’৪৮ সালের প্রথম ভাষা আন্দোলনের পরে তখনকার মুক্তিসংগ্রামী রাজনৈতিক কর্মীদের যে ধরপাকড় শুরু হয়, তার ধারাটা ’৭১ পর্যন্ত প্রায় একই রকম ছিল। একবার ঢোকালে আর বের করার নাম নেই। দরকার হয়েছে বড় বড় ঠেলার। তবে জেলের দরজা খুলেছে। যেমন ’৫২র ২১ ফেব্রুয়ারির ঠেলা, ’৫৪ সালের সাধারণ নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের জয়ের ঠেলা, ’৬২ সালের এনডিএফের ঠেলা, ’৬৯-এর এগারো দফার ঠেলা। তারপর ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে কত জেলের রাস্তা তো সদর রাস্তা হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু প্রথম প্রথম জেল বন্ধের সময়টা বেশি হতো। ভেতরে যারা থাকত তারা মনে করত, সারা পৃথিবীটা নিঝুম। কবে জাগবে ছাত্র-জনতা? নোয়াখালীর কৃষকনেতা মমতাজ মিঞা গাঁয়ের চেয়ারম্যান, প্রথম চোটেই জেলে এসেছিল। বলত, ‘নাও ডাঙ্গায় তুইলা রাইখ্যা মাঝি বান্ধবার চাও। এহন ভাটি। জোয়ার আইলে নাও ভাসাইয়া জোয়ার আইব। আইবই। ছাড়ন নাই।’
এই রকম একটা ভাটির সময় ছিল ’৫৫ সালের শুরুর দিনগুলো। ’৫৪ সালেই যুক্তফ্রন্টের মন্ত্রিসভাকে বরখাস্ত করে জারি হয়েছিল জেনারেল ইস্কান্দার মির্জার ছোট লাটগিরির ’৯৩ ধারা। লাটের শাসন। জেলের ভেতর মনে হতো এই লাট যাইত না, জেলের কপাটও খুলত না।
ঢাকা জেলের পুরোনো হাজতে যারা আটক ছিল, তারা চার বছর একনাগাড়ে পুরোনো হাজতে ছিল। জেলের সুপার সপ্তাহান্তে একবার এলে একটা দাবি পেশ করা হতো। অন্তত এই জেলেরই অন্যত্র নেওয়া হোক। তবে কোনো ফল হয়নি।
কিন্তু হঠাৎ ঝড় এল। যেমন করে বারবার এসেছে। ’৫৫ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি। ভোরবেলায় সারা জেলখানায় যেখানে রাজবন্দীরা ছিল, সবাই একুশের শপথ নিয়েছিল, নিজের নিজের জায়গায় জমায়েত হয়ে। শেষরাতে কানে এসেছিল কাছাকাছি বহু বাসার ছাদ থেকে ‘শহীদ দিবস অমর হোক’, ‘সালাম, বরকত, রফিক তোমাদের ভুলব না’, ‘একুশে ফেব্রুয়ারি অমর হোক’। ১৪৪ ধারা জারি ছিল। মনে হয়েছিল তাই প্রভাতফেরি বোধ হয় হয়নি। সারা দিনের কোনো খবর পাওয়া যায়নি বিকেল পর্যন্ত। চাপা পড়ে গেছে সারাটা শীতের সকাল দুপুর বিকেল। সন্ধ্যা হয়ে আসছে। লক আপের সময় হয়ে এল। হঠাৎ জেলগেটে আওয়াজ। মনে হতে লাগল জেলগেট ভেঙে ফেলছে বিরাট জনতা। ‘শহীদ দিবস অমর হোক’, ‘একুশে ফেব্রুয়ারি অমর হোক’, ‘সালাম, বরকত, রফিক, তোমাদের ভুলব না’, যেন হাজার হাজার কণ্ঠের আওয়াজ। হঠাৎ মনে হলো একটা নতুন রাগিণী। শত শত ফাল্গুনের কোকিল বসন্তকে ডেকে এনেছে। কোকিল আর কোকিলা। তাই তো মেয়েদের গলা। অনেক অনেক মেয়ের গলা। সঙ্গে অনেক ছেলের গলা।
সন্ধ্যা পেরিয়ে গেল। লক আপ হলো না। পুরোনো হাজতে আঙিনার বন্ধ দরজার ফুটো দিয়ে দেখা গেল, জমাদার, সেপাই মেট পাহারার ছোটাছুটি চলেছে। থেকে থেকে সেই হাজার কোকিল ও কোকিলার আওয়াজ।
একসময় দরজাটা হাট করে খুলে গেল। জেলার, ডেপুটি জেলার ও ওয়ার্ডারদের সদলবলে প্রবেশ। একটি কথা ফেটে পড়ল ফুলের সুগন্ধের বোমার মতো। ‘চলেন আপনেরা পুরোনো বিশ সেলে, সাত সেলে, ছয় সেলে দেওয়ানিতে। এখানে মেয়েদের রাখতে হবে। ইউনিভার্সিটির মেয়েরা এসেছে। জেনানা ফাটকে জায়গা নাই।’
রাত সাড়ে আটটায় যার যার জিনিসপত্র কম্বল ইত্যাদি নিয়ে সেল এলাকায় চলে গেল পুরোনো হাজতের বন্দীরা। মাথার মধ্যে একসঙ্গে কয়েকটা আগ্নেয়গিরি জন্ম নিচ্ছে। ১৪৪ ধারা ভেঙে ইউনিভার্সিটিতে কালো পতাকা উড়িয়ে ছেলেমেয়েরা সভা করে মিছিল বের করেছে। জনা তিরিশেক মেয়ে, শ খানেক ছেলে গ্রেপ্তার হয়েছে। কালো নিশান নিয়েই মেয়েরা জেলে এসেছে। একদিকে এই ব্যাপার, আরেকদিকে রাত সাড়ে নয়টার সময় জেল এলাকার মুক্ত আকাশের তলায় ফাল্গুনের চাঁদ। সঙ্গে তারাভরা আকাশ। অনেকক্ষণ পরে জেলের গরাদ বন্ধ হলো এক এক করে। রাত ১০টায় ঘণ্টি পড়ল। গিনতি মিলেছে। হাজার ঘটনা ভরা জেলখানাতেও একটি ঐতিহাসিক রাত।
রাত ভোর হলো। ঢাকা শহরে সারা পূর্ব বাংলায় এই ভোর কোকিল আর কোকিলাদের পঞ্চমস্বরে দীপক রাগিণীতে জাগার গান। লক আপ খুলে দেওয়ার পরে সাত, ছয়, পুরোনো বিশ দেওয়ানির বন্দীরা বেরিয়ে এসে মিলিত হলো কপি আর ভেন্ডির বিস্তীর্ণ খেতের আশপাশে। সাত সেল থেকে বিশ সেলের এলাকা পর্যন্ত খোলা। সামনে জেলের উঁচু দেয়াল। ঢাকার মতি সর্দারের ভাষায় চৌদ্দ ফুট। এই নামটিকে তিনি নির্বাচনের সময় জেলে এসে চালু করে গিয়েছেন। এই চৌদ্দ ফুটের তলায় দেখা গেল একজন ওয়ার্ডার আর কয়েদি ওয়াল-পাহারা।
পুরোনো হাজতের বন্দীরা দুই দিন এই খোলা জায়গাতে ঘোরাফেরার নেশায় মেতে রইল। দেওয়ানিতে আটক কয়েকজন পুরোনো বন্দীর সঙ্গে কথা যেন আর শেষ হতে চায় না। পূর্ব বাংলার রাজনীতি আর সেই সঙ্গে সেই সময়কার পাকিস্তানের পশ্চিম এলাকার গণতন্ত্রের সংগ্রামীদের কথা যেন আর ফুরোতে চায় না। দুই এলাকাতেই জেলখানায় গণতন্ত্রের সৈনিকেরা বন্দী, জনগণ নির্যাতিত, নয়া উপনিবেশের কয়েদি, যুদ্ধ জোটের কামানের খোরাক। মুক্তির মন্ত্রণা আর শেষ হতে চায় না। তবে সবাই তো আর রাজনীতির সন্ন্যাসী, দরবেশ নয়। একটি ডালিয়ার চারদিকে এমনই কয়েকজন রসিক গবেষণা শুরু করে দিয়েছিল পুরোনো হাজতে, মেয়েরা কে কার খাটে পা ঝুলিয়ে বসে বেণি খুলে গল্প করছে। পুরোনো হাজতের বন্দীদের কারও কারও কথা ওরা জিজ্ঞেস করছে কি? জমাদারনীর কাছে জানতে চেয়েছে? কে কেমন দেখতে? একজন বলে ফেলল, ‘আমার লোহার খাটে শুইয়া রইছে একটা আগুনের লতা। হায়! আমি দেখলাম না কন্যা তোমারে।’
দুদিন এই করেই যাচ্ছিল চৌধুরী আর সালামেরও। ওদের বয়স বছর পঁচিশ-ছাব্বিশ। দেয়ালের কাছাকাছি গিয়েই আবার ফিরে হনহন করে হাঁটতে হাঁটতে ওরা কথা বলছিল। হঠাৎ নজর পড়ে গেল। ওয়াল-পাহারার কেমন যেন রকম-সকম। তারপর হাঁটতে হাঁটতেই চোখ খোলা রাখল ওরা এদিকে।
কালো দাগকাটা কোর্তা-পাজামা পরনে রোগাটে মানুষটা। মনে হয় যেন পুতুল। লক্ষ করে দেখল ওকে বিকেলে। পরদিনও দেখল সারা দিন। এবার বুঝল ওকে কিছুটা। সন্ধের আগে যখন চৌকার লোকেরা বালতি আর বাক্সে করে ভাত, ডাল, তরকারি নিয়ে আসে, তখন বুঝতে পারা যায়, এই ওয়াল-পাহারা পুতুল নয়, মানুষ। থালা-বাটি কলসির জলে ধুয়ে যখন ভাত, ডাল নেয়, তখন দু-একটা কথা বলে। কথার মধ্যে একটি আঞ্চলিক টান। পূর্ববাংলার কত অঞ্চলের কত টান দেওয়া বাংলা ভাষা। চেনা-জানা অথচ মনে হয় অচেনা-অজানা। দেশের মানুষগুলোকে জানাই হলো না, চেনাই হলো না ভালো করে, দূর ছাই।
একদিন একদিন করে আরও চারটে দিন চলে গেল। তারপর ওয়াল-পাহারার যেদিন সপ্তাহ শেষ হবে, সেদিন হঠাৎ বিকেলের দিকে চৌধুরী আর সালামকে সে হাত নেড়ে কাছে ডাকল। বলল, ‘কাল অন্য ওয়ালে চলে যাব।’ তারপর মুষ্টিবদ্ধ হাত তুলে বলল, ‘সালাম।’ চৌধুরী বলল, লাল সালাম। পাহারা বলল, লাল সালাম। তুই? চৌধুরী বলল, কমরেড, সালামকে দেখিয়ে পাহারা বলল, তুই? সালাম বলল, কমরেড লাল সালাম,
বাড়ি?
পাহারা বলল, হালুয়াঘাট। তারপর সেই চৌদ্দ ফুটের দেয়ালের তলায় পরিচয়ের একটা তরঙ্গ বয়ে গেল। চৌধুরী নেত্রকোনার ছেলে। হাজংরা তার অজানা নয়। সালাম শুনেছে এদের অনেক কাহিনি।
জানা গেল, গোলোক গুণের দশ বছরের জেল হয়েছিল ’৪৯ সালের হাজং চাষিদের বড় লড়াইয়ের সময় ধরা পড়ে।
চৌধুরী আর সালাম বলতে চাইল, গত কয়েক বছরে কী কী ঘটেছে। কিন্তু বুঝতে পারল, বলার দরকার করে না। হাজং কমরেড তার শীর্ণ মুখে আকর্ণ হেসে বলল, জানে, সব জানে, সব জানে।
কয়েক বছর ধরে নিজে সে অপরিচয়ের আড়ালে রয়ে গেছে। প্রথমে কয়েদি হিসেবে, তারপর পাহারা হিসেবে, তারপর ওয়াল-পাহারা হিসেবে। খুনের সাজানো মামলায় সাজানো সাক্ষীর কথায় আর অনেকের মতো তারও জেল। তৃতীয় শ্রেণীর কয়েদি। হাজার হাজার কয়েদির মধ্যে দলে-মুচড়ে মিশিয়ে দিয়েছে পাঁচ বছরের জেলজীবন। দুই বছর পরে ছাড়া পাবে। দশ মিনিটের মধ্যে বুঝিয়ে দিল কোনো আক্ষেপ নেই। ’৫২ দেখেছে, ’৫৪ দেখেছে, এবার ’৫৫ দেখল। মেয়েরা জেলে এসেছে।
ফিসফিস করে বলল, ‘আমাদের পাহাড়ের দুইটা মাইয়া আছে ঢাকা জেলে জেনানা ফাটকে। আমার শালী বিনা বিচারে বন্দী।’ বলল, ‘এই মাইয়াদেরও দুঃখ গেছে। কত মাইয়া আইছে। দেখছি আমি সেদিন গেটে।’
এই কথা বলে চৌদ্দ ফুটের দেয়ালের তলায় হঠাৎ সে একটা কাণ্ড করল। ডান হাতটা মুঠো করে উঁচুতে তুলে ঘুরে ঘুরে নাচল, কীর্তনের সুরে গাইল, ‘লাল ঝান্ডা জিন্দাবাদ,’ ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’, ‘একুশে ফেব্রুয়ারি জিন্দাবাদ’, ‘সালাম, বরকত জিন্দাবাদ’, ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’, ‘একুশে ফেব্রুয়ারি জিন্দাবাদ’, ‘সালাম, বরকত জিন্দাবাদ’।
ওয়ার্ডার এবার চৌধুরীদের বলল, কথা শেষ করেন এইবার। ওয়াল-পাহারা টুপি লাগিয়ে, কোমরে ঝাড়ন বেঁধে থালা-বাটি তুলে নিয়ে যাওয়ার জন্য তৈরি হলো। তারপর বলল, আমার বউ পোস্টকার্ড লিখছে। খবর চাইয়া। লিখসে, কাঁথা সিলাই হইসে, সুঁইটা কুথায় ফালাইলাম। জবাব লিখছি, কাঁথা সিলাই হইসে, নিশ্চিন্ত থাকো। আমিও নিশ্চিন্ত। তারপর আকর্ণ হেসে বলল, শহরের মাইয়ারা জেলে আইসে। জেনানা ফাটক ভইরা ফালাইসে, পুরানা হাজত ভইরা ফালাইসে। কাঁথা সেলাই হইসে, নিশ্চিন্ত। লাল সেলাম।
লাল সেলাম।
লাল সেলাম। যাওয়ার সময় হাসতে হাসতে সে খেত পেরিয়ে আস্তে আস্তে লিকলিকে পা বাড়িয়ে চলে গেল। পরদিন ভোরবেলা অন্য ওয়াল-পাহারা। আবার মিশে গেল গোলোক গুণ হাজার হাজার কয়েদির মধ্যে।
দিন কয়েক পরে জেলগেটে গিয়েছিল দুজনই। ফিরে আসার পথে দুজনই আশপাশের কয়েদিদের ভিড়-ভাট্টার মধ্যে তাকাচ্ছিল। গোলোক গুণের দেখা পায় কি না, তার আশায়।
একজন কয়েদি খাওয়া-দাওয়া সেরে বন্ধ হতে যাচ্ছে নির্দিষ্ট ওয়ার্ডে। বাটিতে খানিকটা জল, তাতে কয়েকটি বেলফুলের কুঁড়ি।
চৌধুরীকে হেসে জিজ্ঞেস করল, ‘কারে তাল্লাশ করেন? কে হারাইছে? মানুষ না আর কিছু?’ পুরোনো হাজতের দিকে তাকিয়ে সে একটু মুচকি হাসল। চৌধুরীর ইচ্ছে হলো বলে, ‘সুঁই খুঁজতাছি।’
‘রহমানের মা ও অন্যান্য’ (১৯৮৪) গ্রন্থ থেকে গৃহীত।
রণেশ দাশগুপ্ত: বাম রাজনীতিক, জেল খেটেছেন অসংখ্যবার। লেখক, অনুবাদক ও সাংবাদিক।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, ফেব্রুয়ারী ১১, ২০১০
Leave a Reply