অর্থনীতির বিভ্রান্তি মোচনের চেষ্টা
আসজাদুল কিবরিয়া
অর্থনীতি আমরা যেভাবেই যতটুকু বুঝি না কেন, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের প্রভাব সবার ওপরই কম-বেশি পড়ে থাকে। আর তাই অর্থনীতি নিয়ে মাথা ঘামানোর চেষ্টা চলে বিভিন্নভাবে। তবে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের নীতিনির্ধারক কিংবা পেশাজীবী অর্থনীতিবিদ ও শিক্ষকদের মাথা ঘামানোর বিষয়টি অনেক বিস্তৃত পরিসরে হয়ে থাকে। তাঁদের অনেক দিক বিবেচনায় নিতে হয়, তত্ত্বীয় কাঠামোর আলোকে তথ্য-উপাত্তের সাহায্য অর্থনীতির বাস্তবতা সম্পর্কে অবহিত হতে হয়।
এ কাজটি খুব সহজসাধ্য নয়। নয় বলেই সবার জন্য এই কাজ নয়। নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে যাঁরা থাকেন, তাঁদের সিদ্ধান্ত গ্রহণের ভুল কিংবা তাঁদের যাঁরা পরামর্শ দিয়ে থাকেন, তাঁদের জানা-বোঝার ত্রুটি দীর্ঘ মেয়াদে দেশের অর্থনীতির ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। আর এই ভুল-ত্রুটির পেছনে কাজ থাকে অর্থনীতির বিভিন্ন দিক সম্পর্কে বিভ্রান্তি। সুতরাং, আগে প্রয়োজন এই বিভ্রান্তি মোচনের চেষ্টা করা। এ রকম চেষ্টার অংশ হিসেবেই অধ্যাপক এম এ তসলিম রচনা করছেন আনপ্লিজেন্ট ইকোনমিকস (অপ্রীতিকর অর্থনীতি) নামের বইটি।
প্রথমেই বলা দরকার যে বইটি আসলে গত তিন/চার বছরে একাধিক ইংরেজি জাতীয় দৈনিক ও ওয়েবে প্রকাশিত লেখকের বিভিন্ন লেখার একটি বাছাই সংকলন। এতে মোট ৪৫টি নিবন্ধ (একটি যৌথ রচনা) স্থান পেয়েছে। সবই ইংরেজিতে লেখা। বিষয়ের মধ্যে রয়েছে মূল্যস্ফীতি, মুদ্রানীতি থেকে আরম্ভ করে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ও শিল্পায়ন। তবে ঘুরে-ফিরে বেশির ভাগ নিবন্ধেই সমসাময়িক অর্থনৈতিক নীতি বিতর্ক বা সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে যেসব বিভ্রান্তি দেখা দিয়েছে, সেগুলো স্পষ্ট করার চেষ্টা রয়েছে। দেশে-বিদেশে অর্থনীতির অধ্যাপনার অভিজ্ঞতার আলোকে লেখক দক্ষতার সঙ্গে অর্থনীতির মৌলিক তত্ত্বের সঙ্গে বাস্তব অবস্থা মিলিয়ে দেখানোর চেষ্টা করেছেন। বোঝানোর চেষ্টা করেছেন বিভ্রান্তির স্বরূপটা। দু-একটা উদাহরণ এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে।
কয়েক বছর ধরে বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বৃদ্ধির জন্য বারবারই ব্যবসায়ীদের অসাধু চক্র বা সিন্ডিকেটকে অভিযুক্ত করা হচ্ছে। এ বিষয়টি উল্লেখ করে এম এ তসলিম বলছেন, ‘যখন দাম বাড়ার জন্য এটি (সিন্ডিকেট) একটি সম্ভাব্য কারণ হতে পারে, তখন সমস্যা হলো এই যে কেউই সন্দেহের সীমা ছাড়িয়ে দেখাতে পারছেন না যে এই চক্র কোথায় অবস্থিত বা কীভাবে এই চক্র বাংলাদেশে কাজ করে।’ (পৃষ্ঠা: ৪৭) আরেকটি জায়গায় তিনি বলছেন ‘এই কার্টেলের উপস্থিতি অনিবার্যভাবেই বাজারে দামের বৃদ্ধি ঘটায় না। বরং অনেক ক্ষেত্রে তা দাম কমিয়ে দেয়।’ (পৃ: ১৮০) মন্ত্রী-আমলাসহ অনেক বুদ্ধিজীবী ও অর্থনীতিবিদ যখন জোর-গলায় সিন্ডিকেটের কথা বলেন, তখন এম এ তসলিম প্রশ্ন করেন, ‘কেন এসব বিশিষ্ট ব্যক্তি জনগণের সামনে সিন্ডিকেটের বিষয়ে সুস্পষ্ট কোনো সাক্ষ্য-প্রমাণ হাজির করছেন না? আদৌ কি এসব সাক্ষ্য-প্রমাণ আছে? নাকি তা প্রকাশ করা খুব বিপজ্জনক?’ (পৃ: ১৫০)
কিংবা ধরা যাক বিলাসদ্রব্যে করারোপের বিষয়টি। ২০০৯-১০ অর্থবছরের বাজেটে বিলাসদ্রব্য হিসেবে মোটর গাড়ি ও ফ্রিজের ওপর কর বাড়ানো হয়। এর উল্টোদিকটি তুলে ধরে এম এ তসলিম যা বলছেন তা মোটাদাগে এ রকম: উচ্চহারে করারোপের ফলে তুলনামূলক কম আয়ের লোকজনের এসব পণ্য ক্রয়ের ক্ষমতা কমে যাবে। এতে করে এসব পণ্যের চাহিদাও কমবে। ফলে এসব সামগ্রী বিক্রিও শ্লথ হয়ে পড়বে। আর তাই শেষ পর্যন্ত বিলাস কর আদায় আর কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে পৌঁছাবে না। অন্যদিকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে এসব পণ্য ক্রয়ের ক্ষেত্রে সরকার নিজেও বড় ক্রেতা। তাই উচ্চ করের জন্য সরকারকেই বেশি রাজস্ব ব্যয় করতে হবে। (পৃ: ৪৫-৪৬)
নিবন্ধগুলোর বেশির ভাগই আয়তনে ছোট। তবে সুবিন্যস্ত। ভাষা বেশ প্রাঞ্জল। সবচেয়ে বড় কথা বিষয়ের ওপর লেখকের দখল ও দক্ষতা এতটাই প্রতিষ্ঠিত যে বেশি কথা না বলেই তিনি অনেক কিছু বুঝিয়ে দিয়েছেন। অর্থনীতির ছাত্র-শিক্ষকসহ অর্থনীতি চর্চাকারীদের জন্য বইটি তাই অবশ্যপাঠ্য। অর্থনীতি সম্পর্কে আগ্রহীরা বইটি হাতে নিলে বিষয়ের প্রতি তাঁদের আগ্রহ বাড়বে। আর যাঁরা শৌখিন অর্থনীতিবিদ বা অর্থনীতি বিশ্লেষক, তাঁরা নিজেদের দুর্বলতা ও সীমাবদ্ধতা বুঝতে পারবেন।
আনপ্লিজেন্ট ইকোনমিকস—এম এ তসলিম \ জাগৃতি, ঢাকা, ২০১০ \ প্রচ্ছদ: রিদাত ফারহান \ ২৪০ পৃষ্ঠা \ ৩৫০ টাকা
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, জানুয়ারী ০৭, ২০১০
Leave a Reply