একদিন রাতে কবি কুদ্দুস মোহনীয় বীণের বাজনা শুনল। পাড়ার ছেলেরা বসে বসে সিনেমা দেখছে। কবি কুদ্দুসের আর তর সইল না। সেও দেখতে গেল। ছায়াছবির নাম কাল নাগিনীর প্রেম। কাল নাগিনী মৌসুমীরে দেখে কবি কুদ্দুস কবিতার খাতা বগলে পুরে নর্তন-কুর্দন দেখতে লাগল। আর নাগরাজ ওমর সানি, আহা! কবি কুদ্দুস নিজেকে নাগরাজ ভেবে বসল। সেই ভাবনার চুলায় কয়লা ঢেলে দিল পাড়ার উঠতি বয়সী ছেলেদের বাংলা মদ। একজন তাকে কপিবর বলে ডাক দিয়ে এক কাপ বাড়িয়ে দিল। যেন কবি কুদ্দুস নাগ হয়ে গেছে, তেমনি কেউটে সাপের মতো কটমট চোখে তাকাল। যেন এখনই ছোবল মেরে দেবে। সেই ছেলেটি ভয় পেয়ে, আগের কথা থুক্কু দিয়ে তুলে নিয়ে বলল, ‘কবিবর, আপনার খেদমতে এক কাপ বাংলা মদ্য, পান করিয়া আমাদের ধন্য করুন।’ কবি কুদ্দুস খুশি হয়ে গেল। মাছের আঁশটে গন্ধের বাংলা মদ এক কাপ গিলে ফেলল। প্রথমে কবি কুদ্দুসের মুখের ভাব দেখার মতো ছিল। মুখটা এটম বোমার প্রভাবগ্রস্ত বিকৃত মুখের মতো বিকৃত হলো। পরে মুখে যখন বিটকা স্বাদের পরে ভালো স্বাদ লাগল, তখন সে আরেক কাপ চেয়ে বসল। চ্যাংড়া পোলা অবাক হলেও আরেক কাপ এগিয়ে দিল। তেলের পাঁচ লিটার পিপার মধ্যে ভরে আনা হয়েছে বাংলা। তাই কারও কম পড়ার সম্ভাবনা নেই। কবি কুদ্দুস একের পর এক কাপ গলায় ঢালে আর মুখ এটমীয় ভঙ্গিতে বিকৃত করে। তার চোখ টিভির পর্দায় স্থির। সেখানে মৌসুমী থুক্কু কাল নাগিনী ভরা যৌবনের দেহ উতলাইয়া নেচে যাচ্ছে। ক্ষণে সাপ হয়, ক্ষণে মানুষ হয়। কবি কুদ্দুস মোহিত হয়ে গেল। একে একে দশ কাপ গিলে ফেলল। তারপরও থামতে চায়নি সে, কিন্তু ছেলেরাই আর কবি কুদ্দুসকে মদ দিল না। তাতে অবশ্য সে গোস্সা করল না। সে নাগিনীকে দেখতে লাগল।
রাত গভীর হয়ে গেছে। আসমানে চান্দের বাত্তি জ্বলছে। কবি কুদ্দুস সেই আলোয় দেখতে পেল তার সামনে এক নাগিনী—কাল নাগিনী। সে দেখল কাল নাগিনী ফণা তুলে সামনে দাঁড়িয়ে আছে। তারপরে মানুষ হয়ে গেল। আহা! কী রূপ তার। দেখলেই বুকে তোলপাড় করে। হূৎ কম্প এক হাজার হয়ে যায়। মাথার রগ টনটন করে। কী সেই চোখের চাহনি! ‘আলিফ লায়লা’য় সিন্ধাবাদ যে নাগিনীর চোখে মালিকা হামিরার দ্বীপ দেখেছিল, সে রকম নাগিনীর চোখের গভীরে কী যেন আছে। কবি কুদ্দুস পাগল হয়ে গেল। কালনাগিনী তখন মুখে বিদ্রূপের হাসি হেসে পেছন ফিরে চলল আর গান গাইতে থাকল, ‘বন্ধু তুমি জানো না আমি তোমার চির সাথি, আমায় জানতে হলে কাছে এসো চলে, মিছে ভয় আর করো না, বন্ধু তুমি জানো না।’ তারপর নাগিনী ক্ষণে অদৃশ্য হয়, ক্ষণে দেখা দেয়। খিলখিল করে হাসে। কবি কুদ্দুসকে ছুঁয়ে যায়। কবি কুদ্দুস হাত বাড়ায়, সে মিলিয়ে যায়। নাগিনীর মাথায় নাগমণি ঝলমল ঝলমল করছে। আর ওপরে চান্দের বাত্তি নিচে নাগিনীর রূপের জ্যোতি— চক্ষু ঝলসে যেন যায় কুদ্দুসের। কালনাগিনী নাচতে লাগল। কবি কুদ্দুসও নাচতে লাগল। কোথা থেকে তার হাতে একটা বীণ এসে গেল। সেই বীণ বাজাতে লাগল সে। নাগিনী বীণের সুরে পাগল হয়ে গেল আর চোখে ক্রোধ এনে নাচতে লাগল। উথালপাতাল সে নাচ। নাগিনীর শরীরের বাঁকে বাঁকে যৌবনের আগুন। চোখে ক্রোধের আগুন। আর কী নাচ! আহা! যেন কামদেবের ফুলবানের মহা প্রলয়। নাচে-গানে-রমণে-সঙ্গমে চাঁদ ঢলে পড়ল। কবি কুদ্দুস ঘুমিয়ে পড়ল নাগিনীর সঙ্গে।
সকালে দেখা গেল কবি কুদ্দুস বোতল হাতে শুয়ে আছে আর তার পাশে শুয়ে আছে এক ঢোঁড়া সাপ। ব্যাঙ খেয়ে পেট ফুলিয়ে শুয়ে বিশ্রাম নিচ্ছে। কবি কুদ্দুসের পায়েও সাপের ছোবলের দাগ। মনে হয়, কবি কুদ্দুস পা চাপা দিয়েছিল।
সকালে কবি কুদ্দুসকে ধরে বাড়ি আনা হলো। দুপুরের দিকে তার ঘুম ভাঙল। চোখ দুটি লাল হয়ে আছে। শরীরও বেশ দুর্বল মদের প্রভাবে। মুখ থেকে বিশ্রী গন্ধ বের হচ্ছে। চোখ মেলেই কবি কুদ্দুস এখানে-সেখানে তাকাতে লাগল। চিৎ কার দিল, ‘কই, আমার নাগিনী কই, আমার কালনাগিনী কই!’ চ্যাংড়া পোলাপাইন হেসে উঠল। ভাবল, কাল রাতের বাংলামদি বাতিক এখনো নামেনি। তারা হাসাহাসি করে চলে গেল। কিন্তু কবি কুদ্দুস ফ্যালফ্যাল করে চারদিকে তাকিয়ে কাউকে যেন খুঁজতে লাগল।
তারপর থেকে দিন যায় রাত আসে, আর কবি কুদ্দুস রাইতে-বিরাতে শুধু নাগিনীকে খুঁজে বেড়ায়। বাংলা মদ গিলে। কাল নাগিনীর প্রেম দেখে। কিন্তু নাগিনী আর দেখা দেয় না। সবাই চিন্তিত হয়ে পড়ল। ওঝা ডাকা হলো, মোল্লাসাবকে ডাকা হলো। মোল্লাসাব পানি পড়া দিলেন। কাজ হয় না। ওঝা সরিষার তেল পড়া, মরিচ পুড়া—কত কিছু দিল কাজ হয় না! শেষে খরখরা দিয়ে পেটানো হলো কবি কুদ্দুসকে, তাও নাগিনী ছেড়ে যায় না। ওঝা-মোল্লা পরাস্ত হয়ে গেল। সবাই আফসোস করতে লাগল—ভালো একটা মানুষের কী হয়ে গেল, কপিবর, থুক্কু কবিবর আর কবিতা লেখে না। উদাস চোখে ফ্যালফ্যাল করে পথের দিকে তাকিয়ে থাকে। রাত হলেই পথে নামে। এভাবেই দিন যেতে লাগল।
একদিন কাঁধে কাপড়ের ব্যাগ ঝুলিয়ে কবি কুদ্দুস বাড়ি ছাড়ল। নদীর পার ধরে হাঁটতে লাগল। হাঁটতে হাঁটতে পথ ফুরায় না। নগর-বন্দর-গ্রাম পেরিয়ে গেল। যেতে যেতে চলে গেল একেবারে দক্ষিণের দেশে। এক দিন এক রাত হাঁটার পর সে এক গাছতলায় ঘুমিয়ে পড়ল। পেটে দানা পড়েনি। শুধুই নদীর জল পড়েছে। ঘুম ভাঙতে ভাঙতে দুপুর হয়ে গেল। হঠাৎ কানে এল মানুষের শোরগোল আর বীণের বাজনা। কবি কুদ্দুস ধড়ফড় করে উঠে গেল। দূর থেকে দেখল সাপের নাচ।
সাপের নাচ শেষ হলো। দুর্বল শরীরে সে ধীরে ধীরে সাপুড়েদের কাছে গেল। সাপুড়ের সরদার কবি কুদ্দুসকে দেখে জিজ্ঞেস করল, ‘কী গো বাপজান, কই থাকি আইছ, কার পোলা গো তুমি?’ কবি কুদ্দুস কী বলবে, খুব কষ্টে মুখে আনল, ‘আমি কবি, বহুত দূর থেকে আইছি।’ বলেই অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেল।
চোখে পানির ছিটা পড়তে জ্ঞান ফিরল কবি কুদ্দুসের। এক নৌকার ভেতরে শুয়ে আছে সে। খানিক দূরে কম্পমান কুপি। ওই আলোআধারিতেই দেখতে পেল মেয়েটিকে, চোখ আটকে গেল তার। বুক ধক করে উঠল; আরে, এই তো সেই চোখ, সেই রাতে যে চোখ দেখেছিল কবি কুদ্দুস। এই তাহলে সেই কাল নাগিনী! এই মেয়ের দেহের রংও কালো। কালো যেন রূপের আলো…।
এসময় বাইরে থেকে সরদার ডাকল, ‘কই রে মা জোছনা, কবি বাপজানরে খাওন দে।’ কবি কুদ্দুস ভাবতে লাগল, ‘এই তাহলে বেদের মেয়ে জোছনা, কালো হলেও তার দেহে যৌবনের জোছনা, চোখে তার তারার ঝিলিমিলি, এই তাহলে আমার সেই কাল নাগিনী।’
জোছনা হাতে খাবার নিয়ে এল। কবি কুদ্দুসের সামনে জোছনা থালা রাখল। কবি কুদ্দুসের হাত অবশ হয়ে আছে। সে হাত নাড়াতে পারল না। কবি কুদ্দুসের মাথায় তখন বীণ বাজতে লাগল। সে কুপির আলোয় জোছনার চোখে চেয়ে চেয়ে দেখতে লাগল—বীণের সুরে কাল নাগিনী জোছনা নেচে যাচ্ছে।
খাওয়া শেষে কবি কুদ্দুস লেম্প জ্বেলে নৌকার গুলুইয়ে বসে কবিতা লিখে যাচ্ছে। খুব ঘোরের মধ্যে আছে সে। তার নাগিনীর দেখা সে পেয়ে গেছে।
আসমানের চাঁদের ছায়া নদীর জলে পড়েছে। জলবাসী জীবের নড়াচড়ায় অথবা বাতাসে জলে আলোড়ন জাগছে। সেই আলোড়নে আকশের একখানা চাঁদ অজুত চাঁদ হয়ে জলে বিম্বিত হচ্ছে। ছায়মূর্তির মতো জোছনা কবি কুদ্দুসের পাশে বসল। জোছনাকে এক পলক দেখেই কবিতা পড়তে শুরু করল কুদ্দুস।
কবিতা শেষে কুদ্দুস অপেক্ষা করছে তার নাগিনীর উচ্ছাস, প্রশংসা শোনার, কিন্তু জোছনা অনেকক্ষণ কিছু বলে না, তারপর হঠাৎ ফিসফিস করে বলে, ‘কাইলকা কবি আমরা এইখান থাকি চইলা যামু, তোমারে আমার খুব মনে পড়ব কবি, পত্তম দেখায় তুমি আমার মন কাইড়ছ।’
বেদের দল সব গোছগাছ করে নৌকা ছাড়ার আয়োজন করছে। পাড়ে দাঁড়িয়ে কবি কুদ্দুস। দিনের আলোয় চোখ ঠিকঠাক দেখছে তার, এই জোছনা তার সেই নাগিনী নয়, এই জোছনা নিতান্তই এক বেদেকন্যা। কল্পনা আর বাস্তবের ফারাক অনেক। এই ফারাক গোচানোর সাহস তার হয় না।
একসময় বেদে বহর চলতে শুরু করল। সর্দারের নৌকার গলুইয়ে জোছনা। ঢেউয়ে সে কুদ্দুসের কাছ থেকে যোজন যোজন দূরে সরে যাচ্ছে। ঝাপসা হয়ে আসে কুদ্দুসের চোখ। হঠাৎ হাউমাউ করে কেদে ওঠে সে, কিন্তু তার কান্না নদী তীরের বাতাসে প্রতিধ্বনি তোলা ছাড়া আর কোথাও পৌঁছায় না।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, ফেব্রুয়ারী ১৮, ২০১০
Leave a Reply