সত্যেন সেন সত্যেন সেনের (১৯০৭-৮১) ঔপন্যাসিক সত্তাকে বিবেচনা করতে গেলে তাঁর গোটা জীবনের ওপরও একবার দ্রুতলয়ে চোখ বুলিয়ে নেওয়া ভালো। রাজনীতিকেই তিনি করেছিলেন জীবনের ধ্রুবতারা। স্বদেশানুরাগের বশবর্তী হয়ে স্কুলজীবনেই যুক্ত হয়েছিলেন কংগ্রেসের অসহযোগ আন্দোলনে (১৯২১)। উদ্দেশ্য, উপনিবেশবাদী শাসন-শোষণের বিরুদ্ধে ভারতবর্ষের স্বাধীনতা ও মুক্তিসাধন। কিন্তু তাঁর আকাঙ্ক্ষাকে তুষ্ট করতে পারেনি কংগ্রেসের অহিংস জাতীয়তাবাদী সংগ্রাম। তিনি কলেজজীবনে এসে দীক্ষা নেন সশস্ত্র স্বদেশী ব্রতে (১৯২৪)। স্বদেশমুক্তির এই আকাঙ্ক্ষা নিয়েই ক্রমশ তিনি উপলব্ধি করেন যে এটিও যথার্থ পথ নয়। কেননা অহিংস, সহিংস যে-প্রক্রিয়ায়ই হোক, এরূপ জাতীয়তাবাদী লড়াই দেশকে রাজনৈতিকভাবে স্বাধীন করতে পারলেও দেশের দরিদ্র শ্রমজীবী মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি সাধনে সক্ষম হবে না। অতএব গত শতকের ত্রিশের দশকে মানবমুক্তির পথ হিসেবে তিনি মার্কসীয় ভাবাদর্শকেই সর্বোত্তম বলে বিবেচনা করেন এবং দেশ ও সমাজের শোষণমুক্তিকেই জীবনের একমাত্র লক্ষ্য করে তোলেন। তাঁর পরবর্তী জীবন সম্পূর্ণভাবে নিবেদিত হয় শোষিত-বঞ্চিত-অবহেলিত ও দলিত মানুষের মুক্তিকামনায়।
১৯৪৭ সালে পাকিস্তান সৃষ্টির পর মার্কসবাদী রাজনীতিকদের ওপর নির্যাতন-নিপীড়ন তীব্রতর হলে সত্যেন সেনকে পরবর্তী ২৪ বছরের অধিকাংশ সময়ই কাটাতে হয় জেলের ভেতর। অতঃপর উপনিবেশবাদসৃষ্ট এ কারাগারকেই তিনি পরিণত করেন উপনিবেশবাদবিরোধী সংগ্রামের মূল হাতিয়ারে। কারাগারের অখণ্ড অবসরে নিরবচ্ছিন্ন অধ্যয়নের পাশাপাশি মননশীলতা ও সৃষ্টিশীলতার চর্চার মাধ্যমে তিনি ওই পরাধীনতার নরককেই রূপান্তরিত করেন স্বর্গের উদ্যানে। রাজনৈতিক কর্মী ও সংগঠকের পরিবর্তে লেখকসত্তার জাগরণে তিনি উদ্ভাসিত হন নতুন পরিচয়ে। তাঁর বিজ্ঞানমূলক ইতিহাস-অন্বেষী রচনার বিষয় অবশ্য সীমাবদ্ধ থাকে ঔপনিবেশিক শাসকদের দ্বারা সরবরাহকৃত কারা-লাইব্রেরির গ্রন্থতালিকার ওপর। অন্যদিকে তাঁর উপন্যাসের কাহিনিতে নিজের জীবনাভিজ্ঞতার পাশাপাশি অন্বিষ্ট হয় কারাবন্দী মানুষগুলোর বৈচিত্র্যময় জীবনাখ্যান। শুধু রাজবন্দী নয়, চোর-ডাকাত-খুনি-পকেটমার-ধর্ষক কারও জীবনই সেই অন্বেষণে গুরুত্বহীন বিবেচিত হয় না। কঠোর অধ্যবসায়ের মাধ্যমে কারাপ্রকোষ্ঠের শৃঙ্খলিত জীবনকেই তিনি এভাবে পত্রপুষ্পে শোভিত করে তোলেন।
আসলে বিষয়-অন্বেষার সীমাবদ্ধতাকে তিনি অতিক্রম করে যান জীবনদৃষ্টির ঔদার্য ও সমগ্রতায়। মার্কসীয় জীবনাদর্শ এ ক্ষেত্রে তাঁর সহায়ক হয়। ওই ভাবাদর্শই তাঁকে উন্নীত করে সংস্কারমুক্ত বিজ্ঞানধর্মী বাস্তবতাবোধে। জীবন যে এক কঠিন দ্বন্দ্বময় ব্যাপার, সেই উপলব্ধিও তিনি অর্জন করেন ওই আদর্শের অনুপ্রেরণায়। ইতিহাসকেও তিনি অনুধাবন করেন ওই দ্বন্দ্বমূলক দৃষ্টিভঙ্গির সহায়তায়। ইতিহাসের অগ্রযাত্রায় এবং মানবসভ্যতা বিনির্মাণে পরিশ্রমজীবীদের অবদানই যে মুখ্য, সেই বোধটিও তিনি আয়ত্ত করেন ঐতিহাসিক বস্তুবাদী দর্শনের আলোকে। আর এ সবকিছুই তাঁর মহৎ ঔপন্যাসিক সত্তা নির্মাণে পালন করে তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা। তিনি তাঁর রাজনৈতিক অভিজ্ঞানের মাধ্যমেই আয়ত্ত করেন একজন সার্থক ঔপন্যাসিকের জন্য অপরিহার্য সংস্কারশূন্য, সর্বগ্রাহী, সেক্যুলার ও সমগ্রতাস্পন্দী জীবনদৃষ্টি।
সত্যেন সেনের উপন্যাসসমগ্রকে তিনটি মোটা দাগে ভাগ করা সম্ভব—সামাজিক, রাজনৈতিক ও ইতিহাস-আশ্রয়ী। তবে স্মরণীয় যে উপরিতলশায়ী এই বিভাজনের অন্তরালে তাঁর সব উপন্যাসেই ফল্গুধারার মতো বহমান থাকে রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি, যা তাঁকে সবলভাবে দাঁড় করিয়ে দেয় উপনিবেশবাদের বিপক্ষে। ফলে তাঁর প্রতিটি উপন্যাসই হয়ে ওঠে একেকটি তাৎপর্যপূর্ণ রাজনৈতিক আখ্যান। উপন্যাসগুলোর স্বতন্ত্র বিশ্লেষণেই প্রতিপন্ন হবে এ বক্তব্যের যথার্থতা।
নিম্নবর্গের প্রতি শ্রদ্ধা ও দেশভাগ
সত্যেন সেনের সামাজিক উপন্যাসের তালিকায় উল্লেখযোগ্য: রুদ্ধদ্বার মুক্তপ্রাণ (১৯৬৬), সেয়ানা (১৯৬৮), পদচিহ্ন (১৯৬৮), এ কূল ভাঙে ও কূল গড়ে (১৯৭১) প্রভৃতি। এসব উপন্যাসে তিনি সামাজিক সমস্যার কেন্দ্রে উপস্থাপন করেছেন একটি রাজনৈতিক সত্যকে, যা ১৯৪৭-এ ভারতবর্ষ ও বাংলাকে করেছে দ্বিখণ্ডিত; যার পেছনে সক্রিয় ছিল উপনিবেশবাদী চক্রান্ত, যা এ দেশের দুই প্রধান সম্প্রদায়ের মধ্যে বুনে দিয়েছে অবিশ্বাস, সন্দেহ ও বিভেদের বীজ। যার পরিণতিতে সংঘটিত হয়েছে জন্মভূমি থেকে উন্মূলিত হওয়ার এক রক্তক্ষয়ী যন্ত্রণাকর বাস্তবতা। কিন্তু ঔপন্যাসিক হিসেবে সেক্যুলার দৃষ্টিভঙ্গি তাঁর নিরাসক্তি চেতনাকে যেমন সমৃদ্ধ করেছে, তেমনি এসব উপন্যাসকে করেছে গৌরবান্বিত। সর্বত্রই জয় ঘোষিত হয়েছে মানবমহিমার।
রুদ্ধদ্বার মুক্তপ্রাণ-এর কেন্দ্রীয় চরিত্রের হূদয়ে যে রক্তক্ষরণ, তার মূলে রয়েছে দেশভাগের যন্ত্রণা, যা তার আত্মাকে করেছে দ্বিখণ্ডিত। কিন্তু বৃহত্তর দেশভাবনা তার হার্দ্য আবেগকে করেছে স্থির ও সংযত। তার স্বদেশচিন্তার সূত্র ধরেই উপন্যাসের উপজীব্য হয়েছে কারাবন্দী বিচিত্র মানুষের জীবনোল্লাস। তাদের বন্দিত্বের পেছনে যদিও কার্যকারণ হিসেবে সক্রিয় থাকে চৌর্যবৃত্তি, দস্যুবৃত্তি, খুন, ধর্ষণ প্রভৃতির অভিযোগ; কিন্তু মনুষ্যত্বের মহিমা নিয়েই উপন্যাসের চরিত্র হিসেবে তারা হয়ে ওঠে তাৎপর্যপূর্ণ। নিম্নবর্গের এমন চরিত্রকে তুচ্ছ-ক্ষুদ্র হিসেবে নয়, মানুষ হিসেবে বিবেচনার মাধ্যমে সত্যেন সেনের ঔপন্যাসিক সত্তা সার্থকতা অর্জন করে।
সেয়ানা উপন্যাসে বিন্যস্ত হয়েছে একজন পকেটমারের জীবনকাহিনি। এমন একটি নিম্নবর্গীয় চরিত্রকে নিয়ে গোটা উপন্যাস পরিকল্পনার মধ্যে লেখকের সাহসের পরিচয় আছে। এ উপন্যাসেও লেখক তাঁর মানবীয় যন্ত্রণার বিচিত্রমাত্রিক রূপই চিত্রিত করেছেন। উচ্চকিত করে তুলেছেন তাঁর মনুষ্যত্ববোধের নানা প্রান্তকে। দেশভাগের মতো রাজনৈতিক ঘটনা তার গোপন ব্যবসাবৃত্তির পরিসরকে সংকীর্ণ করে তার জীবিকাকে কীভাবে সংকটগ্রস্ত করেছে তারও মর্মান্তিক আখ্যান হয়ে উঠেছে এই উপন্যাস। ব্যক্তির ক্ষুদ্র জীবনপরিসরে তিনি সন্ধান করেছেন বৃহত্তর রাজনৈতিক ঘটনার তাৎপর্যকে।
পদচিহ্ন উপন্যাসে গ্রামীণ পটভূমিতে বিশ্লেষিত হয়েছে দেশভাগের পরিণাম। সত্যেন সেনের সেক্যুলার চিন্তার সার্থক রূপায়ণ ঘটেছে এই উপন্যাসে। মার্কসীয় ভাবাদর্শপুষ্ট রাজনীতিভাবনাই তাঁকে দিয়েছে উদার দৃষ্টিভঙ্গি এবং সাম্প্রদায়িক সংকীর্ণতা থেকে মুক্তি। ফলে দুই সম্প্রদায়ের পারস্পরিক বিদ্বেষ ও অভিযোগের কোনো মোহই তাঁকে স্পর্শ করে না। বরং উভয়ের সংকীর্ণতার স্বরূপ তিনি চিত্রিত করেন এবং আশ্রয় নেন ইতিহাসের বৃহত্তর কালগত পরিপ্রেক্ষিতে। ফলে সমকালীন রাজনীতির বিষবাষ্প যেমন তাঁর ঔপন্যাসিক সত্তাকে আচ্ছন্ন করতে পারে না, তেমনি পাঠককেও তিনি প্রকৃত সত্য অনুধাবনের সুযোগ করে দিতে পারেন।
এ কূল ভাঙে ও কূল গড়ে উপন্যাসে উপস্থাপিত হয়েছে নদীচরকেন্দ্রিক পূর্ববাংলার চিরকালীন বিরোধমূলক সংকটের একটি সামাজিক ভাষ্য। তবে লেখক চল্লিশের দশকের রাজনীতির বিদ্বেষমূলক বৈশিষ্ট্য গ্রামের শান্ত জীবনধারায় কী চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছে, তারও বয়ান উপস্থিত করেছেন। কিন্তু দেখিয়েছেন বিভেদমূলক রাজনীতির বিষয়টি অনেকটা আপেক্ষিক; বরং ধর্ম-বর্ণ-সম্প্রদায়গত পরিচয়ের ঊর্ধ্বে এই জীবনধারায় সর্বদাই ধ্বনিত হয় মানবিকতার সুর। উপন্যাসেই লেখক উচ্চকিত রেখেছেন তাঁর শ্রেণি-দৃষ্টিভঙ্গি। রাজনৈতিক হিংসা সৃষ্টির পেছনে শোষক বিত্তবানদের ভূমিকাই যে প্রধান, সেই সত্য উন্মোচনে তিনি থেকেছেন নির্দ্বিধ।
তাৎপর্যপূর্ণ রাজনৈতিক আখ্যান
অপরোক্ষ রাজনৈতিক প্রতিবেদন হিসেবে সত্যেন সেনের যেসব উপন্যাসকে বিবেচনা করা যায়, তার মধ্যে রয়েছে: সাত নম্বর ওয়ার্ড (১৯৬৯), উত্তরণ (১৯৭০) ও মা (১৯৭০)। এসব উপন্যাসে ব্যক্ত হয়েছে লেখকের সুগভীর রাজনৈতিক বোধ ও চিন্তার পরিশীলিত রূপ এবং একটি সুসংহত ও পরিমার্জিত রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি। এতে তিনি উপস্থাপন করেছেন রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহের অসাধারণ শক্তিকে। যে শক্তি কেবল রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক জীবনকেই বদলে দেয় না, মানবমনকেও পাল্টে দেয় বিপুলভাবে। সাত নম্বর ওয়ার্ড উপন্যাসে সেবিকাদের বঞ্চনাবিরোধী অধিকার প্রতিষ্ঠার ধর্মঘট-সংগ্রামও রাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে এর অসাধারণ প্রভাববিস্তারী ক্ষমতার কারণে। এ ধরনের সংগ্রামের মূলে থাকে যে ঐক্যের শক্তি, তা ভীরু সব মনকেও কেমন সাহসী ও বুদ্ধিদীপ্ত করে তোলে, লেখক তা দেখিয়েছেন। অন্যদিকে সাধারণ রোগীকেও তা করে তোলে এই সংগ্রামের প্রতি সহানুভূতিশীল ও একাত্ম, প্রতিপক্ষের মনে উদ্রেক করে আতঙ্কের অনুভূতি। একটি সাধারণ পেশাগত আন্দোলনও রাজনৈতিকভাবে কতটা শক্তির আধার হতে পারে এবং তা জন্ম দিতে পারে বিচিত্র মাত্রার প্রতিক্রিয়া, এই উপন্যাসের স্বল্প পরিসরের মধ্যে লেখক তা উপস্থাপন করায় রাজনৈতিক প্রতিবেদন হিসেবে এটি তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
এদিক থেকে উত্তরণ উপন্যাসের পটভূমি অনেক বিস্তৃত। এ দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ কালকে তাঁর সমস্ত ব্যঞ্জনা ও বৈচিত্র্যসমেত উপস্থাপন করা হয়েছে এ উপন্যাসে। চল্লিশের দশকের উত্তাল ঘটনাবলির তরঙ্গাভিঘাতে এ দেশে কী বিপুল পরিবর্তন সাধিত হয়েছিল, একটি চরিত্রের রূপান্তরশীলতার মধ্য দিয়ে লেখক তা উপস্থাপন করেছেন। একটি সাধারণ চাকরিজীবী মানুষও কীভাবে শোষণ-প্রক্রিয়া সম্পর্কে সচেতন হয়ে প্রতিবাদ সংঘটিত করে, নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে, তারই এক তাৎপর্যময় আখ্যান রচিত হয়েছে এ উপন্যাসে। মানুষের মন যে সদা পরিবর্তনশীলতার মধ্য দিয়ে অগ্রসর হয়, সেই পরিবর্তন-প্রক্রিয়ায় গৃহকোণে আবদ্ধ একটি মানুষও কীভাবে সমষ্টির সংগ্রাম আন্দোলনের মধ্যমণি হয়ে উঠতে পারে, রাজনীতির এই দ্বান্দ্বিক পাঠটি এ উপন্যাসে লেখক রচনা করেছেন।
আর মা উপন্যাস হয়ে উঠেছে এ দেশে বামপন্থি ও জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের মধ্যকার দ্বন্দ্বের এক ঐতিহাসিক দলিল। এ দেশের সশস্ত্র স্বদেশীদের মধ্য থেকেই একসময় মার্কসবাদে দীক্ষিত বামপন্থি কর্মীরা সৃষ্টি হয়। রূপান্তরের এ ঘটনা সাধারণত ঘটে জেলের ভেতর মার্কসবাদী বইপত্র পাঠের মাধ্যমে। মার্কসবাদীরা উপলব্ধি করে যে স্বদেশীদের সহিংস সশস্ত্রতার মধ্য দিয়ে শ্রমজীবীদের মুক্তি সম্ভব নয়। কেননা সশস্ত্র স্বদেশীরা প্রকাশ্যে জাতীয়তাবাদী কংগ্রেসের পতাকাতলে সমবেত হয়ে স্বাধীনতা আন্দোলনকে বেগবান করতে চায়। কংগ্রেসের রাজনীতিতে এ দেশের শোষককুল সক্রিয় থাকায় শ্রমিকস্বার্থ রক্ষাকারী বামপন্থিদের সঙ্গে তাদের বিরোধ হয়ে ওঠে অনিবার্য। মা উপন্যাস এই দ্বন্দ্ব-বিরোধের আখ্যান হিসেবে তাৎপর্য অর্জন করেছে।
ইতিহাসের নতুন পাঠ
সত্যেন সেন রচিত ইতিহাস-আশ্রয়ী উপন্যাসের সংখ্যাই বেশি এবং এ ক্ষেত্রে তাঁর সাফল্যও সর্বাধিক। এ জাতীয় উপন্যাসের মধ্যে উল্লেখযোগ্য: অভিশপ্ত নগরী (১৯৬৭), পাপের সন্তান (১৯৬৯), পুরুষমেধ (১৯৬৯), কুমারজীব (১৯৬৯), বিদ্রোহী কৈবর্ত (১৯৬৯), আলবেরুণী (১৯৬৯), অপরাজেয় (১৯৭০) প্রভৃতি। ইতিহাসের যেসব উপাদান নিয়ে তিনি উপন্যাস রচনা করেছেন, তার কালসীমা খ্রিষ্টপূর্ব কয়েক শতক থেকে খ্রিষ্টীয় উনিশ শতক পর্যন্ত বিস্তৃত। বৈদিক যুগের ভারতকে পটভূমি করে লেখা পুরুষমেধ উপন্যাসের পাশাপাশি তিনি লিখেছেন অভিশপ্ত নগরী ও পাপের সন্তান, যাতে পরস্ফুিটিত হয়েছে খ্রিষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে জেরুজালেম নগরীর পতন এবং তার পরবর্তী পুনর্গঠনের জীবনচিত্র। খ্রিষ্টীয় তৃতীয় শতকের বৌদ্ধ পণ্ডিত কুমারজীবের অহিংস জীবনবোধ নিয়ে আখ্যান রচনার পাশাপাশি বাংলায় পালযুগের বৌদ্ধ শাসনামলেই সংঘটিত শূদ্রদের বঞ্চনাবিরোধী জীবনসংগ্রামের ভাষ্য রচনা করেন বিদ্রোহী কৈবর্ত উপন্যাসে। খ্রিষ্টীয় এগারো শতকের মুসলিম জ্ঞানসাধক আলবেরুনীর সংগ্রামশীল জীবনের আখ্যান রচনার পাশাপাশি তিনি উনিশ শতকে সংঘটিত ভারতবর্ষের উপনিবেশবাদবিরোধী প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রামের গৌরবদীপ্ত কাহিনি বয়ান করেন অপরাজেয় উপন্যাসে; সাম্প্রদায়িক মনোভঙ্গির কারণে যে ঘটনাকে সমকালীন লেখকেরা গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনা করেননি কিংবা সচেতনভাবে করেছেন উপেক্ষা।
কিন্তু সত্যেন সেনের সংগ্রাম মূলত উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে এবং তিনি মানবধর্মে বিশ্বাসী। সম্প্রদায়গত সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে তিনি এক বিশ্বনাগরিক। তাঁর ইতিহাস পরিভ্রমণের অর্থ ইতিহাসের অব্যাহত বিনির্মাণ, নতুন নতুন পাঠসৃজন। তাঁর কাছে ইতিহাস শোষক ও রাজন্যবর্গের কীর্তিগাথা নয় বরং শোষিত-নিপীড়িতজনের সংগ্রামী জীবনভাষ্য। ইতিহাস ব্যাখ্যায় বা জ্ঞানকাণ্ড সৃষ্টিতে তিনি লক্ষ করেন, সর্বদাই শোষককুল আপন স্বার্থতাড়িত ও আধিপত্য বিস্তারে দ্বিধাহীন। ফলে প্রচলিত ইতিহাসের ধারা থেকে তিনি মুখ ফিরিয়ে নেন এবং চেষ্টা করেন প্রকৃত ইতিহাসনির্মাতাদের খুঁজে বের করার। এ কারণেই তাঁর কাছে গুরুত্বপূর্ণ কুমারজীব আলবেরুণীর শোষক-স্বার্থবিরোধী জ্ঞানসাধনা, মধ্যযুগে কৈবর্ত্যদের কিংবা আধুনিক যুগে সিপাহীদের ক্ষমতাকেন্দ্র দখলের সংগ্রামী অভিযান। তিনি মনে করেন, পরিশ্রমজীবীরাই সভ্যতার নির্মাতা, প্রথাগত ইতিহাস যে সত্যকে অস্বীকার করছে। তিনি ইতিহাস-অনুসন্ধানে যথার্থভাবেই লক্ষ করেন যে ধর্মতন্ত্রের শক্তি ও শোষকশক্তি সর্বদাই জোটবদ্ধ এবং তাদের প্রতিপত্তির কাছে নিম্নবর্গীয়রা চিরদিন অসহায়ভাবে আত্মসমর্পণে বাধ্য। তবু তিনি জেরুজালেম নগরীর দাসসমাজের বঞ্চনার ব্যথাকে তুলে ধরে তাদের মুক্তির কথা ভাবেন। তিনি তাঁর লেখনীকে দাঁড় করান দাসতন্ত্র, ধর্মতন্ত্র, সামন্ততন্ত্র, পুঁজিতন্ত্র, উপনিবেশতন্ত্র—সবকিছুর বিরুদ্ধে। এবং সব কালের দলিতজনদের মুক্তির আকাঙ্ক্ষা নিয়ে তিনি এক নতুন জীবনভাষ্য রচনা করেন। এখানেই তাঁর ইতিহাস-অন্বেষার স্বাতন্ত্র্য। এখানেই তাঁর ঔপন্যাসিক সত্তা আধুনিকতায় মণ্ডিত হয়ে পড়ে। এখানেই তাঁর রাজনৈতিক বোধটি স্বচ্ছতা অর্জন করে।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, জানুয়ারী ০৭, ২০১০
Leave a Reply