পরশপথ
কাজল রশীদ
পেরিয়ে এলাম অন্তবিহীন পথ—সারওয়ার আলী
নভেম্বর ২০১১\ প্রথমা\ ৩৬৭ পৃষ্ঠা\ মূল্য: ৪০০ টাকা
নানা ভূমিকায় তিনি উন্মোচিত হয়েছেন। আত্মনিবেদন ও সম্পৃক্ত করেছেন শতভাগ। রূপের রূপকায়ন কাজ হলে বলতে হয়, একই অঙ্গে শতরূপ নয়, সহস্র কাজ। লঘু নয়, প্রতিটিই গুরুতুল্য। সারওয়ার আলী হলেন প্রণম্য সেই কর্মবীর। তাঁর যাপিত জীবনের ঘটনাগুলো সম্প্রতি মলাটবন্দী হয়েছে।
পেরিয়ে এলাম অন্তবিহীন পথ বইয়ে মিলেছে তাঁর শত সহস্র কাজের চুম্বকীয় অংশ। উপসংহার ও তিন অংশবিভাজ্য পরিশিষ্ট ছাড়া পরিচ্ছেদ রয়েছে মোট ১৯টি। এ সবের ঘটনা, সময় ও পরিপ্রেক্ষিতের ঐতিহাসিক গুরুত্ব অনন্য। এক পিচ্চির কাহিনি, ভাষা আন্দোলন প্রসঙ্গ, আমার জীবনের স্বর্ণযুগ: ছাত্র আন্দোলন, সমাজ পরিবর্তনে সংগঠনে, ঊনসত্তরের গর্ব অভ্যুত্থান থেকে নির্বাচন, মুক্তিযুদ্ধ, একাত্তর থেকে পঁচাত্তর, পঁচাত্তর-পরবর্তী দুঃসময়, বিএমএ জীবন, পেশাজীবী আন্দোলন, ছায়ানট, রবীন্দ্রসংগীত সম্মিলন পরিষদ, পরমাণু অস্ত্রবিরোধী চিকিৎসক সংগঠন, চাকরি জীবন-ফাইজার, চাকরি জীবন: রেনাটা ও শিল্প বাণিজ্য সংস্থা, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর, ইন্টারন্যাশনাল কোয়ালিশন অব সাইটস অব কনসিয়েন্স, সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম ও বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতি।
জোয়ার-ভাটা, কান্না-হাসি প্রকৃত ও মানুষের জন্য ধ্রুব সত্য। দেশ ও জাতির ললাটেও এই সত্য উদিত-অস্তমিত হয়। কোনো কোনো সময় থাকে নির্মাণের, প্রস্তুত হওয়ার।
গাঙ্গেয় বদ্বীপবাসী বাঙালির যোজন যোজন সময়ের কালপর্বে যূথবদ্ধ হওয়া, চেতনায় শাণিত হওয়ার সময় হলো পঞ্চাশ ও ষাটের দশক। যার স্বর্ণশস্য হলো সত্তরের দশকের প্রারম্ভে অর্জিত বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা সংগ্রামের বিজয়।
বিশ্বমানচিত্রে লাল-সবুজের পতাকাশোভিত স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়। যাঁদের কর্মসৃজন ও নৈপুণ্যে দুই দশকের দীর্ঘ পথ স্বর্ণপ্রভায় রঞ্জিত হয়েছে, তাঁদেরই একজন হলেন সারওয়ার আলী। তাঁর পেরিয়ে আসা পথই বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পথ। যার প্রতিটি ইঞ্চিতে রয়েছে অজস্র ঘটনা। উত্তাল সেই সময় যেমন কতিপয় সংগঠন, প্রতিষ্ঠান ও দলীয় পরিধির ভেতর-বাইরে উচ্চকিত মানুষের জন্ম দিয়েছে, তেমনি দিয়েছে নিভৃতচারী মানুষও।
ওই সময়ের বাম রাজনীতির সাফল্য-ব্যর্থতা নিয়ে অজস্র প্রশ্ন থাকলেও এ কথা স্বীকার্য যে, কতিপয় নির্লোভ, নিরহংকারী, আদর্শবান মানুষের জন্ম হয়েছে রাজনীতির ওই বোধিবৃক্ষ থেকেই, যাঁদের কেউ কেউ রাজনীতির মাঠে সফল না হলেও তার বাইরে সোনা ফলিয়েছেন। সংগঠন ও সংঘটনে রেখেছেন ঈর্ষণীয় ভূমিকা। প্রাতিষ্ঠানিকতার উৎকর্ষের হয়ে উঠেছেন আদর্শ ও অনিবার্য এক উদাহরণ। অনির্বাণ এই সত্যকে জানতে, বুঝতে ও উপলব্ধি করতে পেরিয়ে এলাম অন্তবিহীন পথ বইয়ের নিবিড় পাঠ প্রয়োজন; যেখানে সন্নিবদ্ধ হয়েছে ইতিহাসের গুরুত্ববহ ঘটনার বহুকৌণিক সত্যাসত্য। লেখকের পেরোনো পথ অদ্ভুতভাবে ইতিহাসের হাত ধরে এগিয়েছে। এ কারণে ইচ্ছা-অনিচ্ছা ব্যতিরেকে অনিবার্যভাবে এই পথ হয়ে উঠেছে ইতিহাসের পথ। আলোচ্য বই এ সত্যকেই বাঙ্ময় করেছে। ১৯৫২ থেকে শুরু হয়ে যার সমাপ্য ঘটেছে ২০১০ সালে। স্বাধীন বাংলাদেশের জ্যামিতির অতীত ইতিহাস-ঐতিহ্য-সংগ্রাম-প্রাতিষ্ঠানিকতা ’৫২, ’৫৪, ’৫৮, ’৬১, ’৬২, ’৬৫, ’৬৯, ’৭০ ও ’৭১ এখানে যেমন স্থান পেয়েছে, তেমন পেয়েছে অভ্যুদয়-পরবর্তী ঘটনা। ’৭২ থেকে শুরু হয়ে ’৭৫, ’৮১, ’৯০, ’৯১, ’৯৬, ২০০১, ২০০৭ প্রভৃতি ঘটনার মধ্য দিয়ে যার অগ্রগমন ঘটেছে। এ সবের বাইরে নতুন সৃজন ও সংগঠনে তিনি পালন করেছেন বহুমাত্রিক ভূমিকা।
যাঁর প্রতিটিই তাঁর নৈয়ায়িক পরশে হয়ে উঠেছে দেশ ও জাতির জন্য নক্ষত্রসম। লেখকের পেরোনো পথ তাই আমাদের ভালোলাগা-ভালোবাসায় ধন্য এক পথ। বাধা আর চুল বাঁধার কথা আমরা সবাই জানি। লেখকও সমরূপক। তিনি শুধু সফল সংগঠক নন, লেখকও। এ ধরনের বইয়ে গবেষণার সংযোগ আবশ্যম্ভাবী। কেননা এ পথ অনেকাংশেই গবেষক ও ঐতিহাসিকের পথ। এ সবের সহযোগ যথার্থভাবে না ঘটলে বড় ধরনের বিভ্রান্তির অবকাশ থেকে যায়। লেখক অনেকাংশেই উতরে গেছেন। যদিও নির্ভুল নয়। পরবর্তী সংস্করণে সংশোধনযোগ্য বিবেচনায় রেখে ছোট্ট দুটি বিষয়ে দৃষ্টিপাত করি।
চরাঞ্চলের মানুষ প্রতিনিয়ত প্রকৃতির সঙ্গে যুদ্ধ করে অদৃষ্টবাদী হয়ে পড়ে, কোনো সংবাদপত্র আসে না, রেডিও শোনে না এবং মূল ভূখণ্ডে কী ঘটছে, সে সম্পর্কে ন্যূনতম ধারণা রাখে না। (পৃষ্ঠা-৮৬)
এখানে আসে না-র সঙ্গে হবে যায় না। আর যদি শোনে না রাখতে হয়, তাহলে হবে রাখে না। অর্থাৎ সংবাদপত্র আসে না, রেডিও শোনা যায় না; কিংবা সংবাদপত্র রাখে না, রেডিও শোনে না। নিচের রাখে না-র ক্ষেত্রে একই বিষয় বিবেচনাযোগ্য।
একেবারে ছোট্ট হলেও এই ভুলটা যথেষ্ট পীড়াদায়ক। যেমন—নজরুলসংগীতশিল্পী, সাধারণ সম্পাদক খায়রুল আলম শাকিল নিয়মিত তত্ত্বাবধানে রয়েছেন; সঙ্গে পার্থ, সম্প্রতি পুনরায় যোগ দিয়েছেন প্রদীপ। সম্প্রতি শুরু হয়েছে ভাষার আলাপ কোর্স। ওয়াহিদুল ভাই নেই, মাথার ওপরে রয়েছেন মিনু আপা (সন্জীদা খাতুন), খুঁটিনাটি সব বিষয় তাঁর নজরে আসে। প্রকৃতপক্ষে হবে খায়রুল আনাম শাকিল। বইটিতে বিভিন্ন ব্যক্তির সংক্ষিপ্ত নাম কিংবা ডাক নাম ব্যবহার করা হয়েছে, যা ব্যক্তিকে শনাক্তকরণের ক্ষেত্রে বাধা ও বেগ পেতে হয়। এ ক্ষেত্রে সন্জীদা খাতুনের অনুরূপ হলে ভালো হতো। নিদেনপক্ষে বইয়ের শেষের দিকে ব্যবহূত সংক্ষিপ্ত নামেও পূর্ণ নামের একটি তালিকা দেওয়া উচিত ছিল।
পেরিয়ে এলাম অন্তবিহীন পথ বইটি লেখকের প্রচেষ্টায় প্রকাশিত হয়েছে। গ্রন্থস্বত্ব ও প্রকাশক হলেন সহধর্মিণী ডা. মাখদুমা নার্গিস। পরিবেশনে রয়েছে প্রথমা বইয়ের দুনিয়া। পরশ পাথরের নাম বহুল উচ্চারিত হলেও তার অস্তিত্বে আজও আমাদের কল্পদেশেই বিরাজমান। বাস্তবে আমরা পাথর না পেলেও পথের দিশা পেয়েছি। সেই পথ হলো সারওয়ার আলীর পেরিয়ে আসা পথ, যার যথার্থ নামকরণ হতে পারে পরশপথ। কেননা এই পথ আলোর পথ, দেশপ্রেমের পথ, মানুষের কল্যাণের পথ, প্রগতির পথ ইত্যাদি। যার এক নাম পরশপথ। যার দিশা ও দীক্ষার বীজমন্ত্র মেলে পেরিয়ে এলাম অন্তবিহীন পথ-এর বর্ণ-শব্দ-বাক্য-অনুচ্ছেদ ও পরিচ্ছেদজুড়ে।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, ফেব্রুয়ারি ২৫, ২০১১
Leave a Reply