শৈশবে যাঁরা পিটার প্যান পড়েছেন, জে এম ব্যারি তাঁদের কাছে আন-বাড়ির কেউ না। পিটার প্যানের একটা কমিকসের বই অনেক দিন আগে পড়েছিলাম। এর শুরুর লাইনগুলো বোধ হয় ছিল এ রকম:
‘এক যে ছিল দেশ। অনেক দূরের দেশ। সে দেশে কক্ষনো রাত হয় না। সবসময় ঝকঝকে দিন। সারাক্ষণ আকাশ নীল। আর সে দেশেই বাস করে পিটার প্যান আর টিংকার বেল।’
পিটার প্যান কী রকম? খুবই ফাজিল ধরনের ছেলে। জাদুবলে তার বয়স থেমে গেছে। এই চিরবালক বাস করে ‘নেভারল্যান্ড’ বলে একটা কল্পনার জগতে। তার একটা গ্যাং থাকে, ‘লস্ট বয়েজ’ নামে। সাদামাটা লোকের সঙ্গে তার কাজকর্ম খুব অল্প। দুটো-একটা মৎস্যকন্যা বা জলদস্যু না দেখে সে সকালে নাশতা করে না।
জে এম ব্যারির প্রধান কীর্তি এই পিটার প্যান। ব্যারির আরেকটি কীর্তি আছে, যার কথা অনেকেই জানে না। ১৮৮৭ সালে ব্যারি ইয়ারবন্ধুদের নিয়ে একটি ক্রিকেট ক্লাব করেছিলেন। ক্লাবের নাম খুবই অদ্ভুত—‘আল্লাহআকবরিজ সি সি’ (১৮৮৭-১৯১৩)। এই ক্লাবে যাঁরা খেলতেন, তাঁরা প্রায় সবাই সাহিত্যে রাঘববোয়াল। তবে ক্রিকেট মাঠে চুনোপুটি। ফিল্মি কায়দায় কয়েকজনের পরিচয় দেওয়া যাক।
আর্থার কোনান ডয়েল: শার্লক হোমস-এর স্রষ্টা। আল্লাহআকবরিজ দলের সেরা ক্রিকেটার।
এইচ জি ওয়েলস: সায়েন্স ফিকশন জাঁর-এর জনক। পৃথিবীর সেরা লেখকদের একজন।
জেরোম কে জেরোম: বিখ্যাত ট্রাভেলগ থ্রি মেন ইন এ বোট-এর লেখক।
পি জি উডহাউস: কড়া হিউমারের ব্রিটিশ লেখক। অনেক সিরিয়াস লেখক তাঁর ভক্ত। ক্রিকেট নিয়ে এন্তার লিখেছেন। তাঁর সেরা ক্রিকেট রচনাগুলো নিয়ে একটা সংকলন বেরিয়েছে। নাম উডহাউজ অ্যাট দ্য উইকেট।
খেলোয়াড়দের সবাই বোধ করি খ্রিষ্টান। অথচ দলের নাম আল্লাহআকবরিজ। বেশ ধন্দ লাগার মতো ব্যাপার। ১৮৯০ সালে ঘরোয়াভাবে ব্যারি আল্লাহআকবরিজ সি সি নাম দিয়ে একটি চটিবই বের করেছিলেন। বইয়ের বরাতে জানা যাচ্ছে, দুজন পণ্ডিতের বুদ্ধিতে তিনি এই নাম রেখেছিলেন। এই দুজনের মতে, ‘আল্লাহ আকবর’ কথাটার মানে হয় ‘খোদা, রক্ষে করো!’ (আসল অর্থ: আল্লাহ মহান)। এ রকম নাম দেওয়ার পেছনের কারণ অনুমান করা শক্ত নয়। মাঠে এদের যেমন দশা হতো, তাতে এই নামই আদর্শ। কিন্তু অনুবাদ হিসেবে এটা স্থূল রকমের ভুল। প্রাচ্য সম্পর্কে কিছুই না জেনে এক্সোটিক ওরিয়েন্ট কল্পনা ও যাপনের যে রীতিকে এডওয়ার্ড সাইদ ‘ওরিয়েন্টালিজম’ বলেছেন, এটা তার খুবই স্থূল একটা রূপ।
২.
জে এম ব্যারির ক্লাবের প্রথম ম্যাচের বয়ান শোনা যাক। শেয়ারের সারে পল্লিতে তাঁর দল নিমন্ত্রণ পেয়েছে। দলের সবাইকে নিয়ে তিনি ট্রেনে উঠেছেন। খুবই উত্তেজনা বিরাজ করছে। ব্যারি ঘুরে ঘুরে সতীর্থদের সঙ্গে কথা বলছেন। সবাই খুবই চাঙা। একজনকে দেখা গেল উত্তেজনায় বসে থাকতে পারছেন না। গ্লাভস পরা হাতে ব্যাট নিয়ে একমনে প্র্যাকটিস করছেন। ব্যারির বুক ভরে গেল। কত সিরিয়াস খেলোয়াড়দের নিয়ে তিনি খেলতে যাচ্ছেন। আরেকজন প্লেয়ারকে দেখে তাঁর কিছুটা মন খারাপ হলো। বেচারা খুবই কনফিউজ, ব্যাটের কোন দিক দিয়ে বল মারতে হয়, বুঝতে পারছেন না। স্টেশনে তাঁর একজন সতীর্থ রাতে শোবার পায়জামা পরে হাজির হয়েছেন। এটা নিয়েও তিনি কিছুটা ব্যথিত।
ট্রেন থেকে নামার পর তিনি বিপদ কিছুটা টের পেলেন। চলন্ত ট্রেনে যিনি ব্যাট ঘোরাচ্ছিলেন, তাঁর অবস্থা খুবই করুণ। মাঠে নামতে তিনি খুবই ভয় পাচ্ছেন। আগে কোনো দিন খেলেননি তো—এই জন্য।
ব্যারি তাঁর ক্লাবের জন্য নয়টি নিয়ম তৈরি করেছিলেন। প্রথম নিয়ম হলো, ‘খেলার আগে প্রতিপক্ষের মাঠে ভুলেও কখনো প্র্যাকটিস করা যাবে না। কারণ এতে আর তো কিছু হবে না, শুধু প্রতিপক্ষের কনফিডেন্স বাড়বে। এটা হতে দেওয়া যায় না।’
প্রতিপক্ষ আগে ব্যাট করতে নামল। সঙ্গে সঙ্গে ঝড় শুরু হয়ে গেল। দেখা গেল, ফিল্ডাররা প্রাণপণে বলের পেছনে ছুটছে, আর বৃষ্টির মতো চার-ছয় হচ্ছে। সারা দিন এই নির্মম পেটানি চলতে লাগল। পরের দিকে স্কোরাররা হতাশ হয়ে রান গোনা বন্ধ করে দিলেন। এমন বেকায়দাভাবে রান হচ্ছে, গুনে লাভ কি! ব্যারির একজন সতীর্থ খুব জনপ্রিয় হয়ে গেল। খেলা শুরু হতেই দেখা গেল: ওভার শেষে আম্পায়ার বলছেন—ওভার, উনি সঙ্গে সঙ্গে মাঠ থেকে বেরিয়ে যাচ্ছেন। অনেক বুঝিয়ে-সুঝিয়ে তাঁকে ফেরত আনতে হলো—খেলা শেষ হয়নি তো, ওভার শেষ হয়েছে।
ব্যারির দল খুব একটা সাফল্য দেখাতে পারল না। তাঁরা এগারোজন মিলে স্কোর করলেন সাকল্যে চৌদ্দ! এই খেলা নিয়ে ব্যারি পরে তাঁর বইতে লিখেছেন, ‘আমরা হয়তো জিততে পারিনি, কিন্তু আমরা মানসম্মান বাঁচিয়েছি, এটাই বড় কথা।’ খেলা শেষে অধিনায়ক বললেন, জয়-পরাজয় বড় কথা নয়। প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণই বড় কথা। আমরা ক্রিকেট খেলি, কারণ আমরা ক্রিকেট ভালোবাসি। একজন টিমমেটের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করে বললেন, ‘প্রথম ইনিংসে তুমি তো দারুণ খেলেছ। চমৎকার সিঙ্গেল নিয়েছিলে। দ্বিতীয় ইনিংসে তুমি অত ভালো অবশ্য করতে পারোনি।’ ব্যারির নিজের খেলোয়াড়ি-জীবনে সবচেয়ে বড় বিপর্যয় ঘটেছিল ১৮৯৭ সালে। ব্রডওয়ে পল্লির বিরুদ্ধে খেলতে গেলে আমেরিকান অভিনেত্রী ম্যারি অ্যান্ডারসন তাঁকে ক্লিন বোল্ড করেন। এই দুঃখ তিনি কোনো দিন ভুলতে পারেননি।
ব্যারির উচ্চতা ছিল খুবই অল্প। পাঁচ ফুট তিন। আর্থার কেনান ডয়েল ছিলেন ঝাড়া ছয় ফুট লম্বা। ডয়েলের পাশে তাঁকে বেশ হাস্যকর দেখাত। ব্যারি দেখতে কিছুটা ছেলেবেলার কার্তিকের মতো ছিলেন। তাঁর মাথার চুল পরিপাটি করে আঁচড়ানো। মুখে কিশোর বয়সের আদল ঘোচেনি, নাকের নিচে দশাসই গোঁফে বেশ ইঁচড়ে পাকা দেখাত। অনেক বছর পর তাঁর সম্পর্কে ফিলিপ কার লিখেছেন, ‘ব্যারিকে দেখলে এই কথাটা মনে আসবে সবার শেষে যে উনি ক্রিকেটারও হতে পারেন। তিনি খুবই খাটো, দেহের গড়ন নাজুক আর সংবেদনশীল মানুষ। চলাফেরায় খুবই আনাড়ি। তাঁর চেহারায় অ্যাথলেটের কোনো ছাপই ছিল না।’
জে এম ব্যারি সম্পর্কে একটা কথা জানা দরকার। তাঁর বয়স যখন ছয়, তখন তাঁর বড় ভাই ডেভিড মারা যান। এতে তাঁর মা খুব ভেঙে পড়েন। ব্যারিকে তখন ভাইয়ের ভূমিকায় অভিনয় করতে হয়। ছোটবেলায় তিনি ডেভিডের জামাকাপড় পরে ঘুরতেন। তার মতো শিস বাজানো শিখেছিলেন। ব্যারি তাঁর আত্মজীবনীতে লিখেছেন, ‘একদিন মায়ের ঘরে ঢুকছি। মা প্রশ্ন করলেন, বাবা আসছ? আমি বুঝতে পারলাম, কার কথা জিজ্ঞেস করছেন। খুবই অনুচ্চ এবং একাকী গলায় মাকে বললাম, না মা। সে আসে নাই। আমি আসছি।’
অনেকের ধারণা, শৈশবের এই ট্রমা থেকে তাঁর মানসিক বামনত্বের রোগটি হয়েছে। তাঁর শারীরিক বৃদ্ধি হয়নি। তাঁর পিটার প্যানের বয়স কখনো বাড়ে না। ডেভিডের মৃত্যুর পর মাও ভাবতেন, তাঁর মৃত ছেলে চিরকাল একজন বালক থেকে যাবে। কখনই বড় হবে না। তাঁকেও ছেড়ে যাবে না।
আল্লাহআকবরিজ সি সির খেলাধুলার রেকর্ড খুবই শোচনীয়। অধিকাংশ ম্যাচেই তারা গো-হারা হেরেছে। তাতে ব্যারির উৎসাহে কোনো উনিশ-বিশ হয়নি। তিনি ক্রিকেট খেলতেন ক্রিকেট ভালোবাসেন বলে। অন্য কোনো হাউশ তাঁর ছিল না।
এই ক্লাবের শেষ কয়েকটি পৃষ্ঠা খুব করুণ। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে তাঁর দলের কিছু তরুণ খেলোয়াড় নিহত হলেন। ১৯১৫ সালে মাত্র ২১ বছর বয়সে জর্জ লিওলিন ডেভিস মাথায় গুলিবিদ্ধ হয়ে খুন হলেন। ব্যারি এই ছেলেটাকে খুব ভালোবাসতেন। পিটার প্যান সৃষ্টির ক্ষেত্রে জর্জ ডেভিস একটি প্রধান অনুপ্রেরণা ও মডেল ছিল। যুদ্ধ যখন শেষ হলো, তখন দেখা গেল অনেকেই নেই। সময় অনেক বদলে গেছে। আর কখনোই আল্লাহআকবরিজ সি সি ক্লাবটি মাঠে খেলতে নামেনি।
গত বছর কেভিন টেলফার ব্যারির এই দলটি নিয়ে একটি বই লিখেছেন—পিটার প্যানের প্রথম একাদশ। ব্যারি সম্পর্কে অনেক গুরুত্বপূর্ণ কথাবার্তা এই বইতে পাওয়া যায়। যে বিশ্বে আমরা বাস করছি, সেখানে গ্রামের সঙ্গে সম্পর্ক চুকে-বুকে গেছে। ক্রিকেটের মধ্য দিয়ে ব্যারি ওই সম্পর্ক হাতড়ে বেড়াতেন। ব্রিটিশ সমাজে জাতে ওঠার একটা চাপা আগ্রহ ছিল তাঁর মধ্যে। সেদিক থেকেও তিনি ক্রিকেটের ওপর ভরসা করেছিলেন।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, ফেব্রুয়ারি ২৫, ২০১১
Leave a Reply