে আঁকা ফিগারগুলোতে রঙের সীমিত ব্যবহার ও শুধু লাইনের মাধ্যমে ফিগারগুলোর কন্টুর আঁকা হয়েছে। ছবিগুলোর পেছনের স্পেস সাদা রাখা হয়েছে।
চীনাদের দর্শন হলো মানুষ প্রকৃতিকে নিয়ন্ত্রণ করে না বরং মানুষ ও প্রাণিকুল প্রকৃতিরই অংশ। আর একজন শিল্পীর আনন্দময় কাজ হলো এই প্রকৃতিকে উপস্থাপন করা। প্রকৃতিকে যেহেতু স্থান-কালের মধ্যে সীমিত রাখা যায় না, তাই চীনা শিল্পীরা প্রকৃতিকে নির্দিষ্ট কোনো ফ্রেমে বন্দী করার চেষ্টা করেননি। তাই তাঁদের ছবিতে পারস্পেকটিভ বা নির্দিষ্ট জ্যামিতিক ছকে কাজ করার প্রবণতা নেই। তাঁদের প্রকৃতি হয় অনেক বেশি কল্পনানির্ভর। তাঁরা সব সময় এমন একটি শান্তিময় জায়গা বা ছবি আঁকতে চেয়েছেন, যা দেখলে একজন শান্তি পাবেন এবং প্রকৃতির নির্জন সান্নিধ্য লাভ করবেন। প্রদর্শনীতে শিল্পীরা সে চেষ্টাটিই করেছেন। দর্শকেরা এ প্রদর্শনীতে গেলে সে অনুভূতি পেলেও পেতে পারেন।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, মার্চ ০৪, ২০১১
Leave a Reply