উর্দু থেকে ভাষান্তর: জাভেদ হুসেন
[এলিস ফয়েজ (১৯১৪-২০০৩ খ্রি.) ইংরেজ বংশোদ্ভূত কবি, রাজনৈতিক কর্মী, সাংবাদিক, শিক্ষক, মানবাধিকার সংগঠক। ফয়েজ আহমেদ ফয়েজের স্ত্রী হিসেবে বেশি পরিচিত। ১৯৩০ সালে ফয়েজকে বিয়ে করেন। লন্ডনে জন্ম, ১৬ বছর বয়সে ব্রিটিশ কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দেন। ইংল্যান্ডে থাকাকালেই ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলনের সপক্ষে কাজ শুরু করেন।এই লেখাটি তাঁর ‘য়াদ কি সায়ে’ নামে স্মৃতিকথার ভাষান্তর]
স্মৃতির ছায়া
২৪ বছর ধয়ে যে আমার শিরায় রক্তপ্রবাহের মতো আপন হয়ে থেকেছে, যে আমার জীবনসঙ্গী…তাঁর সম্পর্কে নিরাবেগ হয়ে কিছু বলা কি সম্ভব?
ফয়েজকে নিয়ে লেখার বেলায় কত স্মৃতি অলৌকিক ঘটনার মতো হূদয়ের আঁচল টেনে ধরে…তবে যখন ভাবি ‘কী লিখব’…পেছন ফিরে তাকাই…আমার দৃষ্টি কারাগারের দরজা হয়ে আমার কাছেই ফিরে আসে। জেলখানার বছরগুলো আমাদের জীবনে কখনো দুঃস্বপ্নের মতো বলে মনে হয়। এই বছরগুলোই আমাদের দুজনকে যা দিয়েছে, তা অন্য কোনোভাবে কি পেতাম? এই কয়েক বছর আমাদের হামাগুড়ি দেওয়া মেয়ে হাঁটতে শিখল, দেখতে দেখতে যৌবনের চৌকাঠে পা রাখল। এই বছরগুলোতেই জীবন কত বাঁক নিল! আমাদের কালো চুলে হালকা তুষারের মতো বার্ধক্য ঝরে পড়ল, কারোর চেহারায় বলিরেখা ধীরে ধীরে জাল বুনে গেল।
মার্চের এক সকালে ফয়েজ যখন আমাকে আর ঘুমন্ত বাচ্চাদের বিদায় জানাল, তখন প্রথমেই আমার মাথায় একটা চিন্তা এল—মাসে মাত্র ৪০০ টাকা দিয়ে কী করে সংসার চালাব? শফিউল্লা ছাড়া বাকি পুরোনো পরিচারকদের বিদায় দেওয়া হলো। শফিউল্লা এখনো আমাদের সঙ্গে আছে। ফয়েজের অনুরক্ত সৎবোন বালী আমাদের সঙ্গে থাকতে লাগল; বদলে যাওয়া প্রতিকূল দিনগুলোতে একজন সঙ্গী পেলাম। প্রথম আঘাত লাগল আমাদের বাচ্চাদের ওপর। কুইন মেরি কলেজ থেকে তাদের নাম কাটিয়ে টমসন স্কুলে ভর্তি করাতে হলো। এ সিদ্ধান্ত যে বাচ্চাদের ওপর কতটা প্রভাব ফেলেছিল, সে কথা বুঝেছি পরে। মুনিজা প্রায়ই আমায় বলত, ‘বাবা যখন এখানে ছিল, আমার একজন আয়া ছিল, স্কুলে দোলনা ছিল, খেলনা ছিল।’ নতুন ঘরে তাকে মেঝেতে বসতে হতো। তবে এর মাঝেই ওর মনোজগতে যেন আশ্চর্য এক পরিবর্তন এল। প্রতি রাতে ঘুমোতে যাওয়ার আগে মেঝেতে হাঁটু গেড়ে অনুপস্থিত বাবাকে ও উর্দুতে আমার বিরুদ্ধে নালিশ জানাত। একদিন সে এমনি করে সব ভুলে নালিশ করছিল, আমি অপেক্ষা করে আছি ওকে ঘুম পড়ানোর জন্য। মুনিজা বলে উঠল, ‘আসমানি বাবা, তুমি হায়দরাবাদে আর কত দিন থাকবে, তাড়াতাড়ি ফিরে এসো।’ আমি বহু কষ্টে হাসি চেপে ওর বাকি নালিশ শুনে যখন ঘুম পাড়াতে নিয়ে গেলাম, শুনি আধো ঘুমে আমার মেয়ে বিড়বিড় করে বলছে—‘বাবা, খুব তাড়াতাড়ি সব ঠিক হয়ে যাবে।’
বহুদিন অপেক্ষার পর ফয়েজের সঙ্গে দেখা করার অনুমতি পাওয়া যেত। প্রতিটা দেখার স্মৃতি আমি বুকে আগলে রাখতাম।
ফয়েজ বন্দী হওয়ার তিন মাস পর দুই মেয়ে নিয়ে আমি ওকে দেখতে লায়ালপুর জেলে গেলাম। আমাদের সুপারিনটেনডেন্টের কামরায় নিয়ে যাওয়া হলো। তিনি আমাদের নাম জানতে চাইলেন, বললাম। তিনি আমাদের তিনজনের দিকে তাকালেন। আমার এখন মনে হয়, আমাদের তখন বোধহয় খুব নিঃসঙ্গ, বিমর্ষ দেখছিল। আমাদের চেহারার হয়তো আমাদের জীবন ছায়া ফেলেছিল।
সুপারিনটেনডেন্ট বললেন, ‘আপনার দুই মেয়ে?’ আমি বললাম ‘হ্যাঁ’। ফয়েজ কামরায় ঢুকতেই মেয়েরা ছুটে ওকে জড়িয়ে ধরল। মুনিজা বিড়বিড় করে বলল—‘বাবা, ওরা বলেছে তোমার হাত-পা ফেটে ফেলবে।’ ওরা কারা আমি আজও জানতে পারিনি। আমরা একসঙ্গে দুপুরে খাওয়ার অনুমতি পেলাম।
আমাদের অভাব বাড়ছিল, বহু প্রয়োজনীয় জিনিস আমরা হিসাব থেকে বাদ দিয়ে জীবন কাটানো শুরু করলাম। ফয়েজ ফিরে এসে রোজগার শুরু করা না পর্যন্ত এ অভাব কাটেনি। জনগণের শাসন ফিরে এল, ফিরে এল ফয়েজ। তখন মনে হলো—সে যেন কখনো এই ঘরের বাইরে ছিল না। এক দিনও না।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, মার্চ ০৪, ২০১১
Leave a Reply