অকথিত যোদ্ধা
কাজল রশীদ
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ১৯৭১ নারী (প্রত্যক্ষদর্শী ও অংশগ্রহণকারীর বিবরণ) \ সংকলন-সম্পাদনা: সুকুমার বিশ্বাস\
মূল্য: ৩০০ টাকা (প্রতিখন্ড) \ মার্চ ২০০৭\ প্রচ্ছদ: সমর মজুমদার\ ২৫৬ পৃষ্ঠা
১. মেঘনা গুহঠাকুরতা তখন দশম শ্রেণীর ছাত্রী। বাবা ও মাকে ঘিরে সুখী একটা পরিবার।
একাত্তরের মার্চের কালো রাত তাঁদের জীবনটাকে উল্টে-পাল্টে দিল। মুক্তিযুদ্ধের শুরু থেকেই ভেতরে ভেতরে আরও একটি যুদ্ধ শুরু হয়েছিল তাঁদের পরিবারে।
গুলিবিদ্ধ হয়েও বাবা জ্যোর্তিময় গুহঠাকুরতা বাসা ও ঢাকা মেডিকেলে মৃত্যুর সঙ্গে লড়লেন কয়েক দিন। একপ্রকার বিনা চিকিৎসায় মারা গেলেন। মা বাসন্তী গুহঠাকুরতা হতোদ্যম হয়ে পড়লেন। সব দিকেই বিপদ, যুদ্ধ আর যুদ্ধ। ঝুঁকি নিলেন অন্য রকমের। খ্রিষ্টান পরিচিতি দিয়ে নিজে ভর্তি হলেন হলি ফ্যামিলি হাসপাতালে আর মেয়েকে রাখলেন ফার্মগেটের একটি অরফানেজে। এভাবেই পুরো নয় মাস বাঁচার জন্য নানা পরিচয়ে নানা জায়গায় যুদ্ধ করতে হয়েছে তাঁদের।
২. আলতাফ মাহমুদকে ধরে নিয়ে যাওয়ার পর স্ত্রী সারা আরা মাহমুদও জীবনযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। বিভিন্ন জায়গায় ছুটে গেছেন স্বামীর খোঁজ নিতে, উদ্ধার করার দুনির্বার আকাঙ্ক্ষায়। রমনা থানাও যেমন আছে, তেমন আছে মগবাজারের পীরের বাসায় যাওয়ার ঘটনা। ভাইদেরও ধরে নিয়ে গিয়েছিল ওরা, কদিন পর ছাড়াও পেয়েছেন। প্রতীক্ষা ছিল ভাইদের মতো আলতাফও একদিন ফিরবেন। মাত্র দেড় বছরের মেয়ে শাওনকে নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস তাঁকেও লড়াই করতে হয়েছে প্রতিকূল পরিবেশ ও পরিস্থিতির সঙ্গে।
বাবাকে হারিয়ে বাসন্তী গুহঠাকুরতার দুঃখ-কষ্ট-যন্ত্রণা আমরা যেমন জানি না, তেমনই জানি না স্বামীকে হারিয়ে সারা আরা মাহমুদের একাত্তরের অভিজ্ঞতার কথা। অথচ এসবই আমাদের মুক্তিযুদ্ধের মৌল উপাদান। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে কেমন ছিলেন বাংলাদেশের নারীরা, আর কী হয়েছিল, কী ঘটছিল তাঁদের জীবনে, তার কোনো কিছুই আমরা জানি না বললে বোধ করি অত্যুক্তি হয় না। এই লজ্জা ও ব্যর্থতার দায়ভার কিছুটা হলেও মোচন করেছে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ১৯৭১ নারী বইটি।
বইটিতে তিন খণ্ডে (৪১+৩১+৪১=১১৩) ১১৩ জন নারীর সাক্ষাৎকার তুলে ধরা হয়েছে। যার মধ্য দিয়ে একাত্তরের যুদ্ধের সময় শুধু নয়, যুদ্ধ-পূর্ববর্তী প্রেক্ষাপট, অভিজ্ঞতা ও বিশ্লেষণ উপস্থাপিত হয়েছে। প্রকারন্তরে যা হয়ে উঠেছে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের অকথিত ইতিহাসের অনিবার্য এক দলিল। মুক্তিযুদ্ধের সম্মুখসমরের কথা কমবেশি আমরা সবাই জানি। এর বাইরেও যুদ্ধ ছিল। ঘরে ঘরে, ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে। যার খবর অনেকেই জানি না। স্বাধীনতার ৪০ বছরের দ্বারপ্রান্ত এসেও এসব তালাশ করার প্রয়াস আছে বলে বাস্তব দৃষ্টে মনে হয় না। এ ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন ঘটল আলোচ্য বইয়ের কল্যাণে। প্রত্যক্ষদর্শী ও অংশগ্রহণকারীর বিবরণ থেকে সম্পন্ন হওয়া বইটিতে মুক্তিযুদ্ধের বহুমাত্রিকতা কিছুটা হলেও উপস্থাপিত হয়েছে। যার ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখলে মুক্তিযুদ্ধের সর্বজনীন রূপ সম্পর্কে জানার সুযোগ তৈরি হবে এবং সবাই মহান মুক্তিযুদ্ধের মহিমা ও মর্যাদার পেছনে নারীর অবদান কতটা, তা গভীরভাবে উপলব্ধি করতে সক্ষম হবে।
‘এ বিশ্বে যা কিছু সৃষ্টি চিরকল্যাণকর/অর্ধেক তার আনিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।’
(নারী: কাজী নজরুল ইসলাম)
সতত সত্য এই উচ্চারণ। সত্যেরও অধিক যদি কিছু থাকে, তাহলে বলতে হয়, নারীর অবদান কখনো কখনো তার চেয়ে বেশি, অনেকটাই বেশি। বিশেষ করে সংসার সমরাঙ্গনে। দুঃখজনক বাস্তবতা হলো, দ্বিবিধ স্থানেই তাঁদের অবদান উপেক্ষিত, মূল্য, স্বীকৃতি ও কপর্দক—সবই শূন্যের কোঠায়। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ক্ষেত্রেও এর ব্যত্যয় ঘটেনি। পাদপ্রদীপের নিচে আসেনি কিংবা আনা হয়নি তাঁদের অবদান। মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস শুধু নয়, পূর্ববর্তী সময়গুলোও নারীর বহুবিধ অবদানে ধন্য হয়েছে। ১৯৪৭-এর দেশভাগ-পরবর্তী সময়ের বিচ্ছিন্ন আন্দোলনসহ বায়ান্নর একুশ-পরবর্তী যে আন্দোলন, ত্যাগ-তিতিক্ষা তার সর্বত্র রয়েছে নারীর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ অবদান। শুধু ঘরের শান্তিশৃঙ্খলা, সুস্থ পরিবেশ, মৌলিক অধিকার পূরণের নিশ্চয়তায় মাত্র নয়, রাজপথে তাঁদের অবদান বহুমাত্রিকতায় অনন্য, পুরুষের সঙ্গে তাঁরাও সম উষ্ণীষের যোগ্যতর। মুক্তিযুদ্ধ গবেষণাকেন্দ্রের পক্ষে মহত্তম কাজটির সংকলন ও সম্পাদনায় রয়েছেন সুকুমার বিশ্বাস। মুক্তিযুদ্ধ গবেষণা ট্রাস্টের এই প্রয়াস মুক্তিযুদ্ধে নারীর অবদানকে লোকচক্ষুর সামনে হাজির করার দালিলিক প্রমাণ হিসেবে উপস্থাপিত হওয়ার যোগ্য। যাতে সংকলক সম্পাদকের গভীর নিষ্ঠা ও গবেষণামনস্কতার চিত্র পরস্ফুিটিত। বইটির প্রচ্ছদ এঁকেছেন সমর মজুমদার। মুক্তিযুদ্ধের প্রতি আন্তরিক যে কারও কাছেই বইটির নিবিড় পাঠ আবশ্যিক। কেননা বইটি মুক্তিযুদ্ধের বৃহৎ ক্যানভাস কিছুটা হলেও ধারণ করতে সক্ষম হয়েছে।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, ফেব্রুয়ারী ১১, ২০১০
Leave a Reply