এলিফ্যান্ট সেলিবেস নামের হাতি ক্যাফেতে বসে রিচি মিলার দাদাইজম ও সুররিয়ালিজমের ওপর যুগপৎ তথ্যে ভরপুর একটি প্রকাণ্ড পুস্তক নাড়াচাড়া করেন। তাঁর হাতে জার্মান চিত্রকর, ভাস্কর ও কবি হিসেবে খ্যাতিমান ম্যাক্স আর্নস্টের বিচিত্র এক চিত্রের বোন্দা বলা পোস্টার। তাঁর ধবধবে সাদা রঙের ডাই করা দীর্ঘ দাড়ির জন্য তাঁকে কোনো সুফি দরবেশের তরুণ বয়সের ছবির মতো দেখায়। তিনি বেজায় গম্ভীর হয়ে আছেন বলে আমি পাশের টেবিলে বসে কফি খেতে খেতে তাঁর সঙ্গে হ্যালো, হাউ ডু ইউ ডু বলার জন্য ফিকির খুঁজি। পোস্টারখানা রোল করতে করতে তিনিই কী ভেবে আমার টেবিলে চলে এসে জানতে চান—হোয়ার ইজ মাই গার্ল? স্পষ্টতই তিনি এরিকা রলনকে খুঁজছেন। আমি তার হদিস জানি না, তাই অনুমানে বলি, সে হয়তো ম্যুজিও ডে ন্যাশনেল আরতে বা মেক্সিকো সিটির জাতীয় জাদুঘরের সামনে ধরনা দিয়ে আছে। আজ ঘণ্টা খানেকের মধ্যেই জাদুঘরে ম্যাক্স আর্নস্টের প্রদর্শনীর উদ্বোধন হবে। দর্শকদের দৃষ্টিকামে চিত্রগুলোর দেহ দলিত হওয়ার আগেই সে হয়তো তা দেখে নিতে চায়। লোহার খিলাল দিয়ে পাইপ খোঁচাতে খোঁচাতে রিচি মিলার আমার অনুমান বাতিল করে দিয়ে বলেন, এরিকা নির্ঘাত ফুটপাতে নাক ছেঁদা করে নথ পরতে গেছে। সাজগোজের গৎবাঁধা কেতায় তার আগ্রহ নেই, তাই সে নথ পরবে, তাতে আপত্তি কী? পাইপ দিয়ে দাড়ি খিলাল করতে করতে রিচি বলেন, এরা ফুটপাতে ক্যাকটাসের কাঁটা দিয়ে নাক-কান ছেঁদা করে, দিস ইজ আন হাইজিনিক অ্যান্ড আই অ্যাম ওরিড।
তাদের পরস্পরের সম্পর্ক কী, এ বাবদে আমি ঠিক ওয়াকিবহাল নই। মেক্সিকো সিটিতে আমরা সবাই পর্যটক। গেল তিন-চার দিন আমরা হরেক কিসিমের জাদুঘরে প্রদর্শনী দেখে ঘুরেফিরে একই ক্যাফেতে এসে বসছি। আমাদের মধ্যে ছুটছাট কথাবার্তাও হচ্ছে। আমরা অপরিচিত এবং ভিন দেশের নাগরিক হলেও পরস্পরের ভ্রমণ সম্পর্কে ইতিমধ্যে কিছু তথ্য জেনে বসেছি। তা থেকে মনে হয় মেক্সিকো সিটিতে আসার আগে রিচি ও এরিকা ট্রেন চেপে পেরুর মাচ্চুপিচ্চুতে একত্রে ভ্রমণ করেছেন। তাতে তাঁদের মধ্যে বোধকরি গড়ে উঠেছে হার্দিক গোছের খাতির জমা। আচার-আচরণে মনে হয় এরিকার ওপর আছে রিচির কিছু দাবি। তিনি ভুরু কুঁচকে জানতে চান, আমি তাকে আজ সিগ্রেট ধার দিয়েছি কি না। এরিকা বেশ কিছুদিন হলো ধূমপান ছেড়েছে, কিন্তু মাঝেমধ্যে সহযাত্রী ট্রাভেলারদের কাছ থেকে চেয়েচিন্তে দু-এক শলা ফুঁকে থাকে। গতকাল আধ ঘণ্টার মতো সে বসে ছিল আমার টেবিলে। রিচি তখনো ক্যাফেতে এসে পৌঁছাননি। বুকের উপরিভাগে একজোড়া ডলফিনের ছবি লেপ্টে এসে সে আমার টেবিলে বসে ছিল। তারপর খোলা কাঁধে দোদুল্যমান জেশচার তুলে চেয়েছিল একটিমাত্র সিগ্রেট। নৈর্ব্যক্তিক গোছের এ নারী নিহিলিজমের ওপর কথাবার্তা বলতে বলতে খোশমেজাজে হাসাহাসি করলে মনে হচ্ছিল সার্কাসের দুটি আওয়ারা ডলফিন সিল্কের অন্তর্বাসহীন তরলে যুগল বল নিয়ে খেলছে। সে মুহূর্তে শুধুু সিগ্রেট কেন, চাইলে আমি তাকে আরও গুরুতর কিছু কিনে দিতে প্রস্তুত ছিলাম।
ঠিক বুঝতে পারি না, এ নিয়ে কি রিচি মিলারের সঙ্গে দ্বন্দ্বের সূত্রপাত হতে যাচ্ছে? তিনি হঠাৎ করে বেজায় চুপচাপ হয়ে গেছেন। তাঁর চোখে-মুখে ভেসে আসা শরতের শুভ্র মেঘের মতো অভিব্যক্তির বদল হয়। অতঃপর তিনি পিতৃব্য সুলভ স্নেহের সুরে বলেন, এরিকা সম্পর্কে তোমাকে একটি তথ্য দিই। বছর দুয়েক আগে সে আফ্রিকার ঘানাতে যায় আদিবাসী জনগোষ্ঠীর শিল্প-সম্পর্কে গবেষণা করতে। ওখানে যক্ষ্মা বাধিয়ে কফ-কাশে রক্ত তুলতে তুলতে ফিরে আসে যুক্তরাষ্ট্রে। বছর খানেকের চিকিৎসার পর মাত্র মাস তিনেক আগে ডাক্তার তাকে ক্লিয়ারেন্স দিয়েছেন। তার আবার যক্ষ্মা হোক এটা তো আমরা চাইতে পারি না, আমরা যারা দর্শক—অসাধারণ এ দেহবল্লরীকে রক্ষা করার দায়িত্ব কি আমাদের নেই? তা বটে, দায়িত্ব আমাদের অবশ্যই আছে। আমি নিজেই আর সিগ্রেট স্পর্শ করব না বলে তওবা করার উদ্যোগ নিলে রিচি আমার কাঁধে হাত দিয়ে বলেন, নেভার মাইন্ড, লেট ইট গো। মেয়েটা কর্কশ কোনো ক্যাকটাস দিয়ে আজ নাক ছেঁদা না করালেই আমি খুশি হব।
রিচি পাইপ ধরান। আমি উষ্টা খেয়ে নখ উপড়ে ফেলার মতো মুখ আমসি করে কাপুচিনোর কাপের তলানি চাখি। মেক্সিকো সিটির জাদুঘরে জাদুঘরে ঘুরে বেড়াচ্ছি বলে আজকাল বিস্তর আর্ট ট্রাভেলারের সঙ্গে মোলাকাত হচ্ছে। এঁদের কেউ কেউ সস্তায় ভাস্কর্য বা চিত্র কিনে নিচ্ছেন। এঁদের মধ্যে নানা দেশের আর্ট কলেজের ছাত্র-শিক্ষকেরাও আছেন। কোনো কোনো শিল্পযশপ্রার্থীর আঁকাজোকায় কামিয়াবি আসেনি, তাই তাঁরা অন্যের কাজ দেখে কোশেশ করছেন আরেকবার জোশে উদেবল হওয়ার। এরিকার মতো আকর্ষণীয়রাও এ কাফেলায় পথ চলছেন। এঁদের পাথেয় তেমন নেই, তাই তাঁরা মওকা পেলে মডেল হয়ে জুটিয়ে নিচ্ছেন রাহা খরচ। আবার রিচি মিলারের মতো শিল্পকলার পাড় অধ্যাপকও আছেন। লাতিন আমেরিকার কোনো অজমফস্বল কলেজে ঠিক জমছে না, তাই তাঁরা যাচ্ছেন দেশ থেকে দেশান্তরে নতুন কোনো শিল্প প্রকরণ অথবা চাই কি আনকোরা সঙ্গিনীর তালাশে। হয়তো বা সাইড বিজনেস হিসেবে সংগ্রহ করবেন মোক্ষম কিছু তথ্য। পরবর্তী সময়ে চাই কি—তা ব্যবহার করে রচনা করবেন পিএইচডির থিসিস। চরিত্র হিসেবে এঁদের কেউ কেউ বিমূর্ত চিত্রের চেয়েও বিচিত্র। দাদাইজম, সুররিয়ালিজম-জাতীয় হরেক কিসিমের ইজমের আলোচনায় এঁরা অশ্রান্ত। এঁদের সঙ্গে সহবতে নিজেকে মাঝেমধ্যে বিভ্রান্তও মনে হয়।
লেটস ওয়ার্ম অফ এ লিটল বিট বলে নীরবতার বরফ ভেঙে রিচি মিলার টেবিলে মেলে ধরেন তাঁর বোন্দা বলা পোস্টারটি। ম্যাক্স আর্নস্টের ১৯২১ সালে জার্মানির কোলোন শহরে আঁকা ‘এলিফ্যান্ট সেলিবেস’ বা ইন্দোনেশিয়ার সেলওয়েসি দ্বীপের হাতি নামের এক চিত্র সরীসৃপের মতো শুঁড় উঁচিয়ে রহস্যময় চোখে আমার দিকে তাকায়। বয়লারের মতো দেখতে এ দৈত্যের শিংওয়ালা মস্তকে দৃষ্টিহীন চক্ষু। তার বাঁদিকে একজোড়া গজদন্ত যেন অন্য আরেকটি মস্তকের ইশারা দিচ্ছে। আরও তাজ্জবের ব্যাপার হলো—এক ম্যানিকুইন বা মেয়েদের জামাকাপড়ের দোকানে সাজিয়ে রাখা মুণ্ডুহীন এক পুতুল কাছে ডাকছে কুচকুচে কালো এ হস্তীকে। ১৯১৬ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ধ্বংসযজ্ঞের প্রতিবাদে রোমানিয়ায় জন্মগ্রহণকারী ফরাসি কবি ত্রিস্তাঁ জারা প্রমুখ জুরিখে দাদাইজম বা দাদাবাদের সূত্রপাত করলে ম্যাক্স আর্নস্ট তাতে যোগ দেন কাতারের পয়লা ঘোড়ায় সওয়ার হয়ে। আমি বলতে চাই, দাদাবাদীদের দর্শন মোতাবেক এ ছবিতেও আছে সৌন্দর্যের সনাতনী সংজ্ঞাকে বদলে দেওয়ার প্রচেষ্টা। পাইপে লোহার খিলাল দিয়ে আগুন খোঁচাতে খোঁচাতে রিচি আমার ইন্টাপ্রিটেশনকে এক রকমের খারিজ করে দিয়ে বলেন, পে অ্যাটেনশন টু দি টপ, হাতির মাথার ওপরের আকাশে মাছ উড়ছে। এ হচ্ছে অবচেতনের কারবার, ম্যাক্স এখানে দাদাবাদকে অতিক্রম করে ঢুকে পড়ছেন পরাবাস্তব এক জগতে, যেখানে উড্ডয়নের জন্য পাখি বা পাখা কিছুর প্রয়োজন নেই, স্রেফ মাছই কাফি। রিচি মিলারের বোলচাল বন্ধ হওয়ার আগেই কোথা থেকে খোদাই মালুম এরিকা এসে হাজির হয়।
না, নাক ছেঁদা করে নথ সে পরেনি। তবে খুব বেয়াড়াভাবে সেজেগুজে সে ক্যাফেতে এসেছে। বেমক্কা সব মেকআপের মিশ্রণে তার মুখখানা বর্ণিল। সে পরে আছে ছালার টাটের মতো কর্কশ বস্ত্রে তৈরি ব্লাউজ—তাতে বুকের কাছে বসানো দুটি ছোট ক্বদের মুখোশ। তাকে দেখে রিচির চোখে-মুখে চিড়িক চিড়িক করে খেলে যায় রোশনাই। এরিকা রিচির জন্যও ফুটপাত থেকে কিনে এনেছে মেক্সিকান আদিবাসীদের ব্যবহূত পঞ্চো। নীলাভ গাঢ় লোহিতে মিশ্রিত পঞ্চো পরিয়ে দিয়ে সেরিচির টাকে নখ দিয়ে আঁকিবুঁকি করলে তিনি তাঁর গুরু নিতম্বে মসৃণভাবে হাত বুলিয়ে ভাঁজ পড়া স্কার্টকে নিপাট করে দিয়ে বলেন, থ্যাংকস ফর দি পঞ্চো। এটা পরে খুব স্টাইলছে ম্যাক্স আর্নস্টের প্রদর্শনী দেখতে যাওয়া যাবে। তাঁদের সাজগোজ দেখে আমি ভাবি, পরের বার চুনোট করা কুঁচানো ধুতির সঙ্গে চায়না কোট পরে আসতে হবে দেখছি।
রিচি এবার তাঁর কানের নিচে চুমো খেয়ে বলেন, ইয়োর লিপস আর ড্রাই। ওয়েট অ্যা বিট। ফ্রুট স্ট্যান্ড থেকে আমি তোমার জন্য কাটা ফল নিয়ে আসছি। রিচি ফলের তালাশে ফুটপাতে গেলে এরিকা এলিফ্যান্ট সেলিবেসের পোস্টার দেখিয়ে বলেন, রিচি আর্ট নিয়ে তোমাকে খুব জ্ঞান দিচ্ছে, তাকে ডমিনেট করতে দেবে না। সে হচ্ছে মেইল গোট, আস্ত পাঁঠা। কিন্তু উনি যে ইনফরমেশন দিচ্ছেন, এগুলো তো ভ্যালুয়েবল? ভ্যালুয়েবল না কচু, বলে সে আমার বুক পকেটে হাত ঢুকিয়ে বের করে নেয় এক শলা সিগ্রেট এবং তা পার্সে লুকিয়ে রেখে বলে, এ এলিফ্যান্টের দুনিয়াজোড়া নামডাক হলেও এখানে আইডিয়া কিন্তু অরিজিন্যাল না। ম্যাক্স অ্যানথ্রোপলজির একটি জার্নালে সুদানের কনকম্বা ট্রাইবের জীবনযাপনের কিছু ছবি দেখেন। যব রাখার ভাঁড়ারের একটি ছবি তাঁর মনে ধরলে সেটাকে ভিত্তি করে অবশেষে বয়লারের মতো বেবাট এ বস্তু আঁকেন। রিচি বাটিতে করে লেবুর রস ও চিলি ছড়ানো ফল নিয়ে এলে সে খুব আদুরে মেয়ের মতো তার মুখের কাছে মুখ নিয়ে বলে, ইউ ক্যান স্ম্যাল, আই ডিড নট স্মোক টুডে। তারপর প্লাস্টিকের কাঁটাচামচ দিয়ে তারিয়ে তারিয়ে ফল খেতে শুরু করলে মুখোশের মুখের ছিদ্রপথে তার স্তনবৃন্ত ঘুলঘুলিতে চড়ুইয়ের চঞ্চল চোখের মতো তাকিয়ে থাকে বাইরের দিকে।
একটু দেরি করে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের ঝুট-ঝামেলা শেষ হলে পর আমরা একত্রে জাতীয় জাদুঘরের দিকে প্রদর্শনী দেখতে মেলা দেই। এ এলাকাটা মেক্সিকো সিটির হিস্টোরিক্যাল ডিসট্রিক্ট বলে খ্যাত। এখন অবহেলায় পড়ে আছে আজটেক জামানার ধ্বংসপ্রাপ্ত পিরামিড। স্প্যানিশরা এ পিরামিড ভাঙচুর করেই ক্ষ্যান্ত হয়নি, তারা পিরামিডের আগ্নেয়শিলা ব্যবহার করে পরবর্তী সময় গড়ে তোলে বিশাল এক ক্যাথিড্রাল। এ মুহূর্তে ক্যাথিড্রালের সামনে ঘোট পাকিয়ে ঘোরাফেরা করছে গুচ্ছ গুচ্ছ পর্যটক। বোধকরি সুরুয খানিক হেললে তারা ছায়াসমেত তুলবে তার ছবি। সড়কে এলোপাতাড়ি যানজট সম্পূর্ণ থির হয়ে যেন কোন জাদুবলে বাড়ি ফেরার প্রতীক্ষা করছে। এ ধুন্দুমারে আটকা পড়েছে বেশ কিছু ভারী ট্রাক ও লম্বা-চওড়া চেসিসের লিমোজিন। সূর্যালোকে তাদের ঘূর্ণিবাত্যার পর চরে বেফানা হয়ে আটকে পড়া নৌযানের মতো দেখায়। আর এ প্রেক্ষাপটে জাদুঘরের মারমেল পাথরের দালান, তার সামনে অশ্বারোহণে ব্রোঞ্জমূর্তি। সমস্ত স্থাপত্যটি যেন স্প্যানিশ ঔপনিবেশিক যুগের স্মৃতি হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, তার দেয়ালে, অলিন্দে, খিলানে কোথাও মেক্সিকান আদিবাসী আজটেক কালচারের তেমন কোনো ছাপ দেখা যায় না ।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠান শেষ হয়ে গেলেও কাউন্টারে রাখা চিপস সালসা ও পানীয় হিসেবে টাকিলা, লবণ ও লেবু রিসেপশনের জের হিসেবে আগত দর্শকদের উৎসাহ জোগাচ্ছে। দিন তিনেক পর এখানে আবার দেখা হয় গুস্তাবের সঙ্গে। গুস্তাবের শেকড় লাতিন আমেরিকার কোনো দেশে হলেও তিনি হিস্পানিক আমেরিকান হিসেবে বাস করেন যুক্তরাষ্ট্রের কোনো অখ্যাত শহরে। তার চিত্র কেনার ধাত আছে। সপ্তা খানেকে তিনি অনেকগুলো স্কেচ ও তেল-জলের ছবি কিনে রীতিমতো ফতুর হয়ে গেছেন। দিন তিনেক আগে আমি তাঁকে এক কমার্শিয়াল ডিসট্রিক্টে গিটার বাজিয়ে হ্যাট মেলে ধরে খয়রাত মাগতে দেখেছি। এ আর্ট ট্রাভেলারের হাল-হকিকত দেখে মনে হচ্ছিল ফাইন আর্টের জন্য তিনি গাঁট কাটতেও প্রস্তুত। আমাকে আজ তিনি না চেনার ভান করে ঘুরে ঘুরে কাউন্টারে গিয়ে জিভে লেবু ও নুন মাখিয়ে টাকিলা পান করেন। তাঁর হাতে এ মুহূর্তে সদ্য কেনা কোনো তৈলচিত্র নেই। তবে তিনি সিনার কাছে জাপটে ধরে আছেন চিত্রিত এক ধূপদানি। দ্রব্যটি মনে হয় অ্যান্টিক। ঠিক বুঝতে পারি তাঁর এ অর্থনৈতিক হালতে তিনি এ বস্তু কেন খরিদ করলেন।
এসব আবজাব দৃশ্য দেখে সময় নষ্ট না করে ম্যাক্স আর্নস্টের মূল প্রদর্শনীর দিকে নজর দেওয়ার জন্য রিচি মিলার পাইপ দিয়ে ইশারা করলে আমি ও এরিকা পান্ডার পেছনে পূজারিদের মতো সুড়সুড় করে ঢুকে পড়ি এক্সিবিশন হলে। এখানে ঠিক চিত্র নয়, তবে প্রদর্শনী হচ্ছে তাঁর আস্ত এক গ্রন্থের প্রতিটি পৃষ্ঠার। বইটির শিরোনাম ‘উনে সিমাইনে দে বনতে’, যার কাজ চালানোর মতো তরজমা হতে পারে ‘এক সপ্তাহের বন্দিত্ব’। ১৯৩৩ সালে ইতালিতে ভ্রমণের সময় ম্যাক্স মাত্র তিন সপ্তাহে চিত্রিত এ পুস্তকটি রচনা করেন। সারা গ্রন্থে আছে সাকল্যে ১৮২টি ইমেজ। পরাবাস্তববাদের প্রখ্যাত কবি পল এলুয়ারের সহায়তায় তা প্রকাশিত হয় ১৯৩৪ সালে প্যারিসে। মুদ্রিত ছবি কেটে কেটে কোলাজ ভঙ্গিতে সাজানো পৃষ্ঠাগুলোর কোথাও দেয়ালে লেপ্টে ঝুলছে অর্ধনগ্ন নারী, তার জনন ইন্দ্রিয়ের সঙ্গে শিকল দিয়ে বাঁধা পুরুষ, আর তার মস্তকে বসানো সিংহের মুখ। এসব দৃশ্য দেখে যেন বেজায় উদ্দীপিত হয়েছে এ রকম ভাব করে একটি চিত্রের সামনে এরিকা শিস কেটে উল্লাস প্রকাশ করেন। এ পৃষ্ঠার চিত্রে শিল্পী বুটজুতা ও লেডিজ শুয়ের মিশেলে তৈরি করেছেন মানুষের আকৃতির মুকুট পরা সিন্ধু-ঘোটক। শিল্পী তাবৎ ইমেজগুলোকে এমনভাবে সাজিয়েছেন, যাতে উপস্থাপিত হয়েছে তাঁর অবচেতনের অন্ধকার দুঃস্বপ্নময় পরাবাস্তব এক জগৎ, যেখানে সিংহের প্রতীকী মুখোশ পরে ক্ষমতাবান মানুষ নগ্ন নারীদেহের চারদিকে ছড়াচ্ছে যুগপৎ ভায়োলেন্স ও যৌন অবদমন।
শিল্পী এ সময় ইতালিতে ছিলেন, তাঁর এ কাজে কি ফ্যাসিবাদের উত্থানের নিপীড়নময় অস্থিরতা বর্ণিত হয়েছে? বিষয়টি নিয়ে ভাবতে গিয়ে আবার গুস্তাবের সঙ্গে চোখাচোখি হয়। তিনি প্র্রপাতের সমানে চোখমুখ মাথাইলে ঢাকা এক নারীর চিত্রের সামনে ধূপদানি হাতে দাঁড়িয়ে। এ ছবিতে ফ্রটাজ বা গ্রাফিক আর্টের পেনসিল দিয়ে ঘষে ঘষে দৃশ্যপটে ডেপথ তৈরি করার নমুনা আছে। ফ্রটাজের এ পদ্ধতি ম্যাক্সেরই আবিষ্কার। গুস্তাব ধূপকাঠি জ্বেলে তাতে ধোঁয়া দিতে শুরু করলে হা হা করে তার দিকে একজন প্রহরী তেড়ে আসেন। বিতর্কে জড়াতে গুস্তাব পিছপা হন না। তাঁর সাফসফা বক্তব্য হচ্ছে, প্রদর্শনীর ফ্লাশ জ্বালিয়ে ছবি তোলা যাবে না—এ নিয়ম সম্পর্কে তিনি বিলক্ষণ ওয়াকিবহাল, কিন্তু ধূপের ধোঁয়া যে দেওয়া যাবে না—এ ধরনের তো কোনো রুল নেই। রিচি মিলার তাঁর কাছাকাছি এসে এমন কটমট করে তাকান, তাতে মনে হয় তিনি বলতে চাচ্ছেন, গুস্তাব যদি ক্রমাগত গাধার মতো আচরণ করতে থাকেন, তাহলে দাদাবাদের মতো জটিল জিনিস তিনি বুঝতে পারবেন কীভাবে?
প্রহরীর সঙ্গে বাগাড়ম্বর করতে করতে গুস্তাব কাউন্টারের দিকে গেলে রিচি গটমট করে আমার কাছে চলে এসে বলেন, গুস্তাবের সমস্যা হচ্ছে সঠিক তথ্যের অভাবে চিত্রগুলো বুঝতে না পেরে সে আজাইরা উৎপাত করছে। ম্যাক্স ইমেজগুলো আরগানাইজ করেছেন সাতটি দিনের শিরোনামে সাত সাতটি ভিন্ন ভিন্ন থিমে। প্রতিটি দিনের সঙ্গে সম্পৃক্ত কোনো না কোনো প্রাকৃতিক উপাদান। যেমন রোববারের থিম হচ্ছে ‘কাদামাটি’ আর সোমবারের বিষয় হচ্ছে ‘পানি’। আবার কোনো কোনো দিনের থিমের সঙ্গে যুক্ত বিমূর্ত উপাদান। যেমন বৃহস্পতিবারে তিনি ফোকাস করেছেন ‘শূন্যতা’র ওপর আবার শনিবারের ইমেজে এসেছে ‘অজানা’ প্রসঙ্গ। এ সবকিছু একটু গভীরভাবে খুঁটিয়ে না বুঝে শুধু ছবির নিচে ধূপধুনা দিলে চলবে? আমি প্রতিটি দিনের রকমারি সব থিমের কথা ভাবি, তবে গুস্তাবের আচরণ নিয়ে কোনো পাল্টা মন্তব্য না করলে রিচি বিরক্ত হয়ে অন্যদিকে ছবি দেখতে চলে যান।
ঠিক তখনই এরিকার শিস শুনে তাকিয়ে দেখি সে দুহাতে দুটি করোটি নিয়ে রাজপথে ছুটে যাওয়া সিংহের মুণ্ডুওয়ালা মানুষের চিত্রের সামনে দাঁড়িয়ে আমাকে ইশারা দিচ্ছে। কাছে যেতেই কোনো কথাবার্তা না বলে আমার পকেটে হাত ঢুকিয়ে সে তুলে নেয় দেশলাই। তারপর নিস্পৃহ ভঙ্গিতে বলে, ‘গুস্তাবের দোষ কী? হি ইজ অ্যান ইন্টারেস্টিং গাই। সে তার মতো করে চিত্র এনজয় করবে, এতে আপত্তির কী আছে? আমরা যথেষ্ট স্টাডি না করে প্রদর্শনী দেখতে আসি বলে রিচি সকলের সমালোচনা করে। এগুলো হচ্ছে ছবি বোঝার প্রচলিত পথ। দাদাবাদী শিল্পী ম্যাক্স আর্নস্ট সনাতনী ধারায় ছবিগুলো তৈরি করেননি। ১৮৮৩ সালে জুলেস মেরি একটি চিত্রিত উপন্যাস প্রকাশ করেছিলেন। ম্যাক্স সে উপন্যাসের সঙ্গে ভিক্টোরিয়ান এনসাইক্লোপিডিয়া থেকেও ছবি কেটে কেটে কোলাজ করে এ গ্রন্থে কী যে বিচিত্রভাবে তা সিজিল মিছিল করেছেন। এগুলো দেখে গুস্তাবের যদি বেমক্কা আচরণের উৎসাহ জাগে, তাহলে তো তাকে বিশেষ একটা দোষ দেওয়া যায় না। বেশ দূরে থামের আড়ালে রিচি এখন মগ্ন হয়ে ডায়েরিতে নোট নিচ্ছেন। সেদিকে তাকিয়ে এরিকা বলে, গুড, হি ইজ নাও ডিপলি এনগেইজড, এ চান্সে আমি বাইরে গিয়ে একটু স্মোক করে আসি।
হলকক্ষের পেছন দিকে ম্যাক্স আর্নস্টের স্বপ্ন শিরোনাম দিয়ে একটি কামরায় কিছু হচ্ছে। নিতান্ত কৌতূহলবশত ওখানে উঁকি দেই। এদিকে পর্দায় মাল্টিমিডিয়ার আয়োজন হয়েছে। শিল্পীর ইমেজসমূহের খণ্ডিত অংশ যথা কাটা হাত, পাখি সাজা মানুষ ইত্যাদি ভেসে যাচ্ছে পর্দায়। বেঞ্চে বসে দুটি তরুণ, তাদের দিকে রূঢ় দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ম্যাক্সের ভাস্কর্য। আর আরেকটি যুবতী মেয়ে তার চিত্রের নগ্নিকার অনুসরণে উন্মুক্ত বক্ষা হয়ে একটি ইমেজের সম্পূর্ণ মেরুদণ্ডের হাড়গোড় ছুঁয়ে ছুঁয়ে বাজিয়ে যাচ্ছে হার্প। দেয়ালের আয়নায় সমস্ত কিছুর প্রতিফলন হচ্ছে। এ দৃশ্যপটের দিকে তাকিয়ে থাকলে এ বয়সেও সৃষ্টি হয় অহেতুক উত্তেজনার। এবং তার তোড়ে দাদাবাদে এতক্ষণ যে সবক নিয়েছি তা বরবাদ হওয়ার উপক্রম হয়। সুতরাং দ্রুত বেরিয়ে আসি লবিতে।
লবির শেষে ওপরে ওঠার স্প্যাইরাল সিঁড়ি। মারমেল পাথরের এ সিঁড়ি যেন ঘুরে ঘুরে পাকচক্রে জড়িয়ে উঠে যাচ্ছে স্বর্গের দিকে। আর তার গোড়ায় চিৎপাত হয়ে অবহেলায় পড়ে আছে গুস্তাবের লাশ। ভালো করে তাকিয়ে দেখি তার মুঠোয় শক্ত করে ধরা ধূপদানিটি, পাশে গড়াচ্ছে টাকিলার গেলাশ ও কাটা লেবু। না গুস্তাব অক্কা পাননি, সাময়িকভাবে দেহ রক্ষা করছেন মাত্র। তার অভ্যন্তরে টাকিলা ক্রিয়া করছে কি না।
প্রদর্শনীতে ফিরে যেতে ইচ্ছা হয় না, তাই বাইরে বেরিয়ে আসি। ব্রোঞ্জের অশ্বারোহী মূর্তির আড়াল থেকে সিগ্রেট ফুঁকতে ফুঁকতে এরিকা ঠোঁট গোল করে শিস দিয়ে আমাকে কাছে ডাকে।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, জানুয়ারী ১৪, ২০১০
Leave a Reply