আপনার জন্ম তো ওপার বাংলার দিনাজপুরের রায়গঞ্জে। শৈশবের কথা কিছু বলুন।
দেশভাগের আগে যে অখণ্ড দিনাজপুর ছিল, তারই একটা থানা শহর রায়গঞ্জ। সেখানেই আমার জন্ম। পূর্ববঙ্গে চলে আসার পেছনে কিছু কারণ ছিল। আমাদের জমি যারা আবাদ করত, তারা ঠিকঠাক ফসল দিত না। আমার দাদা ছিলেন জোতদার। তাঁকে অনেকে খাজনা দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছিল। বাবা ছিলেন হোমিওপ্যাথি ডাক্তার। তিনি মুসলিম লীগবিরোধী ছিলেন। পাকিস্তানও চাননি। এ জন্য রোগীরা বাবার কাছে আসত না। বাবা ছিলেন কংগ্রেসের অনুসারী। এসব কারণে নানা সমস্যায় পড়েছিলাম।
বখাটেরাও উৎপাত করত। বাবা শেষপর্যন্ত বললেন, তোরা পাকিস্তান চলে যা। তখন আমার বয়স পনেরো-ষোলো। উনি ভারতে থেকে গেলেন। আমাদের ভাইবোনদের পাঠিয়ে দিলেন।
আপনারা এসে কোথায় থাকতে শুরু করলেন?
পূর্ব পাকিস্তানের দিনাজপুরে। এক আত্মীয়ের বাড়িতে উঠেছিলাম, সেখানে থাকতে থাকতেই বাড়ি ভাড়া করে বসবাস শুরু করেছি। ছাত্রজীবনেই। আপনি একবার জেল খেটেছিলেন। সেই সময়কার কথা বলুন।
১৯৫৪ সালের কথা। আমি তখন বিএ পড়ি। ছাত্র ইউনিয়নের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়লাম। তখন সেকশন নাইনটি টু ৯২-ক ধারা জারি হলো। আমিও অ্যারেস্ট হলাম।
পরীক্ষা কি জেলখানায়?
না, বিএ ফার্স্ট ইয়ারের পরীক্ষাটা ওখানে হয়েছিল। সুরেন্দ্রনাথ কলেজে আগে প্রিন্সিপাল ছিলেন গোবিন্দ চন্দ্র দেব। তখনকার প্রিন্সিপালকে বলে তিনিই ব্যবস্থাটা করে দিয়েছিলেন, জেলখানায় আমার অ্যানুয়াল পরীক্ষাটা নেওয়ার জন্য।
বিএ পাস করেই কি ঢাকায় আসেন?
সঙ্গে সঙ্গে এলাম না। কিছুদিন চিন্তা-ভাবনা করে তারপর ঠিক করলাম ঢাকায় আসতে হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে হবে।
লেখালেখি শুরু করলেন কবে?
লেখালেখি রায়গঞ্জ থেকে দিনাজপুরে আসার পরই শুরু হয়েছিল। আমার বাবা ইংরেজি ও বাংলায় লিখতেন। মূল ঝোঁক ছিল উপন্যাস লেখার প্রতি। তাঁর কাছ থেকেই লেখক হওয়ার স্বপ্নটা আসে।
ঢাকায় এসে আপনি গল্প লিখতেন, কবিতাও তো লিখতেন।
কলকাতার কাগজে কবিতা ছাপা হয়েছিল। পরে আস্তে আস্তে গল্পের দিকে ঝুঁকলাম। আর্থিক কারণও অবশ্য ছিল। সিকান্দার আবু জাফর তখন একটা পত্রিকা করতেন, সমকাল। আমার লেখা সেখানে ছাপা হতো। কবিতার চেয়ে গল্পে বেশি সম্মানী পেতাম।
বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়াটা তো আপনার জন্য অনিশ্চিত ছিল।
আসতে দেরি করে ফেলেছিলাম। বাংলা বিভাগের সভাপতি মুহম্মদ আবদুল হাই আমাকে বিদায় করে দিয়েছিলেন। আমি মন খারাপ করে চলে আসছি। গোবিন্দ্র চন্দ্র দেব ও মুনীর চৌধুরী রাস্তা দিয়ে আসছিলেন। ব্যাপার শুনে জে সি দেব স্যার মুনীর চৌধুরীকে বললেন, এই ছেলেটাকে দেখো তো, ভালো বাংলা জানে, জেলটেল খেটেছে। মুনীর চৌধুরী আমাকে হাই স্যারের কাছে নিয়ে গেলেন। হাই স্যার আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, কী কী বই পড়েছ? একের পর এক নাম বলতে লাগলাম। তিনি আমাকে ফরম দিয়ে বললেন, ভর্তি হয়ে যাও।
পড়তে পড়তে চাকরি নিলেন?
বাংলা বিভাগে প্রিলিমিনারি ফার্স্ট ইয়ার প্রথমবার কমপ্লিট করতে পারিনি। থাকার জায়গা নেই। তখন খবরের কাগজে একটা চাকরি নিয়েছিলাম, দৈনিক মিল্লাত-এ। তারপর প্রিলিমিনারি দিয়ে মাস্টার্স করলাম।
আপনার বিয়ের প্রসঙ্গে আসি। মেয়ে কি পূর্ব পরিচিত ছিল?
একটু পরিচয় ছিল, ওর মেজো ভাই আমার বন্ধু। বিয়ের কথাবার্তা চলছিল দেখে বন্ধুদের সাহায্যে গোপনে আমরা বিয়ে করে ফেললাম। বিয়ের পর ও বলল, আমাকে একটা শাড়ি দেবে না? ফুটপাত থেকে একখানা শাড়ি কিনে নিয়ে এলাম। ও সেই শাড়ি পরে নিউমার্কেটের এক স্টুডিওতে আমার সঙ্গে ফটো তুলতে গিয়েছিল। বিয়ের পর দুজন দুদিকে চলে গেলাম। আমি ঠাকুরগাঁও, আর ও হোস্টেলে।
আমাদের একসঙ্গে থাকা শুরু হলো ১৯৬১ কি ১৯৬২ সালে, ঠাকুরগাঁওয়ে। ওখান থেকে চলে এলাম ঢাকায়। ঢাকায় চলে আসার পরে কাজকর্ম খুঁজছি। জাফর ভাই তখন বললেন, তুমি সমকাল দেখাশোনা করো। দুশো টাকা বেতন ঠিক হলো। ওই টাকা দিয়েই আমি তখন ওকে নিয়ে থাকি। এর মধ্যে খবর পাওয়া গেল আলাউদ্দিন আল আজাদ জগন্নাথ কলেজ থেকে চলে যাচ্ছেন, বিলেত যাচ্ছেন। হাসান হাফিজুর রহমান বললেন, দরখাস্ত দাও। দরখাস্ত দিলাম। ইন্টারভিউ দিলাম। জগন্নাথ কলেজে বহুত ঝামেলা ছিল, আমাকে নানা ধরনের প্রশ্ন করা হলো, দিলাম জবাব। চাকরিটা হলো।
কত বছর ছিলেন জগন্নাথ কলেজে?
১৯৬২ সালের সেপ্টেম্বরে জয়েন করেছিলাম, আর ১৯৮৭ সালে আমাকে দিয়ে দিল বাংলাদেশ গেজেটিয়ারে, সম্পাদকও করেছিল। তারপর ওখান থেকে আমাকে নিয়ে গেল মিউজিক কলেজের প্রিন্সিপাল হিসেবে। ওখান থেকে আমি রিটায়ার করি ১৯৯৩তে।
অনেক দিন থেকেই বিভিন্ন কাগজে আপনি লিখছিলেন। প্রথম উপন্যাস বেরোলো ১৯৬৩ সালে, ‘পিঙ্গল আকাশ’। পরের পাঁচ বছর আপনার আর কোনো বই বের হয়নি।
হ্যাঁ। ছোটগল্পের বই উন্মূল বাসনা বের হয়েছে ১৯৬৮ সালে। তত দিনে আমি পরিচিত হয়ে গেছি গল্পলেখক হিসেবে।
পঞ্চাশের দশক থেকে সাহিত্যিকদের মধ্যে গ্রামজীবন প্রান্তিক মানুষদের নিয়ে লেখালেখির ঝোঁক থাকলেও পার্থক্য হলো আপনি ওদের যৌনতাকেও লেখায় তুলে ধরেছেন। এদিকটায় আপনি আগ্রহী হলেন কেন?
যৌনজীবন তো বাস্তবতারই একটা অংশ। আমি এই বাস্তবতাকে ধরতে চেষ্টা করছিলাম। ভূমিহীন কৃষক বা প্রান্তিক চাষির কথা বলছি। যাদের মেয়েদের দুর্বলতার সুযোগ নেয় ভূমির মালিকেরা। এটাই ছিল আমার কাছে মূল ব্যাপার। যখন স্কুলে পড়াই তখন এ রকম অনেক মানুষের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে।
স্কুলে চাকরির সময় আপনার কিছু জানাশোনা হয়েছে, অভিজ্ঞতা হয়েছে।
হ্যাঁ, অবশ্যই জানাশোনা হয়েছে। যেমন বীরগঞ্জে চাকরি করার সময় একজনকে আমি খুঁজে বের করেছিলাম। তেভাগা আন্দোলনের সময় সে খুব সক্রিয় ছিল। তখন বৃষ্টি শেষ হয়ে গেছে, শরৎকালের ব্যাপার। সে সকাল-বিকাল মাঠে আলের মধ্যে শুয়ে থাকে। আমি বললাম, কী করো এখানে, শুয়ে থাকো কেন? বলে, এখানে গান শুনি। কিসের গান? সে বলে, এই যে বীজ ফেলা হয়েছে ধানের, বীজটি যখন চারা হয়ে একটু একটু করে ওপরে উঠছে, গান গাইতে গাইতে উঠছে। ওই গানটা আমি শুনতে পাই। এটা শোনার পরে মাথা খারাপ হয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা হয়েছিল আমার। এই যে মাটির কাছের, তৃণমূলের মানুষ তাদের কল্পনা বলি, আবেগ বলি, প্রেম বলি এগুলো তাদের কর্মের সঙ্গেই যুক্ত। তারা প্রকৃতির একটা অংশ। এটা যখন অনুভব করি তখন প্রকাশ করতে ইচ্ছে করে।
‘প্রদোষে প্রাকৃতজন’ উপন্যাসে ইতিহাসকে সাধারণ মানুষের জায়গা থেকে পাঠ করার ভাবনাটা কীভাবে পেলেন?
ভাবনাটা এসেছে ইতিহাস পড়তে গিয়ে। দেখেছি বখতিয়ার খলজি আসছে। বিপরীতে লক্ষণ সেনের বিরাট সেনাবাহিনী প্রতিরোধের প্রস্তুতি নিচ্ছে। কিন্তু বখতিয়ার খলজির সেনাবাহিনী যখন ভেতরে প্রবেশ করল তখন লক্ষণ সেন নেই। পালিয়ে গেছে। এটা কেন হলো? স্থানীয় লোক এদের প্রতিহত করবে না এই বিশ্বাস থেকে।
ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে কৃষক বিদ্রোহ বারবার হয়েছে। কৃষক বা সাধারণ মানুষ এভাবে ইতিহাসের চাকা ঘুরিয়েছে। এখান থেকেই বোধ হয় অনুপ্রেরণাটা এসেছে।
বাংলাদেশের সাহিত্যের স্ট্যান্ডার্ড সম্পর্কে আপনার কী মনে হচ্ছে?
সামগ্রিকভাবে বাংলা সাহিত্যে এখন রম্যলেখা প্রাধান্য পাচ্ছে। শওকত ওসমান বলি, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ বলি, আবু রুশদ বলি এদের উপন্যাস তো শুধু কাহিনি নয়। এর মধ্যে মাটি, মানুষ তাদের সমাজ ও দেশ আছে। এখনকার লেখার মধ্যে এই জিনিসটার বেশ অভাব।
পাশাপাশি অন্য রকম লেখালেখি কি নেই?
পাশাপাশি নিরীক্ষামূলক কিছু লেখা যে হচ্ছে না, তা নয়। সংস্কৃতি কত অগ্রসর হয়েছে এখন। বাংলাদেশের খেলাধুলা, সংগীত, নাটক, সিনেমা—সবকিছুতেই একটা জাগরণ ঘটে চলেছে।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, ফেব্রুয়ারী ১১, ২০১০
Leave a Reply