নিজের স্টুডিওতে শিল্পী ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী ভাস্কর প্রিয়ভাষিণীর বাবার মেজাজ ছিল কড়া। তবে পরিবারে ছিল রুচিস্নিগ্ধ সাংস্কৃতিক পরিবেশ। পরিবারের এই আবহ তাঁর কল্পনাশক্তিকে উজ্জীবিত ও বিস্তৃত করেছে। রূপসী বাংলার নানান মৌলিক রূপ-আকার-বিন্যাসকে দৃষ্টিনন্দন করে এক নতুন প্রকাশভঙ্গিতে উপস্থাপন করেছেন ভাস্কর প্রিয়ভাষিণী।
নাগরিক কোলাহল এড়িয়ে ধানমন্ডি লেকের পাড়ে নিরিবিলি এক সবুজ আঙ্গিনায় তাঁর স্টুডিও। এক টুকরো সবুজ প্রকৃতি যেন তাঁর বাসায় অগোছালোভাবে ঢুকে পড়েছে। আমাদের বাক্সবন্দী ইট-সিমেন্ট-বালির জীবনের জন্য ভাস্কর প্রিয়ভাষিণী সৃষ্টি করেছেন এক প্রচ্ছন্ন স্বতঃস্ফূর্ত বৈচিত্র্যময় নানান আকৃতির সবুজ-স্নিগ্ধ দেয়াল। বারান্দার একধারে পামগাছ থেকে নির্মিত নৌকার আকৃতিতে তৈরি বসার খানিকটা জায়গা, দেয়ালে নানান সময়ের ফ্রেমে সপ্রাণ-সজীব কিছু ছবি, আর পুরোটা জুড়ে বিভিন্ন আকৃতির ভাস্কর্য। প্রকৃতি থেকে আহরিত বৃক্ষ, গাছের গুঁড়ি, ডাল-কাণ্ড-শাখা-প্রশাখা-শেকড়বাকড় কোথাও অবিকৃতভাবেই উপস্থাপিত হয়েছে, প্রকৃতিকে তিনি যেভাবে দেখেন তা কিছুটা সংযোজন-বিয়োজন করে নিজস্ব করণ-কৌশলে নতুন অভিব্যক্তি দেন। থমকে যেতে হয় একটি বক, পালকিতে গ্রামের বধূ, ছোট্ট পাখি, ছাতা হাতে পথিক, মমতাময়ী মা, চকিত মুহূর্ত, স্নানরতা, কোনো জনাকীর্ণ মিছিলের প্রতিচ্ছবি দেখে! সদা হাস্যোজ্জ্বল, নম্র, মমতাময়ী, কল্পনা বিলাসী, অফুরন্ত প্রাণশক্তি সমৃদ্ধ ভাস্কর ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী সম্ভাষণ জানান তাঁর স্নিগ্ধ, বৈচিত্র্যময় ভাস্কর্য বারান্দায়। নানা আকৃতির, বিভিন্ন গড়নের অসংখ্য ভাস্কর্যের ফাঁকে এক চিলতে বসার জায়গা। এ হলো সার্বক্ষণিক ভাস্করের স্টুডিও।
প্রকৃতির সরল-সতেজ অভিব্যক্তিতে আচ্ছন্ন ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী ও তাঁর ভাস্কর্য। প্রাতিষ্ঠানিকভাবে তিনি ভাস্কর্য নির্মাণ শেখেননি; বরং তাঁর শিল্পবোধ, শিল্প বিনির্মাণে ত্রিমাত্রিক প্রয়াস, নান্দনিকতা তাঁকে সমৃদ্ধ স্বভাবশিল্পী হিসেবে খ্যাতি দিয়েছে। শিল্পীর ভাষ্য, ‘আমি ছবি আঁকি চোখে, হাতে নয়।’ প্রকৃতির নানান পরিত্যক্ত, জীর্ণ বৃক্ষ-শেকড়-লতা-গুল্ম-শাখা-প্রশাখায় তিনি প্রাণ সঞ্চারণ করে চলেছেন। প্রিয়ভাষিণীর কাজের নামকরণে রয়েছে কবিতার সুষমা। যেমন, ‘ছলোছলো নদীধারা’, ‘বর্ষার পথিক’, ‘বাদলশেষে পাখির গান’।
তাঁর শৈশব ছিল বর্ণিল। শৈশবে গ্রাম বাংলার শ্যামল প্রকৃতির অপার সান্নিধ্য বাড়িয়েছে তাঁর সৌন্দর্যপিপাসা। সবুজ প্রকৃতিই তাঁর আরাধ্য, জড় ভাস্কর্যে তিনি রোপণ করেন সবুজ প্রাণ। অনেক কাজেই তিনি চমৎকারভাবে জুড়ে দিয়েছেন তাজা মানিপ্ল্যান্ট, সবুজ ঘাস, ছোট ছোট উদ্ভিদ, লতাগুল্ম, পাতাবাহার এবং বনসাই বৃক্ষ। ভাস্কর্যে জুড়ে দেওয়া সপ্রাণ সবুজ সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘আমাদের শহরের মানুষ বাধ্য হয়েই অ্যাপার্টমেন্টে বাস করে, তাদের দু দণ্ড সময় সবুজের সান্নিধ্যে স্নিগ্ধ হয়ে উঠুক আমার ভাস্কর্যের মাধ্যমে।’
পরিত্যক্ত উপকরণকে কীভাবে ভাস্কর্যের রূপ দেওয়া যায় তার উদাহরণ হতে পারে প্রিয়ভাষিণীর ভাস্কর্য। যদিও তাঁর কাজের উৎস প্রকৃতি, তিনি কল্পনা আর সৃজনশীলতায় এর নতুন রূপ সৃষ্টি করেছেন। এখানে শুধু সৌন্দর্যই মূল কথা নয়, বরং স্বতঃস্ফূর্ত, গতিশীল, বাঙ্ময় ও অর্থময় অভিব্যক্তি প্রধান হয়ে ওঠে। প্রকৃতির সাধারণ জীর্ণ পরিত্যক্ত কোনো অংশকে শিল্পী তাঁর সযত্ন পরিচর্যায় পুনর্জীবিত করেন। এখানেই তাঁর মৌলিকতা, তাঁর সৌন্দর্যপিপাসু মানবিক মনের স্নিগ্ধ উন্মোচন।
প্রিয়ভাষিণী ভীষণভাবে তাঁর শৈশব দ্বারা প্রভাবিত। তাঁর সাদাসিধে, আটপৌঢ়ে জীবনে নিসর্গ প্রতিভাত হয়েছে বিচিত্র রূপে। তিনি প্রকৃতির অস্পষ্ট, দুর্বোধ্য, সুপ্ত ভাষাকে নিজের উপলব্ধি আর সৃজনশীলতায় রূপ দেন। জীবনের অন্ধকারকে তিনি সাহসের সঙ্গে অতিক্রম করেছেন। রিক্ত অভিজ্ঞতাকে সযত্নে রূপান্তরিত করে ধূসর পটভূমিকে সতেজ করেছেন তিনি । এই শিল্পী ত্যাগ ও কাজের স্বীকৃতি হিসেবে ২০১০ সালে স্বাধীনতা পদকে ভূষিত হয়েছেন।
ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণীর জন্ম ১৯৪৮ সালে খুলনায়। সৌন্দর্যের অন্বেষায় শুধু নয়, তাঁর কাজে জীবনের প্রতিফলন আমাদের প্রাণময় করে তোলে।
সিলভিয়া নাজনীন
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, জানুয়ারী ০৭, ২০১০
Leave a Reply