সমকালীন শিল্প-বিশ্লেষণ
মাসুদা খাতুন
সমকালীন শিল্প ও শিল্পী—নজরুল ইসলাম \ দ্বিতীয় সংস্করণ: ফেব্রুয়ারি ২০০৯ \ পাঠক সমাবেশ, ঢাকা \ প্রচ্ছদ: কাইয়ুম চৌধুরী \ ৩৩২ পৃষ্ঠা \ ৭৯৫ টাকা
নজরুল ইসলামের সমকালীন শিল্প ও শিল্পী শীর্ষক শিল্প-সমালোচনার বইটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৯৫ সালের জানুয়ারিতে। প্রকাশক ছিল বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী। ২০০৯-এর ফেব্রুয়ারিতে পাঠক সমাবেশ গ্রন্থটির পরিবর্ধিত সংস্করণ প্রকাশ করেছে। এতে গবেষণাধর্মী প্রবন্ধ এবং বিশ্লেষণমূলক প্রদর্শনী সমীক্ষা দুটিই স্থান পেয়েছে। ডিসেম্বর ১৯৭৩ থেকে জানুয়ারি ১৯৯৫ সময়কালের মধ্যে বিভিন্ন সাময়িকী ও পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত সমকালীন শিল্পকলাবিষয়ক লেখালেখি থেকে ৩০টি লেখা প্রথম সংস্করণে স্থান পেয়েছিল। প্রথম সংস্করণ থেকে দুটি প্রবন্ধ বাদ দিয়ে এবং ১৯৯৫ থেকে ২০০৮ সময়ের মাঝে রচিত ১৮টি প্রবন্ধ সংযোজন করে এ সংস্করণ প্রকাশ করা হয়েছে। নতুন সংস্করণে মোট রচনার সংখ্যা ৪৬।
বাংলাদেশে অল্প কয়েকজন শিল্প-সমালোচকের মধ্যে নজরুল ইসলাম একজন। সত্তরের দশকের শুরু থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত তিনি নিরবচ্ছিন্নভাবে শিল্প-সমালোচনা করে আসছেন। বাংলাদেশের আধুনিক শিল্প অনুধাবনের ক্ষেত্রে এবং শিল্প-ইতিহাস বিশ্লেষণে তাঁর লেখাগুলো গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমান গ্রন্থে ১৮টি নতুন প্রবন্ধের সংযোজন গ্রন্থটিকে পূর্ণতা দান করেছে। ‘জড়-জীবন: চিত্রকের অনবদ্য প্রদর্শনী’, ‘বাংলাদেশের সমকালীন চিত্রকলায় বিষয় বিবেচনা: প্রসঙ্গ, মানুষ’, ‘নারী: বাংলাদেশের আধুনিক চিত্রকলায়’, ‘কামরুল হাসানের চিত্রকলায় নারী’, ‘বাংলাদেশের আধুনিক চিত্রকলায় প্রকৃতি’, ‘বাংলাদেশের নদী ও আধুনিক চিত্রকলা’, ‘বাংলাদেশের সমকালীন চিত্রকলায় নগর’, ‘বাংলাদেশের সমকালীন চিত্রকলায় ঢাকা’—এ প্রবন্ধগুলোতে বিষয়ের উপস্থাপনাকে কেন্দ্র করে চিত্র বিশ্লেষিত হয়েছে।
এই ভিন্ন দৃষ্টিকোণ শিল্প-সমালোচনার পরিপ্রেক্ষিতকে বিস্তৃত করেছে। ‘বাংলাদেশের সমকালীন চিত্রকলায় বিষয় বিবেচনা: প্রসঙ্গ, মানুষ’ শিরোনামে প্রবন্ধটিতে লেখক জয়নুল আবেদিন, কামরুল হাসান, সফিউদ্দীন আহমেদসহ স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ের শিল্পীদের চিত্রে মানুষের উপস্থাপনকে বিশ্লেষণ করেছেন। এ প্রসঙ্গে লেখক একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন রেখেছেন: ‘আঙ্গিক কিংবা কৌশলের অভিনবত্ব যা-ই হোক, জয়নুল, কামরুল, সুলতান—এঁদের মতো মানুষমুখী শিল্পী কি আমরা এই সময়ে পাচ্ছি? অথবা ঘুরিয়ে প্রশ্ন করা যায়, এখনকার শিল্পীদের মানুষনির্ভর চিত্রকলা কি জয়নুল, কামরুল, সুলতানের চিত্রকলার মতো সর্বজনীন আবেদন রাখতে পারছে?’ ‘বাংলাদেশের আধুনিক চিত্রকলায় প্রকৃতি’ শীর্ষক প্রবন্ধটিতে তিনি লিখেছেন, ‘জয়নুল আবেদিন শুধু প্রকৃতিকে চিত্রিত করেননি, প্রকৃতি থেকে তিনি তাঁর নন্দনতত্ত্বের মৌলিকত্বও গ্রহণ করেছেন। বাংলার নদী থেকে শিখেছেন সবেগ, সতেজ, রঙিন রেখার ব্যবহার এবং বাংলার মাটি, মাঠ, পানি, আকাশ আর বৃষ্টি থেকে নিয়েছেন স্বচ্ছ, সজীব রং।’ এভাবে একধরনের নিরীক্ষার গভীরতা তাঁর বিশ্লেষণে ধরা পড়েছে। এ ছাড়া তাঁর উল্লিখিত প্রবন্ধগুলোতে বিষয়কে ধরে সমাজ, দেশ ও পরিবেশের সঙ্গে চিত্রকলার গূঢ় সম্পর্কটি উঠে এসেছে। চিত্রকলা শুধু আঙ্গিক ও কলাকৌশলের ওপর ভিত্তি করে দাঁড়াতে পারে না। তার মধ্যে শিল্পী কৌশলে তাঁর সময় এবং স্থানকে মিলিয়ে দেন। লেখক শিল্প-বিশ্লেষণে আঙ্গিকসর্বস্ব না হয়ে এই স্থান ও সময়কে খুঁজে বের করতে তৎপর থেকেছেন। তাঁর অনুসন্ধিৎসু দৃষ্টি নানা দিক থেকে শিল্পের তাৎপর্য বিশ্লেষণে অধিকতর সক্ষম। সমকালীন শিল্প ও শিল্পী বইটি শিল্পরসিক, শিল্প-শিক্ষার্থী এবং সাধারণ পাঠককে শিল্পের রসাস্বাদনে সহায়তা করবে।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, জানুয়ারী ০৭, ২০১০
Leave a Reply