যে জীবন শালিকের
মোকারম হোসেন
শালিক প্রসঙ্গে লিখতে গিয়ে মনে পড়ল শামসুর রাহমানের কবিতা: ‘শালিক শালিক শালিক/ ওরা রোদে পোড়ে ছায়ায় ঘোরে/ ওরা রৌদ্র ছায়ার মালিক।’
শামসুর রাহমান ওদের রৌদ্র ছায়ার মালিক বানালেও আদতে ওরা সমগ্র রূপসী বাংলার মালিক। কোথায় শালিক নেই! ওদের বিচরণ সর্বত্র। শালিক এখানকার এক প্রধান গায়ক পাখিও। ওদের সুরেলা সংগীত বনের নিবিড়তাকে মধুময় করে তোলে। জীবনানন্দের কবিতায় সেই ব্যাকুলতা ফুটে উঠেছে বারবার। তাঁর লেখায় অসংখ্যবার শালিকের প্রসঙ্গ এসেছে। সৌরভ মাহমুদ এ কথাগুলোই তুলে এনেছেন তাঁর বাংলার এবং জীবনানন্দের শালিকেরা গ্রন্থে। আপাত বিচারে গ্রন্থটি অতিমাত্রায় বিষয়ভিত্তিক মনে হতে পারে। শুধু শালিক পাখি নিয়ে একটি বই! কিন্তু লেখক সাহস সঞ্চয় করেছেন জীবনানন্দ দাশের কাছ থেকে। তিনিই পথ দেখিয়েছেন; ওদের ভাষা শেখো, ওদের বুঝতে শেখো, ভালোবাসতে শেখো। উপলক্ষ্য শালিক হলেও লেখক তার সঙ্গে অনুষঙ্গ হিসেবে অনেক কিছু হাজির করেছেন। তা ছাড়া বৈচিত্র্যের বিচারেও আমাদের শালিকের সংখ্যা একেবারে কম নয়, অন্তত বারো। তন্মধ্যে নয় ধরনের শালিক সারা বছর দেখা যায়। তবে সারা বিশ্বের ১৪৮ জাতের শালিকের তুলনায় সংখ্যাটি নিতান্ত নগণ্য।
গ্রন্থের প্রায় সবকটি লেখার উপ-শিরোনাম নেওয়া হয়েছে জীবনানন্দ দাশের কবিতা থেকে। তাঁর বিশাল কাব্যসম্ভার থেকে লেখক প্রাসঙ্গিক পঙিক্তগুলো জন্য তুলে এনেছেন। সঙ্গে জুড়ে দিয়েছেন নিজের অভিজ্ঞতা, স্মৃতি ও কিছু দরকারি কথা। শুরুতেই লেখক সাবলীলভাবে নিজের জীবনের পাখি দেখার গল্পগুলো বলেছেন। এ কারণে সব শ্রেণীর পাঠক খুব সহজেই লেখার সঙ্গে একাত্ম হতে পারবেন। প্রতিটি লেখায় যুক্ত হয়েছে প্রাণবন্ত কিছু ছবি। আলোচ্য শালিকের মধ্যে কয়েকটি মোটামুটি দুর্লভ। তার মধ্যে চিতিপাখ তেলশালিক একটি। সৌরভ জানাচ্ছেন ‘১৯৭৪ সালে পাখি পর্যবেক্ষক হোসেইন ও তার সঙ্গীরা ঢাকায় এ পাখিটি দেখেছিলেন। উনিশ শতকে একবার সিলেট অঞ্চলেও দেখা গিয়েছিল। পাখিপর্যবেক্ষক রাসমুসেন ও তাঁর সঙ্গীরা ২০০৫ সালে সিলেটে পাখিটি দেখেছেন।’ কিন্তু সোনাঝুঁটি ময়না আমাদের দেশে একেবারেই বিরল।
গ্রন্থের প্রায় শেষ দিকে এ ‘জীবনে আমি ঢের শালিক দেখেছি’ শিরেনামে লেখক জীবনানন্দের উপন্যাস ও কবিতায় শালিক প্রসঙ্গ তুলে এনেছেন (পৃ: ৬৭)। কিন্তু পরবর্তী অংশে আবার ‘জীবনানন্দের কাব্যে শালিক’ নামে আরেকটি রচনা পাঠককে কিছুটা হলেও বিভ্রান্ত করবে (পৃ: ৭৩)। একইভাবে ৮৭ পৃষ্ঠায় ‘উপন্যাসে শালিক’ শিরোনামে আরেকটি নিবন্ধ অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। সবগুলো উদ্ধৃতি একই শিরোনামভুক্ত হলে ভালো হতো। কিংবা গদ্য এবং পদ্য আলাদা আলাদা করেও দেখানো যেত। অগ্রন্থিত কবিতা নিয়ে আলোচনায় আমরা গবেষণাভিত্তিক কিছু তথ্য পাই। অগ্রন্থিত ১২টি কবিতায় ১৯ বার শালিকের কথা আছে। এর পরের লেখাগুলোতে লেখক শালিক প্রশ্নে জীবনানন্দের কবিতাগুলো আরও নির্দিষ্ট করে আলোচনা করেছেন। আছে কাব্যগ্রন্থ বেলা অবেলা কালবেলার কথা, বনলতা সেন, মহাপৃথিবী, ঝরাপালক-এ শালিক শিরোনামের কবিতা। পরিশিষ্টে পক্ষীবিশারদ সালীম আলী ও ড. রেজা খানের প্রাসঙ্গিক আলোচনা বইটিকে আরও সমৃদ্ধ করেছে।
বাংলার এবং জীবনানন্দের শালিকেরা—সৌরভ মাহমুদ \ ফেব্রুয়ারি ২০১০ \ ঐতিহ্য, ঢাকা \ প্রচ্ছদ: ধ্রুব এষ \ ৯৬ পৃষ্ঠা \ ৭০০ টাকা।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, জানুয়ারী ০৭, ২০১০
Leave a Reply