নানা অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময়ে কারাবরণ করেছেন বাংলাদেশে ও বিশ্বের নানা প্রান্তের কবি, শিল্পী, সাহিত্যিক। জেল-জুলুমেও তাঁদের চিরতরে স্তব্ধ করা যায়নি। তাঁদের সেই সংগ্রামী চেতনাকে ধারণ করেই আয়োজন জেলখানার লেখালেখি
১৯৫০ সালের ৭ জুন আমি জেলে যাই। সেদিন কমিউনিস্ট পার্টি ‘মুক্ত এলাকা দিবস’ ঘোষণা করেছিল। স্থানগুলো হলো বাংলাদেশের ময়মনসিংহের উত্তরাঞ্চলের হাজং, পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার কাকদ্বীপ আর মাদ্রাজের তেলাঙ্গানা। জনযুদ্ধ তখন শুরু হয়েছে। আমি একটা পোস্টার এঁকেছিলাম। যার বিষয় ছিল ময়মনসিংহের মানচিত্র হাতুড়ি-কাস্তে দিয়ে ঘেরা। পোস্টারের ওপরে লেখা ছিল মুক্ত এলাকা দিবস, যা দেয়ালে লাগাতে গিয়ে আমি পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হই।
জেলে আমাকে রাখা হয় ১৪ সেলে। ‘শকুন্তলা ফাটক’ বলে যার একটা সুন্দর নাম ছিল। আমার রাজনৈতিক সতীর্থ আবদুল্লাহ আলমুতী শরফুদ্দীন, আলী আকছাদ, শ্রমিকনেতা আবদুল বারি এবং ক্ষেতমজুর নেতা মনু মিয়াও এখানে ছিল। জেলের ১৪টি কক্ষই দুদিকে লম্বা শিক দিয়ে ঘেরা ছিল। দুজন করে থাকার নিয়ম, তবে একজনও থাকত।
সকালে যখন লকআপ খুলে দেওয়া হতো, তখন আবদুল্লাহ আলমুতী, আলী আকছাদসহ অন্যরা শুনতে চাইত, রাতে আমি কী লিখেছি। রাতে লেখা গল্প-কবিতা তখন আমি পড়ে পড়ে তাদের শোনাতাম।
প্রথম দিকে যখন খাতা ছিল না, মুতী ভাই কিছু লেখার জন্য মাঝেমধ্যেই তাগাদা দিতেন। তখন খবরের কাগজের সাদা মার্জিনের মধ্যে পেনসিল দিয়ে লিখতাম। জেল কর্তৃপক্ষের অনুমোদন নিয়ে আমি কমলা রঙের মলাট দেওয়া একটা খাতা আনিয়েছিলাম এবং ওই লেখাগুলো উঠিয়ে রেখেছিলাম।
সেখানে আমি সতীর্থ সঙ্গীদের প্রতিকৃতি এঁকেছিলাম। কয়েকজন কয়েদিও ছিল। জেলখানায় একটা রজনীগন্ধার ঝাড় এত ভালো লেগেছিল যে মনে হয়েছিল মুক্ত জীবন। তার ড্রয়িংও আমি করেছি। ওই খাতায় আমি বেশ কিছু গল্প-কবিতাও লিখেছিলাম।
কবিতাগুলো ছিল মূলত সুকান্ত ভট্টাচার্যের অনুকরণে, গণচীনের অভ্যুদয় ও নতুন জীবনের জয়গান নিয়ে। দুঃখটা হলো, এসবের সবই আমার হারিয়ে গেছে।
আমাদের বেগমবাজারের বাসায় মূল ফটক দিয়ে ছোট একটা করিডোর ছিল, যেখানে ঢুকলেই ছিল ইলেকট্রিকের মিটার, তার পাশে তালা মারা দরজা। ওটিই ছিল আমার স্টুডিও। সেখানে আমি ছবি আঁকতাম। ওই ঘরে একটা কালো টিনের বাক্সে আমার জেলজীবনের খাতাটা রাখা ছিল। সঙ্গে ছিল ইতালি থেকে আমিনুল ইসলামের লেখা চিঠি ও ছবি এবং শিল্পী পরিতোষ সেন ও দিলীপ দাশগুপ্তের লেখা চিঠি ও ছবি।
এ ছাড়া খুবই মূল্যবান একটি জিনিস যত্ন করে খামের ভেতর রাখা ছিল। বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারির শহীদ আবুল বরকতকে রক্তাক্ত অবস্থায় ধরেছিলাম। আমার হাতে ছিল কাঁদানে গ্যাস থেকে বাঁচার জন্য পানিভেজা রুমাল। ওই রুমালের এক কোণে একটা লাল ফুল এমব্রয়ডারি করা ছিল। যার লাল উজ্জ্বল রং রক্তের উজ্জ্বলতায় হারিয়ে গিয়েছিল। বায়ান্নর সেদিনের ঘটনা আমার আজও স্পষ্ট মনে আছে। একুশে ফেব্রুয়ারি। তখন দুপুর গড়িয়েছে। ঢাকা মেডিকেল কলেজের ছাত্রাবাসের সারি সারি ব্যারাকের সম্মুখের ঘাসে আমি এবং হাসান হাফিজুর রহমান বসেছিলাম চার-পাঁচটা ব্যারাক পেরিয়ে, লাল খোয়া রাস্তার একধারে।
হাসান বলছিল নতুন কবিতার কথা, আর আমি ভাবছিলাম আজকে জাদুঘরে ঢাকা আর্ট গ্রুপের ২য় চিত্র প্রদর্শনীর কথা। যেখানে আমার তেলচিত্রগুলো রাখা ছিল। হঠাৎ দেখলাম, ব্যারাকগুলোর দক্ষিণ পাশ দিয়ে একটা চলন্ত জটলা। দৌড়ে গেলাম। বেশ লম্বা, শ্যামবর্ণ, মুখমণ্ডল পরিষ্কারভাবে কামানো, সারা চেহারায় বৃষ্টির বড় বড় ফোঁটায় ভরে যাওয়া ঘাম আর পরনের প্যান্টের পেটের নিচ থেকে কল খুলে দেওয়ার মতো অঝোরে রক্তের ঢল। সবার সঙ্গে আমিও তাকে ধরেছি, আমার সাদা পাজামায় কে যেন আবীরের রং পিচকারি দিয়ে ছড়িয়ে রাঙিয়ে দিল। আমি তাকে ধরেছি বুকের কাছে, আমার মাথা তার মুখের কাছে। একসময় সে চোখ তুলে তাকাল। একটা ছোট শিশুর ন্যায় গড়গড় করে নামতা পড়ার মতো করে বলল, আমার বাড়িতে খবর দেবেন…আমার নাম আবুল বরকত…বিষ্ণুপ্রিয় ভবন, পল্টন লাইন…।
পরমুহূর্তে জবাই করা মুরগির মতো হাঁ করে জিব কাঁপিয়ে ফিসফিস করে বলল, পানি। পানি।
বাঁ হাত দিয়ে মৃদুভাবে ধরেছি তার পিঠ, ডান হাতখানা তার বুকের ওপর। সে হাতে রুমালখানা রেখেছি ধরে, যা মুখের ঘাম মোছার কারণে ভেজা আর নোংরা। ভাবলাম কী করব। জিব কাঁপছে অনবরত খোলা মুখের ভেতর। একটু ইতস্তত করলাম। মনে দ্বিধা, এক ধরনের অপরাধ বোধ। কিন্তু তা ক্ষণিকের জন্য। জিবটা বারবার নড়ছে। পরমুহূর্তেই নিংড়িয়ে দিলাম হাতের রুমাল।
শহীদ বরকতের অমর স্মৃতিমাখা সেই রুমালসহ আমার জেলজীবনের সবকিছুই বাক্সবন্দী অবস্থায় ওই রুম থেকে চুরি হয়, যা আমার জীবনে অনেক বড় ক্ষতি করেছে। চোরেরা পরে হয়তো সবই ফেলে দিয়েছে। কারণ, এসবে তার কোনো কাজেই আসবে না। নেওয়ার সময় হয়তো ভেবেছিল, অনেক দামি কিছু আছে।
প্রসঙ্গত, একুশে ফেব্রুয়ারির এই ঘটনা নিয়ে আমি হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’ সংকলনে ‘একটি বেওয়ারিশ ডায়েরির কয়েকটি পাতা’ বলে একটি গল্প লিখি। এবং সেই সংকলনে ‘রক্তাক্ত একুশে’ নামে একটি লিনোকাটও করেছিলাম। একটি কবিতাও লিখেছিলাম ‘পারবো না’ এই শিরোনামে, যা ছাপা হয়েছিল সেই বছরই কলকাতায় সুভাষ মুখোপাধ্যায় সম্পাদিত পরিচয় পত্রিকায়।
মুর্তজা বশীর: শিল্পী, সাহিত্যিক, গবেষক। বাম রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, ফেব্রুয়ারী ১১, ২০১০
Leave a Reply