স্টারি নাইট পাবলো পিকাসোর সঙ্গে ভিনসেন্ট ভ্যান গঘের কখনো দেখা হয়নি। স্প্যানিশ চিত্রকর প্রথম ওলন্দাজ মাস্টার পেইন্টারের ছবি দেখেন ১৯ বছর বয়সে, প্যারিসে ব্যক্তিমালিকানাধীন সংগ্রহশালায়। কিন্তু দুজনকে ঘিরে প্রচলিত ঐতিহাসিক ঘটনাবলি পর্যালোচনা করলে এটা সহজেই অনুমান করা যায়, তাঁদের দুজনের মধ্যে দেখা হলেও কখনোই বন্ধুত্ব হতো না। ভ্যান গঘ গভীরভাবে দুর্জ্ঞেয় নিঃসঙ্গ, অনিশ্চিত এক লোক। অন্যদিকে পিকাসো জন্মগতভাবেই দৃঢ়চেতা, আত্মবিশ্বাসী এক নেতা। কাজেই কারও পক্ষেই কাউকে মানিয়ে চলা সম্ভব হতো না। কিন্তু মৃত্যুর পর তাঁরা পরস্পরের মুখোমুখি হয়েছেন আন্তর্জাতিক চিত্রকলার বাজারে। এখানে সর্বোচ্চ দামে বিকিয়েছে তাঁদের শিল্পকর্ম। এ দুজনই বিশ্বের বড় বড় জাদুঘরে দর্শনার্থীদের আগ্রহের মূল হিসেবে যৌথভাবে ভাগাভাগি করে নিয়েছেন প্রথম ও দ্বিতীয় স্থানটি।
বিশ শতকের প্রথম দিকের ভ্যান গঘের স্টারি নাইট সিরিজের ছবিগুলোর সঙ্গে কি নীতিগতভাবে, কি নান্দনিকভাবে পিকাসোর মন্তামার্তেতে আঁকা পোর্ট্রেটগুলোর অবশ্য মিল খুঁজে পাওয়া যায়। আর এই সদৃশ্যকে বিষয়বস্তু করেই আমস্টারডামের ভ্যান গঘ মিউজিয়ামে শুরু হয়েছে নতুন এক প্রদর্শনীর, যার নাম দেওয়া হয়েছে প্যারিসে পিকাসো (১৯০০-১৯০৭)। জুনে আবার এই প্রদর্শনী স্থানান্তরিত হবে বার্সেলোনার পিকাসো জাদুঘরে।
প্রদর্শনী উন্মুক্ত হয়েছে যে ছবিটি দিয়ে, তাতে ঘোষিত হচ্ছে পিকাসোর প্রথম আত্মপ্রকাশের সদর্প বার্তা: এটি পিকাসোর আঁকা একটি আত্মপ্রতিকৃতি, যা তিনি এঁকেছিলেন প্যারিসে, ১৯০৬ সালে। দর্শনার্থীদের জন্য প্যারিসে আগত সদ্য যুবক পিকাসোকে বোঝার জন্য এই শিল্পকর্মটির দারুনভাবে আদর্শ।
ছবিতে পিকাসো নীল প্যান্টের সঙ্গে ভি-গলার লম্বা হাতার জামা পরে আছেন। ডান হাত পকেটে ঢোকানো, দৃঢ়বদ্ধ চোয়ালের এক তরুণ, যাঁর চোখেমুখে জ্বলছে উল্কার মতো তীব্র দীপ্তি, অকুতোভয় চোখে সাফল্যের বার্তাও স্পষ্ট, যে সব রকম বাধাকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেওয়ার জন্য তৈরি। এই বর্ণনা বিখ্যাত শিল্প-ঐতিহাসিক ও চিত্র সংগ্রাহক দানিয়েল হেনরি কানভাইলারের (১৮৮৪-১৯৭৯)।
প্রদর্শনীর ৮০টি ছবির নির্বাচক বিশ্বখ্যাত পিকাসো বিশেষজ্ঞ ও বার্সেলোনা জাদুঘরের কিউরেটর মেরিলিন ম্যাকালি। তরুণ পিকাসোর প্যারিসে আগমনের পর থেকে প্যারিস অবস্থানের শেষ দিনের হিসেবে, ছবি আঁকার ধারাবাহিকতা রেখে সাজানো হয়েছে প্রদর্শনীর পেইন্টিংগুলো।
বিশ শতকের শুরুর দিকের চরম অস্থির সময়ে সদ্য যুবা পিকাসোর প্যারিসে আগমন, সেই সময়ে চারপাশের অস্থিরতার কাঁপনকে তিনি অপার কৌতূহলে বোঝার চেষ্টা করছেন—ফলে কম্পিত, আলোড়িত শিল্পী এ সময়ই চিত্রিত করেন ‘কানা গিটারঅলা’, ‘কাপড় ইস্ত্রিরত নারী’ আর ‘দুঃখভারাতুর নারীর ন্যুড’। তাঁর ছবিতে রাজনৈতিক বিষয় মূল হয়ে ওঠে আরও পরে, দু-তিন দশক বাদে।
তবে প্যারিসে পিকাসোর আগমন ঘটেছিল এক মুক্তবিহঙ্গ যুবক হিসেবে। নির্দ্বিধায় তিনি বার্সেলোনার প্রান্তীয়-চরিত্র, স্মৃতি সব পেছনে ঝেড়ে ফেলে প্যারিসে এসেছিলেন। কোনো রকম পিছুটান ছিল না তাঁর পরিবারের জন্য, পিছুটান ছিল না তাঁর ফেলে আসা জন্মভূমির জন্যও—সানন্দে তিনি এই স্বেচ্ছা-নির্বাসনকে গ্রহণ করেছিলেন।
কপর্দকহীন পিকাসোর আশ্রয় জোটে বার্তো-লাভোরে, সেখানে শোচনীয় দৈন্যদশার এক স্টুডিওতে অন্য শিল্পীদের সঙ্গে ভাগাভাগি করে কাজ শুরু করেন তিনি। এ সময় তাঁর সঙ্গী ছিলেন প্রেমিকা, চিত্রশিল্পী ও মডেল ফেরনান্দে অলিভিয়ের। পিকাসোর প্রথম প্রেমিকা তিনি, পিকাসোর রোজ-পিরিয়ডে (১১০৫-০৭) আঁকা অনেক ছবির মডেলও ছিলেন তিনি।
পিকাসোর আঁকা এই সময়ের বিভিন্ন পোর্ট্রেটে সেই সময়কার বাধাবন্ধনহীন জীবন যাপন, তাঁর পারিপার্শ্বিক রাস্তার অ্যাক্রোব্যাট—সব মূর্ত হয়ে উঠেছে। এই পর্বে এসে তাঁর শুরুর দিকের বিষণ্ন নীল রঙের ব্যবহারও ক্রমশ বদলে হয়ে যায় গোলাপি।
এই প্রদর্শনীর অধিকাংশ ছবি ধার হিসেবে নিয়েছে বার্সেলোনা জাদুঘর আর এই জাদুঘরের প্রধান পোপ সেররার বক্তব্য হলো, এই স্বল্প পরিচিত ছবিগুলোর সবচেয়ে মজার দিক হলো এতে খুঁজে পাওয়া যায় এমন এক পিকাসোকে, যাঁর আবির্ভাব ঘটেছিল প্যারিসে এক স্পণমানব হিসেবে, যে তাঁর চারপাশের সবকিছুকে প্রবলভাবে নিজের মধ্যে টেনে নিতে, শুষে নিতে প্রস্তুত, যাঁর সঙ্গে পরবর্তী ইস্পাতকঠিন পিকাসোর কোনোই মিল নেই। ‘এ সময়ে যাঁর যাঁর ছবি তাঁকে অনুপ্রাণিত করেছে, তাঁদেরকেও তিনি অনুকরণ করেছেন বিনা দ্বিধায়। ফলে কোনো ছবি তিনি পুরো অনুকরণ করেছেন, কোনোটি আবার নিজের মতো করে সম্পাদনা করেছেন। মোটকথা, প্যারিসের যা কিছু সে সময়ে তাঁর নজর কেড়েছে, সবই তাঁর ক্যানভাসে স্থান পেয়েছে। তিনি হুবহু সিজানের মতো ছবি এঁকেছেন, ছবি এঁকেছেন ভ্যান গঘ আর রেনোয়াকে অনুকরণ করেও…পরে সবকিছু তিনি তাঁর মতো করে পুনর্নির্মাণ করেছেন।’
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, ফেব্রুয়ারি ২৫, ২০১১
Leave a Reply