রোকেয়া সুলতানা শিল্পী রোকেয়া সুলতানার কাজের মূল বৈশিষ্ট্য ছন্দোময় কম্পোজিশন আর উষ্ণ রঙের ব্যবহার। নারী ও প্রকৃতি তাঁর কাজের প্রধান বিষয়। আশির দশকে ম্যাডোনা সিরিজ এঁকে বিখ্যাত হয়েছিলেন এ শিল্পী। তাঁর বিখ্যাত কয়েকটি সিরিজ হলো জল, বায়ু, মাটি, সম্পর্ক।
রবীন্দ্রনাথ ও জীবনানন্দের কবিতা তাঁর কর্মের অনুপ্রেরণা। টেম্পারা, মিক্সড মিডিয়া, এক্রেলিকে তিনি বেশির ভাগ ছবি এঁকেছেন। ক্যানভাসে উজ্জ্বল রঙের ব্যবহার, ফোরগ্রাউন্ডের সঙ্গে ব্যাকগ্রাউন্ডের প্রভেদের অনুপস্থিতি, ছন্দোময় রেখার মাধ্যমে ফিগারের উপস্থাপন শিল্পীর কাজে এনে দিয়েছে নিজস্ব বৈশিষ্ট্য। তাই কাজের ভিড়েও তাঁর কাজকে আলাদাভাবে শনাক্ত করা যায়।
ক্যানভাসকে শিল্পী তুলনা করের তাঁর ব্যক্তিগত ডায়েরির সঙ্গে। কারণ তাঁর প্রতিদিনকার আবেগ আর অনুভূতিরই রূপদান করেন তাঁর শিল্পকর্মে। নিজের শিল্পকর্ম সম্পর্কে তাঁর বক্তব্য হলো ‘আমি আমার শিল্পকর্মকে নির্দিষ্ট কোনো শিল্প আন্দোলনে অন্তর্ভুক্ত করতে চাই না বরং বিশুদ্ধভাবে নিজস্বতা বজায় রাখতে চাই।’
সমকালীন বাস্তবতা নারীর আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটে তাঁর শিল্পকর্মে।
‘ধরণী’ নামের চিত্রকর্মটি তিনি সম্প্রতি এঁকেছেন। এখানে বিশাল ক্যানভাসে একটি নারী-ফিগারকে চিত্রায়িত করেছেন, যার শরীরের বিভিন্ন অংশ ওয়ার্ডরোবের ড্রয়ারে ভাগ করা, ফিগারটির পাশেই একটি কালো রঙের চেয়ার।
ছবিটি নিয়ে শিল্পী তাঁর নিজস্ব ভাবনা সম্পর্কে বলেন, মেয়েরা সামাজিক ও পারিবারিকভাবে ছোটবেলা থেকেই থাকে বঞ্চিত। তারা তাদের কথা, চাওয়া-পাওয়া সব সময় প্রকাশ করার সুযোগ পায় না। তাই তাদের অবদমিত গোপন ইচ্ছাগুলো লুকিয়ে থাকে তাদের মনের নিভৃত কোণে। দৈনন্দিন কাজে ব্যবহূত ড্রয়ারে আমরা যেমন আমাদের জিনিসপত্র গুছিয়ে রাখি, তেমনি মেয়েদের এই গোপন ভালো-মন্দ আকাঙ্ক্ষাগুলোও তারা লুকিয়ে রাখে মনের এক একটি কোণে। আর পাশের চেয়ারটি হয়তো বা কেউ আসবে বা তাদের আত্মিক মুক্তিকে আহ্বান করবে, এরই প্রতীক।
শিল্পী তাঁর প্রিয় রং লাল আর হলুদ ব্যবহার করে ছবিটি এঁকেছেন। তাঁর সংবেদনশীল সত্তার প্রকাশ ঘটেছে ছবিটিতে। এই ছবির ধারাবাহিকতায় আরও ছবি আঁকবেন বলে তিনি জানান।
বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে নারীর অবস্থান নিয়ে শিল্পী উদ্বিগ্ন। বিশেষ করে ইভ টিজিং এবং এর শিকার মেয়ে ও তাদের আত্মীয়স্বজনের দুর্ভোগ নিয়ে শিল্পী মর্মপীড়ায় ভোগেন। এ বিষয়ে তিনি মানুষের সচেতন হওয়া দরকার বলে মনে করেন। পরবর্তী সময়ে এ বিষয় নিয়ে ধারাবাহিকভাবে কাজ করবেন বলে ভাবছেন।
শিল্পী রোকেয়া সুলতানার জন্ম চট্টগ্রামে ১৯৫৮ সালে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ থেকে ১৯৮০ সালে বিএফএ ডিগ্রি লাভ করেন। কলকাতার বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ছাপচিত্রে এমএফএ ডিগ্রি লাভ করেন। বর্তমানে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের ছাপচিত্র বিভাগে শিক্ষকতা করছেন। রোকেয়া সুলতানা প্রথম নারী শিল্পী, যিনি ১৯৯৯ সালে এশিয়ান বিয়ানালে পুরস্কার লাভ করেন।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, ফেব্রুয়ারি ২৫, ২০১১
Leave a Reply