ফ্রান্সের সম্রাট ষোড়শ লুইয়ের দরবারে সুদূর হিন্দুস্তানের মহীশুর রাজ্য থেকে রাজদূত এসেছেন। প্রত্যাশা ইংরেজদের বিরুদ্ধে ফ্রান্সের রাজনৈতিক ও সামরিক সমর্থন লাভ। ফ্রান্সের চিরপ্রতিদ্বন্দ্বীর বিপক্ষে সাহায্যের আবেদনে সম্রাট মোটেই বিস্মিত হননি, বরং খুশিই হয়েছিলেন। কিন্তু দূতদের পরের অনুরোধটিতে তিনি বেশ অবাক হলেন। কারণ, আবেদনটি অতি সামান্য, যা পূরণ করা সম্রাটের জন্য হেলাফেলার ব্যাপার। বিশ্বনন্দিত ফরাসি বিলাসসামগ্রী, সুগন্ধি বা অস্ত্রশস্ত্র কিছুই চাইলেন না মহীশুরের দূতের। তাঁরা ফরাসি দেশের কিছু ফুলের বীজ এবং কিছু ভালো জাতের গাছের চারা প্রার্থনা করেন। সম্রাটের অনুমতি পেলে এগুলো দেশে নিয়ে যাবেন তাঁরা।
মহীশুরের রাজদূতেরা যখন দেশে ফিরলেন, তখন শুধু ফুলের বীজ আর গাছের চারাই নয়, সঙ্গে নিয়ে এলেন ফরাসি মালী, বন্দুক বানানোর কামার, কাচ-চীনামাটির কারিগর ও লিনেন বোনার তাঁতি। এই দূতদের পাঠিয়েছিলেন মহীশুরের উন্নয়নে নিবেদিতপ্রাণ নরপতি টিপু সুলতান, যিনি একাধারে বীরযোদ্ধা ও দেশপ্রেমিক, যিনি মাত্র ৪৬ বছর বয়সে ১৭৯৯ সালে শ্রীরঙ্গপত্তমের যুদ্ধে ইংরেজদের কাছে আত্মসমর্পণ করার চেয়ে বীরের মতো লড়ে আত্মবিসর্জন দেওয়া শ্রেয় মনে করেছিলেন। ঘরে-বাইরের ষড়যন্ত্র ও চক্রান্তে টিপু সুলতানের মতো একজন অতুলনীয় শাসক ও সংস্কারকের পতন ইতিহাসের এক দুঃখজনক অধ্যায়।
নিজের সময়ের চেয়ে এগিয়ে ছিলেন টিপু সুলতান। তিনি ছিলেন বিজ্ঞানমনস্ক, যুদ্ধবিদ্যায় পারদর্শী। বহু ভাষায় দক্ষ। দেশ-বিদেশের খবর রাখেন নিয়মিত। নিজের বিশাল গ্রন্থাগারে জ্ঞানসাধনায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটানোয় তাঁর কোনো ক্লান্তি নেই। আবার এরই পাশাপাশি বিশ্বাস করতেন, তাঁর সরকার আল্লাহর প্রদত্ত (খোদাদাদ সরকার)। ‘তিনি ভুল করতে পারেন না, কারণ তাঁর সিদ্ধান্তে থাকে আল্লাহর আশীর্বাদ।’ (সিরাজুল ইসলাম)
মহীশুরের সব উন্নয়নে টিপু সুলতানের অবদান অপরিসীম। দেশজুড়ে সেচের ব্যবস্থা করে পতিত জমিকে আবাদের উপযোগী করা থেকে নতুন নতুন ফসলের প্রবর্তন—সবই তাঁর বিস্ময়কর উদ্ভাবনী চিন্তা ও শক্তির পরিচায়ক। ভাবতে অবাক লাগে, সেই ১৭৮৪ সালে বিশ্বের সব বন্ধুরাষ্ট্রকে মহীশুরে বিনা শুল্কে বাণিজ্য করার আহ্বান জানিয়েছিলেন তিনি। ইউরোপ, দূরপ্রাচ্যের অনেক দেশে বৈদেশিক বাণিজ্য বাড়ানোর জন্য বাণিজ্যদূত প্রেরণ করার কৃতিত্ব তাঁরই। ভারতীয় শাসকদের মধ্যে সম্ভবত তিনিই প্রথম, যিনি একটি কার্যকর নৌবাহিনী গঠন করে ইউরোপীয় নৌশক্তিকে ঠেকানোর সুদূরপ্রসারী চিন্তা করেছিলেন। নৌবাহিনী সম্পর্কে বিস্তারিত লিখিত পরিকল্পনা টিপু সুলতানের মৃত্যুর পর তাঁর কাগজপত্রের ভেতর পাওয়া গেছে।
এহেন দূরদর্শী ও প্রাজ্ঞ হয়েও টিপু সুলতানের চরিত্র ছিল নানা বৈপরীত্যে ভরা। ‘বাবা হায়দার আলী প্রায় নিরক্ষর ছিলেন, ছেলে টিপু বিদ্বান। অথচ বাবা নন, বিদ্বান ছেলে টিপুই ছিলেন নানা কুসংস্কারের বশ।’ দৈবের প্রগাঢ় আস্থা তাঁর। সিরাজুল ইসলাম লিখেছেন, ‘টিপুর প্রাত্যহিক জীবন পরিচালিত হতো প্রধানত জ্যোতিষীদের উপদেশ অনুসারে। নিজাম, মারাঠা, ইংরেজরা কোন সময়ে তাঁর কী ক্ষতিসাধন করতে পারে এবং কীভাবে তাদের মোকাবিলা করা সম্ভব, সে সম্পর্কে তিনি জ্যোতিষীদের পরামর্শ চাইতেন। তিনি স্বপ্নেও বিশ্বাস করতেন এবং রাতের প্রতিটি স্বপ্ন তিনি ডায়েরিতে লিপিবদ্ধভাবে স্বপ্নশাস্ত্রীদের সহায়তায় বিশ্লেষণ করতেন।’
টিপু সুলতানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে শত্রু ও বন্দীদের প্রতি চরম নিষ্ঠুরতার অভিযোগ রয়েছে প্রচুর। এসব সত্ত্বেও টিপু সুলতান ভারতের সমকালীন রাজাদের মধ্যে ‘মুকুটতুল্য’। আঠারো শতকের সর্বশ্রেষ্ঠ নরপতি বা এই শ্রেষ্ঠত্ব সামরিক সাফল্যের চেয়েও দেশের সার্বিক উন্নয়নে তাঁর অসামান্য অবদানের জন্য প্রাপ্য। উপমহাদেশের অনড়-অচল পরিবর্তনবিমুখ সমাজকে ঢেলে সাজিয়ে পাশ্চাত্য সমাজের মতো গতিশীল করা ছিল তাঁর লক্ষ্য। তিনি নিজেও জানতেন, তাঁর সংস্কার কর্মসূচি ঝুঁকিপূর্ণ, তবু তিনি সংস্কারনীতিতে ছিলেন বদ্ধপরিকর। এ সম্পর্কে তাঁর বিখ্যাত উক্তি স্মরণ করা প্রাসঙ্গিক হবে। তিনি প্রায়ই বলতেন, ‘সত্য ও ন্যায়জীবনে ভয় ও আপসের কোনো অবকাশ নেই, হয় করুন নয়তো মরুন।’ শ্রীরঙ্গপত্তমের যুদ্ধে টিপু সুলতান নিজের জীবন দিয়ে এই উক্তিকে সার্থক করেছিলেন। মহীশুরের বাঘ টিপু সুলতানের রাজপ্রতীক যে ‘বাঘ’ হবে, এতে আর আশ্চর্য কি!
টিপু সুলতানের রাজপ্রাসাদ, অস্ত্র, বর্ম, সিংহাসন, সেনাবাহিনী, পতাকা, রাজদণ্ড—সর্বত্র বাঘের দৃপ্ত পদচারণ। প্রাসাদের অভ্যন্তর বাঘের প্রতীকে ছেয়ে আছে। সেই ভয়াল প্রাণীটি কখনো মূর্ত, কখনো বা বিমূর্তরূপে বিরাজিত। ঐতিহাসিক কিরমানী লিখেছেন, ‘সুলতান তার শাসনামলের গোড়া থেকেই বাঘকে তার ব্যক্তিগত প্রতীক হিসাবে চিহ্নিত করেন।’ প্রতীক হিসেবে বাঘের নির্বাচন রাজনৈতিকভাবে ছিল সুচিন্তিত। বহু শতাব্দী ধরে মহীশুরের প্রাচীন রাজবংশ হোয়সালাদের রাজকীয় প্রতীক ছিল বাঘ। সারা মহীশুরে বাঘ নিয়ে বহু রোমাঞ্চকর ও জনপ্রিয় লোককাহিনি ছড়িয়ে রয়েছে। বাঘের নখের অলংকার ধারণকালে দেহে অসীম শক্তির সঞ্চার হয়, এমন বিশ্বাস মহীশুরের ঘরে ঘরে।
টিপু সুলতানের সেনারা বাঘের ডোরাকাটা বিশেষ বুনটের পোশাক পরে যখন কুচকাওয়াজ করে রওনা দিত, তখন টিপু সুলতানের শক্তি সম্পর্কে এক ধরনের ভয়মিশ্রিত শ্রদ্ধা ও গর্বের উদ্রেক হতো জনসাধারণের মনে। ঐতিহাসিক ব্রাউনিং লিখেছেন, ‘প্রজাসাধারণের মনে রাজশক্তির প্রতি ভয় ও সমীহ সৃষ্টির জন্যই ব্যাঘ্র প্রতীকের ব্যবহার বেছে নেওয়া হয়েছিল।’
ভ্রমণ ও যুদ্ধযাত্রা ছাড়াও টিপু সুলতান দৈনন্দিন কাজকর্মেও সোনালি সুতোয় বোনা বাঘের ডোরাকাটা জামা পরে থাকতেন। বাঘের মুখ আঁকা যুদ্ধের পোশাকে তিনি সেনাবাহিনী, কারখানা অথবা রাজধানীর দেয়াল মেরামত তদারকিতে বের হতেন। ১৭৮৬ সালে টিপু সুলতান নিরেট সোনা এবং নানা মণিমুক্তাখচিত একটি নতুন সিংহাসন তৈরিতে হাত দিয়েছিলেন। সোনার তৈরি বড় একটি বাঘের ওপর দাঁড়িয়ে আছে তাঁর নতুন সিংহাসনটি। বাঘটির বিরাট হাঁ করা মুখে ঝকঝকে স্ফটিকের দাঁত, মণি বসানো চোখ, উজ্জ্বল দ্যুতি। সিংহাসনের ছত্রীর ওপর একটি হিরেজহরতে ঢাকা হুমা পাখি শোভা পাচ্ছে। যথার্থ অর্থে এটিকে সিংহাসন না বলে ব্যাঘ্রাসন বলাই হয়তো অধিক যুক্তিসংগত।
মহীশুরের পতাকার কেন্দ্রবিন্দু একটি প্রদীপ্ত সূর্য। কিন্তু লাল জমির ওপর রয়েছে বাঘের গায়ের ডোরাকাটা চিহ্ন। সবুজ রঙের এ রকমেরই একটি পতাকা ১৮০৬ সালে ইংরেজদের বিরুদ্ধে ভেলোর বিদ্রোহের সময় ওড়ানো হয়েছিল। বেঁচে থাকলে তাঁর পতাকার এই সম্মানে হয়তো তৃপ্তি পেতেন তিনি।
বাঘের সৌন্দর্য ও ভয়াবহতার সবচেয়ে আকর্ষণীয় ও বিস্ময়কর ব্যবহার ফুটে উঠেছে টিপু সুলতানের জন্য কাঠের তৈরি রং করা একটি খেলনায়। প্রমাণ-সাইজের এই ডোরাকাটা কাঠের বাঘটি একজন ইংরেজকে মাটিতে ফেলে তার টুঁটি চেপে ধরে রয়েছে। অসহায় ইংরেজটির পরনে গোলাপ ফুল আঁকা লাল কুর্তা, কালো ব্রিচেস, সাদা মোজা, কালো জুতা ও কালো হ্যাট। ভয়ালদর্শন বিশাল বাঘটি শিকারের ওপর হাঁটু গেঁড়ে বসে আছে। এর ভাটার মতো চোখ, এর দাঁত আমূল বিঁধে রয়েছে শিকারের গলায়। একটি ছোট পাইপ অরগান বাঘের শরীরের বাঁ পাশের ভেতরে লুকানো। জন্তুটির পেছন দিকের একটি হাতল ঘোরালেই মুমূর্ষু (মরণাপন্ন) মানুষের আর্তনাদ আর থেকে থেকে বাঘের গর্জন শোনা যায়। এই বাঘের শিকারটি তখনো যে বেঁচে আছে, এটি বোঝানোর জন্য কনুই থেকে শিকারের একটু ওপরে ওঠানামা করত। অনেকের ধারণা, এই ধাতব বাজনাদার খেলনাটি টিপু সুলতানের ফরমায়েশ মোতাবেকই তৈরি করা হয়েছিল। সম্ভবত পাইপ অরগান এবং এর অন্যান্য যন্ত্রপাতি তৈরি করে দিয়েছিল ফরাসিরা, যাদের সঙ্গে টিপু সুলতানের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল। তবে বাঘের চিত্রিত কাঠামো এবং কাঠের ইংরেজটি অবশ্যই স্থানীয় শিল্পীদের তৈরি।
শোনা যায়, ইংরেজের সঙ্গে প্রোটোনোভোর যুদ্ধে হেরে গিয়ে টিপু সুলতান অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন। এ রকম মানসিক অবস্থায় একদিন শুনতে পেলেন, সেই যুদ্ধের অন্যতম ইংরেজ কমান্ডার স্যার হেক্টর মনরোর একমাত্র ছেলে বাঘের আক্রমণে নিহত হয়েছে। ঘটনাটি টিপু সুলতানের কাছে দৈবের ইঙ্গিত বলেই মনে হলো। মহীশুরের রাজকীয় প্রতীক বাঘের হাতে চিরশত্রু ইংরেজের বিনাশের ঘটনাটি তাঁকে এই অদ্ভুত বাঘের খেলনা তৈরিতে উৎসাহ জুগিয়েছিল বলে অনেকের অভিমত। খেলনাটিতে কল্পনাশক্তির প্রয়োগ ছাড়াও চোখে পড়ে একের পর এক অনেক যুদ্ধে হেরে কোণঠাসা মহীশুরের বাঘ টিপু সুলতানের শত্রুর প্রতি ঘৃণা এবং প্রতিশোধের উদগ্র স্পৃহা। অবসর সময়ে তিনি এই খেলনা বাঘের গর্জন শুনে আনন্দ পেতেন বলে শোনা যায়।
শ্রীরঙ্গপত্তমের পতনের পর ইংরেজ কমান্ডার ও তাদের সেনাদের লুটের তাণ্ডব শুরু হলো। টিপু সুলতানের গ্রন্থাগার, তাঁর বিখ্যাত অস্ত্রশালা, তোষাখানা, ধনরত্ন এমনকি তাঁর স্বপ্ন বিবরণের বইও বিলেতে লুটের মণি হিসেবে পাড়ি দিল। কিরমানী লিখেছেন, ‘সুলতানের নতুন সিংহাসনটিই ভেঙে টুকরো টুকরো করা হয়।’
ইংরেজদের পরাজিত না করে এই নতুন সিংহাসনে বসবেন না বলে টিপু সুলতান পণ করেছিলেন। যুদ্ধের কারণে ব্যস্ত থাকায় তাঁর আর এই সাধের সিংহাসনে কোনো দিন বসা হয়ে ওঠেনি। এর রেলিংয়ের রুপা এবং পায়ের সোনা খুব দ্রুত গলিয়ে ভাগবাঁটোয়ারা শেষ হয়েছিল। ওয়েলেসলি এই অব্যবস্থা সম্পর্কে নিজেই অসন্তোষ প্রকাশ করে লিখেছেন, ‘শ্রীরঙ্গপত্তমে লুট হয়নি এমন বাড়ি দু-একটির বেশি চোখে পড়েনি। শুনতে পেলাম, লুট করে নেওয়া অনেক মূল্যবান মুক্তা, সোনার আস্তখণ্ড এবং দামি তৈজসপত্র আমাদের সেনা ও সেপাইরা বাজারে বিক্রি করছে। এদের কয়েকজনকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে এবং অন্যদের চাবুক মেরে বহু চেষ্টার পর আমাদের সেনাদের মধ্যে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে এনেছি।’ লুটতরাজ বন্ধ করতে মাদ্রাজ থেকে কর্নওয়ালিশও হস্তক্ষেপ করলেন। তাঁর চেষ্টায় সিংহাসনের সোনার বাঘের বিশাল মাথাটি উদ্ধার করা হলো। মণিমুক্তাখচিত হুমা পাখি, যা কর্নেল গ্রান্টের ভাগে পড়েছিল, সেটি ১৭৬০ পাউন্ড দিয়ে সরকারের জন্য কিনে নিলেন তিনি। বাঘের মাথা, হুমা পাখি, টিপু সুলতানের ব্যবহূত কার্পেট, তাঁর ক্যালিগ্রাফিক পতাকা ইংল্যান্ডের রাজা তৃতীয় জর্জের জন্য উপহার পাঠানো হলো।
টিপু সুলতানের পোষা অনেক বাঘ ছিল। রাজধানীর পতনের পর কর্নেল ওয়েলেসলি বেশ কয়েকটি বাঘ অভুক্ত অবস্থায় দেখতে পেয়েছিলেন। বাঘগুলোকে খাবার দেওয়ার বা দেখাশোনা করার লোক না থাকায় কয়েক দিন পর এদের মেরে ফেলা হয়। এ ছাড়া টিপু সুলতানের ১৬টি শিকারি চিতা ছিল। এর থেকে তিনটি চিতা, তাদের দেখাশোনা করার ছয়জন লোক এবং দুটি গরুর গাড়ি রাজা তৃতীয় জর্জকে উপহার দেওয়া হয়।
এত লুটপাট আর বিশৃঙ্খলার মধ্যেও ইংরেজরা কিন্তু টিপু সুলতানের সেই বিখ্যাত খেলনা বাঘটিকে মোটেই ভুলে যায়নি। এটিকেও লুটের অন্যান্য মালের সঙ্গে যত্ন করে জাহাজে তুলে দেওয়া হলো। লন্ডনে পৌঁছে বাঘটি বেশ কয়েক বছর গুদামে বন্দী হয়ে রইল। পরে ১৮০৮ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মিউজিয়ামে এটিকে জনসমক্ষে হাজির করা হয়। অল্প সময়ের মধ্যে প্রবল জনপ্রিয়তা আদায় করে টিপু সুলতানের বাঘ, যা সেই সময়ের বহু পর্যটক, কবি, নাট্যকার ও চিত্রশিল্পীর মনোযোগের বিষয়বস্তু হয়ে উঠেছিল। পরবর্তী সময়ে বিলেতের নানা জাদুঘর ঘুরে ঘুরে টিপু সুলতানের বাঘ অবশেষে ভিক্টোরিয়া অ্যান্ড আলবার্ট জাদুঘরে থিতু হয়। তবে এই দীর্ঘ সময়ে খেলনার অরগানটিকে বেশ কয়েকবার সংস্কার করতে হয়েছিল। বহু বছর ধরে অগণিত দর্শককে শিহরিত ও রোমাঞ্চিত করে টিপু সুলতানের পরাক্রমশীল বাঘ এখন বয়সের ভারে ক্লান্ত। আগের মতো বিলেতের নানা জাদুঘর ঘুরে বেড়ানোর শক্তি আর অবশিষ্ট নেই। কর্তৃপক্ষ তাই এটিকে বাইরে প্রদর্শনীতে পাঠাতে রাজি নয়। কিন্তু এর আকর্ষণ আর জনপ্রিয়তার কথা মাথায় রেখে তারা এই বিখ্যাত শার্দূলটির একটি হুবহু প্রতিকৃতি তৈরি করেছে চিত্রিত ফাইবার গ্লাস দিয়ে। ১৯৯৫ সালে সেটি ইংল্যান্ডে প্রদর্শিত হয়।
দেশ থেকে ইংরেজদের চিরতরে তাড়ানোর স্বপ্ন দেখতেন টিপু সুলতান। এই খেলনা বাঘটি হয়তো তাঁর সেই ইচ্ছা পূরণের একটি নিমিত্ত মাত্র। কিন্তু বিদেশিদের ঘৃণ্য আগ্রাসন ও দখলদারির বিরুদ্ধে এমন সূচিমুখ, জ্বালাময়ী অথচ দীর্ঘস্থায়ী প্রতিবাদের নজির আর কখনো চোখে পড়ে কি না সন্দেহ।
[কৃতজ্ঞতা: সিরাজুল ইসলাম—ঐতিহাসিকের নোটবুক, কথা প্রকাশ, ঢাকা। কাবেরী পোননাপা, ‘টিপু দি টাইগার কিং’ দি তাজ ম্যাগাজিন, মুম্বাই।]
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, জানুয়ারী ১৪, ২০১০
Leave a Reply