সমাজ-সংসারের মানস-মানচিত্র
মাহবুব আলম
পাতা উল্টাই—মোজাফফর হোসেন \ ফেব্রুয়ারি ২০১০ \ বোধি প্রকাশ,
ঢাকা \ প্রচ্ছদ: সব্যসাচী হাজরা \ ১৫১ পৃষ্ঠা \ ১৭০ টাকা
পাতা উল্টাই আত্মজৈবনিক রচনা হলেও কারও কারও হয়তো একে প্রথাসিদ্ধ আত্মজীবনী বলতে দ্বিধা হতে পারে। দর্শনের অধ্যাপক মোজাফফর হোসেন (৭ ডিসেম্বর ২০১০ তিনি মৃত্যুবরণ করেন) তাঁর দেখা সমাজ ও সময়কে আত্মস্থ করেছেন নিজস্ব জীবন-দর্শনের আলোকে। এরই টুকরো টুকরো স্মৃতি এই বইয়ে বিধৃত হয়েছে। স্বগতোক্তির মতো কয়েকটি ছোট পরিচ্ছদও এখানে রয়েছে, যাকে ঠিক প্রবন্ধের পর্যায়ে ফেলা যায় না অথচ চিন্তাকে উসকে দেয়। একই সঙ্গে আছে পঞ্চাশ-ষাটের দশকের উত্তরের জেলাগুলোর ভূমিনির্ভর আর্থসামাজিক পরিস্থিতির বদলে যাওয়ার এক প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ। লেখকের ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণার ফাঁকফোকর দিয়ে চোখে পড়ে সে সময়ের এক সাধারণ মুসলিম পরিবারের জীবন-সংগ্রাম—মুসলিম মধ্যবিত্তের বেড়ে ওঠার কাহিনি।
তিনি মারা গেছেন। জীবনের বেশির ভাগ সময়ই তিনি কাটিয়েছেন রাজধানীর বাইরে, তাই বর্ণিল কোনো অভিজ্ঞতা তাঁর হয়নি; যা হয়েছে নেহাতই এক প্রান্তিক মানুষের অভিজ্ঞতা—এসব কারণ দেখিয়ে তাঁর নিজের কথা লিখতে অনাগ্রহের কথা উল্লেখ করেছেন ভূমিকায় (‘যে কারণে এই লেখা’)। ‘মফস্বলের সাধারণ ব্যক্তির আত্মস্মৃতিতেও স্বকালের সমাজচিত্র থাকে এবং তা প্রজন্মান্তরে মূল্যবান হয়ে ওঠে।’ যার ফসল পাতা উল্টাই। বাল্য, কৈশোর ও কর্মজীবনের প্রায় সবটাই কাটিয়েছেন তিনি একাধিক জেলা শহরে, যাকে এখানো বলা হয় মফস্বল। এসব শহরে তাঁর বেড়ে ওঠা, স্কুলপাঠ্য বইয়ের গণ্ডি পেরিয়ে তাঁর পড়াশোনার ডানা মেলা, বাইরের পৃথিবীর ধ্যান-ধারণার মুখোমুখি হওয়ার আনন্দের কথা বলেছেন স্মৃতিমেদুর ভাষায়। নিজের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের প্রতি গভীর অনুরাগ, মহান মুক্তিযুদ্ধের অমর স্মৃতি এবং তাঁর শিক্ষকজীবনের কুড়িয়ে পাওয়া নানা অভিজ্ঞতার কাহিনি এখানে বিধৃত হয়েছে ১৯টি পরিচ্ছদে। ‘নিজে নিজের কথা বলার ইতি-নেতি’, ‘নিজে নিজের মুখোমুখি’ এবং ‘আমার প্রয়াত পিতা এখন মহাজাগতিক’—অনুচ্ছেদগুলোতে তাঁর চিন্তার নির্ভার প্রকাশটি চাদরের মতো পরিপাটি করে বিছানো।
‘চল্লিশের দশকের ঢাকা’য় ফুটে উঠেছে ’৪৬-এর সাম্প্রদায়িকতাগ্রস্ত ঢাকার দিনগুলো, যখন হাফপ্যান্ট পরা ছোট ছোট ছেলেরাও কথায় কথায় চাকু বের করত। ‘দিনাজপুরের মুখ’-এ লেখক দেখেছেন ভূমিনির্ভর সামন্ত সমাজের অনঢ়-অচল অবশেষ। পাশাপাশি তাঁর চোখে পড়েছে সাহিত্য, সংগীত, নাটক চর্চার ঐতিহ্যে গঠিত আরেক দিনাজপুর, যে শহরের মানুষ মুক্তিযুদ্ধের সময় এগিয়ে এসেছিল তাদের ছেলেমেয়েদের আত্মীয়স্বজনবিহীন শিক্ষক মোজাফফর হোসেনকে জান দিয়ে বাঁচাতে।
এই বইয়ে মহান মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিকে স্মরণ করে লেখা পাঁচটি রচনা ভিন্ন মাত্রার। পরিবারেসহ লেখকের দিনাজপুর থেকে মালদায় আশ্রয় নেওয়ার বিবরণ ‘ভাদু-সীমান্ত পারের সহযোদ্ধা’। ব্যক্তি-কথন হলেও এর সামাজিক ভূমিকাটি চোখে পড়ার মতো।
সে সময়ের কালজয়ী বাংলা গান যে প্রভাব ফেলেছিল তরুণমনে, তার স্মৃতি হাতড়াতে গিয়ে তিনি লক্ষ করেছেন যে তখন গানের বিষয়বস্তু তুমি আমি ছাড়িয়ে জীবনের বিস্তৃৃত পরিধির মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে, ‘মনোযোগ দিতে হতো না, গান নিজেই মনোযোগ কেড়ে নিত। সুরকার-গীতিকারের কথা ভাবতে শিখেছি আরও পারে।’ এ যেন ষাটের দশকে চোখ ফোটা আমাদের অনেকেরই সেই কখনো উজ্জ্বল, কখনো আবছা সময়ের স্মৃতির অনুরণন। সে সময়ের জেলা শহরের আরেকটি জনপ্রিয় বিনোদনের কথা বলতে ভোলেননি লেখক। বাঁশের খুঁটিতে মঞ্চ তৈরি করে পাড়ায় পাড়ায় অভিনীত হতো সিরাজউদ্দৌলা, মীর কাশিম, টিপু সুলতান ইত্যাদি। বিষাদ-সিন্ধুর মর্যাদা ছিল প্রায় ধর্মগ্রন্থের সমান। মুরব্বিদের বইটি পড়ে শোনাতে হতো।
জীবনের নানা পর্বে যাঁদের প্রত্যক্ষ সংস্পর্শে এসেছিলেন, সেই গুণীজনদের লেখক তুলে ধরেছেন ‘স্মৃতির মানুষে’, তথা বিশ্লেষণ ছাড়া রক্ত-মাংসের ঘরোয়া মানুষ হিসেবে। ড. গোবিন্দচন্দ্র দেবের প্রসঙ্গ তুলে বলা যাক, ‘একবার বাহাদুরাবাদ ঘাট থেকে ফেরির প্রথম শ্রেণীর কামরার সামনে তাঁকে দেখে চেকারের সন্দেহ হয়েছিল তিনি বুঝি তৃতীয় শ্রেণীর কোনো যাত্রী হবেন। সারা পোশাকে হয়তো তা-ই মনে হয়েছিল। তাই টিকিট দেখাতে বললে তিনি তা বের করে বলেছিলেন, “আই এম এ ম্যান অব ফার্স্ট ক্লাস, দো অ্যাট লুক লাইক থার্ড ক্লাস”।’ এরপর লেখক বলেছেন, ‘আহা রে, পাকসেনারাও যদি স্যারকে দেখে ওই চেকারের মতো একটা ভুল করত!’ ঝরঝরে গদ্যে আমাদের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাসের উপাদান নিয়ে লেখা এই বইটি একটি বিশেষ কালসীমার আঞ্চলিক ইতিহাস রচনায়ও বিশেষ সহায়ক হবে।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, জানুয়ারী ০৭, ২০১০
Leave a Reply