বীরাঙ্গনাদের নান্দীপাঠ
কাজল রশীদ
মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস বাঙালি জাতির হাজার বছরের ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ সময়। গাঙ্গেয় ব-দ্বীপের মানুষের পক্ষে সেই স্মৃতি কখনো ভোলার নয়। দুঃখ-বেদনা-যন্ত্রণার সঙ্গে আনন্দ-খুশির অবর্ণনীয় অভিজ্ঞতায় ঋদ্ধ ১৯৭১। পৃথিবীর ইতিহাসে বাঙালির মতো প্রাণ বিসর্জনের ঘটনা বিরল। স্বাধীনতার জন্য ৩০ লাখ শহীদের আত্মোৎসর্গের সঙ্গে রয়েছে চার লাখ মা-বোনের নারীজীবনের সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকারের নজির। আমাদের স্বাধীনতার অর্জনে, মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ে রয়েছে জানা-অজানা মা-বোনের দীর্ঘশ্বাস, আর দেশকে ভালোবেসে, দেশপ্রেমের অগ্নিমন্ত্রে উজ্জীবিত হওয়ার অনির্বাণ অধ্যায়, যা গল্পের মতো হয়েও অবিশ্বাস্য গল্প-কাহিনির জনয়িতা। কল্পনা এখানে নতজানু হয়; মানুষ তার বিনম্র নান্দীপাঠ করে।
দুঃখজনক বাস্তবতা হলো, গৌরবের সেসব ঘটনা আজও লিখিত হয়নি। ইতিহাসের সোনালি অতীতে মেলেনি স্থান। বিস্মৃতির অতলে যা হারিয়ে যাচ্ছে। যার বিপরীতে দাঁড়িয়ে প্রশংসাযোগ্য একটি ক্ষেত্রসমীক্ষার কাজ সম্পন্ন করেছেন সুরমা জাহিদ। সেই গবেষণালব্ধ প্রয়াস বীরাঙ্গনাদের কথা। মুক্তিযুদ্ধে তাঁদের ত্যাগ সর্বোচ্চ হলেও মুক্তিযুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে তাঁরা সবচেয়ে বঞ্চিত-অবহেলিত। সামাজিকভাবেও নিগৃহীত। কোনো রকম খোঁজখবর কারও জানা নেই। মুক্তিযোদ্ধাদের নানাভাবে রাষ্ট্রীয় সাহায্য-সহযোগিতা ও পৃষ্ঠপোষকতা করা হলেও বীরাঙ্গনারা সবকিছু থেকে বঞ্চিত। অথচ স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে সর্বোচ্চ উষ্ণীষ পাওয়ার যৌক্তিক দাবিদার তাঁরা। কিন্তু ইতিহাসের কোথাও যথাযথ মর্যাদায় তাঁদের স্থান দেওয়া হয়নি। লোকচক্ষুর আড়ালেই রয়ে গেছে মুক্তিযুদ্ধে তাঁদের ত্যাগের মহিমা।
সুরমা জাহিদ দেশের বিভিন্ন স্থানের ৫০ জন বীরাঙ্গনার সেই মহিমা তুলে ধরেছেন। সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে, সরেজমিনে এসব তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করা হলেও উপস্থাপন করা হয়েছে বর্ণনাত্মক ভঙ্গিতে। পাঠ-উপযোগিতা বৃদ্ধিতে যা সহায়ক হয়েছে।
’৭১-এর নির্মম অভিজ্ঞতা বীরাঙ্গনাদের কাছে স্বতন্ত্র। মোটা দাগে যা এক মনে হলেও অভিনিবেশী পাঠক খুঁজে পাবেন প্রকৃত সত্য। পাকিস্তান আর্মির অত্যাচার, নির্যাতন, মনোবৃত্তি কতটা পৈশাচিক ও অমানবিক হতে পারে, তার জীবন্ত দলিল এই বই; যার প্রতিটি পৃষ্ঠা ট্র্যাজেডির অশ্রুতে সিক্ত, যা ভূলুণ্ঠিত মানবতা আর নারকীয় তাণ্ডবলীলার ঐতিহাসিক সাক্ষী। যেমন: ‘তাঁদের শুধু একটাই কাজ ছিল। একজনের পর আরেকজন আসতই। যদি কোনো দিন বাচ্চাকে দুধ খাওয়াতাম, তা দেখেও তারা ক্ষেপে যেত। এই ছোট বাচ্চাকে মায়ের কোল থেকে টান মেরে ঢিলা দিয়ে ফেলে, তারপর তারা তাদের কাজ করত, আর বাচ্চাটা পড়ে কান্না করতে করতে একসময় ঘুমিয়ে পড়ত। আমার তাকে কোলেও তুলে নেওয়ার সময় বা সাহস কিছুই ছিল না, শুধু তাকিয়ে তাকিয়ে দেখা ছাড়া। আচ্ছা তারা কি মানুষ ছিল? না অন্য কিছু। আসলে দেখতে কেমন ছিল না? এই উঁচু, লম্বা, বড় বড় গোঁফ, কালো, মোটা মাঝেমধ্যে মনে হতো কোনো রাক্ষস বা দৈত্য বুঝি। দেখলেই ভয়ে সব ভুলে যেতাম। যেমন জানোয়ারের মতো ছিল দেখতে, কাজগুলোও করত জানোয়ারদের মতোই।’ (পৃষ্ঠা: ২৫৪)
এ রকম অজস্র ঘটনা। মা-বোনদের সম্ভ্রমহানির মধ্য দিয়ে অর্জিত হয়েছে এই দেশের স্বাধীনতা। অথচ স্বাধীন বাংলাদেশ তাঁদের কোনো খোঁজখবর রাখে না, যা নিয়ে তাঁদের রয়েছে সীমাহীন ক্ষোভ। যেমন লেখা হয়েছে: ‘হারামজাদা কুত্তাগুলো লাফাইয়া লাফাইয়া এসে আমার উপর পড়ছে। প্রথমে আমি তো ভয়ে চিল্লাচিল্লি শুরু করি। তারপর শুরু করে। আমি কিছু বলার, কওয়ার সুযোগ পাই নাই। আমার চিল্লাচিল্লিতে তখন অনেক লোক জড়ো হয়েছে ঠিকই। কিন্তু সবাই খাড়াইয়া খাড়াইয়া তামাশা দেখছে। কেউ আসেনি এগিয়ে আমাদের সাহায্য করতে।…
আমি মাগি, নডি, বেশ্যা নাকি যে আমার এমন অবস্থা হবে। কেন হয়েছে। কেন জানতে আইছ। জেনে কি কিছু করতে পারবা। কিছু করতে পারবা না। তবে কেন শুধু শুধু আইছ।’ (পৃষ্ঠা: ৭৬ ও ৭৭)
স্বাধীনতার ৪০ বছর উদ্যাপনের দ্বারপ্রান্তে এসেও আমরা কিছুই করতে পারিনি আমাদের বীরাঙ্গনাদের জন্য। তাঁদের সম্পর্কে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গিরও পরিবর্তন হয়নি। তাঁদের নিয়ে রচিত হয়নি মহৎ কোনো সাহিত্য, নির্মিত হয়নি উচ্চকিত হওয়ার মতো কোনো চলচ্চিত্র। যার মধ্য দিয়ে মূলত প্রতিভাত হয়েছে আমাদের খর্বাকায় মানসপ্রবৃত্তি, যা আমাদের লজ্জা-বেদনা আর ব্যর্থতার তালিকাকে করেছে দীর্ঘ।
বীরাঙ্গনাদের কথা বইয়ের নিবিড় পাঠ সেই সত্যকে গভীরভাবে আলোড়িত করে। সুরমা জাহিদ আলোচ্য বইয়ে গবেষণার প্রকৃত নির্যাসই তুলে ধরেছেন। যাতে উপস্থাপিত হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের মৌল চেতনা ও সত্য ঘটনাবলির দলিল-দস্তাবেজ সাপেক্ষে গল্পের সরলীকরণ।
গবেষণাটি নিঃসন্দেহে মৌলিক ও সাহসী চেতনায় সমুজ্জ্বল। প্রত্যাশিত ছিল আরও বেশি মনোযোগ। ঘটনার উপস্থাপন, বাক্যের গঠন ও বানান বিভ্রাটজনিত সচেতনতা উৎকর্ষ বৃদ্ধিতে সহায়ক হতো।
প্রকৃত আবেদন ও নিবিড় পাঠকে হূদয়গ্রাহী করত। যেমন: ‘আমিতখন তাকে সব খুলে বলি।…এই আঁতুড় ঘরের সন্তান নিয়ে কেনো আমি ঘর ছাড়ছি বুঝতেই তো পারছেন।…তোরে পাহাড়া দিয়ে গাড়ি ভাড়া করে… সেই কালো ছায়া আমাদের ওপর পড়ক।’ এসব গৌণত্রুটি। কিন্তু মনোযোগ পীড়িত হয়। নতুন সংস্করণে এ বিষয়ে লেখকের মনোযোগ প্রত্যাশিত।
বীরাঙ্গনাদের কথায় একই সঙ্গে ঘৃণা ও শ্রদ্ধা গ্রন্থিত হয়েছে। ঘৃণা পাকিস্তানি হানাদার ও তাদের এ দেশীয় দোসরদের জন্য। আর ভক্তি-শ্রদ্ধা ও সম্মান সেসব মা-বোনের প্রতি, যাঁদের সম্ভ্রমের বিনিময়ে আমাদের স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে। বিশ্ব মানচিত্রে লাল-সবুজের পতাকা ঠাঁই পেয়েছে। কবি শামসুর রাহমান লিখেছেন: ‘তুমি আসবে বলে, হে স্বাধীনতা,/
সকিনা বিবির কপাল ভাঙলো/সিঁথির সিঁদুর মুছে গেল হরিদাসীর।’ [‘তুমি আসবে বলে, হে স্বাধীনতা’
অগণন সকিনা আর হরিদাসীর সম্ভ্রম হারানোর এই দেশে বীরাঙ্গনাদের প্রতি সর্বোচ্চ সম্মান ও শ্রদ্ধা প্রদর্শিত হোক। বীরাঙ্গনাদের কল্যাণে ব্রতী হোক মানুষ-সমাজ ও রাষ্ট্র। লিখিত হোক সকল বীরাঙ্গনার বুকভেদি দুঃখ-যন্ত্রণা আর কষ্টের ইতিহাস। পালিত হোক আপন আপন ভূমিকা। সুরমা জাহিদ যেমন পালন করেছেন লেখক ও গবেষকের ভূমিকা, বীরাঙ্গনাদের কথা বইয়ে।
বীরাঙ্গনাদের কথা—সুরমা জাহিদ। অন্বেষা, ঢাকা; ফেব্রুয়ারি ২০১০; প্রচ্ছদ: ধ্রুব এষ; ৪০০ টাকা; ৩৬৮ পৃষ্ঠা
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, জানুয়ারী ০৭, ২০১০
Leave a Reply