নরকের বৃত্তান্ত
আলতাফ শাহনেওয়াজ
রৌরব—লীসা গাজী \ ফেব্রুয়ারি ২০১০ \ সূচিপত্র, ঢাকা \ প্রচ্ছদ: মাসুদ কবির \ ১১৯ পৃষ্ঠা \ ১৯৫ টাকা
রৌরব এক নরকের নাম। এই নরক পুরাকালের। একালে এসে লীসা গাজী তাঁর প্রথম উপন্যাসের নাম রাখলেন রৌরব। কেন? লীসা তাঁর উপন্যাসে তুলে এনেছেন একটি পারিবারিক আখ্যান। মুখলেস সাহেব, তাঁর স্ত্রী ফরিদা এবং দুই মেয়ে লাভলী ও বিউটিকে নিয়ে একটি নতুন পরিবারের চিত্র ভেসে ওঠে উপন্যাসের প্রথমে এক ঝলকের মতো।
আমরা দেখতে পাই, মুখলেস-ফরিদা দম্পতির পরিবারের দুই মেয়ে একা একা কোথাও বের হতে পারে না। মা ফরিদা বেগম তাঁদের কোথাও বের হতে দেন না। মেয়ে দুটি বিবাহযোগ্য। কিন্তু বিয়ের নামগন্ধ নেই। বিষয়টি নিয়ে দুই বোনের নিজেদের তেমনভাবে কি মাথাব্যথা আছে? তবে প্রথম থেকে বোঝা যায়, বিশেষত মা ফরিদা বেগমের কড়াকড়ি আচরণের কারণে বোনদের মধ্যে এক ধরনের অবদমনের চোরা স্রোত আছে। ফলে এই উপন্যাসের সূচনা পঙিক্ত নির্মিত হয় এভাবে, ‘রাস্তায় আবোলতাবোল ঘুরতে লাভলীর খুব ভালো লাগে। কিন্তু বাসা থেকে বের হওয়াটা পুলসিরাত পার হওয়ার মতো কঠিন এবং জটিল। আজ অবশ্য ঘটনা অন্য রকম। আজ ও সম্পূর্ণ একা বাইরে,— কীভাবে এই অসম্ভব সম্ভব হলো তা একমাত্র খোদা তাআলাই বলতে পারেন।’
লাভলীর বাসা থেকে বের হওয়ার মধ্য দিয়ে উন্মোচিত হয় রৌরবের পর্দা। এরপর সারা দিন বাসায় ফেরে না লাভলী, ঘুরতে থাকে নিউমার্কেট, গাউছিয়া হয়ে রমনা পার্ক। এর মধ্যে আমরা লাভলীর মস্তিষ্কের ভেতর একটি লোকের অস্তিত্ব টের পাই। সে লাভলীর সঙ্গে সঙ্গে থাকে। তাঁকে বিভিন্ন রকম পরামর্শ বাতলে দেয়। আর এভাবেই বিভিন্ন ঘটনা ও স্মৃতিপ্রবাহের পরম্পরায় আমরা ৪০ বছর বয়সী লাভলীর পূর্ব ও বর্তমান জীবন সম্পর্কে জানতে পারি। জানতে পারি খালাতো ভাই রিয়াজের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের কথাও। তবে লাভলীর মস্তিষ্কের ভেতরে বসে যে লোকটি প্রতিনিয়ত কথা বলে, সাওয়াল-জবাব করে, সে কি লাভলীর অবদমিত আত্মার বিপরীত রূপ? কেননা, উপন্যাসের শেষ পর্যায়ে যখন লাভলী তাঁর ওপর জেঁকে বসা পারিবারিক চাপ ও দমনকে থোড়াই কেয়ার করে, ঠিক তখনই উপন্যাসের পৃষ্ঠা থেকে এই লোকটিও হাওয়া হয়ে যায়। রৌরব উপন্যাসের প্রতিটি চরিত্রের মধ্যেই অবদমনের ছাপ বিদ্যমান। লাভলী, বিউটি, ফরিদা বেগম ও মুখলেস সাহেব—সবাই অবদমনের চরম শিকার। উপন্যাসটি যে রকম বয়ানের মধ্য দিয়ে এগোয়, তার মধ্যে এক ধরনের চমক আছে, যাকে ফ্যান্টাসি বললেও ভুল হবে না।
উপরন্তু এখানে মেয়েদের একান্ত জীবনকে সাবলীলভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। নিছক মেয়েলিপনায় নয়, বরং মেয়েকে স্বতন্ত্র ব্যক্তির দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা হয়েছে এই উপন্যাসে।
লীসা গাজী রচিত রৌরবের গল্প-কাঠামো ও বিন্যাস সম্পর্কে আশাবাদী হওয়া যায়। উপন্যাসের গল্প সংগঠন ও চরিত্র নির্মাণে লীসা গাজীর সাফল্য উল্লেখ করার মতো।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, জানুয়ারী ০৭, ২০১০
Leave a Reply